কিভাবে বিলাত জয় করলো সিলেটের অভিবাসীরা
সিলেটের জয়গাথা - বিলাতে
ভারত উপমহাদেশের ছোট্ট একখণ্ড ভূমি পদ্মা ব্রহ্মপুত্র নদ নদীর সমন্বয়ে গড়ে উঠা একটা ব দ্বীপ ''বাংলা'' তার নাম - ২৫০টির ও অধিক নদী এবং ১ হাজারের ও বেশি মোহনা নিয়ে এই বাংলা গঠিত - সারা দুনিয়ার মধ্যে সবচে' বড় ''ব দ্বীপ’' আমাদের এই দেশ । এই ভূমিতেই বসবাস করে পৃথিবীর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম জাতিগত জনগোষ্ঠী বাঙ্গালি জনগোষ্ঠী । হান জাতিগোষ্ঠী (চাইনিজ ) এবং আরব জাতিগোষ্ঠীর পর পৃথিবীর কোথাও এত বড় এথনিক গ্রুপ আর নাই ।
বাংলার জনগণ আর ব্রিটিশদের সম্পর্ক সেই ষোড়শ শ শতাব্দী থেকে - ভারতীয় ব্রিটিশ কলোনির গোড়াপত্তন ঐতিহাসিক ভাবে হয়েছিল বাংলা থেকেই সেই ১৭৫৭ সালের বর্ষাকালে পলাশীর আম্র কাননে । তারও ১ শ থেকে দেড় শ বছর আগে ব্রিটিশ বনিক রা মসলিন - পাঁট - মসল্লা - ধনিয়া - ডাল - চাল - আপিম- নীল - গাঁজা - খদ্দর কাপড় এর রফতানির কাজে লিপ্ত ছিল বাংলায় ।
১৭৫৭ সাল এ এসে ওদের উপনিবেশিকতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করে কেবল । তারপর থেকে শুরু হয় বাংলা ও ব্রিটিশ সম্পর্ক - যা আজও অটুট দৃঢ় এবং ভঙ্গুর নয় ।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন ছিল পৃথিবীর অন্যতম বিশাল প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি - লন্ডন ষ্টক এক্সচেঞ্জ এ নিবন্ধিত । শেয়ার বাজারে তার শেয়ার খুবই চড়া দামে লেনদেন হতো ঐ আমলেই - এই ছোট্ট কোম্পানিটা তখন শাসন করতো প্রায় ৭৫% ভাগ মুঘল সাম্রাজ্যকে । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এতই বিশাল এবং এতই ছিল তার প্রতিপত্তি যে , ১৭ শ শতাব্দীতে স্বয়ং ব্রিটিশ সরকার কে সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পাউন্ড ধার দিত। যার জন্যই মনে হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কে দাপ্তরিক ভাবে ডাকা হত ‘' অনারেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি , আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এত টাকার প্রধান উৎস ছিল তখনকার বেঙ্গল - গোল্ডেন বেঙ্গল - সুজলা, সুফলা অতি পরিচিত বেঙ্গল । ১৬ শ শতকে বাংলা ছিল জগতের অন্যতম ধনী এবং শিল্পশালী দেশ । প্লটমির বইতে আরও প্রমাণ পাওয়া যায় যে ২৪ খ্রিস্টাব্দে বাঙ্গাল তাতে বোনা খদ্দর এবং খাদি কাপড় রোম এর সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞীরা পরিধান করতো।
