হলিডে ইতালিতে - Italy Holiday
- ইমরান আহমেদ চৌধুরী
এ |
Fishing in a Lake in Italy |
- জুল ভার্ন তার বিশ্ব ভ্রমণ করেছিল আশি দিনে শুনলেই গা’ টা কেমন জানি শিউরে উঠত সেই কিশোর বয়সে প্রথম যখন পড়েছিলাম । আসলে জুল ভার্ন কাগজে কলমেই ঘুরে এসেছিল বিশ্বভ্রমান্ধ - বস্তুত পক্ষে সে কখনো ফরাসীর বাইরে কোন দেশেই যায় নি জীবনেও ।
- সেই শৈশব কাল থেকেই মনে মনে ইবন - ই - বতুতা কিংবা মার্কও পলো এর দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর সখ ছিল প্রকট । বিলাতে চিরস্থায়ী ভাবে অভিবাসনের আগে কেবল বাংলাদেশেই বসবাস করেছি মোট ২৪ টি স্থানে - ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়তে সর্বেসাকুল্যে মোট ১৪ টি স্কুলে পড়াশুনা করেছি ।
- অবচেতন ভাবে কখন যে এই মনটা হয়ে গিয়েছে বিশ্বভ্রমান্ধ ঘুরে বেড়ানোর ভক্ত তা আজ ও নিজেই উপলব্ধি করতে পারি নাই , আর সে জন্যই মনে হয় ভ্রমণের কোন প্রকার সুযোগ পেলে তা আর সহজে হাতছাড়া করতে না করে হারিয়ে যাই - এই একবিংশ শতাব্দীর নব্য পর্যটক মার্কও পলো অথবা ইবন- ই - বতুতার মত । ঠিক এমনি ভাবেই গত ১৩ই অগাস্ট হারিয়ে গিয়েছিলাম জীবনের সকল কোলাহল, নিত্য নৈমত্তিক কাজকর্ম থেকে সন্তর্পণে পালিয়ে গেইয়েছিলাম এক সপ্তাহের জন্য —— গন্তব্য সেই জগত বিখ্যাত পর্যটক মার্কও পলোর শহর ভেনিসে ।
- সেই ছোট শিশু বেলা থেকেই মা আর বাবার মুখে শুনেছি প্রাচ্যের ভেনিস হিসেবে পরিচিত আমাদের দেশের বরিশাল নগর এর কথা , এই শহরে প্রথম গিয়েছিলাম স্কুলে পড়াকালীন সময়ে স্কাউট ক্যাম্পিং এ পটুয়াখালী যাওয়ার পথে সেই ১৯৭৬- ৭৭ সনে । স্কাউট টিমের ট্রুপ লিডার থাকাতে বরিসাল শহরের সাথে ভেনিস শহরের মানসিক সেলুলয়েড গুলো প্রতিস্থাপন করার সুযোগ আর সেদিন হয় নাই । ঐ খাল, নদী, হ্রদ, সাগরের উপহ্রদ (লেগুণ), গোনডোলা সমৃদ্ধ ভেনিস শহর পানির উপর দাঁড়িয়ে আছে মনের পর্দায় সেই অনাবিষ্কৃত কৌতুহল হয়ে আজ প্রায় ৫৮ বছর যাবত ।
- ১৯৮৬ শরৎকাল এর এক সন্ধ্যায় পরিচিত হয়েছিলাম এক জন কম বয়স্ক যুবকের সাথে এক বন্ধুর নতুন বন্ধু - বেশ কিছু দিন পর তাকে প্ররোচিত করে চোরাশিকার করে নিয়ে আসলাম আমার কর্মক্ষেত্রে অনেক পটিয়ে এবং এ ও বলেছিলাম - আমার এখানে আসলে বিদেশ ভ্রমণ এর ও সুযোগ আসতে পারে ভবিষ্যতে । তারপর ক্রমে ক্রমে আমারা পরিণত হলাম বন্ধুতে । খুবই নম্র, ভদ্র এবং হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর । তখনও মাইক্রো সফট এর উইন্ডো এর যুগ আসে নাই - ডস বেইসেড কম্পুটার মাত্র ১৪০ মেগা বাইট মেমোরি একটা ফ্যাক্স বা চিঠি টাইপ করতে গেলে সারাদিন চলে যেত । তাই বিদেশি প্রিন্সিপাল, বাইয়ার, এজেঞ্ছি ধরতে হলে হাত দিয়ে বা ইলেকট্রিক আই বি এম টাইপ রাইটার এ ছিল শ্রেষ্ঠ সম্পদ । সারা দিন হাত দিয়ে লিখে ফ্যাক্স করেই কেটে যেতও ওর সারা দিন , মাথা গুঁজে কাজ করেই যেত - মেঘ না চাইতেই অনেক টা বৃষ্টির মত কাজ পেতে থাকলাম আমরা বিভিন্ন সেক্টরে ; ইন্ডেন্তিং, এজেঞ্ছি , গার্মেন্টস এবং সাপ্লাই এর বিদেশি প্রিন্সিপ্যাল এর অভাব নাই । ক্রমান্বয়ে; ধীর গতিতে বাণিজ্য লক্ষ্মীর দেখা মিলল মনে হল । বসির, জন, সোহরাব এবং ও সবাই একটা ভাল টিম বানিয়ে ফেললাম অবলীলাক্রমে ;
- মাথাগুঁজে কাজ করতে লাগলো ফ্রেডী - ফ্রেড্রিক ডি কোস্টা তেজগাঁও হোলি রোসারি রোমান ক্যাথোলিক চার্চের পাদ্রী ফাদার গোমেজ ডি কোস্টার কনিষ্ঠ পুত্র ফ্রেডী । ১৬৭৭ সালে এই গির্জা নির্মিত ওরা ৬ পুরুষ (জেনারেশন) যাবত পাদ্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছে - দারুণ একটা মডার্ন এবং জ্ঞানী পরিবার ওদের । ঢাকার এলিট সোসাইটির একটি বর্ধিষ্ণু পরিবার । স্কয়ার ফার্মা, ঢাকার আর্চ বিসব থেকে শুরু করে বঙ্গভবন থেকে সর্বদাই আমন্ত্রণ পায় ঐ পারিবার । অনেক ধরনের সামাজিক উন্নয়ন মূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত এদের এই পরিবার - বর্গী ( পোর্টোগিজ ) রক্ত বহন করে আসছে ওরা গত ৪ শতাব্দী যাবত । একেবারে মনেপ্রাণে খ্রিস্টীয় ধর্ম অনুশাসন অনুযায়ী জীবন যাপন করে ওরা । ওদের দেখে মনে পরে যেতো আমার বাল্য কালের খ্রিস্টান বন্ধু অলক, কল্পনা এবং ডিঙ্গেদার একদা জমিদার পরিবার রয় চৌধুরী দের কথা ওরা মনে হয় ব্যাপ্টিস্ট ছিল । আর ফ্রেডীর পরিবার রোমান ক্যাথলিক এই যা বিভক্তি । কিন্তু, একদিন কথায় কথায় ও আমাকে বলল যে সে আসলে একজন এগ্নোস্টিক (অজ্ঞানবাদী) অর্থাৎ সে ধর্ম এবং ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে সন্দেহ প্রবণ এবং ধর্ম পালনে তেমন আগ্রহী নয় । ওর এই ধরনের খোলামেলা কথায় আমি আরও ওর ব্যাপারে কেমন জানি আগ্রহী হলাম - বন্ধুত্ব গাঁড় থেকে আর গাঁড় হয়ে গেল ক্রমে ক্রমে - নিজের অজান্তেই সে হয়ে গেল আমার সবচে বিসস্থ বন্ধুতে । অফিস শেষ প্রায়ই আইস ক্রিম খেতে চলে যেতাম কিন্তুকি অথবা ইন্টারকনের সুমিং পুলে বসে বসে কফি পান করতে করতে ওর কাছ থেকে পর্তুগাল, রোমান, জার্মান কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সব প্লেয়ার দের সম্পর্কে ওর ভাষ্য ধারা বিবরিনি শুনতাম । আইকমান, হিম্লার, গয়েবল, হিটলার সম্পর্কে ওর জ্ঞান ছিল অপরিসীম এবং বিভিন্ন আব্রাহমিক ধর্ম গুলোর গোড়াপত্তনের ইতিহাস ও বলেই যেত একটা টেপ রেকর্ডার এর মত । আরও একটা মিল খুঁজে পেলাম আমাদের মধ্যে সেটা হল সে ও আমার মত পর্যটক হতে চায় । সারা জীবন অবিবাহিত একাকী থাকার তার বাসনা ।
- বিজনেস সম্প্রসারিত হতে লাগলো - ছোট বেলার বন্ধু আলিম এর সাথে একটা ফ্যাক্টরি তে একসাথে কাজ আরম্ভ করলাম ১ লক্ষ পিস লেডিস টপ এর ইতালিয়ান কোম্পানি এসিয়াটেক্স এর জন্য । বিরাট অর্ডার । আলিম রিকুয়েস্ট করলো ওর অফিসে কাজের অনেক চাপ তাই ওর ফ্রেডী কে দরকার - টেলেক্স এবং বাইয়ার দের সঙ্গে যোগাযোগ এর জন্য জাস্ট দিনে দুই ঘণ্টা পাঁচটার পর থেকে । আলিম ফ্রেড আর আমি এক কড়কড়া রোদেলা দুপুরে হোটেল সোনারগাঁ তে ক্যাফে বাজার রেস্তরাতে বুফে লাঞ্চ এর জন্য নিয়ে গেলাম ইতালিয়ান কোম্পানির বাইয়ার মারথা বিয়াঙ্কা কি সাথে নিয়ে । ভীষণ প্রচণ্ড গরম বাইরে আমার গাড়ী থেকে নামার সাথে সাথে মনে হল যেন আগুনের চুলার মধ্যে প্রবেশ করালাম - মারথা বলল এই গরম কিছুই না ওদের দেশে - শুনে আমরা অবাক । রেস্তরাঁতে আমরা এক টেবিল আর একটা মাত্র টেবিলে ছয়জন গেস্ট বাকি সব খালি - চুঁটিয়ে আড্ডা মারলাম সেই সন্ধ্যা পর্যন্ত গরমে আর ঐ শিতাতাপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে বের হতে ইচ্ছা হচ্ছিল না । প্রায় আমার থেকে এক ইঞ্চি লম্বা পাঁচ ফুট এগার ইঞ্চি লম্বা স্লিম তম্বী তরুণী মারথা অলিভ অয়েলের মত গায়ের রং বেশ খোলামেলা পোশাক পরনে তবে খুবই মার্জিত ; আধো আধো ভাঙ্গা ইংরেজি বলে বেশ সুন্দর ভাবে কথা বলে । পারিবারিক ব্যবসা ওর দাদার বানানো এই কোম্পানি - অনেক গল্প করলো - ১ বছর যাবত কাজ করছে মিলান ইউনিভার্সিটি এর বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইন ফ্যাকাল্টি থেকে সদ্য গ্র্যাজুয়েট হয়েই নিজেদের কোম্পানি তে যোগদান করেছে - ওর বাবা, ওর মা, তিন ভাই এবং ওর বড় বোন সবাই মিলে কয়েক মিলিওন মার্কিন ডলার টার্নওভার এর এই ব্যবসা চালায় - বাংলাদেশে এটাই ওদের প্রথম কাজ । শুনে আমার আরে ফ্রেড এর বুক টা ফুলে গেল - কারন ওদের সাথে আমরাই প্রথম যোগাযোগ স্থাপন করে নিয়ে এসে প্রথম অর্ডার আনি । আলিম এর তো চক্ষু চরক গাছে । আমাদের কে সর্ব সাকুল্যে প্রায় ৮ থেকে ১০ পারসেন্ট কমিশন পেতে শুনে ও প্রায় অপ্রকিতস্থ । মারথা যখন জানতে পারল যে ফ্রেড ও রোমান ক্যাথলিক তখন ওর আমাদের উপর আরও কেমন জানি আস্থা বেড়ে গেল - অবলীলায় প্রকাশ করে ফেলল যে ওরা আগামীতে আরও তিন চারটা কাজ আমাদের দিতে চায় - সব গুলোই ১ লক্ষ পিস এর মত । শার্ট, মেয়েদের শর্টস, ব্লাউস এবং