Bangladesh Booming : Holiday - ইতালিতে হলিডে
ইমরান আহমেদ চৌধুরী
ভেনিছ নগরীতে আমি
জুল ভার্ন তার বিশ্ব ভ্রমণ করেছিল আশি দিনে শুনলেই গা’ টা কেমন জানি শিউরে উঠত সেই কিশোর বয়সে ; প্রথম যখন পড়েছিলাম । আসলে জুল ভার্ন কাগজে কলমেই ঘুরে এসেছিল বিশ্বভ্রমান্ধ - বস্তুত পক্ষে সে কখনো ফরাসীর বাইরে কোন দেশেই যায় নি ।
সেই শৈশব কাল থেকেই মনে মনে ইবন - ই - বতুতা কিংবা মার্কও পলো এর মত দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর সখ ছিল প্রকট । বিলাতে চিরস্থায়ী ভাবে অভিবাসনের আগে কেবল বাংলাদেশেই বসবাস করেছি মোট ২৪ টি স্থানে - ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়তে সর্বেসাকুল্যে মোট ১৪ টি স্কুলে পড়াশুনা করেছি ।
অবচেতন ভাবে কখন যে এই মনটা হয়ে গিয়েছে বিশ্বভ্রমান্ধ ঘুরে বেড়ানোর ভক্ত তা আজ অব্দিও নিজেই উপলব্ধি করতে পারি না , আর সে জন্যই মনে হয় ভ্রমণের কোন প্রকার সুযোগ পেলে তা আর সহজে হাতছাড়া না করেই বিদেশ ঘুরার জন্য হারিয়ে যাই - এই একবিংশ শতাব্দীর নব্য পর্যটক মার্কও পলো অথবা ইবন- ই - বতুতার মত । ঠিক এমনি ভাবেই গত ১৩ই অগাস্ট হারিয়ে গিয়েছিলাম জীবনের সকল কোলাহল, নিত্য নৈমত্তিক কাজকর্ম থেকে সন্তর্পণে পালিয়ে গিয়েছিলাম এক সপ্তাহের জন্য —— গন্তব্য সেই জগত বিখ্যাত পর্যটক মার্কও পলোর শহর ইতালির ভেনিস এ ।
সেই ছোট শিশু বেলা থেকেই মা আর বাবার মুখে শুনেছি প্রাচ্যের ভেনিস হিসেবে পরিচিত আমাদের দেশের বরিশাল নগরীর কথা , এই শহরে প্রথম গিয়েছিলাম স্কুলে পড়াকালীন সময়ে স্কাউট ক্যাম্পিং এ পটুয়াখালী যাওয়ার পথে সেই ১৯৭৬- ৭৭ন সনে । স্কাউট টিমের ট্রুপ লিডার থাকাতে বরিসাল শহরের সাথে ভেনিস শহরের মানসিক সেলুলয়েড গুলো প্রতিস্থাপন করার সুযোগ আর সেদিন হয় নাই ট্রুপ লিডার হওয়ার কাজের চাপে। ঐ খাল, নদী, হ্রদ, সাগরের উপহ্রদ (লেগুণ), গোনডোলা সমৃদ্ধ ভেনিস শহর পানির উপর দাঁড়িয়ে আছে মনের পর্দায় সেই অনাবিষ্কৃত কৌতুহল হয়ে আজ প্রায় ৫৮ বছর যাবত ।
১৯৮৬ শরৎকাল এর এক সন্ধ্যায় পরিচিত হয়েছিলাম এক জন কম বয়স্ক যুবকের সাথে এক বন্ধুর নতুন বন্ধু - বেশ কিছু দিন পর তাকে প্ররোচিত করে চোরাশিকার করে নিয়ে আসলাম আমার কর্মক্ষেত্রে অনেক পটিয়ে এবং এ ও বলেছিলাম - আমার এখানে আসলে বিদেশ ভ্রমণ এর ও সুযোগ আসতে পারে ভবিষ্যতে । তারপর ক্রমে ক্রমে আমারা পরিণত হলাম বন্ধুতে । খুবই নম্র, ভদ্র এবং হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর । তখনও মাইক্রো সফট এর উইন্ডো এর যুগ আসে নাই - ডস বেইসেড কম্পুটার মাত্র ১৪০ মেগা বাইট মেমোরি একটা ফ্যাক্স বা চিঠি টাইপ করতে গেলে সারাদিন চলে যেত । তাই বিদেশি প্রিন্সিপাল, বাইয়ার, এজেন্সি ধরতে হলে হাত দিয়ে বা ইলেকট্রিক আই বি এম টাইপ রাইটার এ ছিল শ্রেষ্ঠ সম্পদ । সারা দিন হাত দিয়ে লিখে ফ্যাক্স করেই কেটে যেতও ওর সারা দিন , মাথা গুঁজে কাজ করেই যেত - মেঘ না চাইতেই অনেক টা বৃষ্টির মত কাজ পেতে থাকলাম আমরা বিভিন্ন সেক্টরে ; ইন্ডেন্তিং, এজেঞ্ছি , গার্মেন্টস এবং সাপ্লাই এর বিদেশি প্রিন্সিপ্যাল এর অভাব নাই । ক্রমান্বয়ে; ধীর গতিতে বাণিজ্য লক্ষ্মীর দেখা মিলল মনে হল । বেল্টু , জন, সোহরাব এবং ও সবাই একটা ভাল টিম বানিয়ে ফেললাম অবলীলাক্রমে ;