নদ এবং নদীতে সরীসৃপের মত আকা বাঁকা সেই বাংলার ভারী মালামাল বহনের একমাত্র বাহন ছিল নদীপথে নৌকা - বজরা এবং পাল তোলা ছোট জাহাজ - খরস্রোতা নদীগুলোতে উজানে পাল তোলা নৌকা আর গুণ টেনে সরবরাহ পৌঁছান সম্ভব ছিল না - তখনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চালু করতে লাগল বেঙ্গেলের জাহাজ বানানো শিল্প , বাংলার তৎকালীন যানবাহন এবং মালামাল বহনের বাবস্থা কে উন্নত করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবদান অনস্বীকার্য । এগুলো সবই হয়েছে ১৭৫৭ এবং ১৮৬০ সালের আগে - সিলেট ইস্ট কোম্পানির অধীনে আসে ১৭৭৫ সালের দিকে । ১৮৩৫ সালে ওরা দখল করে জৈনতা - খাসিয়া দের কে পরাজিত করে । কর্নেল লিস্টার নামক এক ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আর্মির অধিনায়ক সিলেট দখল করে ১৫ ই মে ১৮৩৫ সালে আর তার পর থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত সিলেট ব্রিটিশ দেড় করায়ত্ত ছিল ।
ব্রিটিশ পতাকাবাহী নদী মাত্রিক জাহাজ গুলো বানানো হতো তখন ইংল্যান্ডের পাইন আর ওক কাঠ দিয়ে - যেগুলোর আয়ুকাল ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত কারণ পৃথিবীর সবচে বড় বে - বে অফ বেঙ্গলের নোনা পানিতে ঐ সব বিদেশী কাঠের বানানো জাহাজ বেশী দিন অতটা লাবণ্য সহ্য করতে পারত না - অনেক ভেবে চিনতে ব্রিটিশরা বাংলার মেহগনি এবং আসামের /বার্মা আর পার্বত্য চট্টগ্রামের সেগুণ ( টিক) দিয়ে বানানো শুরু করলো নদী এবং সমুদ্রগামী কাঠের পাল তোলা নৌকা এবং জাহাজ - মেহগনি এবং টিক এর বানানো জাহাজের আয়ু কাল ব্রিটিশ কাঠের চাইতে কম করে হলেও ১২ থেকে ১৫ বছর বেশি হতে লাগল ।
ঐতিহাসিক ঐ সব পাল তোলা নৌকা এবং সমুদ্র গামী জাহাজ গুলো চাঁদপুর - ভৈরব - সিলেট - করিমগঞ্জ হয়ে মেঘনা - সুরমা - কুশিয়ারা - বড়াক নদী তে উজান বেয়ে পৌঁছে যেত বর্তমান আসামের শিলচর এ । চাঁদপুরে এসে কোন কোন জাহাজ চলে যেত বার্মার রেঙ্গুনে আর বাকিগুল চলে যেত কলকাতার হুগলী বন্দরে । নিত্য আসা যাওয়ার নদীপথ ।
১৮১২ সালে বাংলায় নির্মিত ''বেঙ্গল মার্চেন্ট'' জাহাজ ১৮২৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ পতাকা মাথায় নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেরিয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে - সাগরে - নোঙ্গর গেড়েছে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি হারবারে, নিউ জিল্যান্ড এর ওয়েলিংটন, অকল্যান্ডএ , ক্রাইস্টচার্চ বন্দরে, লন্ডন, লা হারভে হয়ে ১৮২৭ সালে শেষ বারের মত নঙ্গর গেড়েছিল স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো পোর্টে ।