মেয়েদের জিনস - ওরা শুধু মেয়েদের ফ্যাশন নিয়েই কাজ করে । গল্পে গল্পে ফ্রেড যখন বলতে লাগলো প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস, ক্লিওপেট্রা , মারক এন্থনি , জুলিয়াস সিজার, অগাস্টাস, কনস্টান্টিনোপল এর সম্রাজ্ঞী কেথেরিন, বিযেন্টাইন এবং অটোম্যান এর ইতিহাস মারথা এসব একজন বিদেশির মুখে শুনে হতভম্ব, বিহ্বল ও স্থম্ভিত হয়ে শুনতে থাকল সারাক্ষণ - ফ্রেডির দিকে ওর চোখের মায়াবী চাহনি দেখেই বুঝে ফেললাম কেল্লা ফতে। অভিজ্ঞ জহুরির তো আর খাঁটি সোনা চিন্তে ভুল হওয়ার কথা না । গল্পে গপ্লে মারথা বলল ওদের ফ্যামিলি অনেকতে অনেক মিশ্রণ দ্রবণে - ওর দাদী ইহুদি পোল্যান্ড এর, ওর দাদা ইতালিয়ান রোমান ক্যাথলিক, ওর মা জার্মান প্রটেস্টান্ট খ্রিস্টান, বোন এর বয়ফ্রেন্ড ব্রাজিলের এবং ভাই রা দুজনাই ইতালিয়ান সঙ্গী এবং দুজনাই রোমান ক্যাথলিক । ও নিজেও এতটা ধর্ম তে বিশ্বাসী না - কিন্তু সে খুবই গর্বিত একজন ইতালিয়ান রোমান হেরিটেয হিসেবে । ইতিহাস সম্পর্কে জানার খুবই তার আগ্রহ । তারপর সবই আজ বাস্তব অতীত সব আজ ইতিহাস - মারথা আর ফ্রেডী এখন দুই দুইটি কন্যার মাতাপিতা …।।
- সেই ফ্রেডির আমন্ত্রণে আজ আমি ইতালির ভেনিসের উদ্দেশে রওয়ানা দিচ্ছি ……… ত্রিশ বছর পর ওর সাথে দেখা হবে আবার … ত্রিশ বছরের জমে থাকা কত কথা ……। হতে যাচ্ছে আমাদের মোলাকাত আবার ত্রিশটি বসন্ত পরে ।
- ত্রিশ বছরের জমে থাকা কত কথা।
- ইজি জেটে দুই ঘণ্টার ফ্লাইট লুটন (ইংল্যান্ড) থেকে। ফাতিমা সব গুছিয়ে দিল ব্যাগে। ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে ঢুকলাম বিমানবন্দরে। বোর্ডিং কার্ড অনলাইনে চেক করে নিয়েছিলাম আগেই। সোজা সিকিউরিটি চেক করে ঢুকে পড়লাম স্টারবাকসে। সেখানে বসে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর লেখা একটা বই পড়তে শুরু করলাম। পড়তে পড়তে ফ্লাইট প্রায় মিস করেই ফেলেছিলাম।বইটির ওপর একটি রিভিউ লিখব ভেবে পড়ছিলাম। আর গুরুত্বপূর্ণ লাইনগুলো হাইলাইট করতে গিয়ে কখন যে ফ্লাইটের গেট বন্ধ করে দিয়েছিল, তা একেবারে খেয়াল করিনি। হঠাৎ দেখেই দিলাম দৌড়, আধা বন্ধ গেট টেনে ধরে ঢুকে পড়লাম।
- দুই ঘণ্টা বই পড়তে পড়তে চলে গেল, মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বিশাল সাগর, আর একটা দ্বীপের মতো জায়গা। প্লেন অবতরণের পর ফ্রেডি ফোনে যে বাসের টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছিল, সেটি স্ক্যান করেই বাসে উঠে বসলাম। মার্কো পলো এয়ারপোর্ট থেকে ভেনিস শহরের প্রধান বাস স্টপে যেতে হবে, সেখানে ফ্রেডি আমার জন্য অপেক্ষা করবে। নীল আকাশ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তা–ঘাট। ঘড়ির কাটায় কাটায় বাস ছাড়ল, বাসের এসিতেও গরম উপলব্ধি করলাম। ইংল্যান্ডে সকালে ৫-৬ ডিগ্রি। জ্যাকেট গায়ে দিয়ে বের হয়েছি। এখানে ৩২-৩৪ ডিগ্রি গরম, প্রচণ্ড রোদ। ঘামতে শুরু করেছি অনেক দিন পর। ২০ মিনিটেই ভেনিসে পৌঁছে গেলাম, রাস্তার দুই পাশের অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের উপহ্রদ (লেগুন) আর স্পিড বোট, প্রমোদ তরী আর পাল তোলা ডিঙিতে এমেচার নৌকা চালকেরা সাগরের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে। ওই গভীর সমুদ্রে একা একা মেয়েরে শালতি (ডোঙা) এক কাঠের দুই পাশে বইঠাটা দিয়ে বামে ডানে বইঠা চালিয়ে এগিয়ে চলেছে সেই দিগন্তের দিকে। নীল আকাশের প্রতিচ্ছবি সাগরের পানিতে পড়েছে এমনভাবে দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন, এই মাত্র কোনো শিল্পী আপন মনে বসে বসে মোটা তুলি দিয়ে নীল রং দিয়ে জলরাশিকে পেন্ট করে চলে গেছে। সূর্যের কিরণের বিচ্ছুরণ ঢেউয়ে ঢেউয়ে আলোর প্রতিফলিত রশ্মি বিকিরণ করছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো রমণী তার আঁচলটি বিছিয়ে সূর্যের দিকে মুখ করে অপেক্ষা করছে তার পরদেশি নাবিক প্রেমিকের জন্য।
- বাসের জানালা দিয়ে বামে আর ডানে তাকিয়ে অপরূপ উপহ্রদের দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে চলে আসলাম ভেনিসে বুঝতেই পারিনি। বাসটা থামল। চারদিকে তাকিয়ে খুঁজলাম ফ্রেডিকে, অনেক দুরে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে হাফ পেন্ট পরা মাঝ বয়সী এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপের উপরে সানগ্লাসটা রাখা। ৩০ বছর পর একটু থমকে গিয়ে ব্যাগটা ঘাড়ে নিয়ে নামলাম আর দেখলাম, ফ্রেডি আমাকে চিনতে পেরে এগিয়ে আসছে, মুখে ৩২টি দন্ত বিকশিত সেই পুরোনো হাসি। একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম-বুকে ধরে রাখলাম অনেকক্ষণ। ৩০ বছরে প্রচুর বদলে গেছি আমরা দুজনই। ব্যাগটা ঘাড়ে নিয়েই হাঁটতে থাকলাম ভেনিসে বাস স্টপের পাশেই অদূরে ভেনিস রেলওয়ে স্টেশনের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে কথা, কুশল বিনিময় হলো। পরিবার নিয়ে কথা হল। স্টেশনে এসে দুটি টিকিট কিনল তার শহর পরডেনোনে যাওয়ার জন্য। রাত ১২টার ট্রেনে যাব আমরা; প্রায় ১ ঘণ্টার জার্নি।
- কিন্তু সন্ধ্যা হওয়ার আগেই হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখতে চাই ভেনিস শহরটাকে। স্বপ্নের শহর ভেনিস। ইতালিতে এর আগে চার চার বার গিয়েছি। কিন্তু উত্তর ইতালিতে আসা হয়নি একবারও। ফাতেমা হচ্ছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অবতার সে কোথা থেকে যেন শুনছে যে, ভেনিসের ঐ খাল গুলোর পানিতে নাকি খুবই দুর্গন্ধ তাই ওকে কোন ভাবেই ভেনিসে নিয়ে যেতে রাজী করাতে পারি নাই । কিন্তু, ওদের সবাই কে এভাবে ফেলে রেখে একা একা ভেনিস এর মত এত প্রসিদ্ধ পর্যটন ডেসটিনেশন এ এসে সম্পূর্ণ আনন্দ টা পাচ্ছিলাম না ; মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম ভেনিসে একা একা সবই করবো কিন্তু ওদের সবাই কে ফেলে স্বার্থপরের মত ভেনিস এর সবচে বড় আকর্ষণ গন্ডোলা তে চড়বোনা ।
- স্টেশন এর লাগেজ রাখার বক্সে সাইড বাগ হোল্ডল টা রেখে লক করে দিয়ে বেরিয়ে পরলাম - ওহ ভীষণ গরম রোঁদ টা অত্যন্ত প্রকট , হাঁটতে হাঁটতে পঞ্চাশ গজ হাঁটতেই পেলাম একটা ছোট্ট বাংলাদেশিই টং জাতীয় দোকান - অনেক রকমারি জিনিস বিক্রি করছে - শুভ্যেনির, ব্যাগ, হেট, থেকে শুরু করে খেলানা, শ্যাল, সেলফী স্টিক সবই আছে আই দোকানে ; দোকানদার ৩০-৩৫ বয়সী এক যুবক ; ফ্রেডী আর ও অনর্গল ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলল আর এই ফাঁকে আমি একটা স্ট্র্ব জাতীয় একটা হ্যাট পছন্দ করলাম - আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল লোকটার নাম ঝন্টু বাড়ি ফরিদপুরের শরিয়তপুরে , ১৮ বছর যাবত আছে এখানে ঐ রকম আরও পাঁচটা টং দোকান আছে তার ভেনিসে । সপরিবারে বসবাস করছে এখানে - বউ, ছেলে এবং মেয়েরা সবাই ই একেক তা দোকান চালায় । বেশ ভালোই আছে ঝন্টু সাহেব । একটু অপ্রুস্তুত মনে হচ্ছিল যদিও নিজেকে তবুও বিশ্বের অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ এই ভেনিসে আমার বাংলার এক বাঙালি কে দেখে বেশ গর্বই বোধ করলাম । কুশলাদি বিনিময় শেষে কিছুতেই পয়সা নিতে চাইল না । জোড় করে ৮ ইউরো দিয়ে আসলাম এবং ওর দেশপ্রেম ও আতিথেয়তা দেখে খুবই মুগ্ধ হলাম । চলে আসার সময় বলল যাবার সময় যেন আবার দেখা করে যাই - তেলের পিঠা পাটালী গুড় দিয়ে বানানো ওগুলো খেয়ে যেতে বলল - শুনে মনটা ভরে গেলো । বাঙ্গালীর অতিথি পরায়নতা বিশ্ব বিখ্যাত - এই জন্যই মনে হয় বাঙ্গালীদের রেস্তোরাঁ ব্যাবসা এত সফল সব খানেই ।