মাথাগুঁজে কাজ করতে লাগলো ফ্রেডী - ফ্রেড্রিক ডি কোস্টা তেজগাঁও হোলি রোসারি রোমান ক্যাথোলিক চার্চের পাদ্রী ফাদার গোমেজ ডি কোস্টার কনিষ্ঠ পুত্র ফ্রেডী । ১৬৭৭ সালে এই গির্জায় ওরা ৬ পুরুষ (জেনারেশন) যাবত পাদ্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছে - দারুণ একটা মডার্ন এবং জ্ঞানী পরিবার ওদের । ঢাকার এলিট সোসাইটির একটি বর্ধিষ্ণু পরিবার । স্কয়ার ফার্মা, ঢাকার আর্চ বিসব থেকে শুরু করে বঙ্গভবন থেকে সর্বদাই আমন্ত্রণ পায় ওরা । অনেক ধরনের সামাজিক উন্নয়ন মূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত এদের এই পরিবার - বর্গী ( পোর্টোগিজ ) রক্ত বহন করে আসছে ওরা গত ৪ শতাব্দী যাবত । গ্রামের বাড়ী বালু নদীর তীরে কালিয়াকৈর এ । একেবারে মনেপ্রাণে খ্রিস্টীয় ধর্ম অনুশাসন অনুযায়ী জীবন যাপন করে ওরা । ওদের দেখে মনে পরে যেতো আমার বাল্য কালের খ্রিস্টান বন্ধু জেমস অলক, কল্পনা চৌধুরী দের কথা এবং ডিঙ্গেদার একদা জমিদার পরিবার ঐ চৌধুরীরা ওরা মনে হয় ব্যাপ্টিস্ট ছিল । আর ফ্রেডীর পরিবার রোমান ক্যাথলিক এই যা বিভক্তি । কিন্তু, একদিন কথায় কথায় ও আমাকে বলল যে সে আসলে একজন এগ্নোস্টিক (অজ্ঞানবাদী) অর্থাৎ সে ধর্ম এবং ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে সন্দেহ প্রবণ এবং ধর্ম পালনে তেমন আগ্রহী নয় । ওর এই ধরনের খোলামেলা কথায় আমি আরও ওর ব্যাপারে কেমন জানি আগ্রহী হলাম - বন্ধুত্ব গাঁড় থেকে আর গাঁড় হয়ে গেল ক্রমে ক্রমে - নিজের অজান্তেই সে হয়ে গেল আমার সবচে বিসস্থ ব্যক্তিতে । অফিস শেষ করে প্রায়ই আইস ক্রিম খেতে চলে যেতাম গুলশান দুই নম্বর চত্বরের ''কিন্তুকি''তে অথবা ইন্টারকনের সুমিং পুলে বসে বসে কফি পান করতে করতে ওর কাছ থেকে পর্তুগাল, রোমান, জার্মান কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সব প্লেয়ার দের সম্পর্কে ওর ভাষ্য ধারা বিবরিনি শুনতাম । আইকমান, হিম্লার, গয়েবল, হিটলার সম্পর্কে ওর জ্ঞান ছিল অপরিসীম এবং বিভিন্ন আব্রাহমিক ধর্ম গুলোর গোড়াপত্তনের ইতিহাস ও বলেই যেত একটা টেপ রেকর্ডার মত । আরও একটা মিল খুঁজে পেলাম আমাদের মধ্যে সেটা হল সে ও আমার মত পর্যটক হতে চায় । সারা জীবন অবিবাহিত একাকী থাকার তার বাসনা ।
বিজনেস সম্প্রসারিত হতে লাগলো - ছোট বেলার বন্ধু আলিম এর সাথে একটা ফ্যাক্টরি তে একসাথে কাজ আরম্ভ করলাম ১ লক্ষ পিস লেডিস টপ এর ইতালিয়ান কোম্পানি এসিয়াটেক্স এর জন্য । বিরাট অর্ডার । আলিম রিকুয়েস্ট করলো ওর অফিসে কাজের অনেক চাপ তাই ওর ফ্রেডী কে দরকার - টেলেক্স এবং বিদেশী ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ এর জন্য জাস্ট দিনে দুই ঘণ্টা পাঁচটার পর থেকে । আলিম ফ্রেড আর আমি এক কড়কড়া রোদেলা দুপুরে হোটেল সোনারগাঁ তে ক্যাফে বাজার রেস্তরাতে বুফে লাঞ্চ এর জন্য নিয়ে গেলাম ইতালিয়ান কোম্পানির ক্রেতা মারথা বিয়াঙ্কা কে । প্রচণ্ড গরম বাইরে আমার গাড়ী থেকে নামার সাথে সাথে মনে হল যেন আগুনের চুলার মধ্যে প্রবেশ করালাম - মারথা বলল এই গরম কিছুই না ওদের দেশে - শুনে আমরা অবাক । আমাদের ধারনা ইউরোপ মানেই ঠাণ্ডা, বরফ, আমরা ছাড়া আর এক টেবিল এ টেবিলে ছয়জন গেস্ট বাকি পুরা রেস্তরাঁ খালি - চুঁটিয়ে আড্ডা মারলাম সেই সন্ধ্যা পর্যন্ত গরমে আর ঐ শিতাতাপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে বের হতে ইচ্ছাও হচ্ছিল না । প্রায় আমার থেকে এক ইঞ্চি লম্বা পাঁচ ফুট এগার ইঞ্চি লম্বা স্লিম তম্বী তরুণী মারথা অলিভ এর মত গায়ের রং বেশ খোলামেলা পোশাক পরনে তবে খুবই মার্জিত ; আধো আধো ভাঙ্গা ইংরেজিতে বেশ সুন্দর ভাবে কথা বলে । সারাক্ষণ মুখে হাসি । পারিবারিক ব্যবসা ওর দাদার বানানো এই কোম্পানি - অনেক গল্প করলো - ১ বছর যাবত কাজ করছে মিলান ইউনিভার্সিটি এর বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইন ফ্যাকাল্টি থেকে সদ্য গ্র্যাজুয়েট হয়েই নিজেদের কোম্পানি তে যোগদান করেছে - ওর বাবা, ওর মা, তিন ভাই এবং ওর বড় বোন সবাই মিলে কয়েক মিলিওন মার্কিন ডলার টার্নওভার এর এই ব্যবসা চালায় - বাংলাদেশে এটাই ওদের প্রথম কাজ । শুনে আমার আরে ফ্রেড এর বুক টা ফুলে গেল - কারন ওদের সাথে আমরাই প্রথম যোগাযোগ স্থাপন করে নিয়ে এসে প্রথম অর্ডার আনি । আলিম এর তো চক্ষু চরক গাছে । আমাদের কে সর্ব সাকুল্যে প্রায় ৮ থেকে ১০ পারসেন্ট কমিশন পেতে শুনে ও প্রায় অপ্রকিতস্থ । মারথা যখন জানতে পারল যে ফ্রেড ও রোমান ক্যাথলিক তখন ওর আমাদের উপর আরও কেমন জানি আস্থা বেড়ে গেল - অবলীলায় প্রকাশ করে ফেলল যে ওরা আগামীতে আরও তিন চারটা কাজ আমাদের দিতে চায় - সব গুলোই ১ লক্ষ পিস এর মত । শার্ট, মেয়েদের শর্টস, ব্লাউস এবং মেয়েদের জিনস - ওরা শুধু মেয়েদের ফ্যাশন নিয়েই কাজ করে । বাংলাদেশ কে দেখে সে বিমোহিত এবং আমাদের লোকজনের ক্যান ডু ( করতে পারি বা করতে পারবো) মনোভাব টা মেয়েটার খুবই পছন্দ হয়েছে। ফ্রেড যখন বলতে লাগলো প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস, ক্লিওপেট্রা , মারক এন্থনি , জুলিয়াস সিজার, অগাস্টাস, কনস্টান্টিনোপল এর সম্রাজ্ঞী কেথেরিন, বিযেন্টাইন এবং অটোম্যান এর ইতিহাস মারথা এসব একজন বিদেশির মুখে শুনে হতভম্ব, বিহ্বল ও স্থম্ভিত হয়ে শুনতে থাকল সারাক্ষণ - ফ্রেডির দিকে ওর চোখের মায়াবী চাহনি দেখেই বুঝে ফেললাম কেল্লা ফতে। অভিজ্ঞ জহুরির তো আর খাঁটি সোনা চিন্তে ভুল হওয়ার কথা না । গল্পে গপ্লে মারথা বলল ওদের ফ্যামিলি অনেকতে অনেক মিশ্রণ দ্রবণে - ওর দাদী ইহুদি পোল্যান্ড এর, ওর দাদা ইতালিয়ান রোমান ক্যাথলিক, ওর মা জার্মান প্রটেস্টান্ট খ্রিস্টান, বোন এর বয়ফ্রেন্ড ব্রাজিলের এবং ভাই রা দুজনাই ইতালিয়ান সঙ্গী এবং দুজনাই রোমান ক্যাথলিক । ও নিজেও এতটা ধর্ম তে বিশ্বাসী না - কিন্তু সে খুবই গর্বিত একজন ইতালিয়ান রোমান হেরিটেয হিসেবে । ইতিহাস সম্পর্কে জানার খুবই তার আগ্রহ । তারপর সবই আজ বাস্তব অতীত সব আজ ইতিহাস - মারথা আর ফ্রেডী এখন দুই দুইটি কন্যার মা তাপিতা।
সেই ফ্রেডির আমন্ত্রণে আজ আমি ইতালির ভেনিসের উদ্দেশে রওয়ানা দিচ্ছি । ত্রিশ বছর পর ওর সাথে দেখা হবে আবার … ত্রিশ বছরের জমে থাকা কত কথা । দেখা হতে যাচ্ছে আমাদের মোলাকাত আবার ত্রিশটি বসন্ত পরে ।
ইজি জেট এ দুই ঘণ্টার ফ্লাইট লুটন ( ইংল্যান্ড) থেকে , লুটন নামিয়ে দিলো ফাতেমা লুটনের কাছেই ওর অফিস - সাথে একটা সাইড ব্যাগ হোল্ডল মাত্র কয়েক টা ট্রাউজার শার্ট, সেভিং কিট, টাওওাল ইত্যাদি । ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে প্রবেশ করলাম বিমানবন্দরে - বোর্ডিং কার্ড অন লাইনে চেক করে নিয়েছিলাম আগেই - সোজা সিকুরিটি চেক করে ধুঁকে পরলাম , স্টারবাক্স এ একটা লম্বা ফ্রাপপাচিনু অর্ডার দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর লেখা একটা বই পড়তে শুরু করলাম - বই পড়তে পড়তে ফ্লাইট প্রায় মিস করেই ফেলেছিলাম আরেকটু হলে , বই টার একটা রিভিউ লিখব ভেবে পরছিলাম আর ইম্পরট্যান্ট লাইন গুলো হাই লাইট করতে যেয়ে কখন যে ফ্লাইট এর গেট বন্ধ করে দিয়েছিল তা একেবারে দেখিই নাই । হঠাৎ দেখেই দিলাম দৌড় - আধা বন্ধ গেট টেনে ধরে ঢুকে পরলাম ।
