স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৯৭১ - ইন্ডিয়াতে শরণার্থী বালক যোদ্ধার স্মৃতিকথা - লেফটেন্যান্ট ইমরান আহমেদ চৌধুরী (অব:)
স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৯৭১
ইন্ডিয়াতে শরণার্থী
বালক যোদ্ধার
স্মৃতিকথা
লেফটেন্যান্ট ইমরান আহমেদ চৌধুরী (অব:)
স্বাধীনতা যুদ্ধ আমার জীবনের একটা সবচে’ বড় অধ্যায় - স্বাধীনতা সংগ্রাম আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে ভিন্ন ভাবে । ১৯৭১ থেকে ২০২০ সাল এই ৪৯ টি বছর যাবত বহন করে আসছি এক বিশাল গল্প, এক বিভীষিকাময় অন্নুছেদ, এক দুঃস্বপ্ন, মহা এক আতঙ্ক, এক ভয়, এক ভীতি, এক যন্ত্রণা এবং এক না বলা বিরগাথা । সেই উত্তাল দিন গুলোর কথা বার বার প্রত্যহ মনের পর্দায় ভেসে উঠে । জীবন থেকে উড়ে গেছে ঘটনাবহুল এই কয়েক টি মাস ; আপাতঃ দৃষ্টিতে যদিও মনে হবে অল্প কয়েক টা দিন কিন্তু বাস্তবতায় ঐ দিন গুলো ছিল বাঙ্গালী জাতির জীবনের তথা আমার জীবনের সবচে কঠিন সময় ; এ রকম সময় আমি চাই না অথবা আশাও করিনা আসুক আর কোন আমার বয়সী বালকের জীবনে এই পৃথিবীর কোন দেশে । জীবনের সব আশা , সব ভরসা এবং সকল মনোজ্ঞতা-সুবন্দোবস্ততা কেড়ে নিয়েছিল আমার এবং আমার পরিবারের জীবন থেকে এই মহা প্রলয় । মৃত্যুর ভয় , পশুর মত হত্যা হবার ভীতি , সর্বপরি হত্যাকারীর হাত থেকে বাঁচার জন্য পলায়ন যে কি কঠিন এক সংকল্প , এবং ওটা যে কি পরিমাণ ভয়াত্তক তা’ প্রকাশ করাও এক বিশাল কাজ । চোখের পলকে গৃহ বিহীন হয়ে যাওয়া, পরবর্তী আহারের কোন বন্দোবস্ত না থাকা, সন্ধ্যা নেমে আসার পর কোথায় রাত্রিযাপন করা হবে সেটা না জানা এর এক একটা সব গুলোই অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন । বিছিন্ন সংসার, পরিবার ; মা ও আমরা ভাইবোনরা একসাথে, পিতা কয়েকশ মাইল দূরে চাকরীস্থলে, বোন তার হোস্টেলে রাজধানীতে অধ্যয়নরত। সে যেন এক বিভীষিকাময় প্রহর । শত্রুর বিমান হামলা পর পর দুবার হওয়ার পর শহরের দুই প্রান্ত থেকে শত্রুর অনুপ্রবেশ - গগন বিদারী গোলাগুলির আওয়াজ, বিমানের ভূমিকম্প সম বিদীর্ণ ভয়ঙ্কর ভাবে অপ্রকিতস্তু হবার মত গুলিবর্ষণ ,ও বোমা বর্ষণ । দূর দিগন্তে ধেয়ে আসা শত্রুর ''ইয়া আলী''ও ''আল্লাহ হু আকবর'' হুঙ্কার এর মধ্যে আমরা ক'জন প্রাণ হাতে নিয়ে ধেবে চলছি এক অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে - আলিঙ্গন করতে করতে এগিয়ে চললাম এক অজানা ভব্যিসত কে । গৃহহীন, খাদ্যহীন, ভব্যিসত বিহীন , দিকবিহীন অর্বাচীন, নির্বুদ্ধির মত পথ এগুচ্ছিলাম আমরা । পথিমধ্যে কম করে হলেও কয়েক লক্ষ বার উচ্চারণ করেছি , ''লা ইলাহা ইল্লা আনতা …………… মিনাজ জুয়ালে মিন ‘'... কি জানি আল্লাহ আমদেরকে এই দোওার বদৌলতেই হয়ত সেদিন প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন, হয়ত বা । তা না হলে আজ পারতাম না এই সব লিখতে । ক্লান্ত, অবসন্ন, শুষ্ক শ্বাস প্রশ্বাস নালিকা ও অনাদ্র টুঁটি নিয়ে মাইল পর মাইল দৌড়ানো সঙ্গে মৃত্যুভয় যে কি এক কষ্টকর কাজ সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মত ভাষা আমার নেই । অযাচিত অথিতি, অনাগত এবং অভ্যর্থনা বিহীন ভাবে কারো পরিবারে আশ্রয় নেওয়া কি নিম্ন ধরনের কাজ তা সহজেই অনুমান করা যায়। নিত্তনৈমত্তিক ব্যাবহারিক জিনিশের অভাব, এক কাপড়, এক স্যান্ডেল, এক তোওালে(গামছা) , বিছানার অভাব, বালিশ (তুলা ছাড়া বানানো) ও তোশক বিহীন, লেপ ছাড়া ঘুমানো, অপর্যাপ্ত খাবার, খাবারের স্বাদ ভিন্ন, সারারাতদিন পর্যাপ্ত অফুরন্ত সময় । আতিথেয়তা যবনিকা টেনে অগস্থযাত্রা, সে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা , এক এক্সুডাস, এক বিশাল পথযাত্রা , পায়ে হেঁটে , বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, কাদা, পানি, নৌকা, দৌড়ে দৌড়ে, তুফান, কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডবতা, নিমিষেই তাপমাত্রা কমে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা, সাঁকোর অবাস্তব পাটাতন এবং হাত দিয়ে ধরার ব্যবস্থা বাচ্চা বা বালক, কিশোরদের নিরাপত্তা সম্পর্কে উদাসীনতার উদাহরণ । অবিরাম হেঁটে, কোন প্রকার খাবার নে খেয়েই ১৭ - ১৮ মাইল হেঁটে পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্তে পদার্পণ । সীমান্তের এক বারে গা ঘেঁষে থাকা গ্রামে অবস্থান গ্রহণ - অবিরাম কামানের গোলার আওয়াজ এই সম্পূর্ণ পথ অতিক্রম করার সময় । ঐ সীমান্তবর্তী গ্রামের পরিত্যক্ত স্কুলের ভিতর কয়েক রাত যাপন করে - এক দিন ভারতে প্রবেশ করার পর ভারতীয় এক হিন্দু পরিবারের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করা ভারতীয় বি এস এফ বাহিনীর সহায়তায় । অতঃপর রিফ্যুজি ক্যাম্পে প্রবেশ । জীবনের এক নতুন অধ্যায় । ক্যাম্পে পরিবারের একমাত্র বোয়জোস্ট পুরুষ হিসাবে সদস্য এর অর্পিত দায়িত্ব । পাশে পাশে স্বাধীনতার সংগ্রামের উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হয়ে সামাজিক এবং সমাজ কর্মী হওয়া থেকে শুরু করে ঔশুধ বিতরন, কম্পাউন্ডার হিসেবে কাজ করা । সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে ক্যাম্পে যেয়ে গান গাওয়া ওদের মনোরঞ্জন এবং মানবিক বল বাড়ানোর মাধ্যমে আরও জাগ্রত দেশ প্রেম চাঙ্গা করা । নতুন পত্রিকা জয় বাংলা বিতরণ করা । মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প সংলগ্ন দলের কম্যান্ডার এর আদেশে পাকিস্তান আর্মির ক্যাম্প এবং ওদের বিভিন্ন ভারী অস্ত্রের পজিশন রেকি করা এবং শেষ কয় দিন অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে আগরতালার প্রসিদ্ধ জি বি হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের - জয় বাংলা ওয়ার্ডে নার্সেদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে করতেই একদিন স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশ প্রাপ্তি কিভাবে হল তারই এক অনবদ্য কাহিনী কে লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছি আমার এই ছোট্ট প্রয়াসে । অনেক বছর আগের এই স্মৃতি - এক ১১ বছর বয়সী বালকের নিজের চোখে দেখা, নিজের জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সেই ঝর, আত্মউপলব্ধির এই উপাখ্যান যা আজও ৪৯ বছর পর ও প্রকাশ্য দিবালোকের মত উজ্জ্বল, প্রকট এবং স্ফটিকের মত স্বচ্ছ । এই উপাখ্যান এর উৎপত্তি সেই ফেব্রুয়ারী - মার্চের ১৯৭১ সালের টালমাটাল দিন গুলোতে কি দেখেছি, করেছি, শিখেছি এবং তারই পথ ধরে পঁচিশে মার্চ এর গণহত্যা থেকে একে একে কিভাবে সমগ্র দেশ পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী কব্জা করে ফেলল ক্রমান্বয়ে, শুরু হল প্রতিরোধ, প্রতিবাদ, প্রতিশোধ, প্রতিহত এর মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধ, বিজয়, পরিবারের মিলন, ভাই কে খুঁজতে বের হওয়া, ভাই হারানোর ব্যথা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ, গণহত্যা, এথনিক ক্লিনযিং, বাঙ্গালি রেস ( জাতিকে ) পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করার এক অপপ্রায়াশ, জার্মানির কুখ্যাত হিটলার এবং তার নাৎসি বাহিনীর ইউরোপ তথা বিশ্ব থেকে ইহুদি দের কে হোলক্যাস্ট মাধ্যমে হত্যা করার মত । নাৎসি দের পদাঙ্ক হুবুহু অবলম্বন করে কি ভাবে পাকিস্তান আর্মি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার, আমলা এবং জনগণ পূর্ব পাকিস্তান কে বাঙ্গালি শূন্য করতে চেয়েছিল তারই এক রোজনামচা আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস ।
ইমরান আহমেদ চৌধুরী
নর্থহ্যাম্পটন
ইউ কে
১৭ই এপ্রিল ২০২০
সূচি পত্র
১। প্রথম পর্ব আন্দোলন
২। দ্বিতীয় পর্ব মৃত্যু হামলা
৩। তৃতীয় পর্ব দি এক্সোডাস
৪। চতুর্থ পর্ব আশ্রয়স্থল
৫। পঞ্চম পর্ব ভবঘুরে
৬। ষষ্ঠ পর্ব লং মার্চ
৭। সপ্তম পর্ব ইন্ডিয়াতে রিফ্যুজি
৮। অষ্টম পর্ব রিফ্যুজি ক্যাম্প এ জীবন
৯। নবম পর্ব আমার যুদ্ধ
১০। দশম পর্ব মহানুভব মহামানবগন
১১। এগার পর্ব ইন্ডিয়ান মানবিক উৎকর্ষতা
১২। বার পর্ব আত্মত্যাগ
১৩। তের পর্ব বাংলাদেশের জন্ম
প্রথম পর্ব
আন্দোলন
আমি তখন ক্লাস সিক্স এ পড়ি বেশ ভালো ছাত্র, যদিও লেখাপড়ায় মনোযোগ কম তবুও যে কোন কিছু কয়েক বার পড়লেই ঠোঁটস্থ হয়ে যেত নিমিষেই । ক্লাসের প্রথম কয়েক জনের কাতারেই থাকতাম সব সময়। বরাবরই ভালো রেজাল্ট করতাম । পিতা মাতার দুজনের সরকারি চাকরির বদৌলতে এই বয়েসেই অনেক গুলো ভাল - কম ভালো ছোট ও বড় স্কুলে পড়ে ফেলেছি । ইতিমধ্যে কালীগঞ্জ (খুলনা ), খুলনা (২ টি স্কুল ) , রাজশাহী, লাতু (সিলেট) এবং সিলেট শহর (স্কুল এবং মাদ্রাসা - খণ্ডকালীন - প্রাত সেশন ) পড়াশুনা করে ফেলেছি । আমরা তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া তে থাকি । ছোট বেলা থেকেই অনেক গুলো শহর , বন্দর নগর এ থাকা হয়েছে গেছে । আমার ছোট দুই ভাই এক জন ৯ এবং সবচে ছোট ৭ । বোন ১৫ বছর । ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর টা হল সকল ধরনের রাজনীতির এক গরম বিছানা ; খুবিই সচেতন মানুষ এখানকার , প্রগতিশীল এবং শিল্প সাহিত্য অনুরাগী, একটু বিপ্লবী ধরনের - এই ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই জন্ম গ্রহণ করেছিল বাংলার বারো ভুঁইয়া দের দলপতি ঈশা খাঁ যে বাংলার সুলতানাতের বারো জন জমিদারদের নিয়ে মোগল দের আগ্রাসন এর বিরুদ্ধে ১৪স খ্রিস্টাব্দে করেছিল বিদ্রোহ । ছিমছাম ছিল আমাদের পরিবার টা বেশ সঙ্গীত অনুরাগী, সাহিত্য চর্চা চলত সব সময় , জ্যোৎস্না রাতে বাসায় বসতো গানের আসর - মানু আপা সবচে বড় বোন ; ঢাকায় হোস্টেলে থাকতো ও আসলেই বসত গানের আসর - যে কোন শিল্পীর গলাই সে অতি নিমিষেই নকল করে ফেলত । সে লতা কিংবা নুরজাহান বা সামসাদ বেগম কিংবা ফেরদৌসি বেগম অথবা রুনা লায়লা । আসে পাসের বাসার সবাই এসে যোগ দিতো আমাদের বাসার গানের আসরে । ভাইজান আমাদের বড় ভাই - ১৬ বছর বয়সী ১৯৭১ সালে এপ্রিলে অনুষ্ঠিতব্য ম্যাট্রিক পরীক্ষা প্রার্থী । অনেক লম্বা, দুটো দাঁত তার একটার উপর আরেকটা উঠা - আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে গেঁজ দাঁত । সিলেটে থাকে পড়াশুনার জন্য - ম্যাট্রিক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য । আমার সাথে তার সাপে নেউলে সম্পর্ক - আমি সুযোগ পেলেই ওকে খেপাতাম ও সারাক্ষণ আমাকে খেপাতো নয়ত হাস্যরহস্য করত ; ক্যারাম খেলায় আমাকে পার্টনার বানাত আর আমাকে শিখিয়ে দিত কিভাবে কোন গুটিটা কিভাবে মারতে হবে আর আমি ফেলতে না পারলেই বকা দিত আর শুরু হত ঝগড়া ; ভয় ও পেতাম ওকে খুব আবার সারাক্ষণ কুস্তাকুস্তি চলত । লেফট আউট পজিশনে ফুটবল খেলত বাম পায়ের শট ছিল দারুণ। সিলেটের পুলিস লাইন মাঠে আমারা সিলেট থাকাকালীন সময় ঐ মাঠেই প্রাকটিস করতাম , ওই আমাকে ফুটবল খেলা শিখিয়েছে । সে ছিল নিরামিষ ভোজনকারী - শুধু ডিম তাই খেত ।
বাকি সব নিরামিষ । বাসায় আমরা সারাক্ষণ কেবল আড্ডা, গল্প। ফুর্তি, পড়ার সবাই পড়া । রোববারে দুপুরে খাবার দাবার তাড়াহুড়া করে শেষ করে সবাই ঘসা মাজা ফ্লোরে শুয়ে শুয়ে রেডিওতে শুনতাম সানডে ম্যাটিনি নাতক - রবি ঠাকুরের ডাক হরকরা, ফটিক কিংবা খোকা বাবুর প্রত্যাবর্তন । আম্মা বেশ সুন্দর গান গাইত সারাক্ষণ গুন গুন করে ‘' একটা গান লিখো আমার জন্য , না হয় আমি ছিলাম তোমার কাঁছে অতি নগণ্য । অথবা, ''তুমি যে গিয়াছো বকুলো বিছান পথে , নিয়ে গেছো হিয়া কি নামে ডাকিয়া ……।’' দাদীর বাবাদের বাড়ির অনেক লোকজন আসতেন আমাদেরকে দেখতে । ওনাদের নিকতম প্রধান শহর ই এটা । অনেক মানুষ প্রায় এসে আমাদের খোঁজ খবর নিত - আমাদের আব্বা ছিল দাদীর পরিবারের সবচে বড় ছেলে তাই , খোকা ( আমাদের পিতার ডাকনাম) চৌধুরী ছিল সবার প্রিয় - অকপটেই আমি রপ্ত করে ফেললাম ওনাদের গ্রাম্য এক্সেন্ট ( উচ্চারণ) । ওরা চলে গেলেই দেওয়া সুরু করতাম ওদের কথা বলার স্টাইল এবং হুবুহু উচ্চারণ আর সবাই হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পরত আমার নাটকীয় স্টাইলে ওদের কে নকল করা দেখে । কয়দিন পর পর ঢাকা জেতাম আমার সাথে - তখন কার নিউ মার্কেট, বাইতুল মোকাররম, জিন্নাহ এভেনুই আর ঝকমকে নিওন সাইন গুল পড়তে পড়তে আমার সময় কেটে যেত যখন আম্মা, মানু আপা বা টুলু আপা সওদা করতে ব্যস্ত ।
সেই তখন থেকেই আজও আমার সাইনবোর্ড পড়া আর ওগুলো মুখস্ত করা আমার অভ্যেস । ব্রাহ্মণ বাড়িয়া পিটি আই স্কুলের মাঠে থুখোর ক্রিকেট খেলোয়াড় - ডান হাতি ব্যাটস ম্যান এবং মাঠের সবচে’ নির্ভরশীল উইকেট কিপার ছিলাম আমি । আব্বা সব সময় পড়তে দিতেন মাও সে তুং এর লাল বই বাংলা অনুবাদ, চে’ গুভারার বলিভিয়ার ডাইরি অথবা ওর গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা ম্যাগাজিন । বৃষ্টির দিনে আম্মা আমাদের কে পড়ে শুনাতেন ট্রোজান ওয়ার বিখ্যাত একেলিস এর গল্প, নয়ত মাইকেল মধুসূদনের মেগনাদ বদ কাব্য অথবা এলেক্সান্ডার এর বিশ্ব বিজয়ের গল্প কিংবা হেলেনিক ওয়ার এর গ্রীক মাইথোলজির গল্প বলা ; ব্রাহ্মণ বাড়িয়া ঘোড়াপট্টির আব্দু মামার দোকানে যেয়ে ছানার মুড়কি কিনে এনে বসে বসে ওনার ছেলে আশরাফ এর সাথে খেতাম আমি আর দুলাল। চোখ ধাদানো ব্যায়াম করতেন আর আমরা বসে বসে দেখতাম হেলাল ভাইকে ; বিকালে সবাই চলে যেতাম এয়ান্ডারসন ক্যেনাল এর পারে হাট তে, নিয়াজ মোহাম্মদ স্টেডিয়াম এ ফুটবল খেলা দেখতে , ব্রাহ্মন বাড়িয়া রেল স্টেশনের পাশে ইরানী মানুষেরা তাঁবু গেড়ে আস্তানা বানাত আর চশমা, তাবিজ এবং বিভিন্ন জিনিস রকমারি ফেঞ্চি আইটেম বিক্রি করত ; সম্পূর্ণ পরিবার এক সাথে যেয়ে সিনেমা দেখা আমাদের শেষ ছবি ছিল, যে ছবিতে রঙ্গিলা গরুর গাড়ী চালাতে চালাতে গেয়েছিল , ‘' আরে গা মেরে মনোয়া, গাতা জ্যারে আপানানা নাগরিয়া ছে দূর …। এই ছিল জীবনের খুঁটিনাটি । কি সুন্দর ছিল সময় টা আম্মা এবং আব্বা দুজনেই চাকরি করতেন । বেশ প্রাচুর্য ছিল, অভাব ছিলনা তেমন কোন কিছুর, বেশ সুন্দর পরিচ্ছন ছিল জীবন ও জীবিকা , আনন্দ, ফুর্তি, পরিপাটি সব সুন্দর করে ঘর বাড়ী ঘুছানো এবং সাংস্কৃতিক ভাবে উভয় প্রাচ্য এবং পশ্চিমা ধাঁচেই এগিয়ে যাচ্ছিল জীবন টা ।আমাদের পরিবার টা খুবিই সেকুয়ালার ছিল হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ এবং ক্রিস্টিয়ান সব ধরনের পারিবারিক বন্ধু দের সাথে আমাদের উঠা বসা ছিল একতা নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার ।
আব্বা এবং আম্মা দুজনারিই শৈশব থেকে যুবক সময়ের জীবনটা কেটেছে কলকাতায় ; সারাক্ষণ ওনাদের মুখে কলকাতা ; স্বপনের শহর কলকাতা , প্রাচ্যের লন্ডন নামে খ্যাত কলকাতা - আর কলকাতা - সব ওনাদের মুখে মুখে শুনে শুনেই কেমন জানি চিনে ফেলেছিলাম এসপ্ল্যানেড, চৌরঙ্গী, ফোরট উইলিয়াম, ইয়াসিন মোল্লার টেইলার সপ, গ্র্যান্ড হোটেল, পার্ক সার্কাস, সেক্সপিয়ার শরণি, গড়ের মাঠ, ইডেন ক্রিকেট মাঠ , গড়ি হাট আর চিনতাম বেহালা থেকে সারা কলকাতার বিভিন্ন ট্রাম স্টপ এর নাম গুলো । আব্বা বলতেন আমাদের দাদা চাকরি করতেন কলকাতার প্রসিদ্ধ এবং সবচে’ দামী গ্র্যান্ড হোটেলে - সেই ১৯২৫ সাল থেকে বিলাত থেকে ফেরত আসার পর থেকেই ; রবিবারে স্যুট কোট পরে সে নাকি কলকাতা রেসকোর্সে জেতেন ঘোড় রেস দেখতে এবং ঘোড়ার উপর বাজিও ধরতেন । আম্মা কোন কোন ট্রাম স্টপের পাশের গাছে তার নাম ‘' ডলি’' লেখেছে চাকু দিয়ে কেটে কেটে। আম্মা বলত সবাই কে নিয়ে কলকাতা যাব একবার তোমাদের কে দেখানোর জন্য । আম্মা ১৯৪৬ সালের হিন্দু মুসলিম রাইওট এর সময় কলকাতায় ভিক্টিম দের শুশ্রসা করার জন্য ভলেন্টিয়ার নার্স হিসেবে যোগ দিয়েছিল সেই ১৫ - ১৬ বছর বয়েসেই - বাড়ির সবচে’ ছোট ছিল তাই তার সাত খুন মাফ ছিল; বেশ বর্ধিষ্ণু পরিবার । সিলেটের হবিগঞ্জ থেকে করিমগঞ্জ - দিনাজপুরের হিলি হয়ে কলকাতা অব্দি বিস্তৃত ছিল পারিবারিক ব্যবসা এবং শিক্ষকতা পেশা । ১৯৪৯ সালে সে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত ইন্ডীয়া তে নব প্রতিষ্ঠিত ক্যমুনিস্ট পার্টি তে ও যোগদান করে এবং কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিং ঘেরাও মার্চে থেকে এরেস্ট ও হয়েছিল একবার । তারপর ই ওনার রাজনীতিতে ইস্তেফা এবং পরবর্তীতে ইস্ট পাকিস্তানে এসে গ্র্যাজুএসণ শেষ করে পাকিস্তান সি এন্ড ল্যান্ড কাস্টমসে অফিসার হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করেন । কিন্তু, এসবের পরও আমাদের পিতামাতা ছিল খুবিই ভীষণ চুপচাপ ; চাকরী এবং পরিবার নিয়েই তারা সারাক্ষণ ব্যাস্ত সময় কাটাত ।
জ্ঞ্যান অর্জন কর, শিক্ষিত হও, নিজে স্বাবলম্বী হও , ভাল মানুষ হও,টাকা পয়সার পিছনে দৌড়াইও না , বিপদ এ যারা তাদের সহায়তা কর, সামাজিক উন্নয়নে সকল সময় অবদান রেখ , তোমার থেকে কম ভ্যাগবানদের সকল সময় সহায়তা কর- এই সব ই ছিল আমাদের জীবনকে গঠন করার ছবক । বিরক্ত লাগত যদিও । আর আব্বা ছিলেন একজন অঙ্ক জিনিয়াস, জ্যামিতি তে ছিল সে বেস্ট শিক্ষক ; একদম অতি সহজেই এলযেব্রা এবং ঐকিক নিয়মের অঙ্ক স্ফটিক এর মত স্বচ্ছ ভাবে বুঝিয়ে দিতেন । ১৯৪৬ সালে উনার জীবন তা ওলটপালট হয়ে যায় চোখের পলকে । তখন সে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক এর আগেই নেমে এলো হিন্দু মসুলমান দাঙ্গা ; হাজার হাজার মানুষ চতুর্দিকে ঘর বাড়ী হারাচ্ছে , হচ্ছে নিহত, হাজার হাজার আহত মানুষের হাহাকার ওনার প্রিয় কলকাতায় - যে নগরীকে সে মনে করতো পৃথিবীর অন্যতম সভ্য নগরী । তাদের বাড়ির আসে পাশের প্রায় সব বাড়ি গুলো থেকেই সবাই রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেছে । তারপর, একদিন ওনারা চারজন, আমার দাদা, দাদী, আবার ছোট ভাই ও আব্বা - দাদীর তিনটা শাড়ি দিয়ে বানানো দড়ি বেয়ে নিচে নেমে পালালো কলকাতা থেকে । ২ দিনের পথ ওনাদের আস্তে লাগল ২৪ দিন । সর্বস্বান্ত প্রায় কপর্দকহীন, এক কাপড়ে পালিয়ে জান বাঁচালো । তারপর শুরু হল আঁক ভিন্ন জীবন, পরিবারে নেমে এলো অনেক অভাব । ব্রাহ্মনবাড়িয়া কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হল তিনি । ব্রাহ্মণবাড়িয়া তে উনি কাটিয়েছেন তার ছাত্র জীবনের একটা মূল্যবান সময়। তারপর আর লেখা পড়া চালানো সম্ভব ছিলনা অর্থনৈতিক কারণে তাই বাধ্য হয়েই অনেকটা চাকরী ঢুকতে হল । ভীষণ পড়ুয়া মানুষ ছিলেন আব্বা - রবিবারে সে সাত দিনের ইংলিশ এবং বাংলা পত্রিকা গুলো একদম প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত পড়তো পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ।
উনি একবারে সেকুল্যার মনের মানুষ, সবসময়ই বলতো, পাঞ্জাবীরা বাঙ্গালীদের কখনই পছন্দ করে না, ওদের কাছে আমরা সাইজে ছোট, বেটে, কালো, মাছ খায় আর সর্বপরি আমরা ওদের মত ব্রিটিশ দের দেওয়া সার্টিফিকেট ধারী মার্শাল রেস নই। আরও বলত কেন যে আমাদের নেতারা ওদের সাথে মিলে পাকিস্থান টা বানাল , বলতেন, বুঝছো মিয়া, পাকিস্তান কিন্তু ঐ বেটারা বানায় নাই, পাকিস্তান বানাইছে বাঙ্গালী মুসলমানরা - নিজে বানাইয়া এখন নিজেদের বানানো দেশে নিজেরাই নিগৃহত । তোমার দাদাও কোনদিন চায় নাই , এই দেশ বিভাগের জন্য কলিকাতায় সব ফেলে রাইওয়ট এর সময় পালাইয়া এসেছিলাম, টাঙ্গা বা ট্রামে স্কুলে যেতাম আর দেশে এসে প্রত্যেক দিন সাড়ে তিন মাইল সাড়ে তিন মাইল হেঁটে ম্যাট্রিক শেষ করতে হয়েছে , গ্রামে একটা স্কুলে ও ছিল না । আল্লাহ যদি আমাকে কোনদিন তৌফিক দেয় তাহলে আমাদের গ্রামে একটা হাই স্কুল খুলব । আব্বা আরও বলতেন সব বিহারীরা উর্দু কথা বলে বলে সব ভালো ভালো ব্যবাসা দখল করে বসে আছে , আর অন্যান্য মুসলমান রা পাকিস্তানের জন্য বড় বড় স্লোগান দিয়ে নিজেরাই এখন ইন্ডিয়াতে রয়ে গেছে আর আমাদের কে বানিয়েছে পাঞ্জাবীদের গোলাম । বেইমান সব ।