- হাঁটতে থাকলাম দুজনা ভেনিসের ক্যানালের পাড় দিয়ে প্রধান সেন্ট মার্ক স্কয়ার এর দিকে কিন্তু প্রত্যেক কদমে কদমেই থেমে থেমে আই ফোন অথবা আমার প্রিয় সনি সাইবার শট ক্যামেরা দিয়ে তুলতে লাগলাম ছবি তুলতে - ছবি তোলা আমার অন্যতম প্রধান সখ । এই বিল্ডিং এর ছবি নেই, নয়ত খালের ছবি, অথবা স্পিড বোটে করে ছুটে যাচ্ছে একদল পর্যটক দেড় ছবি, কিংবা গন্ডোলা তে বসে আছে এক রোমান্টিক যুগল এবং নিপুণ হাঁতে লগি দিয়ে নিলিপ্ত ভাবে নৌকার মাঝির চাতুরী - দুইটা দালানের মধ্যে খানে সরু খালের ভিতর দিয়ে কি সুন্দর ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে বা বয়ে যাচ্ছে তার প্রমোদ নৌকা - ভেনিসের অন্যতম প্রদান বৈচিত্র্য ময় এই নৌকা ( ওদের দেশে এটা কে বলে গন্ডোলা ) - একটু খারাপ লাগল আমি নিজে চরলাম না বলে - আমি দেখতে চাচ্ছিলাম ঐ নৌকায় বসলে নৌকা থেকে শহর টা কেমন দেখায় । কিছুক্ষণ পড় পড় ই একেকটা ছোট্ট সাঁকো জাতীয় পুল এই খাল থেকে ঐ খালে, এই দালান থেকে ঐ দালানে যাবার জন্য । প্রায় ১৬০০ বছর যাবত এই নগরী টা দাঁড়িয়ে আছে পানির উপড়ে - সেই ৪২১ খ্রিস্টাব্দে ২৫সে ই মার্চ গ শুক্রবার উচ্চ দ্বিপ্রহরের সময় গোড়াপত্তন হয়ে ছিল এই শহরের । ১১৮ টা ছোট ছোট দ্বীপ জেগে উঠেছিল হয়তোবা কোন আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে এই অ্যাড্রিয়াটিক সমুদের শেষ পাড়ের কিনারে সেই কয়েক লক্ষ বছর আগে - সমতল ভূমি থেকে ঐ সাগরের পানি দ্বারা বিছিন্ন ; কেউ কি চায় এই রকম বিছিন্ন জায়গায় বসবাস করতে ? কিন্তু, জীবন মানেই সারভাইভাল ফর দি ফিটেস্ট ( শক্তিবান ই কেবল বেঁচে থাকতে পারে ) বর্বর দের আক্রমণ এবং আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্য এর এই দ্বীপমালায় বসতি গড়ে তুলে । কিন্তু সমস্যা দেখা দিল জায়গার স্বল্পতা এবং পানির এত নিকটে কিভাবে টেকসই আবাস গড়ে তোলা যায় । বর্বর রা পদাতিক আগ্রাসনে পটু ছিল ওদের সেই আমলে নৌ কেদ্রিক চলাচল এ পারদর্শী হয়ে উঠে তখনো তাই এই দ্বীপমালায় যারা বসতি গড়ে তুলেছিল তারা বর্বরদের তীক্ষ্ণ তরবারির কোপ থেকে রক্ষা পায় সে যাত্রা । তারপর তারপরই সেই জনগণ আসতে আসতে গড়ে তুলে এই বিশাল নগরী , যেখানে এখন প্রতি বছর আড়াই কোটি পর্যটক পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এখানে বেড়াতে আসে । জাহাজ ভড়ে ভড়ে, প্রমোদ তরী নিয়ে , প্লেন ভড়ে বছরের বারো মাসই এখানে লোকে লোকারণ্য । জলাশয়ের মধ্যে কাঠের স্তম্ভ পুতে পুতে সেই কাঠের স্তম্ভের উপর দালানের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করে ঐ ভিত্তি প্রস্তরের উপর নির্মাণ করে ঐ সব দালান এবং রাজ প্রাসাদ তুল্য অট্টালিকা গুলো - থরে থরে সাজানো দালান গুলো দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে - সেই সব কাঠের স্তম্ভ গুলো সেই মধ্য যুগের মিস্ত্রি রা এতই সুনিপুন ভাবে একটা স্তম্ভের গাঁ লাগিয়ে আরেকটা স্তম্ভ মাটিতে পুঁতেছে যা নাকি যাতে কাঠ ভেদ করে পানি ঐ দালানের পাদদেশে প্রবেশ করতে না পারে । কাঠ সচরাচর পানিতে পচে না তাই এখন অনেক দালানের ভিত্তির কাঠ এর বয়েস এক হাজার বছরের ও অধিক । প্রথম আগত পলাতক লোকজন ঐ জলবন্দী এলাকায় মৎস্যজীবীদের সাথে বসবাস করতে থাকে ক্রমান্বয়ে আরও মানুষরা আসতে থাকে বর্বর আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্য - তখন দেখা দেয় জায়গার সংকুলতা - সবাই মিলে ঐ সমুদ্রের উপহ্রদ এ কাটে অনেক গুলো সংযোগ খাল আর আস্তে আস্তে গড়ে তুলে ঐ কাদায় পরিপূর্ণ জলাভূমিতে গড়ে তুলে এক বিশাল জনপদ ।ভরা জোয়ার এর সময় এক্যুয়া আলটা’র কারণে প্রায়শই এই নগরী প্লাবিত হয় । আজ অনেকেই ভেনিস কে নিম্মজিত শহর বলে ডাকে । কিন্তু দালানের ভাঁড়ে কাদা এবং ময়লা গুলোকে সংকোচিত হয়ে একেবারে শক্ত ভিত্তি প্রস্তর হিসেবে কাজ করছে এবং যার ফলে দালান গুলো এখনও দাঁড়িয়ে আছে আপন মহিমায় যদিও গ ১০০ বছরে এই শহর প্রায় ৯ ইঞ্চির সম পরিমাণ মাটিতে দেবে গেছে এবং বিশেষজ্ঞ রা মনে করছে ২০২১ সালে হয়ত এড্রীয়াটিক সাগরের এই উপহ্রদ টা প্রায় নিম্মজিত হয়ে যেতেও পারে । এই শহর দেখে রাশিয়ান নামকরা এক লেখক আলেক্সজান্ডার হেরযেন একদা বলেছিলেন, ‘’ যেখানে শহর বানানো সম্ভব নয় সেখানে শহর বানানো পাগলামি , আর ঐ জায়গায় সবচে’ মার্জিত এবং এই রকম মহীয়ান নগরী বানানো একটা প্রতিভাবান পাগলামির কাজ । ‘’
- জীবনের প্রথম আমি এই রকম নগরী অবলোকন কর ছিলাম আর প্রতি মুহূর্তেই হারিয়ে যাচ্ছিলাম চিন্তার অতল গর্ভে ; কিভাবে সম্ভব ; এরকম একটা কিছু বানানো মানুষের দ্বারা সেই ১৬০০ বছর আগে - অনেক গলি, অনেক ছতর, অনেক দালান, অনেক কোঠা, অলি গলি, নদীনালা, ফুটব্রিজ, সাঁকো, মূর্তি, ম্যুরাল, ইহুদি দেড় গেঁটও, খ্রিস্টান গির্জা, ইহুদিদের উপাসনালয় সিনেগগ দেখতে দেখতে হাজির হলাম সেন্ট মার্ক চত্বর এ ভেনিসের প্রধান মাঠ এ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী সেইন্ট মার্ক এর গির্জা - উপাসনালয় এটা শুধু চার্চ বা গির্জাই নয় এটাকে বলে ব্যাসিলিকা ( রাজপ্রাসাদ) - তার মানে হচ্ছে রোমান ক্যাথোলিক ধর্মের এই গির্জা টা একটি প্রধান উপাসনালয় অত্র প্রদেশের প্রধান ধর্মীয় যাজকের আসন ; একটা অপরূপ রাজ প্রাসাদ সম দালান এটা যা নাকি ইটালীয় - বাইজেন্টাইন স্থাপত্য শিল্পের একটা উদাহরণ । চোখ জুড়িয়ে যায় এই ব্রাসিলিকা টার অপূর্ব কারুকাজ খচিত নির্মাণ শৈলী দেখে । নিজের অজান্তেই হারিয়ে গিয়েছিলাম অনেকক্ষণ ; একটা কোমল গলার আওয়াজে ভেঙ্গে গেলো আবার হারিয়ে যাওয়া টা অকপটে - পাশে দাঁড়িয়ে এক অপরূপা মহিলা প্রশ্ন করলো, আমি তার কয়েক টা ছবি তুলে দিতে পারব কিনা ? অত্যন্ত নম্রতার সঙ্গে উত্তর দিলাম অবশ্যই - নীল প্রিন্টের লঙ ড্রেস পরিহিত স্লিম, অনেক লম্বা, একেবারে স্বর্ণকেশী নারী - প্রায় অনেক গুলো পোজে প্রায় গোটা ত্রিশ ছবি তুলে দিলাম, বার বার সে ক্ষমা চাচ্ছে আমাকে বিরক্ত করার জন্য - সে একা এসেছে আর্জেন্টিনা থেকে প্রমোদ তরীতে করে সঙ্গে মা আর বাবা এবং সে , তরী ভিড়েছে ভেনিসের তীরে আজ সকালে আবার যাত্রা শুরু করবে ক্রোয়েশিয়া মুখী আগামী কাল রাত্রে । মা বাবা অনেক বয়স্ক ওরা ক্লান্ত হয়ে জাহাজে ফিরে গেছে ঘণ্টা খানেক আগে - আর ও একা সারারাত কাটাবে রাতের ভেনিস এর সৌন্দর্য দেখে দেখে কিন্তু কিছুক্ষণ আগে ও সেলফি ষ্টীক টা মাটিতে রেখে হাত ছবি তুলতে গিয়ে ওটা পানিতে পড়ে গেছে তাই অগত্যা আমার শরণাপন্ন হতে হয়েছে । কুশল বিনিময় করার সময় ও বলল তার নাম জুলিয়েটা ; বুয়েনেস আইয়ারস এ থাকে ; মার্চেন্ট ব্যাঙ্কে চাকরী করে - আমি যখন বললাম আমি লন্ডনে থাকি ও বলল সে খুব শিগ্রিই লন্ডন আসবে বেড়াতে ; ওর খুব সখ স্কটল্যান্ড এবং লন্ডন শহর দেখার , কথা প্রসঙ্গে এও বলল যে ওর বাবা ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় আর্জেন্টাইন আর্মি তে লেফটেন্যান্ট ছিল এবং ঐ যুদ্ধে ওর বাবা ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে রেড ক্রস এর মাধ্যমে ছাড়া পেয়েছিল ৩ মাস পর - ওর বয়স তখন ২ বছর । আমিও বললাম আমি তখন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমী তে ট্রেনিং রতঃ হবু লেফটেন্যান্ট । এই সব বলতে বলতেই ফ্রেড এসে বলল চলেন আইসক্রিম খাই - আমি বললাম চলো - ও জুলিয়েটা কেও আমন্ত্রণ করলো আমাদের সাথে আইসক্রিম খাবার জন্য ।
- ফ্রেডী কে গেয়ে শুনালাম, ‘’ঐ জলকে চলে লো কার ঝিয়ারি রূপ ছাপে না তার নীল শাড়ী ( গাউন) ‘’ - দুজনাই অনেক ক্ষণ মনখুলে হাসলাম - মহিলাটা জিজ্ঞেস করলো কেন আমরা এত জোড়ে হাসছি - নজরুল ইসলামের ঐ কবিতা টা কে মার্চেন্ট অফ ভেনিসের মত ইংরেজি তে অনুবাদ করে শুনালাম - শুনে বেশ সংকোচিত হয়ে লজ্জা পেল যেন মনে হল । এই আজে বাজে কথা বলতে বলতে একটা বেশ নামীদামি হোটেলের লবিতে ঢুঁকে গেলাম আমরা তিন জন - লবির শেষ প্রান্তরেই আইসক্রিম পার্লার টা দেখতে পেলাম - হোটেল এর লবি দেখলে চোখ ধাধিয়ে যাওয়ার অবস্থা - চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ফুট উপর থেকে ঝুলিয়ে এসেছে ঝাঁর বাতি গুলো, ওক কাঠের চকচকে ভারনিস কড়া কাঠের প্যানেল দিয়ে ঘেরা দেওয়াল , বিশাল বিশাল ভেনিসের বিশ্ব বিখ্যাত চামড়ার সোফা গুলো, পিতলের দরজার হান্ডেল গুলো চকচক করছে যেন এই মুহূর্তেই কেউ এগুলো পলিস করে দিয়ে গেছে ; সব অতিথি রা নিচু গলায় কথা বলছে আর লবির আরেক প্রান্তে এক বিশাল পিয়ানোর সামনে বসে মনের সুখে লুছিয়ানো পাভারতির সেই প্রসিদ্ধ ইতালিয়ান অপেরা টেনর এর ‘’ চে গেলিদা মানিনা ‘’ গান টা বাজ্জাছে আর গাইছে উচ্চ মর্গে । এক অপূর্ব পরিবেশ - সৌন্দর্য, প্রাচুর্য, নীরবতা, মহীয়ানতা, সম্পদের বহিঃপ্রকাশ এবং এরিস্টোক্রেছী এর সংমিশ্রণ করে তুলেছে হোটেল টা কে দারুণ রোমান্টিকতার স্বর্গে।