দুই ঘণ্টা বই পড়তে পড়তে চলে গেল জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বিশাল সাগর, আর একটা দ্বীপ এর মত জায়গা - প্লেনটা বেশ সুন্দর ভাবে ল্যান্ডিং করলো । ফ্রেডী ফোনে বাসের টিকেট পাঠিয়ে দিয়েছিল ওটা স্ক্যান করেই বাসে উঠে বসলাম মার্কও পলো এয়ার পোর্ট থেকে ভেনিস শহরের প্রধান বাস স্টপে যেতে হবে ওখানে অপেক্ষা করবে আমার জন্য ও । নীল আকাশ, পরিষ্কার পরিছন্ন রাস্তা ঘাট , ঘড়ির কাটায় কাটায় বাস ছাড়ল, বাসের এসি তেও গরম উপলব্ধি করলাম - ইংল্যান্ড এ সকালে ৫-৬ ডিগ্রী , জ্যাকেট গায়ে দিয়ে গাড়ীতে বসলাম এয়ার পোর্টে যাওয়ার জন্য আর এখানে ৩২ - ৩৪ ডিগ্রী গরম । প্রচণ্ড রোদ । ঘামতে শুরু করলাম - অনেক দিন পর । ২০ মিনিটেই ভেনিস এ পৌঁছে গেলাম রাস্তার দুই পাশের এড্রিআটিক সাগরের উপহ্রদ (লেগুণ) আর স্পিড বোট, প্রমোদ তরী আর পাল তোলা ডিঙ্গিতে এমেচার নৌকা চালক রা সাগরের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে অত্যন্ত সাছন্দে । ঐ গভীর সমুদ্রে একা একা মেয়েরে শালতি (ডোঙ্গা ) এক কাঠের দুই পাশে বৈঠা টা দিয়ে বামে ডানে বৈঠা চালিয়ে এগিয়ে চলেছে সেই দিগন্তের দিকে - নীল আকাশের প্রতিচ্ছবি সাগরের পানিতে পরেছে আমন ভাবে দুর থেকে দেখলে মনে হয় জেন এই মাত্র কোন শিল্পী আপন মনে বসে বসে গাঁড় মোটা একটা তুলি দিয়ে নীল রং
দিয়ে জলরাশি গুলোকে পেন্ট করে চলে গেছে; সূর্যের কিরণ এর বিচ্ছুরণ ঢেউয়ে ঢেউয়ে আলোর প্রতিফলিত রশ্মি বিকিরণ করছে দেখে মনে হয় জেন কোন রমণী তার আচল টা বিছিয়ে সূর্যের দিকে মুখ করে অপেক্ষা করছে তার পরদেশি নাবিক প্রেমিকের জন্য । বাসের জানলা দিয়ে এই বামে আর এই ডানে তাকিয়ে অপরূপ উপহ্রদ এর দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে প্রায় চলে আসলাম ভেনিসে তা বুঝতেই পারি নাই । বাস টা থামার লেনে ঢুকে আস্তে আস্তে করে থেমে পড়লো । চতুর্দিকে তাকিয়ে খুঁজলাম ফ্রেডী কে - অনেক দুরে রেলিং এ হেলান দিয়ে হালফ পেন্ট পরা পায়ে কেডস নীল একটা কেলভিন ক্লাইন এর ৎ শার্ট পরিহিত মাঝ বয়সী এক জন ব্যাক্তি দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপের উপড়ে সান গ্লাস টা রাখা । ত্রিশ বছর পর একটু থমকে যেয়ে ব্যাগটা ঘাড়ে নিয়ে নামলাম আর দেখলাম ও আমাকে চিন্তে পেরে এগিয়ে আসছে - মুখে ৩২ টি দন্ত বিকশিত সেই পুরনো হাসি ; কাছে এসেই বলল নামে ইজ ডি কোস্টা, ফ্রেড্রিক ডি কোস্টা ( নাম আমার ডি কোস্টা - ফ্রেডিক ডি কোস্টা ( পৃথিবী বিখ্যাত জেমস বন্ড সিনেমার একটা ডাইলগ )…।। আমি উতরে বললাম মিঃ ডি কোস্টা ‘' আই আম শেইকেন বাট নট স্তার্ড ( আমি একটু ঝাঁকি খেয়েছি তোমাকে দেখে কিন্তু একেবারে ঘট্টিত নয় ) ; একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম - বুকে ধরে রাখলাম অনেকক্ষণ । ত্রিশ বছরে প্রচুর বদলে গেছি আমরা দুজনাই । ব্যাগ টা ঘারে নিয়েই হাঁটতে থাকলাম ভেনিসে বাস স্টপ এর পাশেই অল্প দুরে ভেনিস রেলওয়ে স্টেশন এর দিকে ; হাঁটতে হাঁটতে কথা, কুশল বিনিময় হল - ও আমার ছেলেমেয়ের কথা জিজ্ঞেস করলো আর আমিও ওর সবার কথা জানলাম । স্টেশন এ এসে দুটো টিকেট কাটল ওর শহর ‘'পরডেনোন'' এ যাবার জন্য রাত ১২ টার ট্রেনে যাবো আমরা ; প্রায় ১ ঘণ্টার জার্নি ।
কিন্তু তার আগে ঘুরে দেখতে চাই হেঁটে হেঁটে সন্ধ্যা হবার আগেই ভেনিস শহর টাকে । স্বপ্নের শহর ভেনিস - ইতালিতে এর আগে চার চার বার গিয়েছি কিন্তু উত্তর ইতালি তে আসা হয় নাই একবারও ।
ফাতেমা হচ্ছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অবতার সে কোথা থেকে যেন শুনছে যে, ভেনিসের ঐ খাল গুলোর পানিতে নাকি খুবই দুর্গন্ধ তাই ওকে কোন ভাবেই ভেনিসে নিয়ে যেতে রাজী করাতে পারি নাই । কিন্তু, ওদের সবাই কে এভাবে ফেলে রেখে একা একা ভেনিস এর মত এত প্রসিদ্ধ পর্যটন ডেসটিনেশন এ এসে সম্পূর্ণ আনন্দ টা পাচ্ছিলাম না ; মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম ভেনিসে একা একা সবই করবো কিন্তু ওদের সবাই কে ফেলে স্বার্থপরের মত ভেনিস এর সবচে বড় আকর্ষণ গন্ডোলা তে চড়বোনা ।