আর তার প্রিয় পড়ার সাবজেক্ট ছিল মার্ডার মিস্ট্রি । মাও সে তুং, লেনিন, কার্ল মার্ক্স , চে গুভারা, ফিডেল ক্রাস্ট্রো, আবুল হোসেন ভট্টাচার্য, নিহার রঞ্জন সহ বাংলা বা ইংরেজি বই পড়া ছিল ওনার নিত্য দিনের রুটিন । পৃথিবীর বিভিন্ন রাজ বংশ , বাংলাদেশের জমিদার, পুরা ভারতের বিভিন্ন রাজ বংশ এবং রাজবংশের শাসন আমলের ইতিহাস প্রায় সবটাই ওনার ঠোটঅস্ত । আব্বা ছিলেন এক বিশাল জোকার সারক্ষন একটা না একটা কৌতুক তার বলতেই হবে ।এই ছিল আমাদের পরিবারের জীবন যাপন - ওই আমলেই আমারা বেড়াতে যেতাম সিলেটের বাল্লা তে - খাসি পাহাররের সৌন্দর্য দেখতে, খোয়াই নদীতে ছোট নৌকা ভ্রমণে , তেলিয়াপারা, বড়লেখা, ছোটলেখা, কুমারশিল, সাতগাঁ চা বাগান দেখতে - কিভাবে চা পাতা আহরণ করে ট্রাক্টর এ করে ফ্যাক্টরি তে এনে বাছাই, ড্রাই এবং চা পাতা বানানো থেকে শুরু করে পেটীতে ভরে হাতীর উপড়ে পেটী গুলো বেঁধে নিকতম লাতু (শাহবাজপুর) স্টেশন এনে ট্রেনে উঠিয়ে নিয়ে জাওয়া হত - এসব জানার জন্য ; আব্বার সাথে সুন্দরবন এ যাওয়া । সিলেটের সারেরপার ( লাতুর নিকট) হাওড়ে শীত কালের ভোরে উঠে পাখি মারতে যাওয়া - এই সব মিলিয়ে জীবন টা বেশ অভিযাত্রীসুলভ। একটা পরিছন্ন এবং সুন্দর জীবন ছিল আমাদের পরিবারের। সম্প্রীতি, স্নেহ, আদর ভালবাসা এবং অগ্রগতিশীলতায় পরিপূর্ণ একটা জীবন ব্যবস্থা ছিল আমাদের ।
এই বছর ই প্রথম বাইরে একটু আধটু একা বেরোনোর সুযোগ পেতে লাগলাম । বন্ধুদের যেতে পারতাম বাইরে কিন্তু সন্ধ্যা হবার আগে বাসায় ফিরতেই হবে । কোন রকম অজুহাত চলবে না । সেই বার ই ১৯৭১ সালে প্রথম ২১ শে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের শহিদদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ভোঁর বেলা প্রভাত ফেরিতে গেলাম । সে যে কি মারাত্মক অনুভূতি সেটা প্রকাশ করার কোন ভাষা আমার নেই । শীতের সকালে ঠাণ্ডা পীচ ঢালা পথে এবং কংক্রিট সিমেন্টের রাস্তা দিয়ে হেতে সেই অন্নদা স্কুলের কোনায় হিন্দু মন্দির আর বি বাড়িয়া স্কুলের সংযোগ স্থলে শহীদ মিনারের পাদদেশে পুষ্প মাল্য অর্পণ করাটা ছিল আমার জীবনের সবচে’ একটা বিশাল ঘটনা । একবার আমরা রাজশাহীর প্রেমতলি থেকে বেড়াতে এসেছিলাম বাহ্মনবাড়িয়া তে বেশ কয়েক বছর আগে আমি তখন ৮ কি ৯ বছর বয়সী ছিলাম তখন একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনি সাড়া শহরে পুলিশ ক্যারফুই দিয়ে দিয়েছে এবং দুপুরে অন্নদা হাই স্কুলের ছাত্ররা ক্যারফুই ভঙ্গ করে মিছিল বের করেছিল এবং পুলিস এর গুলিতে অন্নদা হাই স্কুলের এক শিক্ষক এর ছেলে নিহত হয়েছিল ; সেই নিহত ছাত্রের স্মৃতিতেই এই শহীদ মিনার - ওই মিনারে পুষ্প মাল্য অর্পণ করতে পেরে নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করতে লাগলাম ; ওই শহীদ মিনার পাশ দিয়ে হেটে হেটেই প্রত্যহ স্কুলে যেতাম । ২১ শে ফেব্রুয়ারি থেকেই বাংলার আকাশে কালো মেঘের ছায়া বিচরণ করছিল । ঢাকা তে বেশ বাক বিতণ্ডা চলছিল ১৯৭০ এর নির্বাচন এর জনগণের রায় মেনে নতুন সরকার গঠনের ঘোষণার । কিন্তু, ওরা মানে ঐ সামরিক জ্যান্তরা করছিল নানান বাহানা । সেদিন একুশে ফ্রেব্রুয়ারির বিভিন্ন বক্তারা বারবার ঐ সব কথাই বলছিল তাদের বক্ত্রিতায় - হুমায়ুন ভাই, মাহুবুবুল হুদা, সাচ্ছু ভাই, আলী আযম সাহেব, ইমদাদুল বারী, ডক্টর ফরিদুল হুদা এবং অন্যান্য সব বক্তারা । জীবনে এই প্রথম যোগদান করলাম এই রকম অনুষ্ঠানে । বেশ গর্ব বোধ করলাম ।
থমথমে পরিস্থিতি চলল লাগলো - ১ মার্চ স্কুল এ আর ক্লাস হয় না ।। বিশাল বিশাল জাইয়ান্ট ধরনের সিনিয়র ছাত্র রা ( এক জনের নাম মনে আছে আমান- টি, এ রোডের আমানিয়া হোটেলের মালিকের ছেলে ) এসে সব ছোট ক্লাসের ছাত্রদের ক্লাস থেকে বের করে নিয়ে যেত মিছিল, মিটিং এ যোগদান করার জন্য । জীবনেও এরকম স্বাধীনতা পাই নাই কখনও, জীবনেও কোনদিন ক্লাস ফাকি দেবার সাহস করি নাই এবং প্রয়োজন ও মনে কি নাই । কিন্তু, সবচে’ বড় যে কাজটি করল এই মিছিল এবং মিটিং গুলো সেটা হোল আমার চোখ - কান খুলে গেল - কিভাবে ওরা আমাদের কে নিগৃহীত করছে, কিভাবে ওরা আমাদের ন্যায্য দাবী আমদের বিজয়ী দল কে দিচ্ছে না , ওরা আমাদের কে নির্মম ভাবে বৈশম্যের শিকার করছে । কিভাবে ওরা সামরিক জ্যান্তার রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে ১৯৫৮ সাল থেকে। বঞ্চিত করছে আমাদের সম্পদ থেকে আমাদের কে । চলতে পারে না এই বৈষম্য আর । কেমন জানি রাজনৈতিক ভাবে ঘটে গেলো এক নতুন জাগরণ আমার মধ্যে নিজের অজান্তে । দিনের পর আমি এবং আমার আরও কয়েক জন ক্লাস এর বন্ধুরা প্রতিদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কোর্ট পয়েন্ট মিলিত হতাম পরবর্তী প্রোগ্রামের জন্য । আমারা হলাম কয়েকজন মিছিল এর সম্মুখ এর গ্রুপ । তারপর নেতারা এবং তার পর মাইকের রিক্সা এর পর কাফেলা ; কোর্ট পয়েন্ট থেকে মিছিল বের হত অথবা ট্যাঙ্কের পাড় থেকে তারপর পুরা শহর প্রদক্ষিণ করতাম হেটে হেটে । বেশ উপভোগ করতাম, নিজেকে অনেক লম্বা বড় সড় ভাবতে শুরু করা শুরু করলাম।
দিন শেষে তিন আনা দিয়ে দুবরাজের মুরি ভাজি অথবা চানাচুর চিবুতে চিবুতে আমি আর আমার আহেমদি মুসলিম বন্ধু ফারুকি একটা রিকসা নিয়ে অথবা হেটে হেটে বাসায় ফিরতাম সন্ধ্যা হবার আগেই । বাসায় এসে সবাই কে বক্তৃতা দিয়ে দিয়ে বলতাম কি কি করলাম এবং কেন ওরা আমাদের দাবী মানছে না । কিভাবে ওদের কে ভাষা আন্দোলন এবং ছয় দফা আন্দোলনের মত এবারও আমাদের দাবী মানাতে বাধ্য করাতে হবে । আম্মা বেশ অনুপ্রাণিত আমার বক্তৃতায় - আমি বাসায় এসে প্রায় সবার বক্তৃতাই হুবহু নকল করে ডেমো দিতাম আর বাসাশুদ্ধ সবাই কে হাসাতাম। এভাবেই আমার সম্পৃক্ততা হল আন্দোলনের সাথে ।পরিস্থিতি ধীরে ধীরে কেমন যেন থম থমে হয়ে যেতে লাগলো । শহরে পাকিস্তান আর্মি নিয়াজ মোহাম্মদ ফুটবল এবং ওয়াপদা রেস্টহাউজ এলাকায় বিরাট এক ক্যাম্প করে ফেলল । শহরে আর্মির গাড়ি টহল দেওয়া শুরু করল ক্রমশ , এদিকে সংগ্রাম কমিটি ও আস্তে আস্তে ফইটতলা। বাদুঘর, পুইন্নট, এবং আসে পাশের গ্রাম গুলো তে নেটওয়ার্ক করতে লাগলো গোপনে ; কুইছ, বল্লম, রামদা, তলওয়ার, ড্যাগার, গাঁদা বন্দুক, টুটূ বোর রাইফেল,একনালা বা দুনালা বন্দুক , এয়ার গান, তীর ধনুক নিয়ে আস্তে আস্তে তৈয়ার হতে শুরু করলো । মহল্লা , পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠতে থাকল সিভিল ডিফেন্স, আনসার, মুজাহিদ প্রশিক্ষণ , স্কুল, কলেজের ছাত্ররা আমাদের বড় ভাইয়েরা দলে দলে যোগদান করতে থাকল - নিজেকে কেমন যেন একটু ছোট ভাবতে লাগলাম ঐ দলে বয়েসের জন্য না ঢুকতে পেরে । থমথমে ভাব সাব দেখে একটু ভয় ও পেয়ে গেলাম মনে মনে । দুই দিন আর ভয়ে বের হলাম না , আম্মা বারণ করে দিল ।
সব বাড়িতে এবং বাসায় সবাই অস্ত্র পাতি নিয়ে তৈরি হতে লাগলো । বঙ্গবন্ধুর সেই জ্বালাময়ী ৭ ই মার্চের ভাষণ এর চর্চা চারিদিকে । সবার মুখে সেই একই কথা এর উপর আর কোন ভাষণ হতেই পারে না , উনিই আমাদের অবিসংবাদিত নেতা ; আমাদের পথ প্রদর্শক, শ্রেষ্ঠ মহা মানব , যার প্রত্যেক কথা যেন আদেশ এবং শিরোধার্য । সে যে কি এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিকিরণকারি এক আদেশ তা ভাষায় প্রকাশের ভাষা আমার নাই, তদুপরি তখন আমি নিজেই ছিলাম ১০ বছর ১০ মাস বয়সী কত টুকুই বা বুঝি । তারপরও সবার মুখে শুনতে শুনতে এক সময় উপলব্ধি করতে লাগলাম কি যে এক অমোঘবানী ছিল সেই ভাষণ এ । গুটি গুটি পায়ে ক্রমান্বয়ে সময় ও তারিখ এশে হোঁচট খেয়ে মুখ তুবড়ে যেন পড়ে গেল - সেই ভয়াল সকল কালো রাতের চেয়েও কালো রাত …। ২৫ শে মার্চ …… ।
২৭ সকালে বের হয়ে পরলাম আবার - আমাদের প্রধান যাওয়ার জায়গা ছিল ট্যাংকের পার, কোর্ট পয়েন্ট, সাচ্চু ভাইয়ের বাসা, নয়ত আলী আজম সাহেবের বাসা । সকালে ট্যাংকের পার যেয়ে সবার সাথে মিলিত হয়ে দল বল নিয়ে আসলাম মাতৃ সদন এলাকায় তিন রাস্তার মোড়ে - তখন দেখলাম কয়েক শ লোক দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার দুই পারে । আমারা ওখানেই দাঁড়িয়ে গেলাম । একটু পরেই আসা শুরু করল আঁক টা মিলিটারি কনভয় ( গাড়ির শোভা যাত্রা) । মানুষে লোকারণ্য কুমারসিহ্ল রোড আর ট্যাংকের পার - জেলখানা রোড আর সরাইল - কালিকচ্ছ রোড এ মানুষ ধরবার জায়গা নাই । সবাই আর্মির গাড়ি দেখতে দাঁড়িয়ে । সামনের জিপে বসে ছিল আঁক বইর সেনানী , ঠোটে একটা সিগারেট, ক্যাপ টা চে গুভারার ক্যাপের মত, ছুল গুলো বেশ বড় বড় , গাড়ি থেকে নেমে সবাই কে হ্যাট নেড়ে অভিবাদন দিল - আর পাবলিক জয় বাংলা বলে গগন বিদারী আওয়াজে এলেকা প্রকম্পিত করে ফেলল । আম্মার কাছে শুনেছিলাম ট্রোজান যুদ্ধ বিজয়ী একেলিস এর কথা আর আজ দেখলাম সচক্ষে মনে হল, সোল্ডারে লেখা ইস বেঙ্গল লাল চিন্দি উড় উপড়ে আর বাম হাতের বাহুতে এক হিংস্র রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন দেওয়া ব্যাজ । মনে মনে সে দিন প্রতিজ্ঞা করলাম বড় হলে আমি খালেদ মুসারাফ এর মত ইস্ট বেঙ্গলে অফিসার হিসেবে যোগদান করব । তার নাম এর জয়ধ্বনি পড়তে শুরু করলো ।
গাড়ি গুলো এগিয়ে গেল টি এ রোড ধরে স্টেশন হয়ে আর্মি ক্যাম্পের দিকে আমরাও পিছু নিলাম ঐ কনভয়ের । ২৫ তারিখের খবর ঢাকা থেকে আস্তে আস্তে আসতে শুরু হল ; ব্রাহ্মণবাড়িয়া ঢাকা থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার মানুষ রিক্সা, ভ্যান, ট্রেন এবং লঞ্চ এ করে সব এক কাপড় এ ভেগে চলে এসেছে - অনেকের কাছ থেকে শুনলাম সেই বিভীষিকার। সত্য গল্প । বাসার সবাই মনে মনে অপেক্ষা করল এই বুঝি আমদের বড় বোন মানু আপা এসে পরল বলে । কিন্তু কোথাও তার দেখা পাওয়া গেল না । ওখান থেকে হাটতে হাটতে আমরা কয়জন বালক বয়সী আমি, ফারুকী , নিপু, দুলাল ও প্রাণনাথ টি এ রোড ধরে রেল গেট দিয়ে নিয়ায মোহাম্মাদ স্কুলের দিকে যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম অনেক বড় বড় মিছিল রেল লাইন ধরে ধেবে আসছে তাল শহর এর দিক থেকে ; হাতে উদ্যত বল্লম, রাম দা’ আর তীর ধনুক । আমারা ওদের দিকে অগ্রসর হয়ে রেল স্টেশন পার হতেই শুনলাম বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করেছে সকাল ১০ টার দিকে গগন বিদারী জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত পুরা এলাকা ; বাঙ্গালি সৈনিক রা আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে আমাদের সাথে । মুখে মুখে একই নাম মেজর সাফফাত জামিল বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাহিনী সব কয়টি পাঞ্জাবি দের কব্জা করে ফেলেছে এবং ওদের সব গুলোকে বন্দি করে ফেলেছে । এখন হাতে সময় কম তাড়াতাড়ি কুমিল্লা এবং ঢাকা থেকে রেল লাইন দিয়ে ট্রেনে এবং কুমিল্লা থেকে যাতে পাঞ্জাবিরা না আসতে পারে তাই সব রোড ও রেল লাইন রোড ব্লক দিয়ে ওদের আসা বন্ধ করতে হবে ।
দেখা পেলাম আমার পিতামাতার পারিবারিক বন্ধুর ছেলে আওলাদ দাদা এবং ওনার বন্ধুদের ছাত্র লীগের কর্মী সবাই এখন ভীষণ ব্যস্ত নেতা ; দেখতে পেয়ে কাছে টেনে আদর করে দিয়ে বলল চলো - সবাই আমাদের সাথে - মাখন ভাই ( লোকালি সবাই বলে - মাহন ভাই- বি বাড়িয়া এলাকার লোকেরা ‘ খ’ কে ‘হ' উচ্চারণ করে থাকে সাধারণতঃ ) হুমায়ন ভাই , জাহাঙ্গীর উসমান ভাই, কুতুব ভাই আদেশ কুরুল্লাইয়া খালের (এন্ডারসন ক্যানাল) উপড়ে ব্রিজ দিয়ে সকল প্রকার গাড়ি আসা বন্ধ করার জন্য বড় একটা গর্ত খোদাই করতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব । যা বলা তাই কাজ ; সবাই তৎক্ষণাৎ এক বিশাল মিছিল নিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্ট কে সুভেছা দিতে দিতে ওদের ক্যাম্পের সামনে দিয়ে ব্রিজের নিকট পৌঁছে গেলাম ৪৫ মিনিট এর মধ্যে । প্রায় ১ থেকে দের হাজার লোক ব্রিজ এর ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রান্তে কাটা শুরু করল ১২ ফুট এর মত এক বিশাল গর্ত বানান শুরু হল তৎক্ষণাৎ। বড় বড় কড়ই গাছ গুলো কেটে রোড ব্লক বসানো হল , দুদিকে রেল লাইন এ পুরানো মাল গাড়ির বগি এবং গাছ, দিয়ে গড়ে তোলা হল বিশাল আত্ম রক্ষা দুর্গ । যা কিনা অতি সহজেই শত্রু অতিক্রম করে শহরে প্রবেশ করতে পারবে না । চোখের পলকে সন্ধ্যা থেকে রাত হয়ে এলো বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত - ঢুঁকেই দেখি সবাই আমার চিন্তায় অস্থির ; বাসায় হেটে হেটে আসার সময় দেখলাম অনেক পরিবার রিক্সা এবং স্কুটারে করে শহর ত্যাগ করছে।সারা হাতে চারটা চারটা আট তা ফোস্কা, সারা মুখে মাটি, ঘামের সাথে মিশে কাদার প্রলেপের মত লাগছিল । গোসল সেরেই চারটা খেয়েই ঘুমিয়ে পরলাম ক্লান্ত, অবসন্ন অবস্থায় । ঐ রাস্তা অবস্ট্যাকল( প্রতিবন্ধকতা ) এর ১-২ দিনের মধ্যেই কাজে লাগল কুররুইল্লা ব্রিজের পাক আর্মি আর আমাদের বীর বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে প্রচুর গোলাগুলি হল এবং পাক আর্মি শহরে প্রবেশ করতে পারল না ঐ প্রতিরক্ষা এবং ঐ অবস্ট্যাকল( প্রতিবন্ধকতা ) গুলো ভেদ করে , পিছু হটে গেল নিজেদের লেজ গুটিয়ে কুমিল্লা অভিমুখে । বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই সাময়িক বিজয় ওঁদেরকে পরিণত করল শহর বাসীর রক্ষা কবচ হিসেবে । সকল অধিবাসীদের মনোবল আরও বেড়ে গেল কয়েক গুন। দলে দলে যুবক রা আসলো নেমে রাস্তায় বেঙ্গল রেজিমেন্ট কে সহায়তা করার জন্য । একটা কেমন জেন সাহস বেড়ে গেল সবার মধ্যে ।
২৯ শে মার্চ শহরের আকাশে ২ টি পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ এসে অনেক ক্ষণ শহর প্রদক্ষিণ করল ঘুরে ঘুরে । এর পরের ছয় সাত দিন কেটে গেল এভাবেই - ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত তখনও ; কেমন জানি একটা আত্মবিশ্বাস জাগতে লাগল হয়ত আরা মুক্ত এলাকাই থেকে যাব । ইতিমধ্যে ১লা এপ্রিল বিমান হামলা হল - সে এক বিশাল ভয়াত্তক ব্যাপার । ১০ -১২ মিনিট দুটো বিমান গুলি এবং বোমা বর্ষণ, তিতাস গ্যাস এ আগুন লেগে গেল, কালিবাড়ি মন্দির এও আঘাত হানল, এক মহিলা বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত গুলিতে নিহত হলেন। আসে পাশের প্রায় সব বাসা গুলোর লোকেরাই চলে গেল আস্তে আস্তে - এলাকা প্রায় খালি আমাদের পাশের বাসাটাই ছিল কলেজের প্রফেসর দের বাসা ; একদিন ভরে উঠে দেখি ওরা সবাই উধাও । প্রফেসর আসাদ চৌধুরী কয় টা বাসা পরে থাকতেন অনার খালা আবার আমার আম্মার বন্ধু সেই হিসেবে আমাদের খুবি ক্লোজ ছিলেন, একদিন যেয়ে দেখি অনার বাসাতে তালা ঝুলছে । বিমান হামলা যদিও ছিল স্বল্প সময়ের কিন্তু শহর বাসি ভীষণ ভাবে ভয় পেয়ে গেল । নিজের দেশের জনগণ কে নিজের দেশের বিমান বাহিনী হামলা করছে ভাবতে আশ্চর্য লাগল সবার । ইতিমধ্যে, ঢাকার নারকীয়তা সম্পর্কে সবাই আস্তে আস্তে জানল সব কিছু । প্রত্যেক দিন ঢাকা থেকে পরিবার বর্গ নিয়ে লোকজন আসা সুরু করল , ওদের মুখের বিভীষিকা ময় হত্যাযজ্ঞ শুনে আমরা আরও ভয়ার্ত হয়ে পরলাম । আব্বা ইতিমধ্যে ফেব্রুয়ারী মাসেই ঢাকা পিলখানা ই, পি, আর হেড কোয়ার্টার থেকে সিলেট এ বদলি হয়েছে ; ঢাকা থেকে সিলেট যাবার সময় আমাদের সাথে ৭ দিন এর ছুটি কাটিয়ে গেলেন ; অনেক আনন্দ করলাম ঐ কইদিন । বড় বোন ঢাকায় , আব্বা সিলেটে এর মধ্যে হটাত যদি আমরা শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই তাহলে ওরা আসলেও আমাদের খুঁজে পাবে না তাই আমরাও কোথাও যেতে পারলাম না । প্রত্যেক দিন ওদের জন্য এই বুঝি আসলো ।
শহর থম থমে - ইস্ট বেঙ্গল রাতের অন্ধকারে তাদের ক্যাম্প অন্যত্র সরিয়ে নিলো - বিমান হামলার আগেই, শহরে মাইকিং করে বলা হল সব বাসায় - বাড়িতে বাড়িতে এয়ার ডিফেন্সে ট্রেঞ্চ বা বাঙ্কার খুদার জন্য । সিভিল ডিফেন্স এর সাইরেন বাজলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যেয়ে ট্রেঞ্চ এ আশ্রয় নিতে ; অনেক কষ্টে আমারও একটা ইংরেজি ডাবলু আকারের ট্রেঞ্চ বানালাম - তিন, কাঠ, ইট, লোহার পাত দিয়ে ছাদ বানালাম ট্রেঞ্চ এর তার উপর পুকুর পার থেকে আলাদা মাটি কেটে টুকরি তে করে এনে এনে ট্রেঞ্চ এর ছাদের উপর ঢাললাম যাতে করে বিমান হামলায় বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত গুলি ঐ ট্রেঞ্চের ছাদ পেনিট্রেট করে ট্রেঞ্চের ভিতরে আমরা যারা আশ্রয় নিব তাদের গায়ে বা মাথায় গুলি না লাগে । আমাদের বানানো ট্রেঞ্চ এ ৬ জন আশ্রয় নেবার জায়গা ছিল - হাঁটু গেড়ে বসা বা উপুড় হয়ে বসার মত জায়গা ছিল ; আমারা সবাই মিলে তিন দিনে অলান্ত পরিশ্রম করে ওটা বানিয়েছিলাম । রেডি হবার পর দুই তিন বার ট্রায়াল ও দিলাম । আম্মার কড়া আদেশ এই দুর্যোগ পূর্ণ পরিস্থিতিতে আমাকে একদম বাইরে যেতে বারণ কড়া হলো ।
রাত গুলো ছিল নিথর এবং নীরব, রাতের বেলা শহরের নেতারা এবং আর্মির মাধ্যমে দু তিন বার বিমান হামলা হলে কিভাবে ব্ল্যাক আউট করা লাগবে তা টেস্ট করল। সবার চোখেই কেমন যেন ভীতি ভীতি একটা ভাব । অনেক দোকান আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গ্যালো । সারা দিন রাত শহরের নেতারা গাড়ী, ভেস্পা, হোন্ডা নিয়ে সবাই কে আসস্থ করতে ঘুরে বেড়াত ; ওঁরা ঐ দুর্যোগের সময় খুবি পরিশ্রম করেছেন । ব্রাহ্মানবাড়িয়া ঐ এলাকার মধ্যে একমাত্র মুক্ত এলাকা, এপ্রিল মাস চলে এলো ইতিমধ্যে - কুমিল্লা , ভৈরব, আখাউরা, কসবা, সব একে একে পাকিস্তান আর্মির হাতে চলে গ্যেলো । ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে কুমিল্লা ছি এন্ড বি রোড এর উজানিসাহ ব্রিজ পর্যন্ত ওঁরা এসে পড়তে চাইল ; বেঙ্গল রেজিমেন্ট - ই পি আর - মুজাহিদ - আনসার বাহিনী প্রতিহত করে দিয়েছে বেশ কয়েকবার শুনলাম । ইতিমধ্যে ইস্ট বেঙ্গল যুবক দের ট্রেনিং দেবার ব্যবস্থা করে ফেলল - কয়েক শত চোখের পলকেই যোগদান করলো । বেকারি গুলো পাউরুটি বানিয়ে ইস্ট বেঙ্গল সৈনিকদের দিতে লাগল। চারিদিকে এক যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতে থাকল । আমরা খুবি একাকী হয়ে পরলাম ঐ সময় আমাদের পারিবারিক বন্ধু পরিবার দারগা কাকা এবং তার ছেলে মেয়েরা আমাদের কে খুবি সহায়তা করতে লাগলো - ওঁদের কাছে আমরা চীরঋণী । আমাদের ঐ ট্রেঞ্চ বানানো তে ও ওনারা অনেক সহায়তা করলো । আমাদের এলাকা প্রায় জনমানবহীন হয়ে যেতে লাগল ক্রমশঃ , তবুও মনে আসা ধরে বসে থাকলাম আমরা এই বুঝি আব্বা এসে দরজার করা নাড়বে - অথবা মানু আপা এসে হাজির হব যে কোন সময় । অধীর সেই অপেক্ষা । সারারাত বাসায় কারো ঘুম হয় না ।
সবার চোখেই আতঙ্ক । জগত বাজার, ফারুকি মার্কেট, বর্ডার বাজারে অনেক কম দোকান বসতে থাকে । বাসার কাজের লোক বাজার থেকে এসেই বলতে লাগল । একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি কাজের লোক টা আর নেই । আর কোথাও ওকে খুঁজে পাওয়া গেল না সেই ছোট বেলা এসেছিলো আমাদের বাসায় । আম্মা বলল ও খুব ভয় পেয়ে গেছে তাই মনে হয় গ্রামে চলে গেছে ওর মা বাবার কাছে। সারাদিন সারারাত কুকুর গুলো অনবরত করুন সুরে কান্না করে, বিড়াল গুলো শুধু একে ওপরের সাথে মারামারি করে । ইতিমধ্যে, দু দিন বেশ কাল বৈশাখীর ঝর হলে সাথে বেশ বৃষ্টি - ট্রেঞ্চ এর ভিতরে হাঁটু পানি - ট্রেঞ্চের ডাবলু আকৃতির দুই মাথায় দুইটা প্রবেশের মুখ কিন্তু ওগুলোকে ঢাকনা দিয়ে যাতে করে বৃষ্টির পানি না ঢুকার ব্যবস্থা করা দরকার ওটা আর আমাদের কারোর মাথায়ই আসে নাই ।