- একটা খালি সোফায় বসলাম - বসে বসে অপেক্ষা করছিলাম ওয়েটার এর অর্ডার দিবার জন্য । প্রথমে কথা সেই ই শুরু করলো । অনেক গল্প করলাম - তিনটা আইসক্রিম অর্ডার দিলাম ওকে অফার করলাম এক গ্লাস লারয ইতালিয়ান কিয়ানতি ক্লাসিকো রেড ওয়াইন । সে খুব আশ্চর্য হল আমি ওয়াইন নিলাম না - ফ্রেডী নিলো একটা বিয়ার আর আমি শুধু বাদাম বিহীন লেবু ফ্লেভার এর আইসক্রিম খাচ্ছি দেখে - ফ্রেডী ও কে বুঝাল যে আমি একজন রেস্তোরাঁর এবং ওয়াইন বারের মালিক ছিলাম একদা তাই আমার ইতালিয়ান এবং আর্জেন্টাইন সহ সকল দেশের ওয়াইন সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান আছে যদিও আমি নিজে কখনো ওয়াইন পান করি না ।
- এক গ্লাস থেকে ৪ - ৫ - ৬ - ৭ গ্লাস ওয়াইন আর ফ্রেডীর বিয়ার প্রায় ৫ টা তে যখন তখন বিল দিয়ে বের হয়ে আসলাম সেই প্রাসাদোপম হোটেল থেকে । দিব্বি হেঁটে বেড়াতে লাগল জুলিয়া । কথার ফুলঝুরি তার মুখে - অনর্গল কথা বলতে লাগলো, নিয়ন বাতির আলোতে ওর মুখটা লাগছিল অস্পরা দের মত আর যখন প্রাণ খুলে হাসছিল তখন রাতের আলোর বিকিরণ এ ওর দাঁত গুলো মনে হচ্ছিল যেন সাগরের পাড়ে মুক্তা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে । সে বেশ টলটলায়মান মনে হল ; ফ্রেডী আবার এইসব সময়ের জন্য ওস্তাদ বিদেশীনি মহিলার স্বামীতো সব জানে ; ঘড়িতে রাত প্রায় নয়টা - ও বলল চলেন সলিড কোন খাদ্য খাই - তাহলে ও প্রকিতশ্ত হয়ে যাবে - তিন জনে মিলে ডিনার করলাম একটা কোশার রেস্টুরেন্টে - দারুণ মজার হমুস আর সবাই আমার পছন্দ মত ব্রেইসড কর্ণ বিফ ব্রিস্কেট খেল সাথে আলু এবং সালাদ সঙ্গে ব্রেড ।
খেতে খেতে সময় ঘনিয়ে এলো আবার বিদায় নিবার পালা - সমুদ্রের মধ্যে খানে ওর বিশাল নয় তালা প্রমোদ জাহাজে একটা স্পিড বোট ভাড়া করে ওকে ওর জাহাজে উঠিয়ে দিয়ে আমরা আরও ঘণ্টা খানেক হাঁটাহাঁটি করলাম সমুদ্র তটে, রাতের আলোয় স্পিড বোট থেকে আলোকিত ভেনিস নগরীর রূপে পাগল প্রায় আমি ; দুচোখ জুড়িয়ে দেখলাম এই অপূর্ব ঐতিহাসিক নগরী - ইতিহাসের পাতায় পাতায় কত বার যে বারংবার হোঁচট খেয়েছি এই নগরীর গল্পের কাছে , সেই রোমান আমলের পড় মধ্য যুগে মার্কও পলো পর্যটকের বই ট্র্যাভেলশ অফ মার্কও পলো - সে কিভাবে বাংলার বানানো মসলিন দেখেছিল দামাস্কাসে, অটোমান সাম্রাজ্যের সময় ভেনিসের প্রসিদ্ধ প্রকাশক আলাসেন্দাড়ো পাগানিনি ১৪-১৫ শতকে পবিত্র কোরান ছাপাতো এই ভেনিসে এবং পৃথিবীর অন্যতম প্রসিদ্ধ কাঁচের শিল্প গড়ে উঠেছিল এই নগরীতে এখানেই শুরু হয় ভেনিসিয়ান গ্লাস এবং অরনেট ( অলংকৃত ) কাঁচ এর শুভযাত্রা এখানেই শুরু ।
োমান্স বিহীন রোমান্টিক নগরীকে আস্তে আস্তে পিছনে ফেলে যাচ্ছে আমাদের ওয়াটার ট্যাক্সি টা প্রধান ক্যানেল ধরে একের পর এক ব্রিজের নিচ দিয়ে ভেনিস ট্রেন স্টেশন এর দিকে । রাতের আলোতে জ্বল গুলো ঢেউএ ঢেউয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে আলোর ধারা গুলো - সে যেন স্বর্গীয় প্রিস্মের প্রতিছবি মৃদু মন্দ দোলায় ঢেউ খেলা আলোর রশ্নিতে ভেনিসের প্রতিচ্ছবি পানিতে ; এভাবেই ক্রমশ পাড়ে নোঙ্গর কড়া পন্টুনে এসে থেমে গেলো আমাদের ওয়াটার ট্যাক্সি .....…. তড়িৎ উঠে গেলাম স্টেশনে ট্রেন ছাড়তে ১ মিনিট ৯ সেকেন্ড কেবল বাকি - লকার খুলে হোল্ডল টা কাঁধে নিয়ে দৌড়ে গেলাম প্লাটফরমে - স্ক্যানারে টিকেটের গন্ধ শুকিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই আলাউদ্দিন আর চল্লিশ চোরের মত দরজা টা ছিছিম ফাঁকের মত খুলে গেলো আর আমরা দুজন হুমড়ি খেয়ে ট্রেনে উঠে বসলাম পারদোনোনা যাবার উদ্দেশ্যে …।। বিদায় ভেনিস ..….
েনিস থেকে রাত দুটার সময় এসে পৌঁছলাম পারদোননে এ - স্টেশন এই গাড়ী পারকিং করা ছিল ; সোজা ফ্রেডীর ভিলা তে চলে গেলাম ; কাপড় চোপড় খুলে চেঞ্জ করেই শাওওার টা সেরে নিলাম চটপট । একটা
স্ত্রং কাপ চা নিয়ে বসে শুরু হল আমাদের গল্প - সেই গুলশান ২৫ নম্বর রোডের বাড়ির সেই অফিস, থেকে ইতালির ভিসা , প্লেনে উঠিয়ে দেওয়া থেকে প্রথম কয়েক মাস চিঠি পত্র আদান প্রদান, তারপর ফ্যাক্স, এবং দু একটা ফোন কল অতঃপর সব শেষ - এক বছর পর আমি চলে আসলাম লন্ডনে - যোগাযোগ ওইখান থেকেই বিচ্ছিন্ন ; ঢাকায় বসিউর এর কাছে মাঝে মাঝে শুনতাম গল্প কিন্তু ব্যাটে আর বলে সংযোগ আর হয় নাই গত ত্রিশ টি বছর ধরে ; ইতিমধ্যে বুড়িগঙ্গায় অনেক জল গড়িয়ে গেছে । সেই ঢাকা আর ঢাকা নাই - এয়ারপোর্ট রোডে উত্তরা তে আগের মত আর ১২০ মাইল বেগে গাড়ী চালানোর কোন সুযোগ ই নেই আর । মানিক মিয়া আভ্যুনে তে ১৮০ ডিগ্রি টার্ন করার কথা স্বপ্নেও ভাবা যায় না । মহাখালীতে ফ্লাই ওভার শুনলে ক্যামন লাগে , কামাল আতাতূরক আভ্যনুতে দুপাশেই বিশাল বিসাল হাই রাইজ বিল্ডিং । বনানী বাজার কোথায় যেন হারিয়ে গেছে ; ভূতুড়ে বনানী ১১ নম্বর এখন সারাদিন রাত লোকে লোকারন্নন্য । চিনার কোন উপায়ই নাই । ওর মাথায় উস্খখো খুস্খো সাদা পাক চুল, চোখে চশমা, কত যে চেঞ্জ ; টগবগে একটা ২০ - ২১ বছরের তরুণ সেই ছিপচেপে মানুষ টা আজ প্রায় ৫৫ বছরের মধ্য বয়সী বেক্তিত্ত । এক্সট্রিম ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির ছি এ ডি ( কম্পুটার এইডেড ডিজাইন )
এর ডিরেক্টর ; লন্ডন ওয়েম্বলি স্টেডিআম আর রিট্ট্রাক্টএবেল ছাউনি বানিয়েছে ওদের ঐ কোম্পানি, ওর পরিবার আমাদের পরিবার, মা, বাবা, ভাই দের কথা বলতে বলতে সকাল ৭:৩৫ মিনিটে ঘুমাতে গেলাম দুইজন । দুপুর বারো টায় ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার ; উঠেই এক কাপ লেমন চা বানালাম আর আমার উঠার আওয়াজে ওর ও ঘুম ভেঙ্গে গেল । দুজনা এক সাথে চা পান করেই ড্রেস পরেই বেড়িয়ে পরলাম ; পারদোনেন শহর টা দেখতে । নদী একটা আছে খুবই সুন্দর একদম ছবির মত দেখতে ; ভীষণ খরস্রোতা ; পাহাড়ের চূড়ার সব বৃষ্টির পানি এই নদী দিয়েই নেমে আসে । একদম ভিউ কার্ডের মত একটা শহর - নেই কোন কোলাহল, নেই কোন ব্যস্ততা, নীরব ছিমছাম পরিছন্ন একটা শহর, দেখা হলেই এক আগন্তক আরেক পথচারী কে অভিবাদন দিচ্ছে , বনজ জি বলে ; কি সুহৃদ সম্পর্ক আমাদের দেশের মত
এক জন আরেক জনের দিকে কর্কশ নেত্রে চাহনি দেয় না । লন্ডনের চেয়ে অনেক গরম ওখানে ; হাঁটতে হাঁটতে শহরের মধ্য খানে চলে আসলাম ; বিশাল এক টা গির্জা আর গির্জার পাশেই ২৭০ মিটার উঁচু চার্চের টাওয়ার সেই ১২শ খ্রিস্টাব্দে বানিয়েছে ।
ভাবতেই আশ্চর্য লাগে ; টাওয়ার এর নিচের তলায় হল ওই শহরের ক্ষুদ্র জেলখানা ; অল্প কয়জন ২০ জনের মত লোক এর জায়গা হবে মন হল ; বিবিলীওটেকা মানে হল লাইব্রেরি থ্যাকে থ্যাকে ইতালীয় ভাষায় বই সাজানো, বাচ্চাদের এবং বয়স্ক দের আলাদা আলাদা সেকশন ; নীরব নিশ্তব্দ চারপাস । নেই টু শব্দটিও । যে যার মত বই এর পাতায় নিমগ্ন ; অনেক হাঁটলাম সেই প্রসিদ্ধ রোমান ইট বিছান কব্যল স্ট্রিটে ; ক্লান্ত এবং গরমে দুস্তর মত ঘেমে কর্দমাক্ত ; উপায়ান্তর না পেয়ে একটা বারে ঢুকে দুজনা দূটো আইস ক্রিম খেলাম পেভমেন্টে বসে বসে । সম্পূর্ণ একেবারে পর্যটক দের মত হালফ শর্টস পরা মাথায় হ্যাট, গলায় ঝুলান ক্যামেরা, রাক্সাকে ভরা পানির বোতল, সান ক্রিম, ওয়াকিং স্টিক এবং অন্যান্য সামগ্রী । ইতালির প্রত্যেক শহরেই পাবলিক দের পানি পান করার জন্য রয়েছে পানির ফোয়ারা । মানুষ মানুষের সৌহার্দ পূর্ণ সম্পর্ক দেখে আমি অভিভূত ; আমাদের কে ও ওরা শুভেচ্ছা জানাতে কোন প্রকার কৃপণতা দেখাচ্ছে না আরও অনেকক্ষণ হেঁটে শহরের আরেক প্রান্তে এসে একটা লেবানিস রেস্তরা তে