স্টেশন এর লাগেজ রাখার বক্সে সাইড বাগ হোল্ডল টা রেখে লক করে দিয়ে বেরিয়ে পরলাম - ওহ ভীষণ গরম রোঁদ টা অত্যন্ত প্রকট , হাঁটতে হাঁটতে পঞ্চাশ গজ হাঁটতেই পেলাম একটা ছোট্ট বাংলাদেশিই টং জাতীয় দোকান - অনেক রকমারি জিনিস বিক্রি করছে - শুভ্যেনির, ব্যাগ, হেট, থেকে শুরু করে খেলানা, শ্যাল, সেলফী স্টিক সবই আছে আই দোকানে ; দোকানদার ৩০-৩৫ বয়সী এক যুবক ; ফ্রেডী আর ও অনর্গল ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলল আর এই ফাঁকে আমি একটা স্ট্র্ব জাতীয় একটা হ্যাট পছন্দ করলাম - আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল লোকটার নাম ঝন্টু বাড়ি ফরিদপুরের শরিয়তপুরে , ১৮ বছর যাবত আছে এখানে ঐ রকম আরও পাঁচটা টং দোকান আছে তার ভেনিসে । সপরিবারে বসবাস করছে এখানে - বউ, ছেলে এবং মেয়েরা সবাই ই একেক তা দোকান চালায় । বেশ ভালোই আছে ঝন্টু সাহেব । একটু অপ্রুস্তুত মনে হচ্ছিল যদিও নিজেকে তবুও বিশ্বের অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ এই ভেনিসে আমার বাংলার এক বাঙালি কে দেখে বেশ গর্বই বোধ করলাম । কুশলাদি বিনিময় শেষে কিছুতেই পয়সা নিতে চাইল না । জোড় করে ৮ ইউরো দিয়ে আসলাম এবং ওর দেশপ্রেম ও আতিথেয়তা দেখে খুবই মুগ্ধ হলাম । চলে আসার সময় বলল যাবার সময় যেন আবার দেখা করে যাই - তেলের পিঠা পাটালী গুড় দিয়ে বানানো ওগুলো খেয়ে যেতে বলল - শুনে মনটা ভরে গেলো । বাঙ্গালীর অতিথি পরায়নতা বিশ্ব বিখ্যাত - এই জন্যই মনে হয় বাঙ্গালীদের রেস্তোরাঁ ব্যাবসা এত সফল সব খানেই ।
হাঁটতে থাকলাম দুজনা ভেনিসের ক্যানালের পাড় দিয়ে প্রধান সেন্ট মার্ক স্কয়ার এর দিকে কিন্তু প্রত্যেক কদমে কদমেই থেমে থেমে আই ফোন অথবা আমার প্রিয় সনি সাইবার শট ক্যামেরা দিয়ে তুলতে লাগলাম ছবি তুলতে - ছবি তোলা আমার অন্যতম প্রধান সখ । এই বিল্ডিং এর ছবি নেই, নয়ত খালের ছবি, অথবা স্পিড বোটে করে ছুটে যাচ্ছে একদল পর্যটক দেড় ছবি, কিংবা গন্ডোলা তে বসে আছে এক রোমান্টিক যুগল এবং নিপুণ হাঁতে লগি দিয়ে নিলিপ্ত ভাবে নৌকার মাঝির চাতুরী - দুইটা দালানের মধ্যে খানে সরু খালের ভিতর দিয়ে কি সুন্দর ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে বা বয়ে যাচ্ছে তার প্রমোদ নৌকা - ভেনিসের অন্যতম প্রদান বৈচিত্র্য ময় এই নৌকা ( ওদের দেশে এটা কে বলে গন্ডোলা ) - একটু খারাপ লাগল আমি নিজে চরলাম না বলে - আমি দেখতে চাচ্ছিলাম ঐ নৌকায় বসলে নৌকা থেকে শহর টা কেমন দেখায় । কিছুক্ষণ পড় পড় ই একেকটা ছোট্ট সাঁকো জাতীয় পুল এই খাল থেকে ঐ খালে, এই দালান থেকে ঐ দালানে যাবার জন্য । প্রায় ১৬০০ বছর যাবত এই নগরী টা দাঁড়িয়ে আছে পানির উপড়ে - সেই ৪২১ খ্রিস্টাব্দে ২৫সে ই মার্চ গ শুক্রবার উচ্চ দ্বিপ্রহরের সময় গোড়াপত্তন হয়ে ছিল এই শহরের । ১১৮ টা ছোট ছোট দ্বীপ জেগে উঠেছিল হয়তোবা কোন আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে এই অ্যাড্রিয়াটিক সমুদের শেষ পাড়ের কিনারে সেই কয়েক লক্ষ বছর আগে - সমতল ভূমি থেকে ঐ সাগরের পানি দ্বারা বিছিন্ন ; কেউ কি চায় এই রকম বিছিন্ন জায়গায় বসবাস করতে ? কিন্তু, জীবন মানেই সারভাইভাল ফর দি ফিটেস্ট ( শক্তিবান ই কেবল বেঁচে থাকতে পারে ) বর্বর দের আক্রমণ এবং আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্য এর এই দ্বীপমালায় বসতি গড়ে তুলে । কিন্তু সমস্যা দেখা দিল জায়গার স্বল্পতা এবং পানির এত নিকটে কিভাবে টেকসই আবাস গড়ে তোলা যায় । বর্বর রা পদাতিক আগ্রাসনে পটু ছিল ওদের সেই আমলে নৌ কেদ্রিক চলাচল এ পারদর্শী হয়ে উঠে তখনো তাই এই দ্বীপমালায় যারা বসতি গড়ে তুলেছিল তারা বর্বরদের তীক্ষ্ণ তরবারির কোপ থেকে রক্ষা পায় সে যাত্রা । তারপর তারপরই সেই জনগণ আসতে আসতে গড়ে তুলে এই বিশাল নগরী , যেখানে এখন প্রতি বছর আড়াই কোটি পর্যটক পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এখানে বেড়াতে আসে । জাহাজ ভড়ে ভড়ে, প্রমোদ তরী নিয়ে , প্লেন ভড়ে বছরের বারো মাসই এখানে লোকে লোকারণ্য । জলাশয়ের মধ্যে কাঠের স্তম্ভ পুতে পুতে সেই কাঠের স্তম্ভের উপর দালানের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করে ঐ ভিত্তি প্রস্তরের উপর নির্মাণ করে ঐ সব দালান এবং রাজ প্রাসাদ তুল্য অট্টালিকা গুলো - থরে থরে সাজানো দালান গুলো দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে - সেই সব কাঠের স্তম্ভ গুলো সেই মধ্য যুগের মিস্ত্রি রা এতই সুনিপুন ভাবে একটা স্তম্ভের গাঁ লাগিয়ে আরেকটা স্তম্ভ মাটিতে পুঁতেছে যা নাকি যাতে কাঠ ভেদ করে পানি ঐ দালানের পাদদেশে প্রবেশ করতে না পারে । কাঠ সচরাচর পানিতে পচে না তাই এখন অনেক দালানের ভিত্তির কাঠ এর বয়েস এক হাজার বছরের ও অধিক । প্রথম আগত পলাতক লোকজন ঐ জলবন্দী এলাকায় মৎস্যজীবীদের সাথে বসবাস করতে থাকে ক্রমান্বয়ে আরও মানুষরা আসতে থাকে বর্বর আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্য - তখন দেখা দেয় জায়গার সংকুলতা - সবাই মিলে ঐ সমুদ্রের উপহ্রদ এ কাটে অনেক গুলো সংযোগ খাল আর আস্তে আস্তে গড়ে তুলে ঐ কাদায় পরিপূর্ণ জলাভূমিতে গড়ে তুলে এক বিশাল জনপদ ।ভরা জোয়ার এর সময় এক্যুয়া আলটা’র কারণে প্রায়শই এই নগরী প্লাবিত হয় । আজ অনেকেই ভেনিস কে নিম্মজিত শহর বলে ডাকে । কিন্তু দালানের ভাঁড়ে কাদা এবং ময়লা গুলোকে সংকোচিত হয়ে একেবারে শক্ত ভিত্তি প্রস্তর হিসেবে কাজ করছে এবং যার ফলে দালান গুলো এখনও দাঁড়িয়ে আছে আপন মহিমায় যদিও গ ১০০ বছরে এই শহর প্রায় ৯ ইঞ্চির সম পরিমাণ মাটিতে দেবে গেছে এবং বিশেষজ্ঞ রা মনে করছে ২০২১ সালে হয়ত এড্রীয়াটিক সাগরের এই উপহ্রদ টা প্রায় নিম্মজিত হয়ে যেতেও পারে । এই শহর দেখে রাশিয়ান নামকরা এক লেখক আলেক্সজান্ডার হেরযেন একদা বলেছিলেন, ‘’ যেখানে শহর বানানো সম্ভব নয় সেখানে শহর বানানো পাগলামি , আর ঐ জায়গায় সবচে’ মার্জিত এবং এই রকম মহীয়ান নগরী বানানো একটা প্রতিভাবান পাগলামির কাজ । ‘’
জীবনের প্রথম আমি এই রকম নগরী অবলোকন কর ছিলাম আর প্রতি মুহূর্তেই হারিয়ে যাচ্ছিলাম চিন্তার অতল গর্ভে ; কিভাবে সম্ভব ; এরকম একটা কিছু বানানো মানুষের দ্বারা সেই ১৬০০ বছর আগে - অনেক গলি, অনেক ছতর, অনেক দালান, অনেক কোঠা, অলি গলি, নদীনালা, ফুটব্রিজ, সাঁকো, মূর্তি, ম্যুরাল, ইহুদি দেড় গেঁটও, খ্রিস্টান গির্জা, ইহুদিদের উপাসনালয় সিনেগগ দেখতে দেখতে হাজির হলাম সেন্ট মার্ক চত্বর এ ভেনিসের প্রধান মাঠ এ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী সেইন্ট মার্ক এর গির্জা - উপাসনালয় এটা শুধু চার্চ বা গির্জাই নয় এটাকে বলে ব্যাসিলিকা ( রাজপ্রাসাদ) - তার মানে হচ্ছে রোমান ক্যাথোলিক ধর্মের এই গির্জা টা একটি প্রধান উপাসনালয় অত্র প্রদেশের প্রধান ধর্মীয় যাজকের আসন ; একটা অপরূপ রাজ প্রাসাদ সম দালান এটা যা নাকি ইটালীয় - বাইজেন্টাইন স্থাপত্য শিল্পের একটা উদাহরণ । চোখ জুড়িয়ে যায় এই ব্রাসিলিকা টার অপূর্ব কারুকাজ খচিত নির্মাণ শৈলী দেখে । নিজের অজান্তেই হারিয়ে গিয়েছিলাম অনেকক্ষণ ; একটা কোমল গলার আওয়াজে ভেঙ্গে গেলো আবার হারিয়ে যাওয়া টা অকপটে - পাশে দাঁড়িয়ে এক অপরূপা মহিলা প্রশ্ন করলো, আমি তার কয়েক টা ছবি তুলে দিতে পারব কিনা ? অত্যন্ত নম্রতার সঙ্গে উত্তর দিলাম অবশ্যই - নীল প্রিন্টের লঙ ড্রেস পরিহিত স্লিম, অনেক লম্বা, একেবারে স্বর্ণকেশী নারী - প্রায় অনেক গুলো পোজে প্রায় গোটা ত্রিশ ছবি তুলে দিলাম, বার বার সে ক্ষমা চাচ্ছে আমাকে বিরক্ত করার জন্য - সে একা এসেছে আর্জেন্টিনা থেকে প্রমোদ তরীতে করে সঙ্গে মা আর বাবা এবং সে , তরী ভিড়েছে ভেনিসের তীরে আজ সকালে আবার যাত্রা শুরু করবে ক্রোয়েশিয়া মুখী আগামী কাল রাত্রে । মা বাবা অনেক বয়স্ক ওরা ক্লান্ত হয়ে জাহাজে ফিরে গেছে ঘণ্টা খানেক আগে - আর ও একা সারারাত কাটাবে রাতের ভেনিস এর সৌন্দর্য দেখে দেখে কিন্তু কিছুক্ষণ আগে ও সেলফি ষ্টীক টা মাটিতে রেখে হাত ছবি তুলতে গিয়ে ওটা পানিতে পড়ে গেছে তাই অগত্যা আমার শরণাপন্ন হতে হয়েছে । কুশল বিনিময় করার সময় ও বলল তার নাম জুলিয়েটা ; বুয়েনেস আইয়ারস এ থাকে ; মার্চেন্ট ব্যাঙ্কে চাকরী করে - আমি যখন বললাম আমি লন্ডনে থাকি ও বলল সে খুব শিগ্রিই লন্ডন আসবে বেড়াতে ; ওর খুব সখ স্কটল্যান্ড এবং লন্ডন শহর দেখার , কথা প্রসঙ্গে এও বলল যে ওর বাবা ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় আর্জেন্টাইন আর্মি তে লেফটেন্যান্ট ছিল এবং ঐ যুদ্ধে ওর বাবা ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে রেড ক্রস এর মাধ্যমে ছাড়া পেয়েছিল ৩ মাস পর - ওর বয়স তখন ২ বছর । আমিও বললাম আমি তখন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমী তে ট্রেনিং রতঃ হবু লেফটেন্যান্ট । এই সব বলতে বলতেই ফ্রেড এসে বলল চলেন আইসক্রিম খাই - আমি বললাম চলো - ও জুলিয়েটা কেও আমন্ত্রণ করলো আমাদের সাথে আইসক্রিম খাবার জন্য ।
ফ্রেডী কে গেয়ে শুনালাম, ‘’ঐ জলকে চলে লো কার ঝিয়ারি রূপ ছাপে না তার নীল শাড়ী ( গাউন) ‘’ - দুজনাই অনেক ক্ষণ মনখুলে হাসলাম - মহিলাটা জিজ্ঞেস করলো কেন আমরা এত জোড়ে হাসছি - নজরুল ইসলামের ঐ কবিতা টা কে মার্চেন্ট অফ ভেনিসের মত ইংরেজি তে অনুবাদ করে শুনালাম - শুনে বেশ সংকোচিত হয়ে লজ্জা পেল যেন মনে হল । এই আজে বাজে কথা বলতে বলতে একটা বেশ নামীদামি হোটেলের লবিতে ঢুঁকে গেলাম আমরা তিন জন - লবির শেষ প্রান্তরেই আইসক্রিম পার্লার টা দেখতে পেলাম - হোটেল এর লবি দেখলে চোখ ধাধিয়ে যাওয়ার অবস্থা - চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ফুট উপর থেকে ঝুলিয়ে এসেছে ঝাঁর বাতি গুলো, ওক কাঠের চকচকে ভারনিস কড়া কাঠের প্যানেল দিয়ে ঘেরা দেওয়াল , বিশাল বিশাল ভেনিসের বিশ্ব বিখ্যাত চামড়ার সোফা গুলো, পিতলের দরজার হান্ডেল গুলো চকচক করছে যেন এই মুহূর্তেই কেউ এগুলো পলিস করে দিয়ে গেছে ; সব অতিথি রা নিচু গলায় কথা বলছে আর লবির আরেক প্রান্তে এক বিশাল পিয়ানোর সামনে বসে মনের সুখে লুছিয়ানো পাভারতির সেই প্রসিদ্ধ ইতালিয়ান অপেরা টেনর এর ‘’ চে গেলিদা মানিনা ‘’ গান টা বাজ্জাছে আর গাইছে উচ্চ মর্গে । এক অপূর্ব পরিবেশ - সৌন্দর্য, প্রাচুর্য, নীরবতা, মহীয়ানতা, সম্পদের বহিঃপ্রকাশ এবং এরিস্টোক্রেছী এর সংমিশ্রণ করে তুলেছে হোটেল টা কে দারুণ রোমান্টিকতার স্বর্গে।