একদিন সন্ধ্যা বেলা হটাত দেখি আমাদের গ্রামের দুঃসম্পর্কের ফুফুতো বোন জয়তুন বুবুর কাকা এসে হাজির - জয়তুন আমাদের সবাই কে কোলে পিঠে করে বড় করেছে - ও আমাদের পরিবারেরই এক সদস্য । সেই ছোট বেলা ওনার মা মরে যায় তারপর থেকে আমাদের কাছেই থাকতো। সবাই মিলে ওকে বিদায় দিলাম । গ্রামে নিয়ে গেল কারন শহর এর নিরাপত্তা কম । আমাদের রাস্তায় মোট পাঁচটা বাড়ি ছিল । ১০ ই এপ্রিল এর মধ্যে কেবল আমরাই রয়ে গেলাম । একবার প্লান করা হলো ট্রাকে বা নৌকায় করে সিলেট এর দিকে চলে গেলো ভালো হত তার কারণ আব্বা সিলেটে পোস্টিং তখন । আর কোনও রকমে ই পি আর এর কোনও বিওপি তে যেয়ে পরিচয় দিলে ওরাই ব্যবস্থা করে দিত । কিন্তু ১৫০ কি মি যাওয়ার মত ট্রাক বা অন্য কোন যানবাহন পাওয়া গেলো না । নৌকা পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মানুষ কেউ সাথে না থাকাতে ঐ স্বপ্ন পরিত্যাগ করতে হল। তেমন কাউকে আমরা চিনি না ; আমাদের পৈত্রিক বাড়ীতে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না কারণ ওটা একদম চট্টগ্রাম - সিলেট রেল লাইনের পাশেই - এবং পাকিস্তানিরা ততদিনে নাকি ঐ দিক ওদের কব্জায় নিয়ে নিয়েছে ।
একেবারে নীরব শহর - দিনেও রাস্তায় মানুষ কম । সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে সকল বাসায় ইলেকট্রিক লাইট জালায় না - হারিকেন বা কুপি বাতি জালায় সব , ফাইটার প্লেন থেকে যেন সব কিছু অন্ধকার দেখা যায়, এই জন্য তারপর ও শহরের সবাই খুব গর্বিত যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এখনও স্বাধীন এবং এখন পাকিস্তানিরা এই শহর দখল করতে পারি নাই। ঈদগাহ মাঠে বাসের লাঠি দিয়ে প্যারেড করানো সুরু হল সকালে এবং বিকালে ; সেই দূর দূর গ্রাম থেকে যুবকরা সাথের শহরের যুবক রা সব ৪ বেঙ্গলের তত্ত্যাবধানে মুক্তি বাহিনীর ট্রেনিং নিতে লেগে গেলো। একদিন হাটতে হাটতে সমীর দাদা এবং নিপু দের বাসার দিকে সাইকেল নিয়ে গেলাম - ব গুলো বাসায় তালা মারা ; নিপুর এলসেসিয়ান কুকুর টা বাসার গেঁটের ভিতর চেন ছাড়া দৌড়ে বেড়াচ্ছে , আমাকে দেখে ছুটে এলো মনে হল ও কুকুর তার বেশ খিদে পেয়েছে । হাতের হাতার ফল্ডিং ই ছিল ১ টাকা ওটা দিয়ে গাব্দা ( নাম ছিল ঐ এলসেসিয়ান টার) একটা বিশাল পাউরুটি খাওয়ালাম । বাসায় এসে আম্মা কে কানে কানে বললাম যে সব পরিচিত রা শহর ছেড়ে চলে গেছে । আমাদের কি উপায় হবে ? ব্যাঙ্ক তখন খোলা - মা পরদিন ব্যাঙ্কে গিয়ে কি কি সব নিয়ে ফিরল । সারাদিন বাসায় থাকি আর আকাশবাণী রেডিও ও বিবিসি তে খবর শুনি সবাই মিলে বসে বসে । বাসায় কাজের লোক নেই সব কাজ আমাকেই করতে হয় । দিন - রাত আর ফুরায় না । আমরা ভাবলাম আর যা হয় এভাবেই থেকে যাবো ।
ঢাকা থেকে এক পরিবার পরদিন এসে আমাদের বাসয় উঠল । ওদের কাছে সারা রাত আমরা বসে সব শুনলাম - যা বুঝলাম যে মানু আপাদের কলেজের হস্টেল এ পাকিস্তানিরা গুলি করেছে অনেক এবং অনেক ছাত্রী দের এরেস্ট করে নিয়ে গেছে ওদের ক্যাম্পে। ঢাকা শহর এখন একটা মৃত্যুপুরী । হাজার হাজার পুরুষ, মহিলা, শিশু দের পাকিস্তানি আর্মি হত্যা করেছে কম করে হলে ৫ - ৬০০০ মানুষ কেবল প্রথম রাতেই । বিশ্ববিদ্যালয় এ বেশ অনেক মানুষ এবং ছাত্র দের হত্যা করেছে । আম্মা লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করতে লাগলো । বিমর্ষ সেই স্মৃতি গায়ের লোম শিউরে উঠে । পরদিন ঐ পরিবার চলে গেলো ওদের গ্রামে । বাসায় সবাই বসে সিধান্ত নিলাম আমরা এই বাসা থেকে চলে যাব আমাদের পারিবারিক বন্ধু দারগা কাকার বাসার পাশে ওনাদের খালি আরেকটা ভাড়াটিয়া দেওয়া বাসায় । নিরাপত্তার জন্য । কারণ আমাদের এলাকা একবারে জনশূন্য হয়ে গেলো ১৪ই এপ্রিল সকালে । পহেলা বৈশাখ এর কোন কথায় নাই - এবারের নতুন বসন্ত কে কেউই সারম্বরে গ্রহণ করার মত মানসিক শক্তিই পেলেই না মনে হল । যা বলা তাই কাজ পরদিন সকালে দুটো রিক্সায় করে আমরা চলে গেলাম ওনাদের এলাকায় আর ঠেলা গাড়িতে অল্প কিছু সাময়িক সময়ের জন্য বিছানা বালিশ নিলাম বাসা টা ভালো করে তালা লাগালাম এবং জানালা গুলো তে কাঠের তক্তা পেরেক মেরে সীল করলাম ।
১৬ তারিখ সারা দিন চলে গেলো গুছাতে । রাতের বেলা আম্মা পোলাউ আর খাসির মাংস, শামী কাবাব, পায়েস রান্না করলো জয়তুন চলে যাবার পর থেকে আম্মার ই এখন সব কিছু করতে হয় । ভুঁড়িভোজন করলাম কিন্তু পায়েস কম পরে গেলো একটু আম্মা বলল কাল বাজার থেকে দুপুরের দোওানো টাটকা দুধ কিনে আনার জন্য । বলে সবাই ঘুমিয়ে পরলাম - এই এলাকাতে আবার রাতে ছাত্র রা এবং যুবক রা প্রহরা দেয় । হাতে লাঠি, বল্লম, রাম দা, চাপাটি তীর ধনুক, এক দুই জন আবার বন্দুক নিয়ে প্রহরা দিতে দেখলাম । বেশ আরামেই ঘুমালাম রাতটা । অলস সকাল কিছুই করার নাই । সবার মুখেই গুজব সারাক্ষণ , হতাহতের খবর আস্তে লাগল চতুরদিক থেকে। টাটকা ফ্রেশ পাউরুটি, কুমিল্লা বাটার, ডিম পোজ, দিয়ে খুব মজা করে সকালের নাস্তা খেলাম । প্রতিবেশীদের সাথে একটু পরিচিত হবার চেষ্টা করলাম । সবাইর চোখেই কেমন যেন ভয় । আমি কেমন জানি এখনও আশাবাদী এবং মনে মনে বেশ শক্ত যে আমারা হয়ত স্বাধীন এলাকায় থেকে যাব হয়ত । ইচ্ছাপ্রসুত; চিন্তা হয়ত । আমার মন আর বাসায় বন্দী থাকতে চাচ্ছিল না । বয়স ১০ হলেও আমি আমার বয়সী দের থেকে অনেক লম্বা ছিলাম তাই মনে হত ইস আমি যদি বাকিদের মত মুক্তি বাহিনী তে যোগদান করতে পারতাম । বাইরে কিছুক্ষণ গল্প করে বাসায় আসলাম এসে দেখি আম্মা খুব বিষণ্ণ হয়ে চেয়ারে বসে চোখ মুছছে - কাছে গিয়ে আম্মা কে জিজ্ঞেস করলাম , উত্তরে বলল, আব্বার ব্যাপারে আম্মা একটু চিন্তিত ।মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল হটাত । আম্মা বলল ভাত খেয়ে বাজারে গিয়ে দুই সের দুধ কিনে আনার জন্য । কখন যে বেলা ২ টা বেজে গেছে বুঝতেই পারলাম না । তাড়াতাড়ি করে দুমুঠো ভাত খেয়ে নিলাম - কে জানতো এই পোলাউ আর কাবাব এবং খাসীর মাংস ই হবে আমার শেষ আরামের খাওয়া - প্রশান্তির আহার !
বাজারের ভালো দুধ পাবার জন্য জলদি জলদি খেয়ে একটা কাঁসার জগ হাতে নিয়ে পাঁচ টাকার একটা নোট আমার কাছ থেকে নিয়ে দুধ আনতে বের হয়ে পরলাম । বাজার প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে , হেঁটে হেঁটেই রউনা হলাম রাস্তায় রিক্সাও কেমন জানি কম , তাই আর রিক্সার জন্য অপেক্ষা না করে হেঁটেই চলে গেলাম বাজারে । দুই সের দুধ কিনে আবার হেঁটে হেঁটেই ফিরলাম ; রাস্তায় দেখলাম ফোর বেঙ্গল এর একটা ট্রাক আরেক টা বাস কে টেনে নিয়ে যাচ্ছে , আর্মির ট্রাকে দশ বার জন সৈন্য - দেখলেই মনে সাহস ফিরে আসে - ওদের দেখতে লাগে কঠোর, সাহসী এবং বীরের মত । হাটতে হাটতে বাসায় পৌঁছে গেলাম - দরজা করা নেড়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালাম দেখলাম আকাশের পূর্ব কোনায় একটা কালো মেঘের আনাগোনা করছে - আকাশ টা কেমন জানি স্থবির, নিথর, সূর্য টা যে কোন সময় ঐ কালো মেঘে ঢেকে যাবে কি ? ঠিক তখনি আম্মা নিজে দরাজা খুলল । ভিতরে ঢুকেই টেবিলে দুধের জগ টা রেখে সাদা আর লাল চেক ফুল সার্টের হাতার ফ্লোড থেকে ভাংতি পয়সা বের করতে যেয়েই শুনতে পেলাম আকাশ যেন মাথায় ভেঙ্গে পরল মাথার উপর । প্রচণ্ড এক গগনবিদারী শব্দ এবং সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল বৃষ্টির মত গুলির আওয়াজ । সব ফেলে দৌড় দিলাম বাসার বাইরে আম্মা কে টেনে নিয়ে আসলাম আমার সঙ্গে ট্রেঞ্চ অভিমুখে ।
দ্বিতীয় পর্ব
মৃত্যু হামলা
যাহা বলা তাহাই কাজ, বাসার সবাই এবং অন্যান্য বাসা গুলো থেকে সবাই হুড়মুড় করে খোলা আকাশের নীচে এসে দেখতে লাগলো আর সিধান্ত নিতে লাগলো - দৌড়ের মধ্যে খানেই মাথার উপর দেখতে পেলাম চার তা যুদ্ধ বিমান আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ছে বিকট আওয়াজ করতে করতে ; কান এর পর্দা ফেটে যাবার মত অবস্থা - একেবারে নিচু দিয়ে বেশি হলে চারশ থেকে ৫০০ ফুট হবে ওদের দূরত্ব ; ভয়ে, আতঙ্কে, আওয়াজে, নিকটত্বে , হিংস চক্কর দেওয়া , বার বার ডানে আর বামে আকাশে ঘুড়ির মত বার বার গুত্তি (ডাইভ) দেওয়া এত কাছের থেকে দেখে বিহ্বল, কিং কর্তব্য বিমুড়তায় নিমজ্জিত সকলে । সবার চোখে ভয় আর কান্নার রোল চতুর্দিকে । সে যে কি আওয়াজ, সে যে কি গতি কিমি. করে হলেও ঘণ্টায় ২০০ মাইল বেগে শহর প্রদক্ষিণ করতে লাগলো- বাচ্চাদের কান্নায় এবং আর্তচিৎকারে সবাই বেদিশা ; মা সন্তান কে ফেলে দৌড়ে চলে গেছিল হয়ত অজান্তে - শিশুর কান্না শুনে প্রকিততস্থ হয়ে পিছনে ফিরে আবার সন্তান কে বুকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে দৌড় দিল । ছোট একটা গলিতএ বাসাটা আমাদের তখন - মাত্র কয়েকটা বাসা । ইতিমধ্যে প্রত্যেক এক মিনিটের মধ্যেই প্লেন গুলো শহর প্রদক্ষিণ করে আবার ঘুরে আসছে । কান্নার আওয়াজ, কে জানি অতি জোড়ে নিকটেই আযান দিতে শুরু করল, ব্রাহ্মন বাড়িয়া তে লক্ষ লক্ষ হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসবাস সেই ১০০০ হাজার বছরের অধিক সময় যাবত এই শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান ; গলির হিন্দু বাড়ী এবং পার্শ্ববর্তী পূজার মন্ডব থেকে শাঁখা আর কীর্তন সাথে সাথে ঘণ্টা বাজতে লাগলো অবিরাম । কুকুর গুলো ভয়ে ছুটাছুটি করতে লাগলো আর করুন সুরে কেমন জানি কান্না করতে লাগলো ; গলির শেষ মাথায় খোলা মাঠের মত জায়গাটাতে দুটো গরু ঘাস খাচ্ছিল ওরা তেরে মারল এক দৌড় ।
আওয়াজের সাথে সাথে গোল চক্কর মেরে শহর প্রদক্ষিণ করলো প্রায় আট দশ বার - মনে হচ্ছিল ওরা বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর অবস্থান খুঁজতে ছিল মনে হয়। আগের দিন রাতে দারোগা কাকার ছেলে আমার আপন বড় ভাইয়ের মত ওরা কয়জন বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, আমিও পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম - ওনারা বলাবলি করছিল - [মুকুল দাদা ( ইকবাল হোসেন খান - পরে অতিরিক্ত সচিব ) আওলাদ দাদা ( মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড - বি, বাড়িয়া ), মালেক ভাই ( ৭ নেতা হত্যার রাজসাক্ষী), কোহিনুর ভাই ( ৭ নেতা হত্যায় নিহত মহসিন হল, ৪ এপ্রিল ১৯৭৪ ), আওলাদ দাদাদের খালাতো ভাই ইঞ্জিনিয়ার ডিউক দাদা ] যে, সেদিন বিকালে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় তথা ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা বাংলার ছাত্র রাজনীতির চার খলিফার একজন মাখন ভাই ওদেরকে নাকি বলেছেন, ইস্ট বেঙ্গল তেলিয়াপারা চলে গেছে, হুমায়ুন ভাই ( বি, বাড়িয়া কলেজের জেনারেল সেক্রেটারি, পরবর্তীতে প্রতি মন্ত্রী - এক অকুতোভয় নেতা ) ওখান থেকে এসে মাখন ভাই কে জানিয়েছে ; এবং মাখন ভাই ও শহর ত্যাগ করবেন সহসা - শহর মুক্ত এলাকা হিসেবে থাকা সম্ভব না । এতো বড় পাকিস্তান আর্মি কে মোকাবেলা করার মত অস্ত্র এবং পর্যাপ্ত গোলাবারুদ নেই অযথা শক্তি সঞ্চয় না করে শত্রুর মোকাবেলা করলে প্রচুর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সৈনিক প্রাণ হারাবে অযথা । অনেক কিছুই বুঝলাম আবড় বার অনেক গুলো জিনিশ বোধগম্য হলনা - আমি নিজেই কেবল ১০ বছর ১১ ছুইছুই । এগুলো সব মাথায় মধ্যে ঘুরপাক খেলো কয়েক মিলি মাইস্ক্রো সেকেন্ডের এর মধ্যে । কানগুলো আর শব্দ গ্রহন করতে পারছে না । মাথা কেমন জানি চক্কর দিতে থাকল - বোন টুলু আপা , দুই ছোট ভাই ছোটন আর টুম্পা আমার সামনে দিয়ে দৌড়িয়ে ট্রেঞ্চ এর দিকে চলে গেল, আম্মা কি নিয়ে আমি দিলাম এক দৌড় - আম্মা কে ট্রেঞ্চ ঢুকতে সহায়তা করে আমি ধুঁকতে চেষ্টা করলাম বেশ টাইট অবস্থা - অনেক বড় গর্ত ছিল এদের এল সেপের ট্রেঞ্চ টার কিন্তু বেশ পানি , কালো কালো পিপড়া বড় গুলো, এক মুহূর্তের মধ্যেই পিপড়া গুলো আক্রমণ করতে শুরু করে দিল ।
ইংরেজি ''এল '' শেপের ঐ প্রান্তে কি যেন চেঁচিয়ে উঠল ট্রেঞ্চ ইঁদুর বলে এক লাফে বেরিয়ে পরল সঙ্গে সঙ্গে বাকি সব মহিলারা বের হবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পরল - আমি শেষ তাই আমাকে বের হতে হল । যে না বের হলাম আর ঠিক তখনি জমিন থেকে বিমান গুলোর উপর গুলি ছুড়ল ইস্ট বেঙ্গল এর সৈনিক রা ( পরে শুনেছি ) যাহা করা তার সাথে সাথেই বৃষ্টির মত গুলি ছুড়তে শুরু করলো বিমান গুলো - নেমে আসল আরও অনেক নীচে …। গুত্তি টা খায় আমাদের মাথার উপর দিয়ে ব্রাহ্মণ বাড়িয়া শহরের পি টি আই তালশহর এর দিকে থেকে আর উপড়ে উঠেই সঙ্গে সঙ্গে নীচে ডাইভ দিয়েই মেড্ডা - সুহিল পুর এর দিকে নেমে এসেই বোমা ফেলত লাগলো তিতাস গ্যাস এর দিকে । গুত্তি মেরে উপড়ে উঠার সময় ছুড়তে থাকে অঝোরে গুলি …। হাজার হাজার গুলি , বিদীর্ণ সেই শব্দ, আমার জিবনেও এতো প্রকট শব্দ কোন দিন শুনি নাই, ভয়ে থর থর করে কাঁপছি সবাই ; চোখ দিয়ে পানি নেমে আসছে অঝোর ধারায় । আর কয়টা মুহূর্ত বাচবো কিনা জানিনা । আজ এতদিন পর বর্ণনা দিচ্ছি খুব সহজেই কিন্তু তখন যে আমার কি অবস্থা তা যদি চিত্র শিল্পী হতাম তা হলে হয়ত রং আর তুলি দিয়ে ছবি একে একে বুঝাতে পারলো হয়ত আমার পাঠক দের সামনে তুলে ধরতে আমার আসল অবস্থা তা । ইস যদি তখন স্মার্ট থাকত !! ইতিমধ্যে এয়ার রেইড শেল্টার ট্রেঞ্চ থেকে সবাই বাইরে - অতক্ষণে কেবল ৫ - ৬ মিনিট সময় যাবত হয়ত বিমান হামলা সুরু হয়েছে হয়তবা । কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কয়েক ঘণ্টা যাবত আমরা নিপাতিত এই নরকে । চার চারটা বিমান দুই টা দুই টা এক এক সারিতে । অনবরত পাম্পিং করছে গুলি আর বোমা ; আমাদের বাসাগুলো থেকে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে কুন্ডুলি পাকিয়ে উঠে আসতে লাগলো ধুঁয়া , কালো ধুঁয়া আর গন্ধ ।
এই সব করতে করতে কেই কেই বেহুশের মত দাঁড়িয়ে আর কেই কেই মাটিতে ছোট ছোট গাছের নীচেই শুয়ে পড়ল - সবাই কান বন্ধ করার জন্য হাত দিয়ে কান চেপে ধরে থাকল সবাই । এরিমধ্যে আমরা সবাই যার যেমনে উঠেই দিয়াম দৌড় - এক দৌড়ে প্রায় ৫০ - ৬০ গজ দূরের পুকুরে । ভাগ্য ভালো যাওয়ার পথ ছিল আগাছা আর আম,, কাঁঠাল, লিচু গাছ সহ আনারস, সবজি, হলুদ গাছে ভরা । সবাই ঘাড় বেঁকে দৌড়ে পৌঁছে পুকুর পারে - চতুর দিকে প্রায় পঞ্চাশ টা বাড়ীর পিছন সাইডে এই পুকুর একটা ছোট্ট নালার সাহায্যে মদ্ধ্যপাড়া আর কাজিপাড়া বিভক্ত কারি খালের সাথে পুকুর /ডোবা টা সংযুক্ত । পিচ্ছিল, কর্দমাক্ত, ভাঙ্গা মাটির পাত্র ( টেরাকোটা বাসনপত্র) গুলোর ছোট ছোট টুকরায় পরিপূর্ণ পুকুরের( ডোবার ) পারগুলো। কোন কিছু ভাববার কোন অবকাশ নাই ঐ মুহূর্তে । এক এক করে সবাই যে যে দিকে নামার মত স্লোপ পেলো সে টি দিয়েই দুঘন্ধপূর্ণ ডোবায় অনেকটা ঝাঁপিয়েই পরল । সারা ডোবায় ভরা কচুরিপানায় ভরা - সেই সবুজ বড় বড় ডাটা /বৃন্ত সমৃদ্ধ জাতীয় এই ডোবার কচুরিপানা গুলো । দেখলেই ভয় লাগে - সাধারণ সময়ে এক হাজার নগদ টাকা দিলেও জীবনেও নামতাম কিনা এই পচা জায়গায় তা এক সন্দেহ । আমারা যেখানে নামলাম তার পাসে এবং উপড়েই চোখে পরল একটা বিশাল বেত গাছের ঝাড় । বিরাট বড় বড় ডাল পালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চতুর্দিকে এলোমেলো ভাবে ; বড় বড় কাটাগুল্ম , গায়ে খোঁচা লাগার সাথে সাথেই চামড়া কেটে গেল আর রক্ত বের হত লাগল - ভীষণ ব্যাথা ঐ কাঁটার বিষে। টুম্পা যেয়ে নেমেছে বেতের কাঁটা বনের ও পাড়ে - অনেক ডাকাডাকি করেও ওর কোন আওয়াজ নে পেয়ে উঠে যেয়ে ওকে নিয়ে আসলাম আমাদের কাছে।
ইতিমধ্যে প্রায় ১০ মিনিট হয়ে গেছে বিমান হামলার , কোন প্রকার ক্ষান্তি নাই , ডোবার পানি অনেক বেশি ঠাণ্ডা তার মধ্যে ভয় । এরইমধ্যে, কান গুলো সব ফেটে যাওয়ার মত অবস্থা। তৎকালীন বি বাড়িয়া শহরে তখন ছয় তালার উপর কোন বিল্ডিং ছিল বলে মনে হয় না । দু এক তা মসজিদের মিনার গুলো উঁচু ছিল ; যার কারণে বিমান গুল ২০০ - ২৫০ ফিট উপর দিয়ে উড়তে কোন অসুবিধা হচ্ছিলো না মনে হয় । বৈমানিক না হয়ত এটাও জানতো যে বিমানের গতি এতোই দ্রুত ছিল যে, বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর নিকট বিমান বিধ্বংসী কোন প্রকার অস্ত্র নেই যা দিয়ে এত দ্রুত গামী বিমান নীচ থেকে গুলি করে ভূপাতিত করতে পারবে । বিমান গুলো ভৈরব বাজার - তাল শহর প্রান্ত থেকে এসে গড়ির কাটার মত প্রদক্ষিণ করেই বি বাড়িয়া কুমিল্লা সড়ক এর উপর দিয়ে ডাইভ দিয়ে বোমা মারতে মারতে সরাইল - শাহবাজ পুরের দিকে যেয়ে মেঘনা নদীর কিনারা ধরে আবার
ভৈরব বাজার - তাল শহর প্রান্ত থেকে আঘাত হানতে লাগল প্রতি দুই থেকে তিন মিনিট পরপর । সারা শহরে কান্নার আর্তনাদ । আম্মা বললেন, সবাই ‘' লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবাহানাকা ইন্নি কুন্তি মিনাজ জওালিমিন ‘' দোয়া টা ক্রমাগ্রত পড়ার জন্য অনবরত । সারামুখে কচুরি পানার চুলের মত গেঁড় ( শিকড়) এ ভরে গেল । প্রত্যেক রাইন্ড এ যখনি প্লেন গুলো আসা সুরু করে ঠিক তক্ষুনি আমরা সবাই দোওা পড়তে পড়তেই পানিতে ডুব দেওয়া সুরু করলাম আর প্রত্যেক ডুবেই ঐ ডোবার পচা, দুর্গন্ধপূর্ণ, অস্বাস্থ্যকর , ত্রিশ চল্লিশ টা বাড়ির পিছন দিকের টিউবওয়েল এর পানি, গোসল এবং আনুসাঙ্গিক ব্যবাহার করা পানি, এবং আমার আজ আর বলতে দ্বিধা নেই যে ঐ পানিতে অনেক বাসা বাড়ির পয়প্রণালীর - মূত্রাধার এর আবর্জনা ও এই ডোবার পানিতে মিশ্রিত ছিল এতে কোন সন্দেহ নাই । অনেকে আবার ইতিমধ্যে ডোবার পানিতে বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত সাপ এর আনাগোনা দেখতে পেয়েছে বলে সবাই কে সতর্ক করে দিলো ।
ক্রমে ক্রমে কম করে হলেও ত্রিশ থেকে চল্লিশ জন ততক্ষণে ডোবায় আশ্রয় গ্রহণ করেছে । সারা শহরএ বাতাসে পোড়া বারদের গন্ধ এবং তিতাস গ্যাস এর আশেপাশে অনেক শিল্প কারখানায় আগুণের ফুল্কি মেড্ডা এলাকার দিকে আকাশে পিরামিডের মত উঠতে লাগল । সবার চোখেই এক মহা আতঙ্কের ভয় । ভিতি, মৃত্যুর শঙ্কা, শিশু এবং বাচ্চাদের জীবনের চিন্ত্য চোখে কেবল আতঙ্ক । ভয়ে, ঠাণ্ডা পানিতে নিম্মজিত অবস্থায় থাকতে থাকতে আমার সহ অনেকের ই হাইপোথারিয়া (শরীরের তাপমাত্রা অনেক নিচে নেমে যাওয়া ) শুরু হয়ে গেল ; দাঁতে দাঁতে কঙ্কণ শুরু হয়ে শরীরে কাঁপুনি আরম্ভ হল। হটাত দুই টা পর পর ডাইভ দিয়ে এক সাথে আট নয়টা বোমা নিক্ষেপ করেই বিমান গুলো চোখের নিমিষেই দিগন্তের দিকে হারিয়ে গেল … শব্দের একো আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল - কে জানি বলল শেষ বোমা গুলো নামাপ বোমা ও হতে পারে । সবাই সাবধান - জীবনেও এই প্রথম শুনলাম নাম টা । ডিউক দাদা বললেন সর্বমোট ৪২ মিনিট যাবত বিমান হামলা হল । বিমান গুলো চলে যাবার পরও ভয়ে অনেকেই পানি থেকে উঠতে রাজি হল না । পানিতে নামার সময় ভয়ে, তাড়াহুড়া এবং জীবন বাঁচানোর জন্য কেউই খেয়াল করে নাই যে ডোবার পার রায় ৬০ থেকে ৭৫ ডিগ্রী ঢালু । পানি থেকে উপড়ে ওঠে আসা তেমন সহজ ছিল না । গাছের ডালপালা - শিকড় ধরে কোন রকমে উঠে আসলাম কিন্তু বাকিদের উঠিয়ে আনা বেশ কষ্ট কর হয়ে উঠল । সবার ই কাপড় চোপর অবিনস্থ । চপচপে ভিজা ।
আমার দুই কানে পানি ঢুকে কান গুল বন্ধ এবং মনে হচ্ছিল কানের আর মাথার ওজন দশ গুন বেড়ে গেছে । আম্মা, টুলু আপা কে আমি আর আমার ছোট ভাই ছোটন হাত দিয়ে চেন এর মত বানিয়ে অনেক কষ্টে ডোবার কিনারা থেকে উঠালাম - এর মধ্যে চোখ দিয়ে অঝোরে কান্না - ভয়ে একেবারে তটস্থ, শীতে এবং প্রায় ৩৫ মিনিট এর উপড়ে ঠাণ্ডা পানিতে ডুবে থাকার ফলে হাইপোথারমিয়াতে প্রচণ্ড ভাবে আক্রান্ত যে কোন সময় জ্ঞান হারানোর মত শারীরিক অবস্থা । ক্ষিদাও পেল প্রচণ্ড - সাড়া শহর জুড়ে বিশাল কান্নার রোল পড়ে গেল । হাহাকার এর মত অবস্থা । মা ছেলে খুঁজছে, ছেলে বাবাকে খুঁজছে , ভাই ভাইকে নাম ধরে জোরে জোরে চিৎকার করে ডাকছে । পানি থেকে আমারা চারজন উঠে এসে সেই ভিজা কাপড়েই বাসার সামনের উঠান জাতিও খোলা জায়গায় শ্বাস প্রশ্বাস নিয়িমত করাড় জন্য শুয়ে পরলাম আর ভয় কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করতে লাগলাম । সম্পূর্ণ ভাবে অপ্রকিতস্থ সবাই । অনেক গুল অগ্নি স্ফুলিঙ্গ আকাশে দেখা গেল । কলেজ এর দিকে , রেলওয়ে স্টেশন এর প্রান্তে, কোকিল টেক্সটাইল মিলের দিকে সন্নিকটে কোর্ট কাচারির দিকে, মেড্ডা, জগত বাজার, কুমারসিল রোড, ওয়াপদা পাওয়ার হাউস এলাকা সব দিক থেকেই মনে হল আগুন আকাশে উঠে আসতে লাগল - বাতাসে পোড়া পোড়া গন্ধ - সে যে কি এক ভয়ানক এবং ভয়াত্তক দৃশ তা লেখার মত শব্দ আমার জানা নেই - আমি ততক্ষণে ক্লান্ত, আমি একটু আমার বয়সী অন্যান্য দের চেয়ে বেশ লম্বা ছিলাম যদিও তার পর খেলাধুলায় ও ভালো ছিলাম তুলনামূলক ভাবে, আব্বা সেই ৮-৯ বছর বয়েসেই আমাকে বড় বড় টিলা এবং পাহাড় এ নিয়ে যেয়ে বলত না থেমে দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে ওগুলো বেয়ে উঠার জন্য এবং অকপটে আমি সেগুলো করতে পারতাম অবলীলায় কিন্তু সেদিন আমি নিজেকে পরাজিত মনে করতে লাগলাম ।