ঢুকে হমুস আর ব্রেড সাথে ল্যাম্ব শওারমা কেবাব খেলাম দুই বন্ধু মিলে । আশ্চর্য হলেও সত্যি বন্ধু আমার মানিব্যাগে হাত ই দিতে দিচ্ছে না - দেখে বিব্রত এবং রাগান্বিত হলাম ওর উপর একটু । কিছুতেই শুনল না আমার কথা । খেয়ে দেয়ে আবার বের হলাম হাঁটতে হেঁটে চলে শহরের জাদুঘরে ; সেই রোমান, গ্রিক, খ্রিস্টান, বর্বরদের আক্রমণ এবং পারটিসান হয়ে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ইতিহাস থেকে শুরু করে ওশট্র হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য হয়ে হ্যবসবারগ ডাইনাস্টির ইতিহাস সহ এই এলাকার কোন খুটিনাটি কোন কিছুই বাদ পরে নাই এদের সংরক্ষণ থেকে - একেবারে অভিভূত হয়ে গেলাম ; রোমানদের পোশাক এবং ওদের খাঁদি কাপড় দেখে মনে পরল ২৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার তাঁতিদের বানানো খাঁদি কাপড় রোমান দের নিকট রপ্তানি করা হতো - টলোমির বই তে কোথায় জানি একবার পড়েছিলাম । আবার আরেকটা বড় লাইব্রেরী একটা দেখে ঢুঁকে পরলাম - কি পরিচ্ছন্ন - এখানেও তাই বাচ্চাদের আলাদা পড়ার জায়গা আর এক পাশে বয়স্ক দের - ১০০% বই ই ইতালিয়ান ভাষায় লেখা ; সেই ১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ইতিহাস এ ভরা এই বিব্লিওটেকা ( ইতালিতে লাইব্রেরি কে তাই বলে ) । ঘণ্টা খানেক বসে বসে চতুর্দিক অবলোকন করলাম আর ওদের লাইব্রেরির ওএইচ পি তে দেখতে লাগলাম ইতিহাস সমৃদ্ধ ছবি সেই ক্যামেরা আবিষ্কার হওয়ার আদি কাল থেকে । প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ এর ইতিহাস এবং দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ফাসিস্ট মুসলিনি এবং হিটলার - হলোকাস্ট এসব নিয়ে অনেক ছবির সংগ্রহ এই বেবিলিওটেকা তে । মনে হল এটা মনে হয় এই শহরের পাবলিক লাইব্রেরি বোধ হয়।
বাইরে ভীষণ কড়া রোদ রাস্তা ঘাট জনশূন্য - অগাস্ট মাস মানেই হোল সবার হলিডে - পুরা দেশ ছুটি কাটাচ্ছে । ওদের দেশের লোকেরা অন্য দেশে যায় আর অন্যান্য দেশের মানুষেরা ওদের দেশে আসে । ইউরোপে বছরে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মানুষ ট্যুর করে । কম্যুনে ( ওদের পৌরসভা অফিস) একদম শুন্য - মনে মনে ভাবলাম - চুয়াডাঙ্গা পৌর সভার কথা - কারণে অকারণে ঐ অফিসে কম করে হলেও ২ থেকে ৩শ মানুষ ঘুরে বেরাতো ; নাই কোন দালাল, ফড়িয়া , নাই মুহুরি, নাই কানভাসার বা প্রদীপ চানাচুর ওয়ালা । নিশ্তব্দ নিসচুপ পরিছন্ন একটা পরিবেশ - ওইখানে বোর্ডে থরে থরে ছবি গুলো সুন্দর করে সাজিয়ে বাধিয়ে রেখেছে যেই সব জনগণ অতি সম্প্রতি কালে মৃত্যু বরন করেছেন - তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি ; কি সুন্দর ওদের কালচার ।
েলা প্রায় ৬ টা বাজে রওনা হলাম ঐ শহর থেকে ২০ - ২৫ কিলোমিটার দুরে আলপাইন পর্বত মালার প্রথম নিকটবর্তী চুড়া র উদ্দেশ্যে । সেই ১৯৮২ সালে বি এম এ তে ওডিটোরিওয়াম এ মিলিটারি জিওগ্রাফীর ক্লাস নিচ্ছিলো লেফটেন্যান্ট সারওার - সম্পূর্ণ ক্লাস এ মাত্র আমরা হাঁতে গোনা ছাড়া সবাই ই গভীর নিদ্
রায় নিমগ্ন তখন সারওার বলেছিল আলপাইন পর্বত মালা একটি টারসিয়ারী পর্বত মালার অংশ - ঐ টারসিয়ারী পর্বত মালার ই বংশ শেষ হয়েছে হিমালয় পর্বতে - বেশ ভালোই লাগল যে আজ ৩৬ বছর পরও ঐ লেসন টা ভুলি নাই ; আজ আমিও দ্রুত গাড়ি হাঁকিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি ঐ আলপাইন পাহাড় মালার একটি চুড়া মাউন্ট কোভালির দিকে - ফ্রেডি বলল বস আজ রাতে আমরা ঐ পাহাড়ের গহীন একটা গুহার নিকট যেয়ে তাঁবু গাড়বো সন্ধ্যা হওয়ার পড় - ঐ খানেই বার বি কিউ করে রাতের খাবার খেয়ে গাড়ির ভিতরে ডিঁকি তে করে নিয়ে আসা একটা তাঁবুতে ঘুমাবো - জিজ্ঞেস করল কোন অসুবিধা নাই তো । পাহাড়ের চুড়া প্রায় ৭ হাজার ছয় শ ফুট আমরা প্রথম রাতে সন্ধ্যা হবার আগ পর্যন্ত ১২ থেকে ১৫শ ফুট উপড়ে উঠেই রাত নামার আগেই তাঁবু গাড়ব ; গাড়ি এসে থামল মাউন্ট কোভোলা পর্বতের স্কি শ্লোপের পাদদেশে - গাড়ি পার্ক করে সব নামালাম - দুজনার কাছে ওজন প্রায় ৬০ - ৭০ কেজি নিয়ে উঠতে শুরু করলাম পর্বতে ; সে এক কঠিন যাত্রা - গ্রীষ্ম কালে সব সবুজ পাতায় ঢাকা আর শীত সব সফেদ সাদা বরফে আচ্ছাদিত পাঁচ থেকে ছয় ফুট বরফে সব ঢাকা পরে যায় বছরের ৬- ৮ মাস । লক্ষ লক্ষ স্কিয়ার এসে এখানে স্কি করতে । আর এখন আসে পর্বত আরোহী রা যারা হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের চুড়ায় যেয়ে আবার হেঁটে নেমে আসে । কয়েক হাজার লোক , বাচ্চা, আবাল , বৃদ্ধ, বনিতায় একাকার পুরা এলাকা । পা গুলো ক্লান্ত হয়ে গেলো ঘণ্টা খানেক হেঁটেই ; ও তার জিপি এস এ দেখল আমরা প্রায় ৯ শ ফিট উপড়ে উঠে গেছি । অনেক জায়গায় পাহাড়ের উঠার পথ প্রায় ৬০ ডিগ্রি খাঁড়া স্লোপ, উঠতে খুবই কষ্ট হয় , তার উপর অনেক বছরের অভ্যাস নাই পাহাড় এ উঠার । সন্ধ্যা প্রায় সমাসন্ন - সহসা উপলব্ধি করলাম প্রচণ্ড ঠাণ্ডা - নিচে ছিল ২৭ ডিগ্রি আর ওর জি পি এস ওখানে তাপমাত্রা মাত্র ৫.৫ ডিগ্রি । ঘাড় থেকে সব কিছু নামিয়ে সেই আগের জীবনের স্কাউট এর মত দুজনাই ব্যাস্ত হয়ে পরলাম আলো শেষ হবার আগেই তাঁবু গাড়ার এর শুকনো লাকড়ি - কাঠ বা শুকনো পাতা যোগাড় করতে - বার বি কিউ করে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য । তাঁবু ঠিকঠাক দুটো পাহাড় চুড়ার ভ্যালিতে লাগালাম যাতে রাতে ঠাণ্ডা বাতাস কম লাগে আর কাছেই পেয়ে গেলাম একটা ঝর্নার নালা - একদম স্ফটিক এর মত পরিছন্ন পানি - একটা স্যাডেল জাতীয় প্লেটু মনে হল জায়গাটা । গ্রিড রেফেরনেস নিয়ে আই ক্লাউডে সেভ করলাম আর আপন পজিশন ফাতেমা কে এমেল করে দিলাম সঙ্গে সঙ্গে । তাঁবু গাড়ার পর এক ঝলক সূর্যের আলোর দেখা পেলাম কয়েক মিনিটের মত ; তার পর কখন যে কালো রাত নেমে আসল তা আর টের ই পেলাম না - রাতের আহার বানাতে ব্যস্ত হয়ে পরলাম দুজনাই ......…
একটি বিশাল লাভজনক ব্যবাসা এবং অদিবাসি দের জন্যও একটি খুবিই আনন্দ দায়ক সময় । বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে সম্পূর্ণ পরিবার এর সকলের জন্য এইটা একটি বিরাট অবসর সময় কাটানসারারাত তাঁবুতে রাত কাটালাম ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে , রাত ১২ টার পর আস্তে আস্তে তাপমাত্রা নীচের দিকে নামতে থাকে । ব্যাটারি চালিত হিটার টা বেশ ভালই গরম বাতাস দিয়ে আমাদের দুজনকেই বেশ উষ্ণতা দিল । চতুর্দিকে শুধু ভ্যালির মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের তীব্র হাওয়ার শব্দ ছাড়া সব - কৌতুক আর বিভিন্ন মানুষের কথা বলা, এক্টিং করা থেকে একেকজন এর বিভিন্ন গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম মনেই নাই । হটাত ঘুব ভেঙ্গে গেল একটা দমকা হাওয়ার ঝাপটায় মনে হল যেন তাঁবু টাকে উঠিয়ে ফেলে আমাদের কে উড়িয়ে নিয়ে যাবে পাহাড়ের ঢালুর দিকে । ভীষণ খাঁড়া পাহাড় এর স্লোপ - কোথাও কোথাও প্রায় নব্বই ডিগ্রী খাঁড়া । ভাবতেই ভয় লাগে - আবার ভাবলাম পাহাড়ের ঐ প্রান্ত থেকে আবার বন্য কোন পশু না এসে আবার আক্রমণ করে । প্রতিরক্ষার জন্য কেবল আছে পাহাড়ে উঠার লাঠি দুটো আর রাতে বার বি কিউ করার জন্য খন্তা আর দুটো ৪ ইঞ্চি মাংস আর সবজি কাতার চাকু । আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে পরলাম - বালিশের নীচ থেকে টর্চ বের করে লাঠি নিয়ে বের হয়ে পরলাম তাঁবু থেকে । সেই অনেক বছর পর পাহাড়ে রাত কাটাচ্ছি - চাঁদের আলো আর আধারিতে