দিনে দিনে সিলেট শহরের পাশেই গড়ে উঠল নদী বন্দর - উজানে যাবার আগে সবচে বড় শহর - এভাবেই সকলের অজান্তে সিলেট এলাকার হাঁটে, ঘাটে, হাওড়ের বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা, যুবকরা সন্তর্পণে চাকরী নিতে থাকে ওইসব জাহাজে আর বিশাল বিশাল নৌকায় - সিলেট - সিলচর - চাঁদপুর রুটের জাহাজ গুলোতে ।
এক বন্দর থেকে আরেক বন্দর এ - সিলেট শহরে বন্দর নামের সেই বিশাল নদীবন্দর, চালের জন্য চালিবন্দর আজও বিদ্দমান - দাঁড়িয়ে আছে আজও কালের সাক্ষী হয়ে - নীরবে বহন করে যাচ্ছে ইতিহাসের ঐতিহ্যকে বুকে নিয়ে । সিলেট শহরের চাঁদনিঘাট নদী বন্দর টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রিত্তিমপাশার নবাব রা । ইংরেজ দেড় জাহাজ উঠানামা এবং বারথিং কড়া থেকে যাবতীয় কর্মকাণ্ড ওখানেই করতো উজান এ যাবার আগে । প্রসঙ্গত বলা উচিত যে ১৮৬৯ সালের ভূমিকম্পের আগে বাড়াক নদী দ্বিবিভক্ত হয়ে সুরমা এবং কুশিয়ারাতে রুপান্তারিত হয়েছি কিনা তা প্রমাণ করা বেশ কষ্টকর ; কিন্তু
১৮৯৭ এর বিশাল ভূমিকম্প - সম্পূর্ণ সিলেট শহরের ৯৫% বাড়ি - দালান - কোঠা - মাটির ঘর ধূলিসাৎ -পর পর দুটি ভয়ানক ভূমিকম্পের ফলে শুরু হল জরিপ - ব্রিটিশরা অত্র এলাকার ভূমি কম্পের কারণ ভূতাত্ত্বিক জরিপ করে উন্মোচন করলো ডাউকি ফলট্ট নামের এই জায়গায় একটা ভূমিকম্প হওয়ার তথ্য এক ভূকম্পীয় জরিপের ফলাফল আবিষ্কার করলো - নাম দিল ঐ টাকে ডাউকি ফলট হিশেবে । ইতিমধ্যে সিলেট ক্রমাগত ওদের কাছে ইম্পরট্যান্ট হয়ে গেলো অনেক বেশি । এই সিলেটেই ব্রিটিশ তৎকালীন চায়না থেকে আনা চায়ের প্রথম চা গাছ রোপণ করার চিন্তা করলো ; মালনিছরা তেই উপমহাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান শুরু করলো ১৮৫৭ সালে ।
কিন্তু ভূমিকম্পের ভয় এবং ওদের এত বড় পুঁজি বিনিয়োগ যাতে লোকসানে পরিণত না হয় - তাই তৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা রা এবং সিলেট বা আসাম অত্র অঞ্চলের অভিজাত পরিবার গুলোর সদস্য রা , রাজ মিস্ত্রি, কাঠ মিস্তিরিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বানানো শুরু হল হাল্কা ওজনের ঘরের বেড়া যা নাকি ভূকম্পনে কম জান , মাল এর ক্ষতি সাধন করবে , - সেই বেটনের ঘর - বাড়ি - অর্ধেক বেড়া হাল্কা এবং পলেস্তারা কড়া এবং বাকিটা কাঠের ফ্রেমের সাথে চার কোনায় বড় বড় কাঠের খুঁটি ও উপড়ে হালকা ওজন সমৃদ্ধ চাল । অনেক টা ব্রিটেনের টিউডর আমলের ঘরের ডিজাইন অনুকরণ করে । ওদের জরিপ বলল যে এই এলাকায় ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা অনেক - যাতে করে ডাউকি ফলট্ট