আম্মার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না । খুবি বিচলিত মনে হল ; আম্মা খুব রাশভারী মানুষ, খুবি আত্ম সচেতন ; কিন্তু মাটিতে ভিজা কাপড়ে একদম বাক্যহীন ভাবে শুয়ে রইল । ঘরের ভিতর ঢুকতে কেমন জানি ভয় ভয় । ইতিমধ্যে প্রায় আর চল্লিশ মিনিট প্রায় পার হয়ে গেল বেলা তখন প্রায় ৬ টা বাজে বিমান গুলো চলে গেছে ; অনেক এ বলাবলি করল আবার রাতে আস্তে পারে - শহরে বিদ্যুৎ নাই - ইলেকট্রিসিটি স্টেশন কে জানি বলল পুরে গেছে । ভিজে কাপড়, কাদায় ভর্তি , কাল কাল দাগ সর্বত্র, সার্টের হাতা দু এক জায়গায় কাঁটা কিংবা অন্য কিছুতে লেগে ছিড়ে গেছে । শরীরে এক ফোটা শক্তি নেই , আস্তে আস্তে দাঁত খিচুনি বন্ধ হতে লাগলো কিন্তু ঠাণ্ডা কমছে না কোন মতেই । একসময় কখন যে চোখ বন্ধ হয়ে এলো তা বুঝতেই পারি নাই , হঠাৎ কি জানি আমার নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করলো বেশ জোরেজোরে মুন্না মুন্না এবং শাহিন বলে ( শাহিন নামে আমাকে সবাই আমাদের গ্রামে চিনে কারন আমাদের দাদী আমাকে এই নামেই ডাকত - শাহিন ই ছিল আমার প্রথম নাম পরে নাকি আব্বা নাম বদল করে ইমারান রেখেছেন কিন্তু দাদী আর নাম বদলায় নাই - উনি আমাকের আমৃত্যু শাহিন নামেই ডাকতেন তাই গ্রামের সবাই এখনও আম্যাকে ঐ নামেই ডাকে - মুন্না আমার ডাক নাম ) আমার দুটো নাম একসাথে ডাকা শুনে লাফ দিয়ে উঠলাম । বাইরে এসে দেখি আমার আব্বার সবচে’ বড় কাকা নুরুল হক চৌধুরী দাদা তাঁর লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে ; আমাকে দেখতে পেয়েই জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলেন তোমারা এই বাসায় কেন আমি তোমাদের কে খুঁজতে ঐ বাসায় যেয়ে বিমান হামলায় পরে গেলাম আমি তো তোমাদের না পেয়ে বিমান হামলার সময় বাসার সামনের বারান্দার সিঁড়ির পাশেই শুয়ে আশ্রয় নিলাম । বিমান হামলার এক দুই মিনিট আগেই বলল এখন তোমরা এই জায়গায় চলে এসেছো ঐ খানে সারা রাস্তায় একমাত্র বাড়িতে তোমরা একা তাই । তারপর ভাবলাম কোথায় যেতে পারো , অনেক চিন্তা করে বের করলাম এখানে ছাড়া আর কোথাও যেতে পারো তাই সোজা খাল পায়ে হেঁটে বরাবর এইখানেই চলে আসলাম । দাদা কে দেখে অনেক আশস্থ হলাম ; প্রায় ৬ ফুট লম্বা, বিশাল এক সাদা সফেদ দাড়ী, মোছ গুলো তাও দেওয়া, ভীষণ গম্ভীর চেহারা, হাতে তাঁর একটা লাঠি, স্পেশাল ধরনের এই লাঠি টা অনেক দিন আগে একবার আমাকে দেখিয়েছিল , ঐ লাঠির ভিতরে এক টা লম্বা তরবারি লুকিয়ে আছে, হাতল টা তে একটা ছোট কিল্প আছে ঐ কিল্প টা রিলিজ করে লাটির নিচের অংশ ধরে তান দিলেই হাতল অংশে বেড়িয়ে এক সাদা ইস্পাত দিয়ে বানানো তরবারি অনেক ধার এবং চিকন ১.৫ ইঞ্চি থেকে ক্রমান্বয়ে সরু হতে হতে একদম সরু হয়ে জায় শেষ মাথায় শেষ পর্যন্ত একটা দুই ইঞ্চি পেরেকের মত আকার ধারণ করে ; বললাম এটা কেন দাদা, বলল আমি কামরুপকাম্মাখা থানা আসাম পুলিশের লিটারেট কনস্টেবল ছিলাম ১২ বছর , তখন থেকে এটা আমি আত্মরক্ষার জন্য সব সময় সঙ্গে রাখি শহরে আসলে , সুঠাম দেহের অধিকারী এখনো, গত ২৫ বছর যাবত আবসরপ্রাপ্ত । কামরুপকাম্মখা থেকেই নাকি উনি অনেক ব্ল্যাকম্যাজিক শিখেছেন বলতেন । প্রত্যেক মাসের ১৫ - ২০ তারিখের মধ্যে তিনি আসেন বি বাড়িয়াতে ওনার পেনসন উঠাতে । বেশ প্রভাবশালী উনি নাকি এলাকাতে । এক সময় এক দুর্ধর্ষ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন নাকি উনি । আমার আব্বা উনার খুবি আদরের ভাতুস্পুত্র, আব্বা ওনার বড় কাকা কে খুবই শ্রদ্ধা করতেন । ওনাকে হাট ধরে ভিতরে নিয়ে গেলাম ; উনি আমাদের সবাই কে আদর করে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বললেন , ‘' তুমরা ডরাইও না - দাদা আইয়া পরছে, আর কুনু ডর নাই , অক্বন ( এখন) চল আমার লগে, শহরে তাকা (থাকা) আর সেফ না ‘' । বলেই আম্মা বললেন বউ মা , চল অক্কন ( এখন ) , বেইল ( বেলা ) তাকতে তাকতে বাইর হইত অইব ( হবে ) । আম্মা ওনাকে দেখতে পেয়ে দাদা কে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন । উনি দুস্তর মত হাঁপাচ্ছিলেন পুরা সময় টা । বড় বড় শ্বাস নিচ্ছিলেন - আর বললেন ''আমি তুমরা রে ইহানে রাইখ্যা কোন খানে যাইতাম না ।’' শহরে সারা রাস্তা হুইন্না আইছি যে কোন সময় পাকিস্তানি আর্মি কুমিল্লা ভৈরব বাজার আর আহাউরা ( আখাউরা) দিয়া আইয়া বাওনবাইরা ( ব্রাহ্মনবাড়িয়া ) দহল ( দখল ) কইরা লাইবো । ‘' আম্মা জিজ্ঞেস করল, কাকা আমরা কোথায় যাবো ? দাদা বললেন , ''ইতা অক্ষন বাবনের (ভাববার) হম ( সময়) নাই , মা’রে তাগদা কর, হাতে হময় নাই রে মাগো । ‘' বলেই আমাদের সবাই কে বলল লও সক্কলে তাগদা তাগদা বাইর হও হাইঞ্জা( সন্ধ্যা) হইবার আগে । আম্মা কি যেন ভাবলো মিনিট খানেক, আমরা সবাই আমি, তুলু আপা, ছোটন ও টুম্পা অবাক এবং নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছি; তখনো ১০০% ভাগ প্রকিতশ্ত হই নাই তখনো । কানে তখনো কম শুনছি, মাথা ঠিক মত এখনো কাজ করছে না । ইতিমধ্যে, একটা ঘোষনা শুনতে পেলাম যে পাকিস্তান আর্মি আখাউরা এবং ভৈরববাজার দিক থেকে সমান ভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে ; রেল স্টেশনে খবর এসেছে ; দাদা আর বললেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া টু কুমিল্লা রোডের তিনলাখ পীরএ পাকিস্তান আর্মির জিপ এবং ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে । এইসব কিছুই হচ্ছে কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে , আম্মা হটাৎ বলল চলেন কাকা আমরা আপনার সঙ্গে যাবো - এতো গুলো বাচ্চা নিয়ে আর এভাবে এখানে আর থাকে লাভ নাই ; কিন্তু কোথায় যাবো কাকা । দাদা বললেন মা আগে চলো এখান থেকে বের হও তারপর দেখা যাবে কপালে আল্লাহ কি রেখে রেখেছে দেখা যাবে । যাহা বলা তাই কাজ , সবাই হাতের কাছে যা পেলাম তাই একটা শাড়ী দিয়ে পোটলা বানিয়ে বের হয়ে পরলাম । আম্মার কাছে শুধু কয়টা সোনার গয়না আর বোনের পরনে একটা চেন আর দুটো চুরি, আম্মা বাকি সব তালা একটা মেরে চাবিটা দারোগা কাকার বাসায় দিয়ে ওনার তিন মেয়ে বকুল আপা, ইভা এবং রিটা কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয় বলল তোরা পারলে আমার বাসাটার সব জিনিশ পত্র এখানে নিয়ে আসিস । কাকা আর ওনার স্ত্রী আমরা ওনাকে মামীমা বলে ডাকতাম ওনার ছেলেদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পরলাম প্রায় পাগলের মত । ভয়ার্ত চোখে, চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বেড়িয়ে পরলাম । ম্যান রোডে এসে তিনটা রিক্সা নিলাম । আমরা জানিনা কোথায় যাচ্ছি ।। দাদা বললেন কান্দির পার যাবার জন্য । অনেক দূরে শোনা যাচ্ছিলো বিশাল বিশাল কামানের গোলা ছোড়ার আওয়াজ । ঘোড়াপট্টি ব্রিজ পার হয়ে বামে কান্দিরপাড় রোডে উঠেই দাদা কি ভেবে বলল রিক্সা ছেড়ে দিয়ে আমরা সবাই হাটা শুরু করলাম । ব্রিজ পার হবার সময় দেখলাম পুলিস থানার শেষ প্রান্তে নদীর পার ঘেঁষে টান বাজার এর বড় বড় গুদাম গুলো জ্বলছে , ঘোড়াপট্টি স’ মিলের ভিতর অনেক মানুষের ভিড় ওখানে একটা অবিস্ফোরিত বোমা দেখছে কয়েক শত মানুষ, রিক্সা ওয়ালা বলল কে, দাস এর মোড়, আনন্দ বাজার, জগত বাজার , সড়ক বাজার সব খানেই আগুণ আর আগুণ । বলল পাঁচ ছয় জন মারা গেছে , পঞ্চাশ জন এর মত আহত ।
চতুর্দিকে হিন্দুদের উলির আওয়াজ আর শাঁখার শব্দ, জগত বাজার, টান বাজার, সড়ক বাজার এই এলাকা গুলো শতকরা ৯০ শতাংশ হিন্দু বসতি । ঘোড়াপট্টী - থেকেই কাদিয়ানী এলাকা, কান্দিরপার এ ছিল ওদের সাদা সফেদ বিশাল এক কাদিয়ানী মসজিদ, মসজিদে তক্ষণ মানুষ ধুকছে আর বের হচ্ছে , হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় দেখলাম বামে মোড় নেওয়ার আগে সোজা টি , এ. রোড যতদূর নজর যায় ফারুকি মার্কেট আর সিনেমা হল পর্যন্ত । দেখলাম আনসার আর মুজাহিদ রা ছোটাছুটি করছে । সারা শহরে বারুদের একটা গন্ধ । স্বৈর চোখেই আতঙ্ক । কান্দিরপার ছুটছে হাজার হাজার মানুষ নদীর দিকে; ওখান থেকে অনেকেই গয়না নৌকা এবং ছোট ছোট ছই ওলা নৌকা নিয়ে সরে পারতে চায় শহর থেকে । অনেক দুরে আকাশে ধুঁয়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে মেড্ডা - কালিকচ্ছ - কালীবাড়ির দিকে । আব্দুল্লাহ ডিপটির বাড়ীর সামনে যে ছোট ভক্সওয়াগন গাড়ীটা শহরে ছোটাছুটি করছে চতুর্দিকে । এসব দেখে এসেছি একটু আগে, এখন সব কেমন যেন মনের সেলুলয়ডে পুনঃ অনুচিন্তন হতে লাগল । আমি খুবই ভীত এবং সন্ত্রস্থ । কোন কিছুই সহজ ভাবে ভাবতে পারছি না । হেঁটেই চলছি এক ধরনের মেশিনের মত, উপলব্ধি নেই আমি প্রকিতস্থ , যদিও শহরে মাইকিং করা হয়েছিল যে, মুক্ত এলাকা হিশেবে যে কোন সময় এয়ার রেড হতে পারে আপনারা এয়ার রেড হলে কি করবেন সব বলা হয়েছিল - কিন্তু ঘুণাক্ষরেও আমি কিংবা কেউই মনে হয় ভাবতেও পারে নাই যে পাঞ্জাবীরা আমাদের উপর এই রকম নিসংস ভাবে বিমান দিয়ে নিজের দেশের জনগণ কে এভাবে আক্রমণ করতে পারে ।
আমার পরনে ক্রিম কালারের একটা হাফ শর্টস (প্যান্ট ) আর সাদা এবং লাল স্ত্রাইপ দাগ দাগ ফুল হাতা শার্ট, জানুয়ারি মাসে দুটোই এক সাথে বানিয়েছিলাম আমাদের পরিবারের প্রিয় নিউ মার্কেটের হুসাইন টেইলর থেকে বানিয়েছিলাম । পায়ে এক জোড়া বাটা কোম্পানির চামড়ার স্যান্ডেল । কাপড় তখনো আধা ভিজা । মাথায় আমার পোটলাটা । এক হাতে টুম্পা কে ধরে ধরে হাঁটছি । আম্মা ধরে রেখেছে ছোটন কে আর টুলু আপার ঘাড়ে আরেকটা পোটলা । আমরা আধা হাঁটা আর আধা দৌড়ে এগিয়ে চলেছি এক অগস্থ যাত্রায় । রাস্তায় আমাদের মত শত শত পরিবার দল বেধে বেধে আগিয়ে যাছে অজানার পথে , কেউ যাচ্ছে তাদের গ্রামের বাড়িতে, কেউ ছুটে চলছে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে, কেউ আমাদের মত ছুটছে অজানার উদ্দেশে , প্রানের ভয়ে, ফেলে যাচ্ছে পিছনে নিজের হাঁতে গড়া বিস বছরের সংসার কে, পূর্ব পুরুষের স্মৃতি বিজড়িত বসত বাড়ি থেকে সব কিছু, সব স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি, সহায় সম্পত্তি ছেড়ে , এ্যালবাম, পরিবারের সব জমানো টাকা পয়সা, ছবি, বংশের পুরুষানুক্রমে সংরক্ষিত আসবাব পত্র, বাসনকোসন এবং সুখের নীড় পিছে ফেলে । রাস্তায় অনেক যুবকরা এবং ছাত্র নেতারা পানির কলস এবং জগ ও গ্লাস হাঁতে দাঁড়িয়ে আছে পথিক পানি পরিবেশন করার জন্য । সবার মুখে এক গ্লানি, ভয়, বাচ্চাদের আর্তনাদ, পিতা মাতার চোখে অনিশ্চয়তা । চলছি দৌড়ে আর হেঁটে সম্মুখে, শুকনো গলায় বার বার পানি খেয়েও তৃষ্ণা যেন মিটে না । দুপুরে বাজার থেকে ক্রয় কৃত দুধ গুলো টেবিলেই পরে রইল ওভাবেই পায়েস আর পাতিশপ্তা পিঠা খাওয়া হল না । খুদা আর তৃষ্ণা নিয়ে হেঁটে চলছি তো চলছি শহর এর প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছানোর আগে দুরে মাইকে শুনতে পেলাম ক্ষীণ স্বরে বঙ্গবন্ধুর সেই অমোঘ ভাষণ…” এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’'।
তৃতীয় পর্ব
দি এক্সোডাস
সন্ধ্যা প্রায় সমাসন্ন সূর্য আস্তে করে ঢলে গেছে পশ্চিম আকাশে আমাদের ডান দিকে আমরা প্রায় দৌড়িয়ে চলছি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর কে পিছনে ফেলে উত্তর দিকে কান্দির পার দিয়ে পাওয়ার হাউস রোড ক্রস করে রেল লাইন অতিক্রম করে নিয়াজ মোহাম্মাদ স্কুল কে হাতের ডান দিকে রেখে দৌড়াতে লাগলাম, শরীরে আর কোন শক্তি নেই রেল লাইন ক্রস করলাম এক জন এক জন করে সরু একটা ১ থেকে দেড় ফুট চওড়া একটা রাস্তা দুই পাসে বিশাল একটা ডোবা রেল লাইন ঘেসে বিস্তৃত । একটু সচেতন না হলেই খুবই গভীর জলাশয় ডুবে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা । রেল লাইন খুবই ব্যস্ত সবাই পার হওয়ার আগে এক জন জন করে রেল লাইনের অতি সন্নিকটে যেয়ে ঘাপটি মেরে বসে কিছুকক্ষন তার এক দৌড়ে ওপারে যেয়ে আবার ঘাপটি মেরে বসে । তার পর নীচে নেমে যাচ্ছে । সে এক ভীষণ ভয়ার্ত মুহূর্ত , আম্মা বার বার পিছন ফিরে দেখছে আমাদের - পা গুলো আর চলতে চাচ্ছে না সামনের দিকে । আমি সবার পিছনে আমার সামনে টুম্পা তার পর বোন তারপর ছোটন এবং আম্মা, দাদা সবচে আগে । খালি শুনলাম দোয়াটা পড়তে । গলা একদম শুকনো, পিটে প্রচণ্ড খিদা , তার মধ্যে এই চিকন এক চিলতে মেঠো কর্দমাক্ত সরু আইল দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে চলা যে কি কষ্টকর তা হারে হারে টের পাচ্ছিলাম প্রতিটি কদমে । দাদার বয়েস কম করে হলে ৬৫ থেকে সত্তুর হবে কিন্তু মানুষ টা অনেক সবল। চোখের পানি আর নাকের পানি আর চোখের পানিতে আমরা তিন ভাই একাকার । কামানের গোলার আওয়াজ ক্রমাগত মনে হলে সন্নিকটেই আসতে লাগল - অনেক দূরে ইয়া আলী - আল্লাহ হু আকবর আওয়াজ আর তার পড় পড়ি ব্রাশ ফায়ারের শব্দ আর আমাদের মুখে শুধু লা ইলা হাঁ ইল্লা ………………মিনাজ জওালিমিন । কয়েক লক্ষ বার পড়ে ফেলেছি এর মধ্যে । আমাদের পিছনে লম্বা এই আইলে আরও কম করে হলে ৫০ জন হেঁটে আসছে রেল লাইন পার হতে । অনেক দূরে আখাউরার দিকে রেলের ডিজেল ইঞ্জিনের হুইসেলের আওয়াজ শুনে মনে হল এই বুঝি এই ইঞ্জিনে করেই আসছে পাঞ্জাবি রা আমাদের দিকে ; এসেই এক ব্রাশ ফায়ার এ শেষ করে দিবে । মৃত্যু ভয় যে কি কঠিন এক অগ্নিপরিক্ষা যে তা আমাকে এবং পরিবারকে এভাবে মোকাবিলা করতে হবে তা কোনদিনও স্বপ্নেও ভাবি নাই । ভয়ে, ক্লান্তিতে, লজ্জ্যায়, দ্বিধায় ক্ষুদা এবং পানির তৃষ্ণায় সেদিন টা এভাবে শুরু হবে এই গোধূলি বেলা ভাবতেই কেমন জানি নিথর হয়ে পারি আজও এতগুলো বৎসর পরেও । আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেমে আসলো । পূর্ণিমার চাঁদের অর্ধ অংশের রাত ছিল ঐ রাতটা - এটা সেই রাত যে রাত কে জীবনেও ভুলব বলে মনে হয় না । একে এক আমরা ছয় জন রেলইন অতিক্রম করে স্কুল হোস্টেল টা কে ডান দিকে রেখে রাস্তা ফেলে জমিনের ভিতর দিয়ে হাটতে লাগলাম । উঁচু নিচু চাকা চাকা মাটির বড় বড় টুকরা পূর্ণ জমি গুলো । অনবরত গুলির আওয়াজ ; শহর টা কে আস্তে আস্তে পিছনে ফেলে আস্তে লাগলাম । শহরে কোন বিদ্যুৎ নাই । অন্ধকার মাঝে মাঝে দু একটা ছোট ছোট বাতি দেখতে পাওয়া যাচ্ছিলো রেলওয়ে লাইন মধ্যে খানে উঁচু হওয়াতে ফেলা আসা শহর কে আর দেখা যাচ্ছিলো না পরিষ্কার ভাবে । টুম্পা আর পারছিলো না আম্মা ওকে কোলে নিয়ে হাঁটার চেষ্টা করল ; এটা দেখে দাদা ওকে ওনার ঘাড়ে নিয়ে হাটা শুরু করল । ৪৫ থেকে ১ ঘণ্টা হাঁটার পর খালের পারে এসে পরলাম অনেক দূরে একটা নৌকা আমাদের দিকে আস্তে দেখলাম ; খালের পাড়ে খোলা আকাশের নীচে, মাটি তে বসে একটু বিশ্রাম করার চেষ্টা করতেই দাদা এসে বলল চল সবাই ডান দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া - কুমিল্লা রোডের দিকে একটা স্লুইচ গেঁটের উপর দিয়ে হেঁটে পার হবার জায়গা আছে । অনেক গুলো সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে উঠে তারপর একটা ব্রিজের মত পাটাতন দিয়ে হেঁটে খাল তা পাড় হলাম এন্ডারসন ক্যানাল । ততক্ষণে রাত নেমে এসেছে । । অনেক দূরে ছিএন্ডবি রোডে দেখতে পেলাম অনেক গুলো গাড়ী লাইন ধরে এগিয়ে আসছে কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে । কম করে হলেও পঞ্চাশ থেকে ষাট টা এক বিরাট কনভয় । দাদা বললেন ঐ যে পাকিস্তান আর্মি আসছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশে ; ভাগ্য ভালো তোমরা আমার সাথে চলে আসছ । আম্মা প্রায় করুন কান্না কান্না স্বরে দাদা কে ধন্যবাদ দিল । পানি পিপাসায় সহ্য না করতে পেরে খেতের মধ্যে চাদের আলো বিকরণ হওয়া দেখে মনে হল জমিনে একটু পানি জমে আছে - উপায়ান্তর না পেয়ে আমরা সবাই প্রাণ ভরে জল পান করলাম । কিছুদূর যেয়ে একটা মেঠো পথ আবিষ্কার করলাম পূর্ব পশ্চিম দিকে যাওয়ার রাস্তা - পশ্চিম দিকে গেলে শেষ মাথায় পথ টা মিলবে ছিএন্ডবি রোডে ( কুমিল্লা - ব্রাক্ষণবাড়িয়া ) যে দিকে যাওয়া আর আত্মহত্যা করা সমান হবে । তাই পূর্ব দিকে আখাউরার দিই অগত্যা হাটতে সুরু করলাম । মেঠো পথের দুই পাসেই জমি গুলো তে হাঁটু সমান ফসল কয়েকটা তে আর প্রান্তর এর প্রান্তর খালি জমি । আমাদের আসে পাসে আর কোন জন মানব নেই । সেই সন্ধ্যা ৬ টা থেকে হেঁটেই চলছি আমরা ; প্রায় ৪ /৫ মাইল দূরে প্রথম আলো দেখা গেল । পিছন দিকে মেন রোডের গাড়ী গুলো নিকট থেকে নিকটতর হতে লাগলো , আকাশে আখাউরার দিক থেকে আকাশ প্রজ্বলিত করে কামানের/ আরটিলারি সেল গুল উড়ে যাচ্ছে শহরের দিকে গোলা গুলো দুবার বিকট আওয়াজ করে প্রথমে গোলা কামান থেকে বের হওয়ার সময় আর কয়েক মিনিট পর যখন টার্গেটে আছাড় খেয়ে পরে । সে এক বিকট গগনবিদারী শব্দ । প্রত্যেক বার বোমা গুলো আকাশে উঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই মাটিতে শুয়ে পরি মেঠো পথের পাশের নিচু গর্তে চোখ বন্ধ করে কানে হাত দিয়ে আর অপেক্ষায় থাকি কখন আবার শব্দ করে বিস্ফোরিত হবে , ভয়ে চোখে পানি আসতে শুরু করে প্রত্যেক বার আর অঝোরে উচ্চারণ করতে থাকি আমার শিখানো দোয়া টা । প্রতি ১০- ১৫ মিনিট পর পর ই একটা করে বোমা আসতে থাকে আখাউরা থেকে শহরের দিকে , দূরে ভৈরব এর দিক থেকেও গোলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল ক্রমান্বয়ে । রাস্তা আর শেষ হয় না, দূরের ঐ গ্রাম আর কাছে আসে না । রাত এদিকে বাড়তে থাকলো , কারো সাথে কারো তেমন কোন কথাবার্তা নাই , আসলে কথা বলার মত কোন শক্তি ও নেই শরীরে । ভিজা হাফ প্যান্ট , ভিজে ভারি হয়ে যাওয়াতে এবং এই ভিজা অবস্থায় দৌড়ানো ও এত পথ হাটার কারণে ঘর্ষণে ঘর্ষণে কুচকির চামড়া ছুঁলে যাওয়াতে দস্তুর মত রক্ত বের হতে লাগলো । সাথে ভীষণ ব্যথা পেতে শুরু করলো , কিন্তু এখন এসব ছোট খাটো ব্যাপার নিয়ে কথা বলার সময় নাই , আমার জীবনেও আমরা কেউই এত পথ হাটি নাই কখনো। আমাদের পিছনের ছিএন্ডবি রোডের উপর দিয়ে আসা গাড়ীর কাফেলা থেমে গেল পথিমধ্যে । গাড়ীর হেড লাইটের আলো গুলো আর নড়াচড়া করছে না । দাদা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে যেন কি সব দেখার চেষ্টা করলেন বুঝলাম না । উনি আবার হাটা শুরু করলো আর আমাকে বললেন, জলদি চলো বউ মা , এই রাস্তাটা দিয়ে ঐ পাপিস্ট আসতেও পারে কাড়ন মেন রোডে অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে তাই হয়ত ওরে ওইখানে থেমে রাস্তা এইটা দিয়ে আখাউরার দিকে যেয়ে রেল লাইন ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ঢুকতেও পারে । এটা শুনে গলা আরও শুকিয়ে গেল। শরীরে আর কোন শক্তি বাকি নাই সামনে এক কদম যাওয়ার । দাদা বললেন আজ রাতের ভিতরেই পাক বাহিনী শহর দখল করে নিবে । কাল সকালেই হয়ত ওরা ঢাকার মত হত্যাযজ্ঞ চালাবে শহরে । যাহা বলা তাহাই কাজ; আমাদের পিছনে ফেলে আসা গাড়ির কনভয় গাড়ি গুলো থামিয়ে ওখান থেকেই ছুড়তে লাগলো অবিরাম গুলি বর্ষণ , মনে হল আমাদের দিকেই তাক করে গুলি গুলো করছে । আর কত দৌড়াবো । আমারা ৬ জনই কেবল হাঁটছি এই গ্রাম ছাড়া এই মেঠো পথে ভাগ্য আমাদের খুবিই সুপ্রসন্ন ছিল ঐ রাতে যে আকাশে চাঁদের আলো ( সম্পূর্ণ চাঁদ না - শেষ চতুরাংস - ৪র্থ কোয়ার্টার ) তা না হলে সেদিন আমাদের পক্ষে এতটা পথ রাতের আধারে হাঁটা সম্ভব হত না । একটু দূর যাবার ও পর একটা গ্রামের মত কিছু সামনে আছে মনে হল দূর থেকে । এতক্ষণে বোন টুম্পাকে কোলে নিয়ে নিলো বেচারা আর কোন মতেই এগুতে পারছিল না । আম্মা ছোটোন কে হাঁতে ধরে ধরে টানছে সামনে আর আমার মাথায় দুইটা পোটলা। আম্মা এরই মধ্যে, জোড়ে জোড়ে বললেন , ‘' কে আছো জওয়ান হও আগোয়ান হাকিছে ভবিষ্যৎ, এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার , দুর্গম ও গিরি কান্তার মরু দুস্তরও পারাপার, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার । ‘’বিপদে আম্মার এই এক ধরনের ইস্পাত নির্মিত কঠোর আত্মবিশ্বাস দেখে বেশ সাহস পেলাম । আমাদের পরিবারে আমরা আব্বা কে খুব একটা ভয় পেতাম না, আব্বা ছিল আমাদের কাছে সহজ সোজা হাসি তামাসা নিয়ে বিভোর একজন নরম পিতা আর পক্ষান্তরে আম্মা ছিল মজার মজার খাওয়া, শাসন, পড়াশুনা, ইংলিশ ডিক্সেনারি মুখস্থ করা, উচ্চারণ, বানান ও বাংলা অর্থ জানা, গীতাঞ্জলী, সোনার তরি, বঙ্কিম চন্দ্র, নজরুলের অগ্নিবীণা, বিমল মিত্রের কড়ি দিয়ে কিনলাম অথবা গ্রীক মাইথোলজির( গ্রীক পুরাণ ) এর গল্প শোনা উনি পরতেন । হটাৎ হটাৎ এক দিন ফটিক নাটকের ফটিক চরিত্রের অভিনয় করে দেখাতে হত । আবার গানের আসরে গান গাওয়া , কিংবা বড় বড় কবিতা মুখস্ত আবৃতি করা , ওথেলো, মার্চেন্ট অফ ভেনিস, রোমিও জুলিয়েট এবং সেক্সপ্যিয়ার সম্পর্কে এক টা বিরাট গল্প বলা এই জানতাম আম্মাকে কিন্তু আজ সেদিন দেখলাম আম্মাকে অন্য রূপে ।