পাহাড় দেখতে যে কি সুন্দর রাতের বেলা তা যে না দেখেছে তাকে বুঝানো বেশ কষ্টসাধ্য । আকাশে যদিও চাঁদ নাই - প্রায় অমাবস্যার মত কাল তারপর ও সব কেমন যেন পরিষ্কার - মাসুদ রানা বইয়ে পরেছিলাম অন্ধকারে প্রথমে এক চোখ খুলে আর এক চোখ বন্ধ করে রেখে কিছুক্ষণ পর বন্ধ চোখ খুলেই সব পরিষ্কার দেখতে লাগলাম । কিছুই পেলাম না দেখতে । আমার চলাচল শুনে ফ্রেডির ও ঘুম ভেঙ্গে গেল - ওর হাতের মাউনটেন ক্লাইমবিং ঘড়ি দেখে বলল যে , সকাল প্রায় সমাসন্ন ৪৫ মিনিট পরেই ঐ দিক থেকে সূর্য উঠবে । তাঁবু টা থাকুক চলেন সূর্য উদয় টা অবলোকন করে আসি । বললাম চল । প্রায় ৬০০ গজ উপড়ে পাহাড়টার ঐ ছোট্ট চুড়া থেকেই দেখা যাবে সূর্য উঠা দেখা যাবে । তড়িঘড়ি করে কাপড় পরেই বেরিয়ে পরলাম । উপড়ে উঠতে লেগে গেল ৩৫ মিনিট সে এক কঠিন সরু মেঠো পাহাড়ি ট্র্যাক আধো আলো আধো অন্ধকারাচ্ছন - বন্ধুর সেই পথ , অনেক কষ্টে উঠলাম - ওয়াও কি অপূর্ব সে দৃশ - মনে পরে গেল সেই ছোট বেলা আবার সাথে সিলেটের লাঠি টিলা ইপিআর বিওপি থেকে ও সকালে ইন্ডিয়ার ঐ পাস থেকে সূর্য টা পাহাড়ের গা’ ঘেঁষে উঠত লাল একতা অগ্নি গোলক এর মত ; হারিয়ে গেলাম সেই স্মৃতির অতল গর্ভে । কয়েক মাইল দূরে লেক বারচেয এর উপর দিয়ে একটা গ্যাস বেলুনের মত সূর্য টা আস্তে আস্তে ঊর্ধ্ব মুখি হয়ে উঠে আসছে যেন ; সে কি অপূর্ব - সবুজ লেকের পানিতে লাল সূর্যের আলোর বিকিরণ সবুজ এবং লালের সংমিশ্রণ প্রতিচ্ছবিত হচ্ছে প্রিসমের মত । ঢেউ এর সাথে সাথে দুলছে মৃদু ; পকেটে, রাক্সাক, জ্যাকেটের পকেটে হাত দিয়ে দেখি তাড়াহুড়ায় ফোন, ক্যামেরা, ভিডিও সব ই ফেলে এসেছি টেন্টে। ইস এতো সুন্দর একটা ক্ষণের ছবি গুল সেলুলয়েড এ ধরে রাখতে পারলাম না । এই সব করতে করতে সূর্য মামা চোখের নিমিষেই প্রজ্বলিত হয়ে উঠল পূর্ব দিগন্তে । কুয়াসায় ভিজে যাওয়া ঘাসের পাতার চূড়ামণিতে সূর্যের আলোর বিকিরণ জমে থাকা শিশিরের বলয়ে প্রতিবিম্ব হচ্ছে কাঁচের প্রিজমের মত । নেই কোন কোলাহল - প্রকৃতি তার আপন আঙ্গিনায় নিস্তব্ধ এবং আড়মোড়া ভেঙ্গে যেন রাতের বিছানার চাদর টা সরিয়ে জেগে উঠছে - নিত্তনৈমত্তিক কর্মকাণ্ড শুরু করার জন্য। আস্তে আস্তে অতি সন্তর্পণে এক পা দু পা করে নিচে নামতে লাগলাম - পায়ের বুট ছিল না - এডিডাস ট্রেইনার হটাত পিছলে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে ফ্রেডী ধরবার আগেই নীচে নেমে গেলাম কয়েক ফুট , তাকিয়ে দেখি আমি ওর থেকে 20 - 3০ ফুট নীচে দুই তিনটা ওলট পালট খেয়ে একটা গর্তে শুয়ে আছি মাথার হ্যাট নাই, পাহাড়ে উঠার লাঠিও নেই, বাম হাত দিয়ে বেশ কনুই এর পাশে বেশ বড় একটা ক্ষত । বাম পায়ের গোড়ালি মনে হল মচকে গেছে । আমার নামতে সময় লেগেছে মনে হয় কয়েক সেকেন্ড আর ওখান থেকে উঠে দাঁড়াতে সময় লাগছে কয়েক মিনিট - ও নেমে আসলো বেশ কসরত করে - তাকিয়ে দেখলাম ও মা গো মা । এ যাত্রা জমের হাথ থেকে রক্ষা পেয়ে গেছি কপালের গুনে । তা না হলে এটা একটা বড় দুর্ঘটনা হয়ে যেত পারতো । সব ঘটে গেলো কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে । উঠে দাঁড়াতে বেশ কষ্ট পেতে লাগলাম । চারিদিকে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলাম লাঠি আর হ্যাট টা । চোখ বুজে কয়েক মুহূর্ত নিজেকে বললাম ব্রেনে মেসেজ পাঠানোর জন্য - ইমরান তোমার কোন ব্যথা নাই কোন ব্যথা নাই - কোন ব্যথা নাই । এক মিনিটে ৫৫ বার বললাম এবং তার পর হাঁটতে লাগলাম । ব্যথা কম অনুভূত হতে লাগল যেন । ইতিমধ্যে ও এসে হাজির ততক্ষণে আমার পাশে । একটু একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তাঁবুর বেইজ ক্যাম্পে নেমে আসলাম ; ট্রেইনার টা খুলে একটু রেস্ট নিলাম- ইতিমধ্যে ও তাঁবু গুটিয়ে ফেলল সব কিছু র্যাকস্যাক ঢুকিয়ে ফেললো । ওর ব্যাগ থেকে একটা স্প্রে বের করে গোড়ালি তে স্প্রে করে দিলো । অল্পক্ষণের মধ্যেই ব্যাথা বেমালুম আলেমুল গায়েব হয়ে গেলো । স্কন্ধে ৮০ পাউণ্ড ওজন নিয়ে পাহাড় বেয়ে নীচে নেমে আস্তে লাগলাম - আধা পথে এসে রোপ ক্যারেজ ওয়ে দিয়ে নেমে আসলাম । গাড়িতে সব কিছু রেখে একটা গরুর খামারের গরুর দুধের বানানো পনির এবং দুধের ক্রিম চা ও গরুর মাংসের সাথে বানানো পনির স্কিলেট দিয়ে প্রাতরাশ সেরে গাড়িতে চেপে বসলাম ততক্ষণে পায়ের ব্যাথা কম ও হাতের রক্ত পরা বন্ধ হয়ে গেছে ।
ওর পোরসে নিয়ে বেরিয়ে পরলাম দ্রুত গতিতে সকাল সর্বসাকুল্যে কেবল ৭ - ৪৫, রাস্তায় লেক বারচেয এ থামলাম - কোভোলো পাহাড়ের এবং সংলগ্ন সকল পাহাড়ের নিঃসৃত জলরাশি জমে জমেই সৃষ্টি করেছে এই বিশাল লেকের । ওটার পাস দিয়েই আগের আমলের পাহাড় খুঁড়ে সুড়ঙ্গএর ভিতর দিয়ে ওল্ড রোড দেখলাম ; কি বিশাল কাজ- কি ওদের প্রকৌশলীদের মেধা - আর শ্রমিক দের সাহস , হাতুড়ী, কোদাল, বেলচা, সাবল দিয়ে খুদে খুদে বানিয়েছে প্রায় ৫ মাইল দীর্ঘ সুড়ঙ্গ রাস্তা - এক পাশে পাহাড়ের ছাদ আর দেওয়াল আর অন্য পাশে ৩ হাজার ফুট বিশাল পাহাড়ের খাদ - বিশাল সেই খাদ - তাকালেই গা শিউরে উঠে । ঐ ভ্যালী বা কানিওন এর মাঝেই জন্ম নিয়েছে ইতালির অন্যতম প্রধান নদী - যা পারদোনোনা হয়ে কিছু জায়গা শুকিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও প্রবাহিত হয়েছে এড্রিয়াটিক সাগরে । লেকের পাড়েই মাছ এর পোনা ঘুর ঘুর করছে ঝাঁকে ঝাঁকে ; কেউ কণিজাল বা বড়শি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না ঐ সব বালি মাছ জাতিয় মাছ গুলোকে। পাহাড়ের বিশাল গহ্বর এর উপর দিয়ে দুটো পাহাড় কে জোড়া লাগিয়েছে একটা দড়ির ঝুলন্ত ব্রিজ দিয়ে - সেই ২ হাজার ফুট উপড়ে এবং এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ের মধ্যে তফাত ২৫০ - ৩০০ ফুট । ঐ ঝুলন্ত ব্রিজ টা পাড় হলাম একা একা হেঁটে হেঁটে কোমরে সেফটি বেল্ট বেধে আর বেল্টের শেষে ক্লিপ গুল দড়িতে লাগিয়ে দেওয়ার জন্য যাতে পা পিছলে পরে গেলোও যাতে একদম দুই হাজার ফুট নীচে যাতে না পরে যায় কেই । হাজার হাজার পর্যটক চতুর্দিকে ; কেউ এসেছে গাড়ী নিয়ে, কেউ কেউ এসেছে হেঁটে হেঁটে তারা হেঁটে হেঁটেই ভ্রমণ করবে ছয় সাত সপ্তাহ ইতালিতে এসেছে ফিনল্যান্ড থেকে, নিউজিল্যান্ড থেকে, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রাঞ্চ বা রাশিয়া থেকে, কেউ বা এই খানেই তাঁবু তে কিংবা মোটর হোম এই থাকবে কয়েক সপ্তাহ আবার অন্যরা এসেছে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কোচ ভড়ে ভড়ে। গরমের যত বৃদ্ধি পাচ্ছে পরিধেয় কাপড় ও তত সংকীর্ণ হচ্ছে । কেউ কারোর দিকে তাকাবার সময় নাই । ঘাসের মধ্যেই প্রেমিক প্রেমিকারা বিকিনি এবং হ্যাফ পেন্ট পরে কড়া রোডে শরীরের চামড়া ঝলসানোর জন্য শুয়ে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা । সাইকেলের পিছনে বেয়ারিং এর গাড়ীর মত ট্রেয়াইলার এ বসিয়ে মা বা বাবা দিব্বি সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে । লোকে লোকারণ্য । অগাস্ট মাসে ইউরোপ জুড়ে চলে বাৎসরিক ছুটির মাস ঐ মাসে বাচ্চাদের স্কুল , কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব ৬ থেকে ১২ সপ্তাহের জন্য বন্ধ থাকে । হোটেল, মোটেল, বেড এন্ড ব্রেকফাস্ট , হোস্টেল কোথাও কোন জায়গা পাওয়া সম্ভব নয় । সারা দিন ঘুরে বেড়ায় সব পর্যটক রা আর রাতের বেলা সবাই ভালো দামি কাপড় চোপড় পরে শহরে বেরিয়ে পরে সবাই রেস্টুরেন্ট এ খাবার খেতে, বার বা পাব এ যাবে মদ্য পান ও অন্যান্য দের সাথে সামাজিক আড্ডা মারা এবং গান শুনবে, ডার্ট খেলবে বা কারাওকি তে গান গাবে আর বিয়ার, ওয়াইন, বা স্পিরিট পান করবে - আর যুবক যুবতি রা দল বেধে বেধে শহরের ডিস্কো তে নেচে গেয়ে মদ্য পান করে সেই গভীর রাতে যার যার ঘুমাবার স্থানে ফিরে যাবে আবার সকালে শুরু করে দিবে তাদের ভ্রমণ কার্যক্রম । এক অদ্ভুত সংস্কৃতি আমাদের কাছে হয়ত মনে হয় বা হবে । এই অগাস্ট মাসের জন্য চাতক পাখির মত অধীর আগ্রহে বসে থাকে ইউরোপের সব ভ্রমণ করার মত প্রসিদ্ধ বা নৈসর্গিক স্থান গুলো এবং সমুদ্র সৈকত গুলো - বছরে এক দশমিক চার বিলিয়ন পর্যটক রা পর্যটন এ বের হয়ে যায় এই মহাদেশে । একেক টা পরিবার কম করে হলেও তিন থেকে ছয় পাউন্ড ব্যয় করে এই সময় টাতে। মনে হয় গোটা ইউরোপে বসেছে এক বিরাট মিনাবাজার । বাৎসরিক এই হলি ডে কালচার সম্পূর্ণ ইউরোপের জন্য এোর মিলনমেলা । ইস শুধু যদি এই রকম একটা কিছু করা যেতো আমাদের দেশে - বাচ্চাদের স্কুল ছুটির সময় ; তবে আমাদের মত বিশাল দেশে দেশের ভিতরে এত গুল ভ্রমণ কেন্দ্র নাই যা নাকি সবাই কে স্থান দিতে পারবে একত্রে । যদিও বর্তমানে দেশের মানুষ দেশের ভিতরে এবং বহির্বিশ্বেও ভ্রমণ বিলাসী হয়ে উঠছে ক্রমশ ।