এর কারণে আর কোন ভূমিকম্প ভবিষ্যতে অন্য কোন বড় ধরনের জান মালের ক্ষতি না করতে পাড়ে - এই ভেবেই আসাম - শিলং - সিলচর - করিমগঞ্জ ও সিলেটীই - বর্তমান শতাব্দীর প্রথম এ ও দেখা যেত ঐ সব বাড়ি শোভা বৃদ্ধি করে রেখেছে অত্র অঞ্চল কে এক ভিন্ন রূপে - যা কিনা বাংলার আর কোন অঞ্চলে বিদ্দমান নয় মোটেও। আর সঙ্গে সঙ্গে সিলেট এর উৎপাদিত চা নৌকায় - জাহাজে করে চলে যেতে লাগল সিলেট - চাঁদপুর - চট্টগ্রাম - রেঙ্গুন - কলকাতা - লন্ডনে । ক্রমে ক্রমে সুরমা - কুশিয়ারা - মনু নদীর উপত্যকায় সিলেট - তামাবিল -জুরি - বড়লেখা - ছোটলেখা - লাতু - কুমারশিল - করিমগঞ্জ - শায়েস্তগঞ্জ - বাল্লা - সাতগাঁ - রশিদপুর - চাতলাপুঞ্জি - মৌলোভিবাজার হয়ে শ্রীমঙ্গল থেকে সেই তেলিয়াপারা পর্যন্ত গড়ে উঠল কয়েক শত চা বাগান প্রায় ৩ লক্ষ একর অর্থাৎ ৪৭০ বর্গ মাইল জায়গা বিস্তৃত চা বাগান । চা বাগান শিল্প সিলেটের জন্য তেমন কোন সুফল বয়ে এনেছে কিনা সেটা মনে এখন আমাদের ভাববার দরকার আছে । চা শিল্প কি অবদান রেখেছে বা কি রাখে নাই সিলেটে সেটা নিয়ে লিখব অন্যদিন । তবে চা শিল্প দেয় নাই কোন কিছুই সিলেট বা সিলেটের জনগণ কে গত ১৬০ বছর যাবত - পুরাটাই একটা মরীচিকার বা শুভঙ্করের ফাকি বৈ আর কিছুই নয় । সিলেট পরিণত হল বিদেশীদের এক পর্যটন এবং পুঁজি বিনিয়োগের তীর্থস্তান এ - বিশ্ব বিখ্যাত স' অয়ালেস , জেমস ফিনলে, ডানকান ব্রাদারস এর মত বহুজাতিক কোম্পানিরা চা বাগান এ অর্থ লগ্নি করতে শুরু করলো ।আরও করতে লাগল উত্তর ভারতের বেনিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা, রবি ঠাকুরের পরিবার ও প্রচুর বিনিয়োগ করেছিল এবং সিলেটের অনেক অভিজাত পরিবার এবং প্রিত্তিমপাশার নবাব রা পিছিয়ে থাকলেন না এই পুঁজি বিনিয়োগে - ওরাও গড়ে তুললো তাঁদের নিজের চা বাগান - রুঙ্গিছেরা টি এস্টেট ছিল নবাব দেড় । চা রফতানি নিয়ে এলো শত শত নতুন জাহাজ সিলেটের বিভিন্ন বন্দরে নোঙ্গর করে অপেক্ষা করতে লাগল চাএর পেটি গুলো নিয়ে চলে যেতে গন্তব্যে - এই জাহাজ গুলোর বিভিন্ন পদে নিয়োগ করলে লাগলো তারা সিলটের বেকার শিক্ষিত- অর্ধ শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত যুবক সম্প্রদায়কে । সবার অবগতির জানানো অত্যাবশ্যক যে আসাম - ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে চালু হয় ১৯০৬ সালের পড়ে - আজ মনে পড়ে কোন একটা ট্রেন স্টেশন এ পরেছিলাম যে ঐ রেলওয়ে স্টেশন টা ১৯০৬ সালে চালু হয়েছিল - জুরি কিংবা লাতু (শাবাজপুর) এ মনে হয় সেই ১৯৬৯ সালে দেখেছিলাম । এভাবেই আস্তে আস্তে পাল তোলা জাহাজ থেকে জেমস ওয়াট সাহেবের বানানো স্টিম ইঞ্জিন চালিত জাহাজ স্বয়ংক্রিয় মেশিন চালিত জাহাজে পরিণত হয়ে সিলেটের উজান থেকে বয়ে আনতে লাগলো চা - কাঠ - পাথর এবং খনিজ পদার্থ । নিয়োগ পেতে থাকলো শত শত সারেং, বৈঠা ওয়ালা , খালাসি এবং লস্কর রা । শুনতে কটু লাগলেও বলতে বাধ্য হলাম, অনুগ্রহ করে ক্ষমা করবেন পাঠক রা - ওরা আমাদের ঐ সব জাহাজি কর্মীদেড় কে কাগজে কলমে ডাকা হত ‘' ডঙ্কী ম্যান ‘' ( বাংলা অর্থ নাই বা বললাম ) (সূত্র শিপিং কোম্পানির দস্তাবেজ ) ।
ভাগ্য অন্বেষণ এবং সুন্দর জীবন ভিন্ন জনপদে আবাসন গড়ে তোলা মানব সভ্যতার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ - সিলেট অঞ্চলের সেই সব জাহাজে কর্ম রত নাবিক - সারেং - রশি বাহক - নোঙ্গরম্যান - বাবুর্চি - পালের মাস্তুলের উপড়ে উঠে যে ওয়াচ করতো আবহাওয়া এবং পাড়ের বাতিঘরের আলোর নির্দেশনা - স্টিম ইঞ্জিন চালু হওয়ার পর বয়লারে অনবরত কয়লা বেলচা মেরে মেরে ছুঁড়ে মারার কাজে নিয়োজিত খালাসি বা কূলি বা লস্কর রা ও এর বাতিক্রম ছিল না । ওড়াই সম্বভত প্রথম সিলেটী যারা প্রথম পদার্পণ করতে শুরু করলো ভিনদেশের মাটিতে ; সিলেটের রাষ্ট্রদূত হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলো - পুরাতন সিল্ক রুটের নতুন যানবাহন - জাহাজের জাহাজি হিশেবে ।
ঐ সব লস্কররা এক বন্দর থেকে অন্য বন্দর এ নোঙ্গর গাড়তে গাড়তে একদিন বিবাগীর মত বিদায় দিল তাঁদের সেই রাত দিন অক্লান্ত পরিশ্রম এর পেশা কে - চিরতরে ইস্তেফা - স্বপ্নের শহর - পৃথিবীর একমাত্র শহর নাম এরা শুনে এসেছে জন্মের পর থেকেই - এক নাম , এক দেশ,এক আশা, এক ভরসা, চোখ ধাঁধানো বিশাল বিশাল অট্টালিকা, কারুকার্য মণ্ডিত অপরুপ ভাস্কর্য, পিচঢালা পথ, পোশাকে আসাকে পরিছন্নতা, ব্যস্ত এক মহা জাতির জনপদ যেখানে পদচারণা সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের, মহা মিলন স্থল - লন্ডন - বাংলায় পরিচিত যা '' বিলাত '' হিশেবে ।
শতাব্দীর পরিচিত নাম - বংশানুক্রমে উচ্চারিত এক স্বপ্নের জায়গা, বই, পুস্তকে, গানে, জারিতে, পুঁথিতে, পালাগানে, নাটক, যাত্রায়, সংলাপে , বিচারে, কোর্ট, কাচারিতে সব খানেই শুনা এই নাম - ওখানে পদার্পণ করেই চিরতরে নোঙ্গর গেড়ে ফেললেন আমাদের সিলেটের সেই সব উচ্চাভিলাষী লস্কর পূর্ব পুরুষেরা । আজও সিলেট অঞ্চলে অনেকের ই নামের ‘’পদবি'' ( সারনেম) আছে যাদের কে বলা হয় লস্কর ।