হাঁটছি আর অনেকটা চোখ বুজে যাচ্ছে ; ঘুমিয়ে পরার মত অবস্থা - অবিরাম গুলাগুলি চলছে , আবার দেখলাম গাড়ির হেড লাইট গুলো চলন্ত । আখাউরার কামান গুলো এখন আধাঘণ্টা পরপর ফায়ার করছে মনে হল। গ্রামটা আরও কাঁছে চলে আসল ইতিমধ্যে কিন্তু মহা বিপদ হল গ্রাম আর আমাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া - আখাউরা রেল ওয়ে লাইন ; রেললাইন তখন প্রায় তিন শত গজ দূরে আমরা শ্রীরামপুর এর ঐ দিক থেকে খোলা চাষ করার জমিনের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া একটা মেঠো পথ দিয়ে হাঁটছি সুহাটার দিকে তারপর মাছিহাটার নিকটে এসে দেখতে পেলাম রেললাইন এবং ঐ পারে একটা গ্রাম, রেল লাইন পার হবার সাহস আর আমাদের হলোনা সুহাটা গ্রামের দিকেই হাটা শুরু করলাম উত্তর দিকে - কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রবেশ করলাম লোকালয়ে । নিরব রাত , আম্মা বললেন রাত এখন ১০ টা বাজে আমরা সেই সাড়ে ছয়টায় বের হয়ে ছিলাম ।
গ্রামএর প্রবেশ করার মুখেই প্রথমে নজর পরলো মসজিদ একটা বর্ধিষ্ণু গ্রামের উন্নত মানের মসজিদ দেখতে পেলাম আর দেখলাম একটা টিউবঅয়েল । আমরা সবাই কে মসজিদের পাশে বসতে বলে দাদা সামনে হেঁটে হেঁটে চলে গেলেন । টুম্পা কে এতক্ষণ আমি আর বোন দুই হাত ধরে কোন রকমে টেনে এনেছি মাইল দুয়েক পথ । পেটের খিদায় আমরা সবাই অস্থির , ঘড়িতে রাত বাজে ১০ টা ৩৫ মিনিট , নিস্তব্ধ গ্রাম , কোণ বাড়িতে কোন আলো জ্বলছে না । তার উপর অত্যাচার, মৃত্যু ভয় । এই সুযোগে প্রাণ জুড়িয়ে পানি পান করলাম সবাই । কারো মুখে কোনও কোথা নাই । চতুর্দিকে অন্ধকার । আমি আর টুলু আপা পোটলা (সাইজে দশ ইঞ্চি গোলাকার উচ্চতা আঠার ইঞ্চি) টাতে হেলান দিয়ে শুয়ে পরলাম । আগের দিন রাতে ঠিক এই সময় শুয়ে ছিলাম খাটে নরম জাজিম এবং ফ্রেশ বিছানার চাদর এ , নরম তুলতুলে বালিশে ( ছোট বেলা থেকেই আমি একদম নরম তুলতুল বালিশ পছন্দ করি) । আর আজ কোথায় ? গতকাল পোলাউ, শামী কাবাব, খাসীর মাংস খেয়েছিলাম আর আজ বিকাল তিনটা থেকে একমাত্র পচা পানি আর এখন টিউবওয়েল এর পানি ছাড়া আর কিছুই খাই নাই ; তার উপড় ৫ ঘণ্টা যাবত কম করে হলে ১০ থেকে ১২ মাইল হেঁটেছি । আম্মা আমাকে ডাকল কাছে , বলল অনার পায়ের স্যান্ডেল এর ফিতা টা খুলে দেওয়ার জন্য , ঠিক তখনি দাদা এসে হাজির সঙ্গে একজন ভদ্র লোক কে সাথে নিয়ে , পরিচয় করিয়ে দিলেন - দাদা বললেন ভদ্রলোক এর মায়ের বাড়ি আমাদের গ্রামে । দাদা বললেন, অনেক কষ্টে ওনাকে পেয়ে গেলাম নাইলে এই রাত কাটানো কঠিন হত । উনি বললেন কিন্তু ওনার বাড়ীতে কোন জায়গা নাই, ইতিমধ্যে ২৫-২৬ জন সর্বমোট ৫ টা পরিবার আশ্রয় দিয়েছেন উনি , ওনারা নিজেরাই কালকে এই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাবার চিন্তা করছেন । কারন গ্রামটা শহর এবং আখাউরার মধ্য খানে রেল লাইন থেকে ৫- ৬০০ গজ দূরে একদমি নিরাপাদ নয় । উনি এটাও বললেন মামি আম্মা কে মামি বলে সম্বোধন করলেন ভদ্রলোক - উনি সরকারি চাকরি করেন ঢাকায় ; ২৭ই মার্চ পরিবার সহ পালিয়ে এসেছেন । হেঁটে হেঁটে আমরা ওনার বাড়ীতে গেলাম বেশ দূরে গ্রামের শেষ মাথায় প্রায় । একা একটা বাড়ী একটা বেশ বড় একতালা বিল্ডিং উপড়ে টিনের চাল, আর তিন ভিটায় তিনটা টিনের ও ছনের ঘর । আম্মা , টুম্পা আর বোনকে একটা ঘরের রুম দেখালো আর আমাদের তিনজনকে দেবার মত তেমন কোন জায়গা না থাকায় গোয়াল ঘর থেকে ওনাদের গরু বাইরে এনে গোয়াল ঘরের এক পাশে একটা ছোট বেড়া দেওয়া জায়গায় মাটিতে খর আর একটা খেথা দিতে পারলেন ওনারা । আম্মা মনে হয় বাড়ীর ভদ্র মহিলাকে বলেছিলেন আমাদের খুদার অবস্থা ; একটা কুপি নিয়ে আমি, দাদা ও ছোটন শোবার জায়গা টা ঠিক করতে লাগলাম । স্যান্ডেল খুলে দেখি কুপির আলোতে স্ট্রাপ খুলেই দেখি দুই পায়ে গোড়ালি তে ভীষণ বড় বড় দুইটা ফোস্কা আর পায়ের চামড়া ছুলে রক্ত শুকিয়ে গেছে । হাফ প্যান্ট খুলে দেখার সময় পেলাম না ।খরের উপড়ে ঠিক যখনি শুতে যাবো ঐ সময় বাড়ীর মালিক ওনার নাম টা আমি কোনদিনই জিজ্ঞেস করি নাই - উনি হাতে নিয়ে এসেছেন অনেক গুলো চিড়া, খই, পাটালী গুড় এক কগ পানি টিনের গ্লাস আর কয়েক টা তেলের পিঠা । আমি আমৃত্যু ওনার মহানুভাবতার ঋণ শোধ করতে পারবো না । দাদা একটু চিড়া খেলেন , ছোট ভাই খেতে খেতে ঘুমিয়ে পরল , দাদা নামাজ পরলেন অনেকক্ষণ ধরে আর এমনিতেই সব সময় একটু খেতে পছন্দ করি তখনো লোভ সামলাতে পারলাম না, পেট ভরে খেয়ে ঘুমালাম । গোয়াল ঘরের সাথে লাগানো ঘরে সাধারণত বাড়ীর রাখাল বা গরু চোর ঠেকানোর জন্য পাহারাদার রা ঘুমায় পরে শুনেছি , আমাদের গ্রামের বাড়ীতে কয়েক বার গিয়েছি এ জীবনে, আমাদের বাড়ীতে কোন গরু নাই - আমাদের সব জমি চাষ করতেন আমাদের প্রিয় গফুর কমান্ডার কাকা । তাই এই সব দেখি নাই । ঘরটার কোন দরজা নাই আর বেড়া ও অর্ধেক দেওয়া । বাকিটা গরু গুলোকে নজরে রাখবার জন্য খোলা । নাকে একটা গন্ধ যদিও লাগছিল কিন্তু ঐ রাতে, ঐ বিপদের সময় আমাদের কে ই বা অত রাতে আশ্রয় দিত সেদিন ? ঐ পরিবার যে কত মহান তা সেদিন কেবল আমরাই জানি । পায়ে ব্যথা, ফোস্কা র টনটনানি, পায়ের মাসেল টানটান আর মধ্যে কুচকি তে বেশ চুলকাচ্ছে । ঘুম আসলো অনেক নড়াচড়া করার পর , একবার দেখলাম দাদা আমাদের দুজনার উপড়ে কেথাটা দিয়ে দিলেন । তারপর বিড়বিড় করে কি জানি পড়তে থাকলেন ।
ঘুম থেকে উঠেই দেখি আম্মা আমাদের পাশে বসে আছেন । এক দিনেই ও কে বেশ ভিন্ন মানুষ লাগছে , আমাকে চোখ খুলতে দেখেই একটু খানি হাসি দেওয়ার চেষ্টা করল । আমাকে আর ছোট ভাই কে কল তলা আর প্রাতঃকাজ সারার স্থান দেখিয়ে দিল , কয়লা দিয়ে দাঁত মেজে, হাত মুখ ধুয়ে আসলাম সেই একই কাপড় এ , আপা আমার জন্য একটা ফুলপ্যান্ট কাপড়ের পোটলা থেকে বের করল আর একটা শার্ট । ওটা পরলাম , ইতিমধ্যে আপা এসে নিয়ে বসাল ওনাদের রান্না ঘরের বারান্দায় , যেয়ে পিরিতে বসলাম আর একটা প্লেটে একটা রুটি আর ঝোলা গুড় দিয়ে প্রাতরাশ সারলাম । আগের দিন খেয়েছিলাম কুমিল্লা বাটার এর দিয়ে মডার্ন বেকারির টাটকা পাউরুটি, ডিম আর চা আর আজ । জীবন টা চোখের পলকেই বদলে গেল । গোগ্রাসে নাস্তা শেষ করে চতুর দিকে দেখলাম, বাড়ীটা ভর্তি লোক লোকারণ্য । বেশ একটু অপ্রস্তুত এ লাগলো এত গুলো মানুষ দেখে । আপা একটু চুপচাপ মানুষ আমাদের বাসার নিট এন্ড ক্লিন মাস্টার সে ছিল , এমনিতেই ছোট্ট একটা তার উপর এই সব চাপে আরও ছোট্ট হয়ে গেছে । এসেই দেখি আম্মা মোটামুটি বিদায় নেবার জন্য তৈয়ার । টুম্পা এসে যোগ সবাই কে - বেচারা ওর মুখের দিকে তাকানোর কোন উপায়ই নাই ; একদম বিধ্বস্ত অবস্থা । দাদা বললেন , ''ও নাতি জুতা লাগাই লাও, আমরা অক্ষনি যাইতাম গা '' । দাদাকেও বেশ ক্লান্ত মানুষ লাগল, বেশ সাছন্দে থেকে অভ্যাস । আমাদের আব্বা কে ভীষণ স্নেহ করেন , আব্বা কলকাতা থেকে ইস্ট পাকিস্তানে আসার পর থেকেই এই দাদা আব্বাকে অনেক দেখাশুনা করেছেন । তার দুই ছেলে এক মেয়ে । সুখী পরিবার , সংসারে কোন অভাব নাই ; জমি, পুকুর, কাঁঠাল বাগান, শ্বশুর বাড়ীতে অনেক সম্পত্তি এবং পেনসন সব মিলিয়ে বেশ ভালোই ওনার জীবন । কাউকে আর জিজ্ঞেস করলাম না আমরা যাচ্ছি কোথায়, বাড়ী ওয়ালা এবং বাড়ী ওয়ালি দের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিলাম , স্যান্ডেল সু পরার কোন উপায় নাই তাই গাঁটটির মধ্যে জুতা ঢুকিয়ে দিলাম আমরা সবাই খালি পায়ে বের হয়ে পরলাম - আবার হাটা সুরু করলাম, জানিও না কোথায় যাচ্ছি, আম্মা আর দাদা সিধান্ত নিয়েছেন শুধু আমার হাতে একটা ঘড়ি আছে , বলল সকাল ১১ টা বাজে । অনেক দূরে হাল্কা গুলাগুলির আওয়াজ বাড়ীটার বাইরে এসে খোলা জায়গায় যাওয়াতে শুনতে পেলাম । এখান থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর দেখা যায় না । রাস্তা মানে মেঠো পথ ছেড়ে আমরা কোনাকুনি জমির আইলের উপর দিয়ে অনেক জায়গা হাটার পর একটা ছোট রাস্তায় উঠলাম তিন ফুট চওড়া আশেপাশের জমিগুলো থেকে পাচ - ছয় ফুট উঁচু বেশ অনেক লম্বা একটা রাস্তা, আমার ঘাড়ে একটা গাঁটটি আর বোনের ঘাড়ে একটা ; এগারটা - বারোটার সময় সূর্য বৈশাখ মাস বেশ প্রকট রোদ। চৈত্র মাসের সেই কড়া রোদের অভ্যাস এখনো যায় নাই । পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মত হাটার পর একটা গ্রাম পার হলাম । অল্প কিছুক্ষণ এর ভিতরেই শেষ । সামনে যেয়ে একটা নদী পেলাম যার পার দিয়ে যাবার সময় দেখলাম নদীর মাঝ খানে একটা বেশ বড় লোহার নির্মিত লঞ্চ পরিত্যাক্ত ; মনে হল পাকিস্তান আর্মি এটাকে এখানে ফেলে চলে গেছে - মনে হল লঞ্চটা মাটিতে গেড়ে গেছে ওরা মনে হয় আর ওটাকে সরাতে পারে নাই তাই হয়ত ফেলেই চলে গেছে । প্রায় কয়েক মিনিট পর আমরা এসে পৌঁছলাম সতুরা নামক এক গ্রামে - বাজারে অনেক লোক সমাগম - একটা মিস্তির দোকানে ঢুকে পরোটা, কাল জাম , আর সবজি ভাজি দিয়ে দুপুরের খাওয়া খেলাম আর ফ্রেশ দুধ কিনে ওটাকে জ্বাল দিয়ে নিলাম দোকান থেকে বেরিয়ে আমরা একটা কাঠের পুলের নিচে বসে আম্মা একটা ম্যাপ বানালো আর নাম গুল ইংলিশ এ লেখল আমাদের কে অনেক লোকজন ঘিরে ধরে অনেক কৌতুহল দেখালো - আম্মা মাঝে মধ্যে ইংলিশ এ দু একটা শব্দ উচ্চারণ করাতে কয়েক জন উৎসুক মানুষ আমাদের উপর চড়াই হতে চেষ্টা করতে লাগল , দাদা তখন বাজারের মসজিদে নামাজ পড়তে গেছেন ; গ্রাম বাসি আমাদের কে হেনস্তা করার চেষ্টা করল - দু এক জন বলতে শুরু করল আমরা বিহারি কিনা, বেশ উগ্র ভাবে আমাদের কে প্রশ্ন করতে সুরু করল ; আম্মা গেল হটাৎ করে ক্ষেপে বেশ জোড়ে ধমক দিয়ে উঠলো ওরা আরও ক্ষেপে গেল - ঐ সময় দু এক জন মানুষ জিজ্ঞেস করল আমরা যাচ্ছি কোথায় ; আম্মা বললেন আমি যেখানেই যাই না কেন তাতে আপনাদের কি ? বেশ অসস্থিকর পরিস্থিতি আমরা সবাই বেকুবের মত - তখন আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাষায় কথা বলা শুরু করলাম ; ইতিমধ্যে কপাল ভালো দাদা চলে আসলেন এসেই সবাই কে বললেন আমাদের বাড়ী গোপীনাথপুর আমরা ওখানেই যাচ্ছি । বেশ ক্ষেপে গিয়ে বলল ঐ গ্রামের কয়েকজন মানুষের নাম এবং আমাদের বাবার পরিচয় এবং আমাদের পরিবারের কথা ; আম্মার চাকরির পরিচয় ইত্যাদি । পরে ক্ষমা চেয়ে সব অভদ্র লোকগুলো বিদায় নিলো । কাঠের ব্রিজ টা পার হয়ে আমাদের গ্রামের রাস্তায় দিকে মোড় ঘোড়ার আগেই এক জন বলল ওইদিকে না যাওয়ার জন্য ; বলল গঙ্গাসাগর - উজানিশাহ ব্রিজের ওইদিকে হাজার হাজার পাঞ্জাবি এসে ভরে গেছে , মুগরা বাজার জ্বলছে , গঙ্গাসাগর রেল ওয়ে স্টেশন এ পাকিস্তানিরা ক্যাম্প বানাচ্ছে , পুশিং ট্রলি দিয়ে কসবা থেকে আখাউরা পর্যন্ত পেট্রলিং করছে সারাদিন , উপায়ান্তর না পেয়ে আমরা উলটা দিকে রউনা দিলাম মান্দার পুর নামক এক গ্রামে ওখান থেকে ১০ - ১১ মাইল দূরে । আম্মার মন খুব খারাপ হয়ে গেল - অন্য মানুষের বাড়ীতে যেতে হবে বলে । নিজেদের বাড়ী যাওয়া এক কথা আর অন্যমানুষের বাড়ী । কিন্তু আমাদের গ্রাম পাকিস্তান আর্মির মেইন রেল রুটের উপড়ে সদা সর্বদা ওদের যাতায়াত করার রাস্তায় । মোটেও নিরাপদ নয় এবং আব্বা যদি কখনও ফিরে আসে তাহলে আমাদের খুঁজে ও পাবে না আমাদের । শুনে আমাদেরও মন খারাপ হয়ে গেল বেশ । অনেক স্বপ্ন ছিল গ্রামে থাকব - দাদা ও জোড় করেই নিয়ে আসলেন গ্রামে নিজ গ্রামে নিরাপদ জায়গায় পালিয়ে থাকার জন্য সবচে’ উত্তম জায়গা আর আজ কিনা ঐ খানেই যাওয়া যাবে না । উলটা পথ ধরে হাটতে লাগলাম - একটা বেশ বড় রাস্তা কিন্তু বাকি জমিনের সমান্তরাল কোন উঁচু নয় আশে পাসের চাষ করা জমি থেকে । এখানে আসার পর পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি যে এখান থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কুমিল্লা রোড আর দেখা যাচ্ছে না । হাটতেই থাকলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা ; অনেক দূর প্রায় ১০-১১ মাইল প্রথম একটা বড় বাজার পেলাম শিকার পুর বাজার দোকান পাট খোলা দেখে মনে হল রবিবার ঐ দিন সাপ্তাহিক হাট বার । প্রচুর মানুষ, অনেক দোকান, অনেক ফেরিওয়ালা, কোন যানবাহন নাই, না রিক্সা, না স্কুটার, না গরুর গাড়ী কিংবা খাল বা নৌকা ; পথ তো আর ফুরায় না বেলা তিনা চারটা বাজে , দুধের পর আর কিছুই খাই নাই - বাজার থেকে আমরা টোস্ট বিস্কুট আর তিলের খাজা কিনলাম আর চা স্টলের দোকান থেকে তিন চার গ্লাস চা কিনে এনে একটা গাছের নীচে বসে বসে খেলাম সবাই । আবার এসে আঁক গাদা লোক ভিড় করে ঘিরে ধরল এবার আমি আর কোন সুযোগ না দিয়েই খা সম্পর্কে স ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাষায় কথা বলা শুরু করলাম সবার সাথে এবং আম্মা সহ সবাই কে বললাম শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা বন্ধ করতে ; গ্রামের লোক দের একটা দল আছে যারা শুদ্ধ ভাষা শুনলেই মনে করে এরা বাঙ্গালি না ; কারন, ওরা শুদ্ধ ভাষা মনে হয় বুঝে হয়ত বা তার জন্য ওরা মনে করে এরা ভিন দেশি ; তার মধ্যে তখনকার পরিস্থিথি ও ছিল অত্যন্ত সন্দেহজনক । ওদের দোষ দেই না - আর আমাদের অসুবিধা হলো আমার ফেম্যিলির কেউই আমি ছাড়া আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারতো না । অনেক বুঝিয়ে ওদের চেঞ্জ করাতে পারছিলাম না , কিন্তু, আরও একটা জিনিস অবলোকন গ্রামে মধ্যে একটা শ্রেণির মানুষ আছে যারা যেচে পরে শুধু শুধু ঝগড়া লাগাতে চায় - এটা অবশ্য সবখানেই একই । কিন্তু আমরা কোনদিন ঐ ধরনের সমস্যায় শহরেও সম্মুখীন হই নাই - এই প্রথম উপলব্ধি করলাম , জীবনটা বিমান হামলা এবং মহা দলবদ্ধ প্রস্থান এর আগে ছিল খুবি একটা সঙ্কীর্ণচিত্ত (ইন্সুলার) জীবন । আর ঐ শিকারপুর বাজারে সেই দিন টা ছিল আমাদের জীবনের সবচে’ দুঃস্থ, সর্বস্বান্ত, পরিত্যক্ত সময় । ঐ লোক গুলোর গায়ে পরে এসে ঝগড়া লাগানো এবং আমাদের জাতীয়তা নিয়ে প্রশ্ন করায় আমার ঐ এলাকাটা তে যাওয়ার বা থাকার ব্যাপারে মনটা সায় দিলো না । আম্মাকে শুধু জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কোথায় এবং কার ওখানে থাকবো ? আম্মা যাদের কথা বললেন তাতে মনে হলো ঠিক আছে কিন্তু আমি তখনই অনুধাবন করলাম যে, আমার ভাই বোন, আম্মা এবং আমার চালচলন, কথাবার্তা, আমাদের কালচার এদের এই সমাজ এর সাথে খুব এক তা খাপ খাবে না । মনে মনে ভাবলাম, ইস যদি আমরা আমাদের নিজের গ্রামে কেবল যদি যেতে পারতাম কোন ভাবে । যে কয়বার ই আমাদের গ্রামে গিয়েছি তখন দেখেছি ওরা অনেক অন্যরকম , কিন্তু পরপর দুই দুই টান কেবল ভাষা শুনেই যদি এরকম ঝামেলা শুরু করে তাহলে তো বেশ অস্বস্তিকর হবে এই এলাকায় বসবাস করা । আমাদের নিজ গ্রামে অন্তত সবাই জানবে আমরা কারা কিন্তু এই এলাকাতে তো আমরা অনাহূত আগন্তক পরিবার ।
দাদা বেচারা বৃদ্ধমানুষ এবং সারা রাত দিন হেঁটে বেচারা একদম ক্লান্ত এবং অপ্রকিতস্ত হয়ে পরেছেন প্রায় । উনি মানুষ হিসেবে খুবই গম্ভীর এবং একটু অভিজাত গোছের - তর্ক বা কাউকে বচসা করা কিংবা ঝগড়া করা ওনার ধরনের কাজ না । ওনার অনেক কিংবদন্তি আব্বা এবং অন্যান্য কাকা, ফুফু, দাদিদের কাছ শুনেছি বহুবার । আব্বা আমাদের সব সময় বলতেন যে,বড় কাকা (নুরুল হক চৌধুরী) কে যেন কোন সময় কোন প্রকার আপ্যায়নএ কোন কমতি না করা হয় । আব্বাকে উনি ছোট বেলা, যুবক বেলা, স্কুল এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে পড়ার সময় খুব খোঁজখবর করতেন সর্বদা । তাই তো এতবড় মহা দুঃসময়ে উনি নিজের জীবন বাজী রেখে আমাদের কে নিরাপদ স্থানে নিরাপদে নিয়ে পৌঁছানোর জন্য এত বড় ঝুঁকি নিয়েছেন । তাই এসব গুন্ডা জাতিও লোকদের সাথে ঝগড়া করা উনার কাছে কাম্য না । দাদা শুধু আমাকে বললেন ''শাহিন পরিস্থিতি ডা কদ্দুরা বালা হইলে তুমরারে বাড়িত লইয়া যামু গা , ছিনতা কইরো না , অল্প কয়দিন থাইক্কা লাও এহানো ‘’ এই বলেই উনি দাঁড়িয়ে গেলেন আর আম্মাকে বললেন বউমা চলো মা , বেলা তখন পাঁচ টার মত বাজে - হাতে সময় আছে ঘণ্টা দুয়েক, গতকাল এই রকম সময় আমরা ডোবার মধ্যে বসে , ডুব দিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম আর আজ আমরা শহর, বাসা ছেড়ে গৃহহীন, জীবনের নিরাপত্তার জন্য চলেছি ছুটে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে জানিনা এর শেষ কোথায় ? তার উপড়ে পরিবার বিচ্ছিন্ন - আব্বা সিলেটে - বোন ঢাকায় আমরা বাকিরা পথে পথে । আম্মার ২১ বছরের গোড়ে তোলা সংসার ধূলিসাৎ । আদৌ আর কোন দিন ফিরে যেতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না । কতদিন থাকব এইভাবে অথিতি হিসাবে অন্যের কৃপায় । আত্মীয় হওয়া এক জিনিস আর অনিশ্চিত সময়ের জন্য বোঝা হওয়া আঁক জিনিস । মন টা খুবই ভেঙ্গে গেল ; উঠে দাঁড়ালাম , খালি পায়ে হাঁটা বেশ কষ্টকর , প্রায় প্রত্যেক পদক্ষেপেই পায়ের পাতায় ব্যাথা লাগে , অহরহ হোঁচট খেতে খেতে কয়েক জায়গায় ছুঁলে ও কেটেও গেছে , কেটে এবং ছুঁলে যেয়ে রক্ত পতন হয়ে কখন যে রক্ত বন্ধ হয়ে লাল রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে , দেখার সময় ও নেই । অন্যসময় হলে কত বাহানা করতাম, ডেটল, আইওদিন, ই, পি, আরএর এম আই রুমে যেয়ে ব্যান্ডেজ করে আসতাম, অথবা নুরু কাকা অথবা মুকিম ভাই এম আই রুম এর অ্যাসিস্ট্যান্টদ্বয় বাসায় এসে ওষুধ, গজ, ব্যান্ডেজ করতো সাথে সাথে । কিন্তু আজ এসব নিয়ে ভাবার বা ওগুলো নিয়ে তোয়াক্কা করার কোন অবকাশ ই নাই । এক মাসের ব্যবধানে জীবনের কি চরম ছন্দপতন। ভাবতে ভাবতেই হাঁটা শুরু করলাম , দাদা বললেন ঐ যে দূরে সবুজ একটা জঙ্গল এর মত দেখাচ্ছে ঐটার ওপর পারেই যাবো আমরা ; ঐটা তোমাদের আরেক দাদার বাড়ী - সৈয়দ দাদার বাড়ী ওইখানে । উনিও আমাদের পিতার কাকা । একবার দুইবার ওনাকে আমরা দেখেছি - ওনাকে আব্বা ডাকেন ‘' আহাতাহা’' ( তাড়াতাড়ি) মাস্টার, সব কিছুতেই ''তাগদা ( তাড়াতাড়ি ) কইরালাও ''। শিকারপুর অতিক্রম বাজার ত্যাগ করার পর থেকেই আর পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর কামানের (আর্টিলারি) আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না এবং রাইফেল ও মেশিন গানের আওয়াজ আর শুনা যাচ্ছে না - এক বিরাট স্বস্তি ওটা । মনে হল আমরা কি তাহলে বিপদ মুক্ত এলাকায় প্রবেশ করছি নাকি ?