- এইসব অসংলগ্ন অনেক হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে কখন যে ইতালির অন্যতম ইউ নেস কো অনুমোদিত হেরিটেয ( ঐতিহ্য ) নগরী অ্যাঁকিলা তে এসে পরলাম তা বুঝতেই পারিনাই । বন্ধু বলল চলেন হুজুর আমারা পৌঁছে গেছি আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে ; রোমান আমলের এক বিশাল সমুদ্র বন্দর এই শহর টি ছিল ; আজ যা আছে তার অর্ধেক ই পুরাকীর্তি এবং পুনঃখনন করতঃ আবিষ্কৃত নমুনা সমূহ ; এইডরিআটিক সমুদ্র থেকে নদী দিয়ে চ্যানেল এর মত করে এই বন্দরে মালামাল আমদানি ও রফতানি করত সেই আজ থেকে ২৩০০ - ২৪০০ বছর আগে । একটা চালু রোমান ক্যাথলিক গির্জা আছে এখানে এখনও - বিশাল একটা বেল টাওয়ার এখনোও প্রতি ঘণ্টার আগমনী শুনিয়ে দেয় বিশাল ঘণ্টার আওায়াজে । পাশেই একটা জাদুঘর চোখ জুড়ানো সব সমাহার সেই দুই - থেকে তিন হাজার বছর পুরানো সব প্রত্নতাত্তকিক সম্ভার দেখার মত, সেই ২ হাজার বছর পুরানা মোজাইক - ভাবতে আশ্চর্য লাগে ; সহস্র বছর পুরানো পুরাকীর্তির সমাহার দেখতে যেয়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা পাড় করে দিলাম তা ভাবতেই পারি নাই ।
- সেই ঐ আমলের হাড়ি বাসন, বিভিন্ন ধরনের মূর্তি, অস্ত্র সস্র, কারুকার্য খচিত আসবাব পত্র, বাক্স পেরটা, রাজবংসের নিদর্শন সমূহ ; চোখ ধাদানো সব সংগ্রহ । হেঁটে চলে গেলাম সেই নদীর পারে ।
- মনের অজান্তে ঐ শুকনো নদীটির পাড়ে বসে ভাবতে লাগলাম - একদা এটা ছিল প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান বন্দর - কি জানি ? এই বন্দর দিয়েই হয়ত সেই ২৪ - ৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা থেকে খাদি আর খদ্দর কাপড়ের থান গুলো আসতো কি ? প্লটমি এর বইতে অনেক বছর আগে এটা পড়েছিলাম আর খুবই গর্ব বোধ করেছিলাম যে, ঐ আমলে আজ থেকে ২০০০ বছর আগে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা বাংলায় উৎপাদিত খাদি কাপড় রোমের সিনেটের সিনেটর এবং তাঁদের অর্ধাঙ্গিনী ও তাঁদের রাজপ্রাসাদের রক্ষিতা পরিধান করতো । এবং কেন ঐ অপরিচিত বাংলায় কেন এত স্বর্ণমুদ্রা প্রেরণ করা হয় তা নিয়ে রোমের সিনেটে অনেক বাক বিতণ্ডা হতো তা ও পড়েছিলাম - তখন রোমের সম্রাট ছিল - কুখ্যাত নিড়ো সম্রাটের পালক পিতা অগাস্থাস । ভাবতেই আনন্দে আর গর্বে বুক টা উঁচু হয়ে গেলো - দুই ই দুই ও মিলানোর চেষ্টা করলাম কারন - আকিলা থেকে ভেনিস বেশী দুরে না - কারণ মার্কও পলো তার ভ্রমণের বইতেও লিখেছে যে সে, দামাস্কাস এবং রোম ও ভেনিসে ও ঐ সময় ( ১৩ শতাব্দী) বাংলার বানানো মসলিন কাপড় এসব জায়গায় বেচা কেনা হতে দেখেছে ।
রোমান দের মনস্তত্ত্ব নিয়ে অনেক ক্ষণ ভাবলাম - ওরা যে কি বিশাল একেক জন চিন্তাবিদ ছিল তা আমরা ২০০০ বছর পরেও ঠিক মত বুঝে উঠতে পারছিনা ; ওদের প্রকৌশলী এবং ওদের সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে গেলে মাথা তা কেন জানি ভো ভো করে ঘুরতে থাকে ; এত বড় বিশাল বিশাল খাল কেটে প্রধান সমুদ্র থেকে চ্যানেল করে ফ্রেস ওয়াটার পোর্ট বানানো - সব পাল তোলা জাহাজ গুলোকে নিরাপদ স্থানে এনে মাল উঠানো আর নামানো শান্তি মতে কড়া এবং সঙ্গে সঙ্গে অন্যত্র প্রেরন করে দেওয়া - পোর্টের আসে পাশে গুদাম গুলো বানানো - মদ এবং অন্যান্য সামগ্রী যাতে নষ্ট তার জন্য তাপ নিয়ন্ত্রণ করা গুদাম । বিশাল সোজা রাস্তা বানানো সেই আক্যিলা থেকে সুদূর রোম পর্যন্ত - এক বিশাল ব্যাপার । সমুদ্রের বিশাল ঢেউ এ যাতে করে পালতোলা নৌকা জাতীয় কাঠের বানানো গুলো আছড়ে আছড়ে ভেঙ্গে না যায় তাই মনে হয় রোমানরা খাল কেটে এই কর্ণফুলী নদিতে যেমন চিটাগাং বন্দর কম ঢেঊ ওয়ালা নদিতে বানিয়েছে ওরকম এটা - কি জানি পর্তুগিজ রা চিটাগাং বন্দর বানানোর ধারনাটা হয়ত রোমান দের কাছ থেকেই নিয়েছি কিনা কে জানে । বন্দরে নদীর পাশ পাড় ঘেঁষে লাগান অলিভ গাছ আর পরিতাক্ত জাহাজের কাঠ আর ডিজাইন দেখতে লাগলাম নয়ন ভড়ে।
দুপুরে একটা কাফে’ তে ঢুঁকে বাফোলো পিজ্জা সাথে গারলিক ব্রেড, একটা বিশাল গ্লাসে পরিবেশিত আইরান দই ড্রিঙ্ক যা নাকি আমাদের কুমিল্লার জগত বাজারে সকালে বিক্রিত মাঠা র মত স্বাদে অনেকটা । ভরপুট খেয়ে চেপে বসলাম বাঁশে ট্রিএসট যাবার ফেরি ধরতে ; কি সুন্দর বাস - ঠাণ্ডা, নেই কোন কোলাহল, নেই বাসের কোনও বাসের কন্ডাক্টার আওয়াজ বা বাসের গাঁয়ে ঘন ঘন থাপ্পড় মারার বিকট শব্দ ; ড্রাইভার কে তো দেখলে মনে হবে যেন অফিস ফেরত কোন বড় কর্মকর্তা ; আপন মনে গান গাচ্ছে আরে অটোমেটিক বাস তা দিব্বি আরামেই চালিয়ে যাচ্ছে - বিশাল ৪ লেনের মোটর ওয়ে । ভিড় নাই তেমন , বাম হাত চালিত ; আমাদের মত ডান হাত চালিত নয়। ফেরির কাছের শহর এ গাড়ি পারকিং পাওয়া বড়ই কঠিন তাই আক্যিলার নিকট এর বড় ট্রেন স্টেশনে গাড়ি রেখে বাসে চরলাম আমরা দুজন।
ত্রিশ পঁয়ত্রিশ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে - সমুদ্র সৈকত শহর গ্রাডো তে ; নেমেই বাস স্টপের পিছন দিকেই শহর ঢুঁকে পরলাম। আই ফোনে তাকিয়ে দেখি ৩৮ ডিগ্রি গরম - দুস্তর মত ঘামতে লাগলাম । আমাদের লন্ডনে সচরাচর ইন্দে চান্দে ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রা পৌঁছায় ক্বচিৎ । টাউন সেন্টার দিয়ে হেঁটেই পৌঁছে গেলাম সমুদ্র তীরে - ও মা গো, তটে আমার চক্ষু চড়ক গাছে , সমুদ্রের পাড়ে নগ্নপ্রায়, অর্ধ নগ্ন আবাল বৃদ্ধ বনিতা বালক বালিকা , কিশোর এবং শিশু মিলিয়ে শুয়ে শুয়ে রৌদ্র স্নানে মগ্ন কম করে হলেও এক ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার মানুষ । তিল ধারণের জায়গা নাই - কেউ সাঁতার কাটছে, কেই শামুক কুরাচ্ছে, কেই ওয়াটার স্কি মটর স্কুটার চাল্লাছে, কেই গ্লাইডিং করছে, আবার কেই কেউ ছোট্ট ডিঙ্গি বিয়ে বেয়ে চলে যাচ্ছে তীর থেকে বেশ মাইল খানেক গভীর সমুদ্রের দিকে আর বাকিরা চিৎপটাং হয়ে বা উব্বুত হয়ে শুয়ে শুয়ে শরীর কে রোদ খাওয়াচ্ছে সাদা গাঁয়ের চামড়া কে রোডের আগুণের মত গরম তাপে পুড়িয়ে তামাটে চামড়া করার জন্য - যখন সারা ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশ এর মানুষ রা গাঁয়ের রং ফরসা করার জন্য পাগল তখন ওর চাচ্ছে গাঁয়ের তামাটে রঙের মত করে একটু আমাদের মত গাঁয়ের কড়ারা প্রয়াসে ব্যাস্ত ; আজব একটা জগত এটা ; একটা বেঞ্চি তে বসে বসে একটা ভ্যানিলা আইস ক্রিম খেয়ে একটু ঠাণ্ডা হতে চেষ্টা করলাম ।
গ্রাডো শহর থেকে ফেরি তে করে ২৫ মিনিট - ৩৫ মিনিট এ পৌছা যায় - ট্রিএস্ট শহরে - একে বারে ক্রোয়েশিয়া দেশের পাদদেশে । বেশ জায়গা হেঁটে এসে পৌঁছে গেলাম ফেরি ঘাটে । বিরাট এক লম্বা লাইন ; প্রচণ্ড গরম ; দুস্তর মত সিলেটের পুরানা রং মহল সিনেমা হলে বসে সিনেমা দেখার সময় যে রকম ভ্যাপসা এক ধরনের গরম - আইফোন এ দেখলাম ৩৯.৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা ; ঘাড়ের উপর থেকে হাভ্যারস্যাক টা নামিয়ে আরেকটা নতুন পানির বোতল বের করে পানি পান করতে লাগলাম - কড়কড়া রোদ.......