শুরু হোল আন্দোলন, আরম্ভ হল ভারত ছাড়ো ইনকিলাব জিন্দাবাদ । এরই মধ্যে শুরু হোল প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ - ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ দি গ্রেট ফেমীণ ইন বেঙ্গল - পূরা বাংলায় সাড়ে চল্লিশ দশমিক তিন (৪.৩ মিলিওন) লক্ষ মানুষ না খেয়ে - খুদায়, অসুখে মৃত্যু বরন করেছিলো - তারপর সিলেট অঞ্চলের উপর নেমে আসলো সীমারএর খঞ্জর চেয়েও ধাঁর - দেশ বিভাগের খঞ্জর - সিলেট বিভক্ত - কারো শোবার ঘর পূর্ব পাকিস্তানে - রান্না ঘর ভারতে, গোয়াল ঘর আর গরু গুলো পূর্ব পাকিস্তানে আর তার গরু গুলো দিয়ে হাল চাষ করার যে জমি গুলো তা পড়ে গেলো নোমেন্স ল্যান্ড। বিভক্তি বিতর্কিত (ডিশপূঈটএড ) হওয়াতে জমির মালিক হাল চাষ করতে পারছিল না তাদের নিজের বাব দাদার জমিতে ।
জগদ্দল পাঁথরের বোঝা নেমে এলো জেনো অত্র অঞ্চলে - শুরু হোল রেফারএণ্ডাম - কিন্তু অত সব ঝক্কি ঝামেলার মাঝে বহাল তবীয়তে স্বাচ্ছন্দ্যে দীনাতিপাত করছিলো সেই যে একদা নোঙর গেড়েছিল লস্কর এর পরিবার গুলো ।
ইম্পেরিয়াল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে একদা সূর্য অস্ত যেত না এত বিশাল ছিল এর ব্যাপ্তি - টানা ছয় ছয়টি বছর নাৎসি জার্মানিকে পরাভূত করতে যেয়ে - ব্রিটিশ অর্থনীতি পর্যবসিত - মিল কারখানায় যুদ্ধে অনেক পুরুষ মানুষ নিহত হওয়ায় ফলে শ্রমিকের অভাব - অর্থনীতি নতজানু অবস্থা, তার উপর নতুন উটকো ঝামেলা রাশিয়ান কম্যুনিস্ট দেড় নতুন সাম্রাজ্যবাদী কোল্ড ওয়ার সব মিলিয়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা - কল কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম - ক্রমাগত ভাবে নতুন নতুন কলোনি গুলোকে স্বাধীনতা দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকলো ব্রিটেন । উপনিবেশিক করদ রাজ্য থেকে রাজস্ব আসা বন্ধ হতে থাকলো দিন দিন ।
ভারত এর স্বাধীনতা দিতে যেয়ে বিভক্ত করে দিয়ে আসলো আসলে দুইটি প্রদেশ কে ব্রিটিশরা - এক পাঞ্জাব আর অন্যটি হল বেঙ্গল - কোটি কোটি মানুষ গৃহহীন, নিজের দেশেই নিজেরাই রিফুজি, ১৫ লক্ষ মানুষকে জীবন দিতে হল এই ভারতের স্বাধীনতার জন্য যার সিংহভাগি বহন করতে হোল বেঙ্গল আর পাঞ্জাব কে ।
অনুশোচনা এবং প্রয়োজন দুটো যুগপৎ ভাবে পীড়া দিল লন্ডনের তদানীন্তন সরকার কে আর অর্থনীতিকে সচল করার প্রত্যাশায় এবং সাথে সাথে নিজেদের কৃত কর্মের দোষ কে ঢাকা বা ধামা চাপা দেবার জন্য চালু করলো বিভক্ত ঐ সব প্রদেশ থেকে জনবল আমদানি করবার নিয়ম । দু শত বছরের ক্রামগত শোষণের কারণেই মনে আমরা আজ এত গরিব - ১৬শ শতকের বিত্ত শালী ও খাদ্য এবং শিল্পে স্বয়ং সম্পূর্ণ বাংলা ১৯শ শতকে পরিণীত হল এক নিম্ন শ্রেণীর অভাবগ্রস্ত জনপদে - কি বিচিত্র এই পৃথিবীর মানুষের আচরণ ?