আবার আমরা সর্ট কাট নেবার জন্য গোফাড ( মানে রাস্তা ) ফেলে জমিনের আইলের উপর দিয়ে কোনাকোনি হাটতে শুরু করলাম তাড়াতাড়ি সূর্য দুবার আগে পৌছার জন্য । জমি গুলোতে বড় বড় মাটির চাক্কা ভরা । আইল গুলো খুবই সরু এবং আইলের উপড়ের অংশ গুলো বেশ সরু উপর দিয়ে হাটার জন্য , হাটতে গেলেই পা পিছলে জমিতে পরে যায় আর ব্যথা লাগে প্রত্যেক কদমে। কিন্তু, আজ এসব ভাববার সময় আর কারো নাই - ছোট দুই ভাই ও আর কনো উনাপ্যানা করছে না আগের দিন এর মত । মানুষ আভ্যাসের দাস । এক দিনেই সহ্য শক্তি একটু বেড়েছে মনে হয় । কিন্তু আমরা সবাই আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ শঙ্কিত । এটা বুঝা গেলো গ্রাম বাসীরা খুবই ভীত হয়ে পরেছে হওয়াটাই স্বাভাবিক ; অনেকেই আমাদের কে মনে করেছে আমরা ঢাকা থেকে এসেছি কিনা ; ঢাকার খবর সবাই আমাদের কাছ থেকে জানতে চায় । কিন্তু, কেন জানি মনে হল এরা আমাদের মত শহুরে মানুষ এদের মাঝে চায় না । আমারা আসার সময় পথিমধ্যে কয়েক শত পরিবার কে দেখেছি আমাদের মত গ্রামাভিমুখি হচ্ছে পায়ে হেটে হেটে যাচ্ছে তাদের গন্তব্যে । অল্প আধটু কথা ও হয়েছে ওদের সাথে । সবার চোখেই একই অনিশ্চয়তা , একই ভয় , একই চাপা ব্যথা, একই মলিনতা । গুলির আওয়াজ যে কি ভয়ার্ত তা গুলাগুলির মধ্যে খোলা আকাশের নীচে চলাফেরা করা । শরীরে কোন কাপড় মাত্র পরিহিত - কোথা থেকে কে কোন দিকে গুলি করছে তাও জানা নেই , তারপর গগনবিদারী গর্জনে আর্টিলারি বোমা যেকোনো সময় একে বারে পাশে এসে বিদ্যুৎ এর বেগে ফাটতে পারে আর সবাই এক মুহূর্তের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া কোন ব্যাপারই নয় । এই দুদিনের এই জীবনের ভয় নিয়ে দৌড়ানো , গলার শেষ মাথায় আত্মা টা নিয়ে ভাগা আর সৃষ্টি কর্তার নাম জপা - বিপদ মুক্তি পাওয়ার এই বাসনা যে কষ্টকর এটা আমি আমার জীবনেও কাউকে বুঝাতে পারি নাই , আজও পারব কিনা জানা নেই । যে জীবনেও এই অবস্থায় না নিমজ্জিত হয়েছে তাকে কোন ভাষা দিয়ে বুঝানো এক অসম্ভব কাজ । আশ্চর্যের বিষয় আজও আমাকে বাথ্যিত করে সেটা হল, যারা আমাদের কে হত্যা করতে চায় সে ভাবছে আমি ওদের মত একই ধর্মের নয় , হত্যাকারী ও একই সৃষ্টি কর্তার আশিস চাচ্ছে আর ওরা যাকে হত্যা করতে যাচ্ছে সে ও একই সৃষ্টিকর্তার কৃপা চাচ্ছে ঐ হত্যাকারীর হাত প্রাণে বাঁচার জন্য । কি বিচিত্র এই একই ধর্মের মাঝে জাতে জাতে কি বিশাল বিভক্তি ।
অল্প বয়েস আমার কিন্তু সেই ছোট বেলা থেকেই আমি একটু বাতিক্রম ছিলাম - ৮ বছর বয়েসে খুলনা সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে নৌকা করে ঘুরে বেড়াতাম ; আব্বার ব্যাটম্যান নিয়ে মাছ ধরতে যেতাম পুকুরে । ওনার সাথে চলে যেতাম বসন্তপুরে গুলতি দিয়ে পাখি মারতে, রাতের বেলা লঞ্চে খুলনা আসার সময় সারা রাত প্রায় সজাগ থাকতাম লঞ্চের ডেকে বসে নদীর জলে চাঁদের আলো দেখতাম প্রত্যেক টি ঢেউ এ কিরকম ভাবে আলোর প্রতিফলন হয়, ৯ বছর বয়েসে সিলেটের লাতুতে কুমারশিল চা বাগানের হাতীতে মাহুতের সাথে হাতীর গলায় বসে ঘুরে বেড়াতাম লাতু বাজারে , বড়পুঞ্জি - ছোটপুঞ্জির টিলা গুলোতে দৌড়িয়ে উঠে যেতাম না থেমে আব্বার সাথে চ্যালেঞ্জ দিয়ে, বিনিময়ে পেতাম করিমগঞ্জ - বা সিলচর আনা ব্যাডমিন্টন র্যাকেট, বোঙ্গাওয়ালাদের (স্মাগলার ) ইনফ্রমার দের কে বললেই থেকে এনে দিত , অথবা পেশওয়ারী চপ্পল । আব্বা আমাকে সব সময় ম্যাগাজিন পড়তে দিত - ঐ সময় থেকেই জানতাম মাও সে তুং কে , কে চে গুভারা, কোনটা ট্রি নট ট্রি রাইফেল, কোনটা ব্রেন গান , কোনটা ব্রিটিশ টমি গান, এক ধরনের কাঁধে রেখে ফায়ার করার মত একটা টিউব জাতিও অস্ত্র ছিল নামটা সিপাই/এন সি ও রা মনে হয় ভুল উচ্চারণ করত জানিনা - ওনারা ওটাকে ব্লেন্ডিসাইট বলতেন ওটাও চিনতাম, আরও চিনতাম আব্বার পয়েন্ট থ্রি এইট রিভলভার - লাঠিটিলা ( সিলেট ) খণ্ডযুদ্ধ (স্কিরিমিস) এর সময় চিনে ছিলাম টু ইঞ্চ মর্টার, থারি (থ্রি) (ই, পি আর এর পাঞ্জাবি সিপাই রা থ্রি কে থারি বলত ) ইঞ্চ মর্টার ইত্যাদি । হাটতে হাটতে বার বার ফিরে যাচ্ছিলাম ফেলা আসা জীবনের দিকে আর ভাবছিলাম প্রত্যেক টা পদক্ষেপের সাথে সাথে এগিয়ে চলেছি এক অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে ।বারবার ভাবলাম আমাদের কপালে এই দুর্ভোগ আমরা তো চাইনি, আমরা শুধু বলেছিলাম আমাদের কে সমান অধিকার দিতে আর তার জন্য এত বড় প্রতিক্রিয়া । নিজের দেশের মানুষ দের রাতের অন্ধকারে মেরে ফেলল ; যখনি ঢাকার কথা চিন্তা করলাম তখনই আমার বড় বোনের মুখটা ভেসে উঠলো । এইসব ভাবতে ভাবতে এসে গেলাম মান্দারপুর এ । আমাদের মহাপ্রস্থানের মহাস্থান ।
চতুর্থ পর্ব
আশ্রয়স্থল
মান্দারপুর গ্রাম টা দূর থেকে দেখেই মনটা জুড়িয়ে গেল , দূর থেকে দেখে গ্রামটার গভীরতা বুঝা গেল না আমরা গ্রাম তাকে দৈঘ্য দিক থেকেই দেখলাম , সবুজ গাছের পাতার চাদরে আচ্ছাদিত গ্রামটা , মনে হল আকাশে গাছের পাতার একটা গোলাকৃতি সামিয়ানা টাঙ্গানো । বেশ ঘন সবুজের সমারহ । ছোট বেলা থেকেই আমার প্রকিতির সৌন্দর্য এর প্রতি খুব টান, সুন্দরবন , সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেরানো, তেলিয়াপারা, লাতু, বাল্লা, বড়লেখা, বারইগ্রাম, সারেরপার, হাওর, জাফ্লং, সংগ্রাম বিওপি, তামাবিলের কাস্টমস কোয়ার্টার থেকে জানালা দিয়ে দূরে চেরাপুঞ্জির পাহাড়ে ঝরনা গুলো থেকে অনবরত পানি নেমে আসা আমাকে সব সময়ই খুব আন্দোলিত করত । সুন্দরবনে জোয়ারের সময় সব গোলপাতা গাছ গুলোর অর্ধেক পানিতে দুবে যাওয়া আর ভাঁটা আসলে পানি আস্তে আস্তে পিছলিয়ে নেমে যেতে দেখায় আমি এক ভিন্ন ধরনের আনন্দ পেতাম । ঠিক তেমনি মান্দারপুর গ্রাম টা দূর থেকে দেখেই কেমন জানি । কেমন জানি একটা আনন্দ অনুভূত হল মনে মনে, প্রায় পড়ন্ত বেলা - দূরে দেখলাম কৃষক রা গরু আর লাঙ্গল, জোওাল কাঁধে নিয়ে বাড়ী ফিরছে । গ্রামের কাছের জমি গুলোতে সবুজ চকচকে ধানের ক্ষেত, অপূর্ব সবুজ ধানের গাছ গুলো পাঁচ - ছয় ইঞ্চি লম্বা হয়েছে - ধান গুলো চিনতাম না - দাদা কে জিজ্ঞেস করলাম আমার অনুসন্ধিৎসু মন কে সামলাতে না পেরে দাদা বললেন , ‘'ইডী আউস ধান অহন লাগাইছে তিন মাস পর কাটবো । ‘' গ্রামের একদম নিকট বর্তি জমি গুলোতে পাট চাষ করা ; প্রায় তিন থেকে চার ফুট উচ্চতায় পাট গাছ দাঁড়িয়ে কেমন জানি আমাদের মাথাগুলো দুলিয়ে দুলিয়ে আমাদের সম্ভাষণ জানাচ্ছে ।
গ্রামের উপরের সবুজ পাতার সামিয়ানার অপর পারে সূর্য অস্তমুখি ঢেলে পরেছে লুকানোর জন্য । সবুজ পাতার ঢেউ খেলানো মখমল চাদরের উপর সূর্যের রশ্মি গুলো পাতায় লাগা বাতাসের সাথে মনে হলো যেন মগ ডালে দাঁড়িয়ে এক দল নৃত্য শিল্পী আপন মনে হাত গুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথক নৃত্য নাচছে । গ্রামের এক পাশের দর্শন দেখে মনে হল গ্রাম টা দৈর্ঘ্যে বেশি হলে এক মাইল হবে কিন্তু প্রস্ত কতটুকু তা’ অনুধাবন করা গেল না । সব ই কেমন জানি একি সমান্তরাল আসে পাশে কোন উঁচু কিছু দেখতে পেলাম না । এই প্রথম আমি একটা ভিন্ন গ্রাম এ থাকতে যাচ্ছি আমাদের নিজের বাড়ী ছাড়া । আমাদের গ্রাম অন্য রকম, সমতল ভূমির পরেই গ্রামের উপর ছাদের মত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে লাল মাটির পাহাড়( টিলা ) গুলো ।রেল ওয়ে স্টেশন এর বাজার, বাজার এর পর গ্রাম শুরু, তারপর প্রায় ১ মাইল গ্রামবাসীর বাড়ী এবং ফসলের জমি এই মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত নদীর পার বিস্তৃত ২ মাইল দৈর্ঘ্য এবং ১ মাইল সমতল প্রস্থ তারপর পাহাড় । কিন্তু এই এলাকায় সব চেপটা , সমান্তরাল ভূমি , কোন প্রকার উচ্চভূমি চোখে পরল না কোনদিকে । খাল , জলাশয়, পুকুর এর সাথে চাষের জম্বির মধ্যে তেমন কোন উচ্চতার ফারাক নেই , বাড়ী গুলো বেশ উঁচুতে তিন থেকে পাঁচ ফুট উঁচু ঢিবির উপর মনে হোল মাঠের জমি কাটে পুকুর বানিয়ে ঐ ঢিবি বানিয়ে তার উপড় ঘর বানিয়ে , একটা একটা বাড়ী চারিদিকে কলা গাছ, বাসের ঝাড়, আম,আম গাছে ছোট আম, কাঁঠাল,কাঠাল গাছে ছোট ছোট কাঁঠাল ঝুলে আছে, জাম গাছে সমৃদ্ধ । প্রত্যেক বাড়ীতেই একটা বিশাল বিচুলির টাওয়ার । সব সবুজের মাঝে সোনালী একটা গম্বুজ আকৃতির কুতুব মিনার দাঁড়িয়ে আছে । জমির আইল থেকে গোপাটে ( মেঠো পথ - ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাষায় ) এ উঠে এলাম ।
দূরে একটা বড় তিনের চালের সাদা দালান দেখতে পেলাম । দাদা বলল ঐ বাড়ীটার পাশেই সৈয়দ দাদার বাড়ী এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না সামনে গেলেই দেখা যাবে । সকাল ১১ টায় হাটা শুরু করেছিলাম এখন প্রায় ৬-৫০ বাজে এর মধ্যে হয়ত ১ ঘণ্টা সর্ব সাকুল্যে বিশ্রাম নিয়েছি । গত এক দের ঘণ্টা যাবত কামানের গোলার আওয়াজ এবং মেশিন গ্যান এর গুলির আওয়াজ না পাওয়াতে একটু স্বস্তি অনুভব করছি । মাথার উপর দিয়ে কোন কিছু উড়ে যাচ্ছে না মাটিতে শুয়ে পরতে হচ্ছে না, যা কিনা একটা বিরাট নিরাপদ হওয়া ধরনের মত সান্ত্বনা । টুলূ আপা শিকারপুরে ঐ যুবক গুলোর সাথে কথা কাটাকাটি, তর্ক হওয়ার পর তেমন খুব একটা কথা বলে নাই । আম্মার খালি পা’ হাতে স্যান্ডেল, আর ভান্যিটি বাগ, মুখটা শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে, মাঝে মাঝে দাদার সাথে দু একটা কথা বলছে । টুম্পা আর ছোটন দের অবস্থা বিধ্বস্ত । তাকানোর উপায় নেই ওদের দিকে নিজের চেহারার কি অবস্থা কি তা আর বুঝতে বাকী থাকল না । ইতিমধ্যে আমরা সেই প্রাসাদ সম বাড়িটা পার হয়ে ডান দিকে মোড় নিয়েই তিন মিনিট পরেই ওনাদ্যের বাড়ীটা দাদা দেখালো । এক ধরনের উত্তেজনা এবং ধরফরানি শুরু হল আমার ভিতরে জানিনা কেন ! আমি একটু পিছিয়ে পরলাম । এই বাড়ীর আর কাউকে আমি চিনিনা একমাত্র দাদা কে ছাড়া , সবার আগে দাদা, তারপর আম্মা ছোট গলির দুই পাশের বাড়ী গুলো থেকে মহিলা - পুরুষ রা - বাচ্চারা সব ওদের বাড়ীর প্রধান ফটকে আসে ঘোমটার আড়াল থেকে, বাচ্চারা একদম সামনে এসে, পুরুষ রা হুক্কা টানতে টানতে এসে আমাদের কে দেখতে লাগলো ; আমরা আবার কারা ? আমাদের অবস্থা তখন বিপন্ন, ভগ্ন প্রায়, অবিন্যস্ত কাপড় চোপর, ময়লা, খালি পা’ হাতে পোটলা আর কাপড়ের গ্যাঁটটি, না সুইটকেস, না ব্যাগ, না প্রসাধনী, একেবারে ভাগ্যহত এক বিচ্ছিন পরিবারের ৭৫ শতাংশ । বেশ লজ্জাও লাগলো, দাদা বাড়ীতে আগে ঢুকলেন প্রথমে আমরা সব আম্মার পরে এক লাইনে । বাড়ীতে কেউ নাই, শুধু দাদী আর ওনার ছয় /সাত বছরের নাতনী । দাদী একেবারে অপ্রস্তুত বড় ভাসুর কে দেখে, সামনেই আসতে চায় না , আম্মা ঘরের ভিতর ঢুকে গিয়ে পরিচয় দিলো - দাদা যদিও বলেছেন, তারপর আম্মা বুঝতে পেরে যেয়ে চাচী চাচী বলে নিজে থেকেই পরিচিত হোল । ছোট ঐ বোনটা দৌড়ে চলে গেল জানিনা কোথায় ? দাদা আমাদের সবাই কে বসতে বলল, বলেই উনি বলল আমি নামজ ডা পইড়া লাই, তুমরা বও । সারাদিন সারারাত সেই গত কাল বিকালে আমরা ঘর ছেড়েছি এর মধ্যে ৬-৭ ঘণ্টা ঘুম ও বিশ্রাম নিয়েছি । পা’ গুলো আর মানলো না দাঁড়িয়ে থাকতে , আম্মা দাদীকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে আমাদের সবাই কে পরিচয় করিয়ে দিলেন দাদীর সাথে । আমাদের ফ্যামিলির রেওয়াজ অনুযায়ী দাদিকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম সবাই । ছোট খাটো অতি নম্র দাদী , বেশ আদর করলো আমাদের একটা মাদুর বিছিয়ে দিলেন ওটাতেই বসে পরলাম, কারো মুখে কোন টু শব্দ ও নাই , ছোট দুজনকে জীবনেও এত নীরব কোন দিন দেখি নাই । বোন গ্যাঁটটি গুলো ওদের মাথার নিচে দিলো আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হল ওরা দুজনাই ঘুমিয়ে পরল । দাদা নামাজ পরে আসলো, দাদীর ভাইদের বাড়ী টাই পরের বাড়ীগুলো ওখান থেকে অনেকই আসলো আমদের কে দেখতে , হটাৎ দেখি দাদার হাত ধরে ধরে টেনে টেনে নিয়ে আসছে ঐ ছোট্ট মেয়ে টা । দাদা আম্মাকে দেখেই চোখ বড় বড় করে মুখ হা করে দাঁড়িয়ে রইল আর বলল, বউমা আপনে ? আপনারা আমার বাড়ীতে , কি ভাগ্যবান আমি , ওগো বজলু’র আম্মা দেকছিনো কারা আইছে, এইডা আমার খোকা মিয়াঁর পরিবার - আমার কইলজার টুকরা ভাতিজার পরিবার। দাদী কে দেখতে আমাদের পাশের বাসার কবিরের নানীর মত দেখতে ; আমি বলেই ফেললাম । দাদা আমাদের সবাই কে ধরে আদর করে দিলেন ছোট মেয়ে টাকে এনে পরিচয় করিয়ে দিল ওনার বড় ছেলে বজলু কাকার মেয়ে নাম পারুল, আট বছর বয়েস , ওর মা ওকে ৩ মাসের রেখে হটাৎ মারা গেছেন । খুবই সুন্দর একটা মেয়ে পারুল ; প্রথম দেখেই বেশ মায়া লাগল, ইতিমধ্যে ছোট ভাইরা উঠে গেলো ঘুম থেকে , উঠেই দুজনাই কেমন যেন ভ্যাবাচেকা হয়ে পরল , মুখে কোন কথা নাই , আমার মনে হয় ওরা দুজনেই অসম্ভব ভাবে ক্লান্ত, অবসন্ন এবং প্রচণ্ড রকমের নিরুদনতায় (dehydration) ভুগছে । আম্মা কেমনে জানি বুঝতে পারলো সাথে সাথে কল থেকে পারুল কে সাথে নিয়ে গিয়ে পানি নিয়ে এসে ওদের দুজনকে গ্লাস ভরতি পানি দিল আর বলল যত পারো পানি খাও । ওদের দুজনের সার্ট আর প্যান্ট ঘামে ভিজে চপচপে । তাড়াতাড়ি সার্ট খুলে দিলো, ইতিমধ্যে ঐ বাড়ীর মেঝ ছেলে আজিজ কাকা স্কুল থেকে ফিরলেন, শারীরিক প্রশিক্ষণ (পি টি ) শিক্ষক পাশের গ্রাম চারগাছ স্কুলের । এতো গুলো মানুষ ওদের বাড়ীর উঠানে বসে, শুয়ে, দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্থবির হয়ে গেলো, সবাই অপরিচিত আম্মা ছাড়া , তাও আম্মাকে দেখেও ঠাওর করতে পারল না ,কে উনি । বড় দাদা বললেন এটা খোকা মিয়ার পরিবার । শুনে আসস্থ হলেন, আম্মাকে সালাম করলো ; আমাদের কে নাম জিজ্ঞেস করলেন, সবাই অপ্রস্থুত, দাদীর ভাই দের দোকান থেকে কিছু বিস্কুট, মুড়ি, মোয়া, বিচিঅয়ালা আইট্টা কলা (বিচি কলা ) নিয়ে এলো কে জানি , আমরা সবাই গোগ্রাসে খেয়ে ফেললাম, সিকারপুর এ চা বিস্কুট খাওয়ার পর রাস্তায় দুইবার রাস্তার পাশের বাড়ী থেকে পানি চেয়ে খেয়েছিলাম, এর মধ্যে হেঁটেছি হয়ত ৬ - সাত মাইল আর সকালে সুহাটা থেকে ছতুরা ৫ মাইল হবে, ছতুরা সিকারপুর আরও ৬ মাইল সর্বমোট ১৭ - ১৮ মাইল আমরা এক দিনে হেঁটেছি আর গত কাল প্রায় ৮ - ৯ মাইল হেঁটেছি বাসা থেকে পলায়ন করার পর । ভাবতেও অবিশ্বাস লাগে এই শিশু গুলো কেমনে পারলো । তার পর যেকোন মুহূর্তে গুলি বা বোমের আঘাতে মৃত্যু হবার ভয় । এই ভয় যে কি তা আমি কোন ভাবেই আমার লেখা দিয়ে আমার পাঠক দের বুঝাতে পারবো বলে মনে হয় না । ভয়ে থরথর করে কাঁপুনি, গলা শুষ্ক, একদম শুকনা, মুখ দিয়ে ভয়ে কথা বের হয় না, চোখে মুখে চতুর্দিক অন্ধকার লাগে। মাথার, ললাটের ধমনি গুলো যেন কে কনো মুহূর্তে ফেটে যাবে , এত বিকট শব্দ বিমানের আর বিমানের গুলির, বিমানের গুলির কাঁপানো কাঁপানো অবিরাম শব্দ, শহর ছাড়ার পর সারারাত বিক্ষিপ্ত, অসংহত আর্টিলারির বোমার আওয়াজ , প্রত্যেক বোমা টা মনে হচ্ছিলো এই বুঝি আমাদের থেকে ১০ গজ দূরে এসে বিস্ফোরিত হয়ে আমাদের সবাই কে টুকরো টুকরো করে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলবে । এক জন ১০ - ৮ - ৬ বছরের ছেলের কাছে এই ধকল কি বিসাল মনস্তাতিক প্রভাব ফেলতে তা কেউই বুঝবে না, যে এই পরিস্থিতিতে না পরেছে। তারপর জ্যোৎস্না রাতে খোলা প্রান্তরে পাঁচজন মানুষ হেঁটে হেঁটে অগ্রসর হচ্ছে আর পিছন থেকে শত্রুরা ছুড়ছে অনবরত বৃষ্টির মত গুলি , আমাদের তো বুঝার মত বয়েস ও হয় নাই - ওগুলো পিছন থেকে এসে কখন এক সাথে হত্যা করে ফেলবে - প্রায় প্রতি মিনিট পরেই একটা দুই টা গুলি আগুন ছিটাতে ছিটাতে ধেবে আসে ; হে ধরণী তুই দ্বিধা হ …আমরা হারিয়ে যেতে চাই ঐ দ্বিধান্বিত ধরিনির গহ্বরে চিরতরে । এক রাতের ব্যবাধানে জীবনে যে এইরকম পরিবর্তন আসবে তা কোন দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি , আগে শীত কালে দু’ একবার গ্রামে দাদী কে যখন দেখতে এসেছি তখনকার আয়োজন, গভীর রাতে সিলেট মেল অথবা ঢাকা থেকে গ্রিনএরোঁ তে নামতেই দেখতাম একগাদা মানুষ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য ছয় ব্যাটারির টর্চ লাইট হাতে নিয়ে আর কয়েক জন কাঁধে ভার বহন কারি । এক বিরাট কাফেলা সহ বাড়ীতে ঢুকতাম আমরা - বাড়ীর উঠানে সবাই হ্যাজাক বাত্তি জ্বালিয়ে বসে আছে আমাদের আসার অপেক্ষায় । আর আজ ! সময়এর ব্যবাধান কি বিচিত্র । খাবার খেয়ে ফেললাম গোগ্রাসে - আমি এমনিতেই সব সময় একটু পেটুক জাতীয় মানুষ ; আম্মা আমাকে সব সময় চোখ কটমট করত , যাতে কম খাই , বেশি বেশি খাবার জন্যই মনে হয় বেশ শুঠাম দেহি ছিলাম, ক্লাসে সব থেকে উচ্চ উচ্চতার ছাত্রদের একজন ছিলাম ; আমার দোস্ত হেলাল ( পরবর্তিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেয়র ) আমার থেকে চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি ছোট ছিল । আজিজ কাকা একজন খুবই শিক্ষিত মানুষ বলে মনে হল ; ঢাকা ফিজিক্যাল এডুকেশন ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত , বেশ শুঠাম দেহি, বেঁটে কিন্তু বেশ পেশীশালী উনি, তাড়াতাড়ি আমাদের খাবার দাবার এর ব্যবস্তায় ব্যস্ত হয়ে পরলেন উনি, কিছুক্ষণ পর দাদার আরও দুই ছেলে আসলো