গ্রাডো শহর টা আসলেই একটা অপূর্ব শহর একপাশে সমুদ্র সৈকত এ কোলাহল এবং ব্যাস্ততা আর জাহাজ ঘাটের পাশের এলাকা টা একদম চুপচাপ । লাইন লাইন সাড়ি সাড়ি বাড়ি গুলো একটার গা ঘেঁষে আরেকটা বাড়ি দুই টা বাড়ির একটা কমন ওয়াল ; বাংলাদেশের শহরের মেস জাতীয় টেরাস এর মত । দেখেই বুঝা যায় ১৭স খ্রিস্টাব্দে কিংবা তারও আগে এই বাড়ি গুলো বানানো কোনটা
সাদা রং করা, কোনটা নীল, বাড়ির রং গোলাপি আবার কোনটা কালো, দরজার সামনে ঢুকার প্যাসেজে তিমি মাছের মূর্তি, কোন কোন বাড়ির সামনে মৎস্য কন্যার মূর্তি, বাড়ি গুলোর নাম গুলোও বেশ সুন্দর পেস্কাটাউরে ( জেলে দের ) হাউস, বারকা ঘর ( নৌকা ), পেইসে ( মাছ), আরও অনেক মৎস্যজীবী জাতীয় নাম ওদের বাসা গুলোর । সব খালি প্রায় সবাই ই চলে গেছে গ্রীষ্ম কালীন হলিডে করতে - প্রসঙ্গ ক্রমে বলতে হয় এই যে , ১৫ ই অগাস্ট ইতালির সবচে বড় আউটিং করার দিন, ঐ দিন কেই ই ঘরে থাকে না - বার বি কিউ, সাইকেল চড়ে গুড়ে বেড়ানো, আল্পাইন পর্বত এ উটা , কিংবা স্পিড বোটে করে ওয়াটার স্কি করা, বা এক শহর থেকে আরেক শহরে চল্লিশ বা তারও অধিক মাইল হেঁটে হেঁটে ভ্রমণ করার জন্য বেরিয়ে পরা ওদের রেওয়াজ । অনেক গুলো বাড়ির সাড়ি পের হয়ে গুগল ম্যাপ ধরে ধরে লঞ্চ ঘাটে এসে পৌঁছলাম ; মনে পরে গেল সেই গোয়ালন্দ ঘাট এর স্মৃতি, মনে পরে গেল ছোট বেলা মায়ের সাথে ছুটি কাটাতে আসতাম মামার বাড়িতে খুলনা থেকে প্যাডেল স্টিমারে করে আস্তে হত নারায়ণগঞ্জে - তৎকালীন সময়ে নারায়ণগঞ্জে লঞ্চ ঘাটে ইয়েলো ট্যাক্সি পাওয়া যেত, আর ঐ ট্যাক্সি তে করে আসতাম নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা আজিমপুর কলোনিতে ; সারা রাস্তা তখন থাকত নিয়ন বাতির আলোয় প্রজ্বলিত - পিছনের সিটের জানালা দিয়ে মাথা উঁচু করে সাইনবোর্ড গুলো পড়তাম - নিওন সাইন গুলোর উজ্জ্বল আলো গুলো আজও আমাকে সেই আগের মতই উদ্বেলিত করে - কিন্তু ইতালির লঞ্চ ঘাট অন্য রকম, এখানের স্টিমার বা লঞ্চ ঘাটে কেবল দেখতে পেলাম গতি, চাঞ্চল্য ও বেগ কিন্তু দেখতে বা উপলব্ধি করতে পারলাম না কোন আবেগ ! সেই ছোট বেলায় বানী চিরন্তনী বইতে পড়েছিলাম, আধুনিক সভ্যতা দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ - এখানে এসে তা বোধগম্য হলো হাড়েহাড়ে। জাহাজ ঘাটে প্রায় ১০০ মানুষ নীরবে নিশ্তব্দ ভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে পরবর্তী জাহাজ কখন ভিড়বে - সবাই উঠে চড়ে বসবে জাহাজে । কারোর সাথে কারোর কোন কোথা নাই , নীরব সবাই, স্যুটকেস, রাক্সাক, বাচ্চাদের প্রাম, দড়ি বাধা বাচ্চা কাচ্চা যাতে দৌড়ে যেয়ে কোথাও পড়ে না যায় , বা কোন এক্সিডেন্ট আবার ঘটিয়ে বসে, আস্থে আস্তে দেখতে পেলাম একটা কেটামেরান - এক ধরনের জাহাজের পাদদেশ (হাল) - যা কিনা সহজেই পানি কেটে এগিয়ে যেতে পারে অন্যান্য বোটের ডেকের ( তলদেশ) মত এটা সম্পূর্ণ পানি স্পর্শ করে না - এই জাতীয় হাল (পাদদেশ) ওরা নকল করেছে আমাদেরই পূর্ব পুরুষ দ্রাভিদিয়ান তামিল দের কাছ থেকে ; এন্থ্রপোলোজী এর মতে আমরা বাঙ্গালিরা এরিয়ান ( পারশ্য থেকে উত্তর ভারত হয়ে এসেছিল বাংলায় ) এবং বে অফ বেঙ্গল এঁর দক্ষিণ প্রান্ত থেকে নৌকা বা জাহাজে এসেছিল দ্রাভিদিয়ান - তামিল রা এবং এদের সংমিশ্রণের ফসল ই আমাদের ডি এন এ তে প্রাবাহিত ক্রোমোজম -তা তে একটু হলেও আনন্দিত হলাম যাক সুদূর ইতালিতে এ এরা আমার পূর্বসূরিদের আবিষ্কৃত জাহাজের ডিজাইন ব্যবহার করছে । হয়ত বা তামিল দের লেগাছি আমরা এখনো বহন করছি আমাদের ভাসায় - যেমন; আম্মা ( একটি তামিল শব্দ ), আব্বা ( ওরা বলে আপ্পা), যেমন আমরা এবং ওরা বলি লুঙ্গি কে লুঙ্গি, ওরা বলে নদিতে কে নতি আর আমরা বলি নদী , ওরা বলে চুরুট আমারও বলি চুরুট, ওরাও আমাদের মত বলে নক্ষত্র কে নক্ষত্র, ওরা চাউল কে বলে ওদানা আমরা ও বলি দানা । এই সব কি সব অসংলগ্ন অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে পাড়ে ভিড়ল তরী - মনে পড়ল, মা এঁর আবৃতি করে কয়েকটা পংতি ,’’ ঠাই নেই , ঠাই নেই ছোট এ তরী আমারি সোনার ধানে গিয়াছে ভরি ।’’
ভিড় ক্রমশ কমে যাওয়ার পর উঠলাম জাহাজে - জীবনেও কোন ব্যাপারে তাড়া ছিল না আর আজো নাই তেমনটা ; উঠে প্রথমে ডেকের ভিতর ছায়ায় বসলাম ; রোঁদের তাণ্ডবটা ঠেকে বাঁচার জন্য । বসেই দুটো ঠাণ্ডা পানীয় এবং দুটো শ্যালমণ মাছের পেটী দিয়ে বানানো স্যআন্ডুউূইচ অর্ডার করলাম অপেক্ষা করতে করতে পেতে জানি কেমন ক্ষুদা লাগতে লাগল - অন্য সময় হলে হয়ত কখনই এভাবে খেতাম না - শরীরের ওজন এবং বয়স অনুযায়ী রক্ত চাপ, বহুমূত্র জাতীয় অসুখ বিশুখ থেকে দূরে থাকার একমাত্র উপায়ই হল খাওয়ার লোভ এবং অহরহ যেখানে সেখানে যা পেলাম তা না খাওয়া । আর ভাবলাম এই অবকাশ( হলিডে ) থেকে যেয়ে কয়দিন বেশ কয়েক বেশি করে হাঁটবো তা হলেই সব আবার জায়গা মত চলে আসবে । মানুষের সব সমস্যার সমাধান কেবল সেই করতে পাড়ে ; সেলফ হেল্প হল সবচে বড় হেল্প ।
ইতিমধ্যে ঠাণ্ডা পানিও এবং টাটকা ধরা মাছের স্যআন্ডুউূইচ এসে গেল - বেশ রিলাক্স করেই বসে বসে খেলাম আর দূর এ দেখতে পেলাম গ্রাডো শহর ফেলে চলে যাচ্ছি দূরে বহু দূরে , প্রচণ্ড দ্রুত গতি সম্পন্ন এই জাহাজ খানা - একটা লোওার ডেক আর উপড়ে খোলা আকাশের নিচে খোলা বসার চেয়ার । প্রায় ৬০ - ৭০ জন যাত্রী আর সাইকেল হবে ত্রিশ টা । লোওার ডেকের সামনেই ছোট একটা বো এরিয়া ওখানে বেশ দুটো বেঞ্চ এ বসার জায়গা ; ফ্রেডি বলল চলেন সামনে গিয়ে বসি - খাওয়া শেষ করে স্টারবোর্ড সাইডে যেয়ে একটু ফার ব্যাঙ্ক তা অবলোকন করলাম - জাহাজে দুই টা সাইড থাকে একটা হল পোর্টসাইড যেটা ছেড়ে আসা পোর্টের সাইড আর একটা হল স্টারবোর্ড সাইড যেটা আগেরটার বিপরীত সাইড - দূরের সমুদ্র দেখার সাইড ।
অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ধাবমান এই কাটাম্যারান - সমুদ্রের বুকে মসৃণ পানি ভাটির সময় পোর্টে দেখেছিলাম জোওার আসার কথা বেলা বিকাল ৫ টা ত্রিশ এর পর। দূরে এক চিলতে মিষ্টি কুমড়ার ফালির মত একটা ফালি তুল্য অংস টুকু ইতালির সীমানার ভিতর কলসির বা বোতলের গলার মত ঢুকে বাসে আছে ক্রোইয়েশিয়া - ঠিক আমাদের দেশের যেমন আছে শিলিগুড়ি করিডোর ঠিক তেমনি । জাহাজ টা ঐ দিকেই ধাবিত হছে - শিপের বো তে গিয়ে ঐখান থেকেই আইফোনএ একটা তিন চার মিনিটের ফেছবুক লাইভ দিলাম - আমার স্যোসাল মিডিয়ার ৪০০০ বন্ধু এবং ৩০০০ হাজার ফলোয়ার দের জানিয়ে দিলাম আমি কোথায়, কি করছি, কোন দেশে , কোন সাগরের উপর দিয়ে ধাবিত হচ্ছে আমার এই সোনার তরি ...... !
Comments
Post a Comment