যাকে বাংলায় সিলেট অঞ্চলে জনশ্রুতিতে বলা হয় ভাউচার - ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার প্রদান করেছিল ওদের দেশে আসিবার জন্য ওয়ার্ক পারমিট জাতীয় এক ভাউচার - গ্রাম, গঞ্জ , শহরে , বন্দরে ও হাওড়ে হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার এর মত - লোকজন, যুবক, ছাত্র, শ্রমিক, পেশাজীবী, কৃষক সকলেই সেই সব সচ্ছল লস্কর পরিবারদের মত স্বাবলম্বী জীবন যাপনের নেশায় মেতে উঠলো স্বপ্নের শহর ও দেশ বিলাতে যাবার জন্য ।
শুরু হল স্মরণকালের সবচে' বড় এক্সুডাজ (প্রস্থান) গ্রাম - গঞ্জ - হাট - বাজার শুন্য করে দলে দলে লোকেরা পাড়ি জমাতে লাগলো বিলাতে । কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র যুবক, কিশোর,শিক্ষক , প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক সবাই এক পায়ে খাঁড়া হয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় দিনাতিপাত করতে করতে প্রহর গুনতে থাকলো - সেই স্বপ্নের দেশ বিলাতে যাওয়ার অপেক্ষায় ।
বাঙ্গালীর প্রিয় অভ্যাস - আড্ডাবাজী - গল্প প্রেমিক সারারাত পালা গান, জারি , শারি , পুঁথি, যাত্রা নাটক , হাসন রাজার গান গাওয়া - এই সব পার্থিব মোহ কে পিছনে ফেলে এক স্যাঁতসেঁতে আঁধার কালো, কনকনে ঠাণ্ডা, কালো ধুঁয়ায় আছন্ন ভোরে পদার্পণ করলো বিলাতের মাটিতে । নেই কেই পরিচিত, নেই কোন আত্মীয় বা স্বজন শুধু বগলে দাবা কড়া একটা রারাতগুলের বেতের বানানো সুইটকেস এবং উত্তর অথবা পশ্চিম পাড়ার অমুকের ছেলের মুখস্থ তমুকের নাম টা ।
না জানে এক লাইন ইংরাজি, না জানে নিয়ম কানুন, না বুঝে কথা বা ভাষা - বৈরি পরিবেশ, কনকনে শীত, সূর্য বিহীন আকাশ, ঠাণ্ডার প্রকোপে কুপোকাত, বর্ণ বৈষম্য, বিমাতা সুলভ আচরণ এবং নাক সিটকানো সমাজ বাবস্থা এসব কোন বাধাই বাধা হতে পাড়ে নাই সেই প্রথম আগত অগ্রজদের ।
নজরুলের ভাষায় বলতে হয় , ‘' কামাল তূণে কামাল কিয়া ভাই ‘' । সকল বিপত্তিকে অতিক্রম করে - এগিয়ে চলল বঙ্গ শার্দূলেরা - আর সমস্বরে গাইল - ‘'এ তুফান ভারী দিতে হবে পাড়ি কাণ্ডারি হুশিয়ার ‘' । ফ্যাক্টরি , কলে, কারখানায়, ইটের ভাটায়, ডান্ডির পাটের মিলে, ব্রাডফোরডের টেক্সটাইল মিলে, ইস্ট লন্ডনের ইহুদি অধ্যুষিত (পরোপকারী) ইহুদি মালিকানাধীন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত কাজ করে ক্রমে ক্রমে গড়ে তুলেছে আজকের সমৃদ্ধশালী সিলেট অঞ্চল কে ।
হিমালয় সম আত্ববিশ্বাস, শ্রম, নিষ্ঠা, মূল্যবোধ এবং সততা দিয়ে ব্রিটেনের ভগ্ন প্রায় হোঁচট খাওয়া অর্থনীতির চাকা কে আবারও তৈলাক্ত করে সচল করার পেছনে বাঙ্গালী অভিবাসীদের অগ্রজ দেড় ভূমিকা অনস্বীকার্য ।