সাজু কাকা ও মাজু কাকা । সৈয়দ মিয়া দাদা খুব লজ্জিত যে ওনার বাড়ীতে চার ভীটায় চারটা ঘর নেই কারন উনি ঐ ফেলে আসা বড় দালান বাড়ীর থেকে একটু সামনে গ্রামের প্রবেশ মুখে কালভার্রট টার সাথেই বিল্ডিং সহ আরও দুটো টিনের ঘর সহ বাংলা ঘর ওয়ালা বাড়ী বানাচ্ছেন তাই এই পুরাণ বাড়ীর নতুন দুইটা ঘর উঠিয়ে নিয়ে ঐ বাড়ীতে নিয়ে গেছেন কিন্তু কোন ঘর বা বিল্ডিং সবই এখনো রেডি নয় । বর্তমান বাড়ীতে মাত্র দুইটা ঘর আর একটা দহলিজ ( বাড়বাড়ীর ঘর ) একটা ছনের বাকী দুইটা টিনের চাল আর একটার টিনের বেরা আর দুটোই মাটির দেওয়াল দেওয়া । দাদা বলল আম্মাকে ''বউমা আমি আইতাছি দশ মিনিটের মইদ্যয়ে, ‘' বলেই চলে গেলো বাইরে । আমরা ইতিমধ্যে ঘরের ভিতর গিয়ে বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে পরলাম - আর ছোট দুই কাকাদের সাথে কথা বলতে লাগলাম। নুর মিয়া দাদা আজিজ কাকাকে সব ঘটনা খুলে বলছেন রান্না ঘরে বসে বসে , দাদী আর পারুল আর আজিজ কাকা রান্না করছেন আরও একজন মহিলা দাদী কে সহায়তা করছেন । ছোট কাকারা আমাদের কে পেয়ে খুবই আনন্দিত। দুজানাই স্কুলে পড়ে ক্লাস টেন ও নাইনে । এখনও মনে আছে একজন চুল এর স্টাইল ছিল দিলিপ কুমার স্টাইল । মনটা অনেক হাল্কা হল ওনাদের কে পেয়ে এবং ওনারা দুই জনই আমাদের সবাই কে পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত ; প্রথমে এসে বাড়ীতে ঢুঁকে একেবারে ঘাবরিয়ে গিয়েছিলাম । কাকারা দুই জনই একদম শুদ্ধ ভাষা বুঝে না , ওনাদের কথা বলার স্টাইল ও অন্য রকম সব কিছু আমিও ঠিক মত বুঝি না - বাসার মধ্যে আমিই হলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া এক্সেন্ট স্পেশালিষ্ট অথচ আমি নিজেই ওনাদের কথার সব শব্দের অর্থ বুঝতে পারছিলাম না । খালি সব কথায় হাসি হাসি দিয়েই বুঝাতে চেষ্টা করছিলাম যে সব বুঝতেছি । সাজু কাকা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সব কৃষি কাজ তদারক করে , মাজু কাকা হল পরিবারের ফুলবাবু । বুঝে গেলাম , অত বড় এক কষ্টের ধকল পেরিয়ে এসে ওনাদের দুই জন কে বেশ সাছন্দ বোধ করতে লাগলাম । আম্মা উঠে গিয়ে পাকঘর এ গিয়ে সাহায্য করতে লাগলো । টুলূ আপা জীবন এর বেশি সময় বোর্ডিং স্কুলে কাটিয়েছে , ওর জন্য সবার সাথে খাপখাইয়ে নেওয়া খুব সহজ না, তাই চুপ করে সব শুনছে গালে হাত দিয়ে । টুম্পা খুব চেষ্টা করছে ওনাদের মত কথা বলার , ক্লান্তি কেমন জানি কমে এল একটু । সবচে’ বড় যে জিনিস টা হল এইখানে আসার পর থেকে সেই ভয়াত্তক কামান আর গুলির আওয়াজ শুনছিলাম না ; ওটাই মনে হয় সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল মানসিক ভীতি থেকে অবকাশ পাবার কারণ।
এরই মধ্যে সৈয়দ মিয়া দাদ ফিরে আসলেন সঙ্গে আরেক দম্পতি কে সাথে নিয়ে , পরিচয় করিয়ে দিলেন আম্মার সাথে , ওনারা দাদার খুবি প্রিয় বন্ধু দম্পতি ; আসার সময় যে প্রাসাদোপম বাড়ী টা দেখে ছিলাম ওটা তাদের ই , ওনারা আমাদের আব্বা কে চিনেন, উনি এবং আব্বা সমসাময়িক সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে পড়েছেন - আব্বা ছিল কলেজের প্রথম ব্যাচ আর উনি দ্বিতীয় ব্যাচ । তবে আব্বা কখনো মান্দারপুরে আসেন নাই । দাদা এই গ্রামে আছেন গত ১০ বছর যাবত এর আগে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কলকাতায় ছিলেন, তারপর উনি ১৯৬০- ৬১ পর্যন্ত ব্যবসা করেছেন । গত এক যুগ যাবত শ্বশুর বাড়ীতে এসে বাড়ী বানিয়ে থাকছেন এই গ্রামে । দাদার বন্ধু তার স্ত্রী আমরা সবাই একসাথে রাতের আহার খাওয়ার পর দাদা ঘোষণা করলেন যে, আমাদের থাকার জায়গা দাদার বন্ধু মফিজ ভুঁইয়া সাহেবের বাড়ীতে করে এসেছেন দাদা । কারন দাদার বাড়ীতে জায়গা কম । তাই ওনারা দুই জনই এসেছেন আমাদের কে নিয়ে যাবার জন্য । দাদা বললেন আমিও ওখানে থাকবো তোমাদের কে দেখাশুনা করার জন্য , আমাদের তো বলার কিছুই নাই , ওনাদের কথাই শিরোধার্য , যদিও আম্মা বলল, চাচা আমরা কষ্ট করে এইখানেই মাটিতে ঘুমাতে পারবো। কিন্তু সবার চাপাচাপিতে আমরা সবাই ঐ রাতেই গেলাম ভুঁইয়া সাহেবদের বড় বাড়ীতে , যেয়ে দেখি দাদা ইতিমধ্যে আমাদের জন্য রুম, বিছানা, অন্যান্য সব ব্যাবস্থা করে গেছেন ভাত খাবার আগেই । অত রাতে আর গোসল করা হল না - হাত মুখ ধুয়েই ঘুমিয়ে পরলাম সঙ্গে সঙ্গে ।
ভুঁইয়া সাহেবের বাড়ী ভর্তি অনেক লোকজন , সবাই আমাদের খুবি সমাদার করল , দাদা আমাদের তিন ভাইয়ের জন্য একটা হাফ প্যান্ট ও সার্ট কিনে আনলো বাজার থেকে, বোন ও শাড়ী পরা আরম্ভ করল । আম্মার জন্য শাড়ী কিনে আনলেন । দাদা সারাক্ষণ কেবল আল্লাহর কাছে আব্বার জন্য দোয়া করতে লাগলো আর খালি কানতে শুরু করলো, বারবার বলছিল , জানো নাতি কলিকাত্তার রাইয়ট সম তোমার আব্বা আমরারে দেশে ফেরত আইতে অনেক সাহায্য করছে - হেই ছুডু বয়েস থাইকাই ভাতিজা সক্কলের হুজ হবর লইত । তাড়াহুড়া, ভয়, ভীতি এবং মানসিক ভারসাম্য বিমান হামলার পর বের হয়ে আসার সময় তেমন কিছুই নিয়ে আসতে পারি নাই - এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আনলে ঐ গুলো বোঝা বয়ে নিয়ে আসতাম কেমনে ? মান্দারপুর আসা পর্যন্ত পায়ে হেঁটে আসাটাই একটা বিরাট আশ্চর্য আমার কাছে মনে হচ্ছে এখনও - তার উপর যদি আরো ভারী কোন ব্যাগ বা কাপড়ের গ্যাঁটটি বা পোটলা কাঁধে বা মাথায় করে কোন ভাবেই আনতে পারতাম - যে দুইটা পোটলা ছিল ঐ গুলোই অনেক বার ফেলে আসতে ইচ্ছা করছিল । সেদিন সারাদিনই শুয়ে কাটালাম , পায়ে আমাদের সবারই কেটে গেছে, অনেক গুলো ফোস্কা, পা’ গুলো ফুলে গেছে, গোড়ালি ও বেশ স্ফীত - হাঁটলেই ব্যাথা লাগে , তারপর একটু একটু ডাইরিয়ার মত লক্ষণ । আমরা তিন ভাই ই বেশ অসুস্থ হয়ে পরলাম - বিকালে সাজু ও মাজু কাকা এসে প্রায় জোর করেই নিয়ে গেল ওনাদের নতুন নির্মাণাধীন বাড়ী দেখানোর জন্য । আসলেই একটা সুন্দর বাড়ী বানাচ্ছে । আম্মা খুব মনযোগ দিয়ে সব খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করলো , বেশ কয়টা আইডিয়াও দিল ওনাদের । আমরা গ্রামে ঢুকার সময় এই জায়গাটা পেরেয়ি এসেছিলাম আমার মনে পরল । আম্মা কাকাদের বলল তোমরা বাড়ীতে গিয়ে তোমাদের বারবাড়ির ঘর টা পরিষ্কার কর তাড়াতাড়ি কারন আমরা কত দিন থাকব তা তো জানিনা, অন্যের বাসায় থাকতে লজ্জা লাগছে । আমরা এখন উদ্বাস্তু, যে কোন এক জায়গায় থাকতে পারলেই ভালো। তোমরা তোমার আবার সাথে কথা বল - দরকার হলে আমি, টুলু ও মুন্না তোমাদের সাহায্য করব ঐ ঘর টার সব কিছু পরিষ্কার করে ঐ ঘরে আমরা থাকতে পারব অনায়াসে । সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল কাল বৈশাখীর ঝর । সে এক তুলকালাম কাণ্ড, সব ছেলে মেয়েরা ঐ প্রচণ্ড তুফানের মধ্যেই ঘরের বাইরে বেড়িয়ে পরল আম কুড়াতে। আম গাছের নিচে শুধু আম আর আম, কাপড়, সার্ট, লুঙ্গি ভরে ভরে আম কুড়িয়ে এনে বারান্দায় রেখেই আবার দৌড় দিয়েই পৈাছে যায় গাছ তলায় আর বিদ্যুৎ চমকালে আমরা দেখতে পাই আবার ওদের। কিছুক্ষণ পর রণে ভঙ্গ দিয়ে আম্মা ডাকল সবাই কে শোবার জন্য ।
দ্বিতীয় রাত মান্দার পুরে, তিন রাত যাবত গৃহহীন , বাসায় আমাদের কত সুখ ছিল, কত কিছু করার ছিল , রাতে ঘুমাবার আগে জয়তুন বুবু ধমক দিয়ে বলত, হরকিক্স খাইতে, আম্মা সব সময় গরমের দিন সবার বিছানায় নতুন বিছানার চাদর বিছিয়ে দিত। প্রত্যহ ঘরের মেঝে ফুলঝাটা দিয়ে ঝাড়ু দিয়ে ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে মাজা হত । দুপুরে ভাত খেয়ে মেঝেতেই এক ছোট্ট ঘুম হয়ে যেত । বিকালে খেলতে যেতাম মুরশিদ কাকা সাথে সাথে তাখতো সব সময়, অথবা আব্বার সাথে সাইকেলে চরে ক্যাম্পে যেতাম খেলা দেখতে । সবাই যেমন তেমন আমার জন্য খুবি কষ্টকর হয়ে উঠলো জীবন টা, আমি সব সময় খুব উজ্জ্বল আলো পছন্দ করতাম , তাই আমাকে রাস্তার দোকানের উজ্জ্বল, নিয়ন, চকমকে, সাইন ও লাইটিং খুব ভাল লাগতো খুবি অল্প বয়স থেকে, তাই আমি গ্রামে গেলে সন্ধ্যা হলেই হাঁপিয়ে উঠথাম স্বল্প আলো , কুপি বাতি অথবা অপরিচ্ছন হারিকেন এর চিমনি দেখে, আমাদের বাসার হারিকেন এর চিমনি প্রত্যেক দিন ঝকঝক করে পরিষ্কার করতে হত । এখন এখানে ভয় টা কমে গেছে অনেক অংসে যদিও - কেন জানি মনে হল যে , এই অজ পাড়াগাঁয়ে পাঞ্জাবিরা আসবে না হয়ত। কিন্তু প্রধান সমস্যা হল এই অবস্থায় থাকবো কিভাবে ? আব্বার কথা বারবার মনে পরছে সারাদিন । ভাইজান এর এতদিনে সিলেট থেকে চলে আসার কথা কিন্তু কোথায় সে , দুটো গাঁটটির একটা দাদার বাড়িতে রেখে এসছিলাম এই বাড়ীতে আসার সময় ; আম্মা ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে গেছে , আমার আর ঘুম আসলো না ; কেবল কেমন কেমন জানি ভয় লাগে, এই বুঝি এসে পরল আর এসেই নির্বিচারে গুলি চালাবে । সবাই আমরা হত্যা হব ওদের হাতে নির্মম ভাবে , আব্বা কি ওদের হাতে ধরা পরে গেলো না তো ? আমি আমার ঐ বয়েস পর্যন্ত কোনদিন কোন আত্মীয়দের বাসায় যেয়ে থাকি নাই । আমি কারো উপড়ে মুখাপেক্ষী হতে একদম পছন্দ করতাম না সেই ছোট বেলা থেকেই । এখানে এসে আমার একদম মন বসছিল না । তার উপর অনাত্মীয় আরেক জনের উপর এভাবে থাকটা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না । বাইরে তখনো ঝর বইছে বেশ জোরে , টিনের চালে একেকবার এসে ঝাপটা মারছে বৃষ্টির ছিটা প্রচণ্ড বেগে ; ঘর, জানালা গুলো মনে হতে লাগলো যে কোন সময় ভেঙ্গে পরবে । হঠাৎ মনে হোল ও হো , দুইটা পোটলার একটাতে রেডিও টা দেখেছিলাম। ঐটা মনে হয় , নুর মিয়া দাদার কাছে খুব কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম , দাদা যদি না যেতো আমাদের বাসায় তাহলে ঐ ক্রান্তিকালে কি যে উপায় হত আমাদের তা উপলব্ধি করার মত সাহস আমার করতে পারলাম না । পাকিস্তানিরা ঠিকই আমাদের খুঁজে বের করে ফেলত - কেউ না কেউ বলে দিত আমাদের কথা - আব্বার কথা, আমাদের পরিবারের রাজনৈতিক মতাদর্শ । ব্রাহ্মণবাড়িয়া তে দেখেছি অনেক ই পি আর এর লোক পোশাক পরা অবস্থায় ; দু’ এক জনের সাথে কথাও বলেছি, আব্বার পরিচয় দিয়ে । ই, পি আর এর আমার নম্বর ছিল ১৩৫ উনি প্রথম কয়েকজনের এক জন, সেই ১৯৫৮ সালে ই, পি, আর প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই সে কোম্পানি কম্যান্ডার হিসেবে চাকরী করছেন ; পূর্ব - পশ্চিম পাকিস্তান বৈষম্য থাকায় বাঙ্গালি সুবেদার রা অতো তা অগ্রাধিকার পেতো না প্রোমোশন এর সময় । ওরা ওরা নিজেদের পাঞ্জাবি অথবা পাঠান কাউকেই সুবেদার মেজর বানিয়ে নিত । এসব ভাবতে ভাবতে মনে মনে ধারনা করলাম যে, আব্বা নিশ্চয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ই, পি, আর দের মত সেও তার কোম্পানি নিয়ে বিদ্রোহ করেছেন আবার ভাবলাম হয়ত এমন ও হতে পারে যে ওনাকে ধরে বন্দী কিংবা মেরেও ফেলেছে ইতিমধ্যে । মাথার মধ্যে অনেক কিছু ঘুরপাক খেতে লাগলো । কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম জানিনা ।
উঠেই দেখি সৈয়দ দাদা আর নুর মিয়া দাদা বসে আছে বাইরে, দাদার হাতে সেই লাঠি আর তার একটা লেদারের সাইড ব্যাগ নিয়ে । আম্মা আপা আগেই উঠে ঐ বাড়ীর মহিলা আর কাজের লোকদের নাস্তা বানানো তে হেল্প করছে । নুরু মিয়া দাদা আমাদের কে মেসওাক করার জন্য চার পাঁচটা এক ধরনের গাছের ডাল দিলেন । আমরা ওগুলো দিয়েই দাঁত মাজলাম । নাস্তা খাওয়ার পর নুরু মিয়া দাদা বললেন, আম্মাকে, মা , গো, এখন তো আবার যাবার সময় হল , এবার বিদায় দেও। আমার ভাতিজার পরিবারের বিপদ এর সময় তুমরার লগে থাকতাম পাইরা নিজেরে খুব বাজ্ঞ্যবান মনে করতাছি , আমার ভাতিজার অবস্থা যে কি এক আল্লাহ ছাড়া কেই জানেনা , আমারার সোনার টুকরা ভাতিজা খোকা মিয়া, আল্লাহ তারে সহি সালামতে রাখে যেন, এবার আমারে বিদায় দেও গো বউ মা।
এতক্ষণে আম্মা কে এই প্রথম ভেঙ্গে পোতে দেখলাম, বলল কাকা, আপনার ঋণ আমরা কনো দিন এই জীবনেও শোধ করতে পারবো না , এতগুলো বাচ্চা নিয়ে আমার কি অবস্থা হত, আপনে সেদিন না গেলে । আমি চিন্তাও করতে পারছি না । আম্মা খালি বলল কাকা, পারলে আমাদের গোপিনাথ পুর পারলে নিয়ে যান, যদি ওদের বাবা আসে ওখানে তাহলে সহজেই খুঁজে পাবে সবাই কে । আম্মার চোখে পানি দেখে আমরা সবাই দাদা কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম । বিশাল এক লম্বা এক মানুষ ৬ ফুট লম্বা, শরীরে এক ফোটা মেদ নেই, একেবারে সোজা হয়ে দাঁড়ানো , আমাদের সবাই কে কয়েক টা লেবুঞ্চুস হাতে দিয়ে বলল , ‘'আমিযাইয়া লই, পরিস্থিতি ডা বুইজ্জা, বাদল ( ওনার ছেলে ) কে পাডাইয়া অথবা আমি আইয়া নিজেই তমাগোরে লইয়া জাইমু , চিন্তা কইরো না , আমার ভাই সৈয়দ মিয়ার এখনে কুনো অসুবিদা হইত না ।’' আম্মা ওনার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন, পর পর আমরা সবাই দাদা কে কদমবুচি করলাম । সৈয়দ মিয়া দাদার ছোট ছেলে মাজু কাকা বড় দাদা কে সঙ্গে নিয়ে রওনা হয়ে গেলো আমরা দাদা কে সৈয়দ মিয়া দাদার নতুন বাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসলাম ; অনেক ক্ষণ সবাই ছোট পুল টার উপর দাঁড়িয়ে থাকলাম যতক্ষণ দেখতে পেলাম । খুব কম মানুষ ই আছে পৃথিবীতে যে এই ভাবে নিজের জীবন এর ঝুঁকি নিয়ে এত গুলো মানুষের নিরাপত্তা দিবে । যাবার আগে ওনার ব্যাগ থেকে বের করে একটা খাম আম্মায়ে দিয়ে বলল, ''এই নাও বউমা আমার এই মাসের পেনসন- তুমরার অহন টেহা দরকার , লও, এইডি রাহ ।'' আম্মা কোন কথা না বারিয়ে খাম টা নিয়ে নিলো । খুবি বিষণ্ণ মনে ফিরে এলাম; ভুঁইয়া সাহেবের বাড়ীতে না ঢুকে চলে আসলাম দাদার বাড়ীতে । এসে দেখি সাজু কাকা আর আজিজ কাকা এবং ওদের ক্ষেতের কাজের লোক নিয়ে ওনাদের বাইরের দিকের ঘর থেকে সব জিনিস পত্র ঠিকঠাক করছে । কাদা পানি , ঝরা পাতা, গাছের ডাল ভাঙ্গা গত রাতের কাল বৈশাখীর তাণ্ডবে । আম্মা ও নেমে গেলো ওনাদের সাহায্য করতে আমারাও হাত দিলাম । আম্মা এরই মধ্যে, গোওাল থেকে গোবর এনে ঘরের মেঝে হাত দিয়ে মাটীতে বসে বসে লেপা শুরু করল । একটা বিছানা আর প্রায় পাঁচ ফুট জায়গা বের করা গেলো; ওনারা নতুন বাড়ীর কাজে হাত দেওয়াতের দুইটা ঘর উঠিয়ে ঐ বাড়ীতে নিয়ে গেছেন , তাই ঐ দু ঘরের সব মালপত্র এই বাইরের ঘর টাকে স্টোর হিসেবে ব্যাবহার করছিলেন । এখন আমাদের জায়গা করার জন্য এত কষ্ট করছেন , আমাদের কে ওনারা জীবনেও দেখে নাই , আমরা শহরের বাসিন্দা , গ্রামে কোনদিন আসি না , নিজেদের জীবন নিয়েই সারক্ষন ব্যস্ত ছিলাম, এখন বিপদে পরে ওনাদের শরণাপন্ন হয়েছি - তারপর ও ওনাদের অতিথিতেয়তা দেখে বিমুগ্ধ । শুধু আমরা ওদের বড় ভাইছাব হুঁকা ( ‘খ' কে ‘হ' উচ্চারণ করেন এখানে ) । প্রত্যেক মুহূর্তে, প্রত্যেক বাক্য ও শব্দেই আবিষ্কার করছি নতুনত্ব বা উচ্চারণ বিভ্রান্তি ; আমরা এক ওপরের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি কেবল। জীবনেও জানতাম না আমাদের বাংলায় ২৫ মাইল দূরের ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মান্দারপুর গ্রামের সংস্কৃতি, ভাষা,উদাত্ততা বা স্বরাঘাত ( এক্সেনট ) এত ভিন্ন হবে । কিন্তু ওরা ভীষণ সরল, প্রাঞ্জল যদিও একটু উচ্চনিনাদী কিন্তু শহরের মানুষের মত যান্ত্রিক বা কৃত্রিম নয় মোটেও। বিশেষ করে সাজু কাকা ছিলেন একজন অপূর্ব মানুষ । একাই পাঁচ জনের কাজ করতে পারে । আমরা ওনাদের সবাই কে রেখে পারুল নিয়ে গ্রাম টা দেখতে বের হলাম, বেশ সুন্দর, অপূর্ব সুন্দর করে মাটির কলস, হাড়ি, প্লেট, সুরাউয়া বানায় হিন্দু সম্প্রদায়ের কারিগর গুলো, পরিছন্ন হাতের কাজ, দেখতে খুব ভাল লাগলো । গ্রামের মানুষ গুলো ভাবল হয় আমরা বিহারী নয়ত হিন্দু কারণ আমার বোন সালওয়ার কামিজ পরা , পর্দানশিন নয়, আম্মা কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরা , কথায় কথায় ইংলিশ বলে , বেশ একটু মাস্টরনি মাস্টরনি ধরনের , যখন বুঝল যে আম্মা একজন মাস্টার তখন অবাক হল না , সর্বপরি আমরা ভিন্ন ভাষায় কথা বলি। কেবল আমি একটু ব্রাহ্মণবড়িয়ার ভাষায় কথা বলি, বাকিরা শুদ্ধ প্রায় নদীয়া শান্তিপুরি ধরনের । ওরা আমাদের অনেক কথাই বুঝে না আমাকে অনুবাদ করে দিতে হয় প্রায়শঃ । পারুল সবার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল গর্ব করে ; আমাকে ও ভাইছাব বলে ডাকে , খুবি আদর লাগে ঐ ছোট্ট মেয়েটাকে , খুবই নিরীহ, কথার ফাঁকে জানলাম ওর আব্বা সৈয়দ মিয়া দাদার বড় ছেলে বজলূ কাকার মেয়ে , ওর আব্বা আরেক টা গ্রামে থাকে, উনি একজন কামেল পীর টাইপের মৌলানা সাহেব; ওনার একটা বিরাট মাদ্রাসা আছে ; ও এখানে এসেছে ওর দাদীর সাথে কয়েকটা দিন থাকার জন্য । হেঁটে হেঁটে আমরা গ্রামটা প্রদক্ষিণ করে ফিরলাম দুপুরে খাবার আগে । আবার গেলাম ভুঁইয়া সাহেবের বাড়ীতে, দাদা ও আমাদের সাথে আসলেন ; ভুঁইয়া আর আমাদের দাদা জিগ্রী দোস্ত ; ওনারা দুজনায় এই গ্রামের পঞ্চায়েত এর প্রধান মুখ্য কর্তা । যেহেতু আমরা সৈয়দ মিয়া দাদার আত্মীয় তাই গ্রামের সবাই আমদের কে খুব সমীহ করলো বলে মনে হলো। কিন্তু সবার মুখেই কেমন যানই বিষণ্ণতা এবং অনিশ্চয়তা , সবাই খালি জিজ্ঞেস করে আমরা ঢাহা (ঢাকা) থেকে এসেছি কিনা ?