একটা খালি সোফায় বসলাম - বসে বসে অপেক্ষা করছিলাম ওয়েটার এর অর্ডার দিবার জন্য । প্রথমে কথা সেই ই শুরু করলো । অনেক গল্প করলাম - তিনটা আইসক্রিম অর্ডার দিলাম ওকে অফার করলাম এক গ্লাস লারয ইতালিয়ান কিয়ানতি ক্লাসিকো রেড ওয়াইন । সে খুব আশ্চর্য হল আমি ওয়াইন নিলাম না - ফ্রেডী নিলো একটা বিয়ার আর আমি শুধু বাদাম বিহীন লেবু ফ্লেভার এর আইসক্রিম খাচ্ছি দেখে - ফ্রেডী ও কে বুঝাল যে আমি একজন রেস্তোরাঁর এবং ওয়াইন বারের মালিক ছিলাম একদা তাই আমার ইতালিয়ান এবং আর্জেন্টাইন সহ সকল দেশের ওয়াইন সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান আছে যদিও আমি নিজে কখনো ওয়াইন পান করি না ।
এক গ্লাস থেকে ৪ - ৫ - ৬ - ৭ গ্লাস ওয়াইন আর ফ্রেডীর বিয়ার প্রায় ৫ টা তে যখন তখন বিল দিয়ে বের হয়ে আসলাম সেই প্রাসাদোপম হোটেল থেকে । দিব্বি হেঁটে বেড়াতে লাগল জুলিয়া । কথার ফুলঝুরি তার মুখে - অনর্গল কথা বলতে লাগলো, নিয়ন বাতির আলোতে ওর মুখটা লাগছিল অস্পরা দের মত আর যখন প্রাণ খুলে হাসছিল তখন রাতের আলোর বিকিরণ এ ওর দাঁত গুলো মনে হচ্ছিল যেন সাগরের পাড়ে মুক্তা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে । সে বেশ টলটলায়মান মনে হল ; ফ্রেডী আবার এইসব সময়ের জন্য ওস্তাদ বিদেশীনি মহিলার স্বামীতো সব জানে ; ঘড়িতে রাত প্রায় নয়টা - ও বলল চলেন সলিড কোন খাদ্য খাই - তাহলে ও প্রকিতশ্ত হয়ে যাবে - তিন জনে মিলে ডিনার করলাম একটা কোশার রেস্টুরেন্টে - দারুণ মজার হমুস আর সবাই আমার পছন্দ মত ব্রেইসড কর্ণ বিফ ব্রিস্কেট খেল সাথে আলু এবং সালাদ সঙ্গে ব্রেড ।
খেতে খেতে সময় ঘনিয়ে এলো আবার বিদায় নিবার পালা - সমুদ্রের মধ্যে খানে ওর বিশাল নয় তালা প্রমোদ জাহাজে একটা স্পিড বোট ভাড়া করে ওকে ওর জাহাজে উঠিয়ে দিয়ে আমরা আরও ঘণ্টা খানেক হাঁটাহাঁটি করলাম সমুদ্র তটে, রাতের আলোয় স্পিড বোট থেকে আলোকিত ভেনিস নগরীর রূপে পাগল প্রায় আমি ; দুচোখ জুড়িয়ে দেখলাম এই অপূর্ব ঐতিহাসিক নগরী - ইতিহাসের পাতায় পাতায় কত বার যে বারংবার হোঁচট খেয়েছি এই নগরীর গল্পের কাছে , সেই রোমান আমলের পড় মধ্য যুগে মার্কও পলো পর্যটকের বই ট্র্যাভেলশ অফ মার্কও পলো - সে কিভাবে বাংলার বানানো মসলিন দেখেছিল দামাস্কাসে, অটোমান সাম্রাজ্যের সময় ভেনিসের প্রসিদ্ধ প্রকাশক আলাসেন্দাড়ো পাগানিনি ১৪-১৫ শতকে পবিত্র কোরান ছাপাতো এই ভেনিসে এবং পৃথিবীর অন্যতম প্রসিদ্ধ কাঁচের শিল্প গড়ে উঠেছিল এই নগরীতে এখানেই শুরু হয় ভেনিসিয়ান গ্লাস এবং অরনেট ( অলংকৃত ) কাঁচ এর শুভযাত্রা এখানেই শুরু ।
রোমান্স বিহীন রোমান্টিক নগরীকে আস্তে আস্তে পিছনে ফেলে যাচ্ছে আমাদের ওয়াটার ট্যাক্সি টা প্রধান ক্যানেল ধরে একের পর এক ব্রিজের নিচ দিয়ে ভেনিস ট্রেন স্টেশন এর দিকে । রাতের আলোতে জ্বল গুলো ঢেউএ ঢেউয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে আলোর ধারা গুলো - সে যেন স্বর্গীয় প্রিস্মের প্রতিছবি মৃদু মন্দ দোলায় ঢেউ খেলা আলোর রশ্নিতে ভেনিসের প্রতিচ্ছবি পানিতে ; এভাবেই ক্রমশ পাড়ে নোঙ্গর কড়া পন্টুনে এসে থেমে গেলো আমাদের ওয়াটার ট্যাক্সি .....…. তড়িৎ উঠে গেলাম স্টেশনে ট্রেন ছাড়তে ১ মিনিট ৯ সেকেন্ড কেবল বাকি - লকার খুলে হোল্ডল টা কাঁধে নিয়ে দৌড়ে গেলাম প্লাটফরমে - স্ক্যানারে টিকেটের গন্ধ শুকিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই আলাউদ্দিন আর চল্লিশ চোরের মত দরজা টা ছিছিম ফাঁকের মত খুলে গেলো আর আমরা দুজন হুমড়ি খেয়ে ট্রেনে উঠে বসলাম পারদোনোনা যাবার উদ্দেশ্যে …।। বিদায় ভেনিস .
Comments
Post a Comment