সকলেই এসেছিল ভাগ্যউন্নয়নে মনে মনে ভেবেছিল - আবার যাইব ফিরে সেই বাংলার নদী, হাওরের তীরে - তখনি যখনই হয়ে যাবে একটা বেটনের বাড়ি, কয়েক বিঘা আবাদি জমি, হাল চাষ করার জন্য দুই জোড়া গরু আর ব্যাংকে কয়েক লক্ষ টাকা ।
আজ প্রায় সত্তুর বছর পর তাঁরই চতুর্থ প্রজন্ম বেনটলি বা রোলস রয়েস হাঁকিয়ে চষে বেড়াচ্ছে সম্পূর্ণ ব্রিটেন কে ; বালাম থেকে ফোরট উইলিয়াম , ল্যান্ডস এন্ড থেকে সাউথ এন্ড , ডারাম থেকে কোবাম এমন কোন শহর, সিটি বা গ্রাম নেই যেখানে সিলেটের বাঙ্গালী রা নেই ।
শহর, বন্দর , গ্রামে গঞ্জে ব্রিটেনের আনাচে কানাচে গড়ে তুলেছে এক বিশাল রেস্টুরেন্ট সাম্রাজ্য - যে ব্রিটিশরা একদা আমাদের কে চা খাওয়া শিখিয়েছিল আজ সেই ইংরেজদের কে তরকারি খাওয়া এমন ভাবে শিখিয়েছে - আজ বাঙ্গালী সেফদের রন্ধন কৃত চিকেন টিক্কা মসল্লা ব্রিটিশ জাতির জাতীয় খাবার ।
পনের থেকে বিশ হাজার বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেস্টুরেন্ট বিরাজমান করছে আজ ব্রিটেনে - ১৭০০ থেকে ২০০০ মুদিখানা দোকান , কয়েক শ পাইকারি সরবরাহকারী চেইন এবং কম করে হলেও ১০, ০০০ আরও বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত আজ সেই সিলেটের অভিবাসীদের প্রজন্ম । কি ভীষণ এক বিজয়গাঁথা ।
আজকে ব্রিটেনের বাঙ্গালী সম্প্রদায় থেকে সংসদ সদস্যের আসন অলংকৃত করছে পৃথিবীর গনতন্ত্রএর সূতিকাগার ওয়েস্ট মিন্সটার সংসদে তিন বাঙ্গালী ভদ্র মহিলা , কয়েক শ নির্বাচিত বরা পরিষদের কাউঁনসিলর, মেয়র, স্পিকার । ব্যারিস্টার, সলিসিটর , ডাক্তার শিক্ষক, জজ এর পেশায় নিয়োজিত আরও প্রচুর সংখ্যক বাঙ্গালী । আজ সেই ইম্মিগ্রানট এর পুত্র, দৌহিত্র রা ব্রিটেনের ইংলিশ ভাষাভাষী ইংরেজ ছাত্র ছাত্রীদের ইংলিশ শিক্ষা দিচ্ছে - কিভাবে যে টেবিল টা ঘুরে গেলো - ভাবতেই অবাক লাগে !
আজকের সমৃদ্ধির জয়গান গেয়ে শেষ কড়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ; কেউ কি কখনো ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিল ঐ সব অগ্রজ দেড় ছোট্ট পদক্ষেপ একদিন রুপান্তারিত হবে এক মহা লম্ফে ।
এত কিছু করে দিনের শেষে - বাঙ্গালীদের মহা মিলনের কুরুক্ষেত্র প্রসিদ্ধ ব্রিক লেনে যেয়ে এক প্লেট বিরন চালের ভাতের সাথে হাকালুকি হাওরের বোয়াল মাছের ঝোল খেয়ে পাশের পানের দোকানে ঢুকে খাসিয়া পানের এক খিলি পান আর কাঁচা সুপারি চিবাতে চিবাতে ঘরে ফিরার পথে দুরে ব্যাকগ্রাউনডে সঙ্গীতা মিউজিকএর দোকানে বেজে উঠল হাসন রাজার সেই অতি পরিচিত সকলের প্রিয় গান - ‘' লোকে বলে , বলে রে , ঘর বাড়ি বালা নয় আমার .......''
লেখক
ইমরান আহমেদ চৌধুরী
[একজন বিলাতের অভিবাসী লেখক, বক্তা এবং ঐতিহাসিক ]
Comments
Post a Comment