খাবার পর আম্মা খুবই সমীহের সাথে ভুঁইয়া সাহেবের স্ত্রী এবং ভুঁইয়া সাহেব কে বললেন, আপনারা যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমারা কালকে সকালে কাকার আমার কাকা শ্বশুর এর বাড়ীতে চলে যাব , আপনাদের কাছে আমরা আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব আপনাদের আতিথেয়তার জন্য । যদি আপনাদের আজ্ঞা হয় তাহলে আমরা কি পারি কালকে ? ওনারা রাজি হলেন, দাদাও ওনাদের বুঝালেন । ওনাদের স্কুল তখনো খোলা, ভুঁইয়া সাহেব বললেন আমি কথা বলব স্কুল কমিটির সাথে আপনি আমাদের স্কুলে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন ইংলিশ পড়ানোর জন্য । আম্মা বললো তা হলে তো ভালোই হয়। আম্মা এর পর দাদা কে বললেন কিছু বাজার সদাই করে আনার জন্য, আমাকে সাথে জেতে বললেন । আমি নিকটম চারগাছ বাজারে গেলাম দাদার সাথে । আম্মা দাদা কে লিস্ট করে দিয়েছিল । আমি ব্যাগ বহনকারী । বাজারে গিয়ে দাদা অনেক খবর নিয়ে আসলেন । আরও জানতে পারা গেলো বি বাড়ীয়া - কুমিল্লা সড়ক এর পাশের সব গ্রামে হানা দিচ্ছে রাত্রে রাত্রে । শুনে আবার সেই পুরনো ভয় টা আমার মধ্যে আসা শুরু করলো ক্রমে ক্রমে। মেরুদণ্ডে কেমন জানি একটা শিউরে ওঠার অনুভূতি পেলাম । বাজারে দাদার সাথে একজন সুঠাম দেহি বিশাল এক জন ভদ্র লোকের সাথে দেখা হলো ; দাদা যখন ওনাকে বলল এইটা তোমার ভাতিজা , তোমার খোকা ভাইসাবের ছেলে ; শুনামাত্র ওনার আরও দুই ভাইকে দেখে আনল আর আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল আমাকে সবাই এরা এখনো শাহিন নামেই চিনে ; জানলাম এরা আমার আব্বার আপন খালাতো ভাই ওনার নাম তাজু কাকা, মজল কাকা, সবার বড় রফু কাকা এই বাজারে তারা এসেছেন তাদের রাইস মিলের জন্য ধান কিনার জন্য , ওনার শুনেই বলল, মামা আমরা আজকে আসতে পারব না নৌকা নিয়ে অনেক ধান নিয়ে যাইতে হবে , কালকে উনি (তাজু ) কাকা আর মিজান কাকা (ওনাদের সবচে’ ছোট ভাই ) আমাদের কে দেখতে আসবে । দাদা কে জিজ্ঞেস করলাম ওনারা কোথায় থাকে ? দাদা বললেন এই তো ৬-৭ মাইল দুরে সিমরাইল নামক গ্রামে । আরও ভিতরের দিকে - আরও ভাটির দিকে তিতাস নদীর দিকে । মান্দারপুরে কোন নদী নাই তবে নদীর সাথে সংযোগ এর জন্য একটা খাল আছে যেটা দিয়ে ওনারা নৌকা নিয়ে এসেছেন। তাজু কাকা বাজার থেকে আমাদের সবার জন্য অনেক মিস্টি কিনে দিলো ; বারবার ওনারা তিন ভাই আমাদের কল্যাণ নিয়ে অনেক বার জিজ্ঞেস করলেন । খুইব ভাল লাগলো , সব আত্মীয়দের আমাদের পরিবারের প্রতি হামদরদী আব্বা অবশ্য সব সময়ই বলতেন আত্মীয়তার মধ্যে মিল মিলাপ খুবই প্রয়োজনীয় । এখানে এসে দেখলাম আমাদের সবার প্রতি অন্যান্য দের কত অনুভূতি, শহরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া তে হাতে গোনা কয়েক জন আত্মীয় আর অন্যান্য শহরে যেখানে যেখানে আমরা থেকেছি ওখানে আত্মীয় অনেক জায়গায় ছিলই না একেবারে । তাই তো আমরা অনেক কাছের আত্মীয়দেরকেও চিনি না । দাদা কে বলল ওনারা মামা ‘' তারারে আমরার এহানে লইয়া আনমু আমরা কয় দিনের লাইজ্ঞা ‘' । দাদা বললেন অবশ্যই, ‘' বউমার লগে আইয়া কালকা দেহা কর পয়লা’'। এই বলে আমরা বিদায় নিলাম ওনাদের কাছ থেকে । আমারা বাজার সদাই নিয়ে দাদার বাড়ীতে আসলাম , আম্মাকে সব খুলে বললাম কাকাদের কথা, মিষ্টি গুলো দিলাম , আরও কালকে ওনারা দুইজন আসবে আমদের কে দেখতে । আরও বললাম যে, পাঞ্জাবিরা এখন আস্তে আস্তে গ্রামে এসে হামলা করছে , রফু কাকা ( আব্বার আপন খালতো ভাই - ছোট খালার ছেলে ) কি জানি বলতে গিয়েও বললেন না, ইন্ডিয়া তে যাতে যুবক রা মুক্তি ট্রেনিং এর জন্য যাতে না যেতে পারে তাই ওদেরকে বিভিন্ন গ্রামে এসে পাঞ্জাবিরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে , আম্মা বললেন রফু কাকা তো ঢাকায় শ্রমিক পার্টির খুব বড় নেতা, তেজগাঁ এলাকায় তার অনেক প্রতিপত্তি , নেতা হিসেবে, অনেক বার জেলেও গিয়েছে আন্দোলনের জন্য। আমি বললাম নেতা বলেই মনে হয় কথা খুব কম বলে ।আম্মা বললেন , না, তেমন নাতো ও , ও খুব বকবক করে সারাক্ষণ , একবার নাকি সিলেটে এসে আমাদের বাসায় পালিয়েছিল পুলিশ এর হাতে গ্রেফতার এড়াবার জন্য, আমার মনে নেই আমি বললাম । আমি বললাম আম্মা আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থাকতেই শুনেছি অনেক বড় ভাই যারা মুক্তিফৌজ এ যোগদান করেছে তারা বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে ইন্ডিয়া চলে গেছে । আম্মা বললেন, কালকে তাজু কে ভালো করে জিজ্ঞেস করবো । আম্মা দাদা কে লিস্ট এ লিখে দিয়ে ছিলেন ব্যাটারি আনার জন্য - দাদা তিনটা চান্দা ব্যাটারি নিয়ে এসেছেন । আম্মা আস্তে করে বড় পোটলা টা বের করে ওটার ভিতর থেকে আমাদের অতি প্রিয় এন, ই , ছি ৩ ব্যান্ড রেডিও টা বের করলো । ব্যাটারি গুলো লাগিয়ে টুউনিং করতে লাগলো। প্রথমে ঢাকা ধরল, তার পর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আকাশবাণী ধরলো, তারপর বিবিসি ধরতে পারলো। রাত প্রায় ১০ টা এগারটা বাজে, সাজু কাকা নুরু মিয়া দাদা কে আমাদের গ্রামের বাড়ী তে পৌছিয়ে দিয়ে, আমার দাদী কে দেখে এসেছে, দাদী ভালো আছে, আমাদের কে ওখানে যেতে মানা করলো কারণ গ্রামে অর্ধেক লোক পালিয়ে গেছে, দাদী তার বাবার বাড়ী কালকে চলে যাবে ওইখান থেকে লোক এসেছে নৌকা , পাল্কি, হেঁটে নবীনগর এর নিকট দাপুনিয়া নামক এক গ্রামে চলে যাবে । এরিমধ্যে গ্রামে তিন চার বার পাকিস্তানিরা এসেছে। বাজার বন্ধ হয়ে কসবা ক্যাম্প আর মোগড়া তে ক্যাম্প, আখাউরা বিশাল ক্যাম্প আর আরেক দিকে মন্দবাগ - সালদানদী বড় ক্যাম্প , দিনে দশ পনর বাড় ট্রেন ইঞ্জিন আর ইস্নপেকষন ট্রলি দিয়ে পেট্রল করে লাইনের উপর দিয়ে ।
আমাদের গ্রামের অর্ধেক ছেলেরা বর্ডার পার হয়ে মুক্তি ফৌজে জয়েন করেছে । নুরু মিয়া দাদাও দু এক দিন এর মধ্যে ওনার শ্বশুর বাড়ী ইন্ডিয়া বর্ডার সংলগ্ন বাড়াই গ্রামে চলে যাবে । উনি আর দাদী চলে গেলে আমাদের বাড়ীটা সম্পূর্ণ শূন্য হয়ে পরবে। অনেক প্রশ্ন করেও আব্বার ব্যাপারে কোন কিছুই বলতে পারলেন না । সাজু কাকা আরও বললেন উনিও মুক্তি তে যোগদান করবে শিগ্রই । বলল এই পাঞ্জাবী কুত্তাগুলোকে যেমনেই হউক এদেশ থেকে বিদায় অথবা মেরে ফেলতে হবে। বলল ছি এন্ড বি রোড পার হওয়া আর ফুল সেরাত পার হওয়া এক ই কথা , যান ডা হাতো লইয়া দৌড় দেওয়া লাগে , দুই তিন মিনিট পর পর গাড়ী দেয় পাহারা দেয় পুরা রাস্তা । প্রতেক তা ব্রিজের উপড়ে এবং নিচে চেকপোস্ট - ওরে তিন বার চেক করছে , সব খুলে । উনি বললেন বাড়ীতে কাউকে না বলার জন্য । আরও বলল, বাবি (ভাবি), নয়া একডা রেডিও খুলছে, দেহেন পান নি , ‘' স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ‘' । বলে উনি ঘুমাতে চলে গেলেন । আম্মা, বোন উপড়ে সিন্দুকের উপড়ে খাটে, আমরা তিন ভাই সিন্দুকের সাথেই লাগানো চৌকিতে, বিছানা খুবই যত সামান্য , বালিশ এ তুলা নাই, দুইটা কাঁথা, একটা বিছানো আর একটা গায়ে দিবার জন্য । বড় একটা ঘর প্রায় দৈর্ঘ্যে ২০ ফুট প্রস্থে নয় - দশ ফুট মধ্য খানে আজকে একটা পাট কাঠি দিয়ে পার্টিশন কোন রকমে লাগিয়ে দিয়েছে আপাততঃ হিসাবে, চাল ছনের কোন সিলিং নাই । প্রস্থ বরাবর বাসের আর কাঠের কড়িকাঠ গুলো। চাল যেতে উড়ে না যায় বাতাসে বা ঝরে তাই চার চারটা বাঁশ ৪৫ ডিগ্রী - ৫৫ ডিগ্রী তে বেঁকা করে ঘরের বাইরে মাটিতে পুতে ওটার শেষ অংশ চালের প্রধান করিকাঠের সাথে পাটের দরি দিয়ে বেধে রাখা । গ্রামে বেশির ভাগ কাজেই পাটের দরি, সুতলি, রশি ব্যাবহার করা হয় আর সবচে’ বেশি ব্যাবহার হয় বাশ । প্রায় সব বাড়ীতেই একটা বাঁশঝাড় আছে । ঘরে একটা হারিকেন ; টয়লেট প্রায় ২৫০ গজ দুরে পুকুরের ঐ পারে বাড়ীর সীমানার শেষ প্রান্তে ; অন্ধকারে ওখানে দিনের বেলা যেতেই ভয় লাগে , আর রাত্রে বাতিছারা যাওয়ার প্রশ্নই উঠেই না । তাই আম্মা বাতিটা ডিম করে জ্বালিয়ে রাখলো, অনেকক্ষন রেডিও নাড়াচাড়া করেও স্বাধীন বাংলা ধরতে পারলো না, তাই রেডিও বন্ধ করে বাতিটা ডিম করে সবাই ঘুমিয়ে পরল । আমি আর ঘুমাতে পারছি না । আমাদের শোবার ঘর টা বাড়ীর পাশ দিয়ে যাওয়া গলির সাথে লাগানো, কতক্ষণ পর পরই মানুষের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় , কেই কেই আবার সুন্দর গলায় আব্দুল আলিমের পল্লী গীতি গাইতে গাইতে হেঁটে যায় একদম ঘরের পাশ ঘেঁষে । পদধ্বনি আমাকে বারবার শঙ্কিত করে তুলে , এই মনে হয় এসে পরেছে, আমিই একমাত্র পুরুষ এই পরিবাবের আমার কোন কিছুই করার থাকবে না । অঙ্কুরেই মৃত্যু বরন অবধারিত । ভাবি আর একা একাই শিউরে উঠি আর পিপাসা লাগে । বারবার - কাউকে বলতেও পারি না । লজ্জায় এবং এই মুহূর্তে আমি নিজেই যদি আমার এই ধরনের দুর্বলতা প্রকাশ করি, তাহলে, আরও অনেকে ভেঙ্গে পরবে , তাই আমাকে শক্ত থাকতে হবে । বাসায় থাকতে আমরা তিন ভাই অনেক ঝগড়া ঝাটি করতাম মাঝে মাঝে কিন্তু এই চার দিনে একবারও কোন প্রকার রাগারাগি হয় নাই আমাদের ভিতর । এই সব ভাবতে থাকলাম আর মনে মনে ভাবতে লাগলাম - ইস আমি যদি ১৫-১৬ বছরের হতাম আজ । নিজেকে নিজেই দোষারুপ করতে লাগলাম শুধু শুধু , মনের পর্দায় কেবল ভাসতে লাগল একুশে ফেব্রুয়ারির পুষ্প মাল্য অর্পণ করা শহীদ মিনারে, উত্তাল ফেব্রুয়ারী - মার্চের দিন গুলোতে মিছিলে যাওয়া, গলার সব জোড় দিয়ে স্লোগান দেওয়া , সোনার বাংলা কেন শ্মশান লিফলেট টা বারবার পড়া, হিজ মাস্টার্স ভয়েস এর বুল ডগ টার মত বসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নেতা লুৎফুল হাই সাচ্ছু ভাই, আলী আজম সাহেব, ইমদাদুল বারী, ডাঃ ফরিদুল হুদা, মাখন ভাই, কুতুব ভাই, জাহাঙ্গীর ভাই, মাহবুবুল হুদা, আমার প্রিয় হুমায়ুন ভাই দের বক্তৃতা শুনতাম । আব্বা সব সময় বলতেন এই হারামজাদা গুলো আমাদের কে চরম ভাবে শোষণ করেছে , আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে , ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা থেকে সিলেটে বদলি হয়ে যাওয়ার সময় বাসায় কয়দিন জয়েনিং লিভ এ এসে ছিল ; তখন আমার সাথে গল্প করছিল যে, ই, পি, আর এর সবচে’ সিনিয়ার বাঙ্গালি সুবেদার মেজর রব কাকা ( আব্বা অনাকে রব ভাই বলে ডাকতেন ) আব্বাকে সাসি থে নিয়ে একদিন রব কাকা লিডার এর সাথে গোপনে দেখা করে এসেছেন ( রব কাকা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অনেক দিন সাসপেন্ড ছিলেন ) বলছিলেন আম্মাকে, আমি দূর থেকে শুনেছি । আব্বা সব সময় খুবি রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ছিলেন । ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে পড়ার সময় থেকেই উনি অনেক কেই চিনতেন যারা প্রবর্তিতে অনেক অনেক বড় নেতা হয়েছেন, দ্বিজেন্দ্র নাথ দত্ত কেও দেখেছেন এবং কলেজে সম্বর্ধনাও ওনারা দিয়েছে তাঁকে, অলি আহাদ কেও খুব কাছ থেকে চিনতেন বি বাড়িয়া কলেজের দিন গুলো থেকে । আব্বা একজন অত্যন্ত বাক্যবাগীশ বক্তা - খুবিই সুন্দর তার বাচন ভঙ্গি, খুব সাহসী এবং স্পষ্টবাদী ছিলেন যার জন্য ই, পি আর এর পাঞ্জাবী উইং কমান্ডার (মেজর), উইং টু আই সি (ক্যাপ্টেন ) এবং সেক্টর কমান্ডার ( লেঃ কর্নেল ) রা খুব একটা পছন্দ করতেন না , যার জন্য ওরা ওনাকে অনেক বার অনেক মফঃস্বল এবং পাহাড়ি দুর্গম উইং এ রামগড়, লাঠি টিলা, আসালং বিচ্ছিন্ন লড়াই সংগঠিত হওয়া এলাকায় বদলি করতেন । ই, পি , আর ১০০% বাঙ্গালী সদস্যদের কাছে ফজলুল হক চৌধুরী ছিলেন একজন প্রিয় কোম্পানি কমান্ডার । অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ছিলেন আব্বা । সব সময় তার কোম্পানির লোকদের পিতার মত আগলে ধরে রাখতেন ; পাঞ্জাবীরা যাতে ওদের কে কোন রকম ভাবে নিগৃহ না করতে পারে । দেখতেও লাগে ওনাকে একজন স্মার্ট মানুষ হিসেবে, ৬ ফুট লম্বা, শরীরে একফোঁটা মেদ নাই , সকালে পি টি এবং বিকালে ফুটবল লেফট ব্যাক এ খেলতেন অথবা ভলিবল খেলতেন প্রত্যেক দিন - এক লাফে সবার মাথার উপড়ে উঠে বলটা স্মাশ করতেন দেখার মত স্টাইলে - সাদা হাফ প্যান্ট আর সাদা সার্ট সাদা জাম্পার পরা - খুবি স্মার্ট লাগতেন আব্বাকে । রবিবারে ওনার প্রিয় বন্ধু সুবেদার মান্নান কাকার সাথে দাবা খেলতেন অথবা শীত কালে ব্যাডমিন্টন খেলা, ব্যাট মান জলিল কাকা পয়েন্ট কাউন্ট করতেন, আর বলতেন, ‘' বোথাং লস ‘' - যার মানে হচ্ছে, ইংলিশ এ , ‘' বোথ হ্যান্ড লস্ট’'। এসব ভাবতে ভাবতে আবার জন্য মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল ; বেশ কান্না ও পেল - আমি আব্বার খুবি প্রিয় এবং আব্বার কাছে মুন্নির (আদর করে আমাকে মুন্না না ডেকে 'মুন্নি' বেটা বলে ডাকতেন ) সাত খুন মাফ । চোখ ভরে গেল জলে । সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেল সবার আগে । ডাইরিয়া টার উদ্রেকটা তখনো কমে নাই ।
নাস্তা এখন আম্মা আর আপা দাদি কে সাহায্য করে , দুইটা পরোটা একটা ডিম অমলেট দিয়ে খেলাম ; চা এর ব্যবস্থা দেখতে পেলাম , নাস্তা খাওয়ার সময়ই দেখলাম সাজু কাকা আর মাজু কাকা খেতে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে - আম্মা কে জিজ্ঞেস করলাম আমি যেতে পারবো কিনা ওদের সাথে ? আম্মা বলল যাও - আম্মাই কাকা কে বললেন, সাজু, মুন্না কে সাথে নিয়ে যাও, শিখুক জমি কেমনে চাষ করতে হয় । ঐ প্রথম ক্ষেতে গেলাম, প্রথমে ওনাদের বাড়ীর নিচেই একটা জমিতে পাটের জমি, শুরু করল আগাছা নিড়ানো -, গরু দুইটা পাশে একটা চিরুনির মত লাঙল এর শেষাংশে লাগানো ওটার সাথে বেধে রাখল, দুই ভাই মিলে দুইটা নিড়ুনি দিয়ে সব ছোট ছোট পাট গাছের মধ্যে গজিয়ে উঠা ঘাস, আগাছা গুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উঠিয়ে স্তূপ বানালো আর আমার কাজ হল ঐ আগাছার স্তূপ গুলো সব একত্রিত করা একখানে তিন ঘণ্টার মধ্যে ঐ জমিটা শেষ করে , এর পরের একটু দূরে আরেকটা বেশ বড় জমিতে ধান ক্ষেতে ঐ চিরুনি দিয়ে গরু গুলো দিয়ে এসই একি ভাবে আগাছা পরিষ্কার করল ; এক ঘণ্টার মধ্যে শেষ , সাজু কাকা সারাক্ষণ দারুণ সুন্দর গলায় বিভিন্ন ধরনের গান গাইতে থাকল ; ''তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়,’' তারপর গাইল, ''দুয়ারে আইসাছে পাল্কি , ‘' এরপর , ‘' পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া রই আমি ‘' - একের পর একটা গান সারাক্ষণ গান ই গাইল ; মধ্যে খানে তিন জন মিলে মাটির সানকিতে ভাত , ডাল, শাক এর সাথে পুটী মাছ ভাজি দিয়ে খেলাম । সে এক অভিজ্ঞতা , আঁচড়া ( ঐ চিরুনি কে বলে ) টার হাতলে ধরে গরুর সাথে হাটার চেষ্টা করলাম কিন্তু দেখতে যত সোজা বাস্তবে বেশ কষ্টকর। কিন্তু, দুই ভাইয়ের কথায় বুঝলাম, ওরা দুজনেই বাড়ী থেকে পালাবে যে কোন সময় ইন্ডিয়া তে যেয়ে মুক্তিবাহিনী তে যোগ দিতে । দুই ভাই বেশ বন্ধু সুলভ যদিও মাজু কাকা বড় ভাই কে চুডুভাইছা বলে সম্বোধন করে , মনে মনে ভাবলাম ইস আমি যদি এদের মত বড় হতাম । এমনিতেই প্যান্ট আমার মাত্র দুইটা এই জমি তে এসে সব একবারে ময়লা করে ফেলেছি । বেশ ভয় পেলাম, টুলু আপার যা মেজাজ আবার যদি এই গুলো ধুতে হয় তাহলে এক চোট নিবে । ভয়ে ভয়ে ফিরলাম, কিন্তু এইটা ছিল আমার জন্য এক বিরাট অভিজ্ঞতা , লেখাপড়া নাই, যুদ্ধ যদি চলে অনেক দিন তাহলে ক্ষেতে কাজ করেও ওনাদের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করতে পারব । কাকাতো ভাইয়ের ছেলে হিসাবে ওনাদের দুই জনের আদর এবং স্নেহ দেখে আমি ঐ বয়েসেই বুঝেতে পারছিলাম যে, আমি কত ভাগ্যবান । মান্দারপুরের কাকা দের কথা মনে রাখব সারাজীবন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তখন । বাবাজান, আব্বাজান, কাকা, ভাতিজা ছাড়া নাম ধরে একবারও ডাকে নাই -আর সবাই কে গর্বভরে পরিচয় করিয়ে দিত, এইটা আমার ভাইপুত - আমরার বড় বাইসাব হুকা (খোকা) বাইসাবের ছেলে - শাহিন - আমার মুন্না নামটা কেমন জানি হারিয়ে গেল গ্রামে আসার পর, দাদী কেমনে সবাই কে এত শক্ত ভাবে আমার নামটা শিখালো ? আমরা গ্রামে না আসলেও সবাই আমাদের নাম মোটামুটি ভাবে জানতো, দাদী ওদের সাথে গল্প করতেন নিশ্চয় ; দাদী আমার ছিল এক ভিন্ন ধরনের মানুষ । পরে দাদী সম্বন্ধে লিখবো, তবে, সে ছিল এক কঠিন ভদ্রমহিলা ; জীবনেও এইরকম স্পেশাল টাইপের বৃদ্ধ পরিবারের মা ও কর্ত্রী দেখিও নাই এবং আজ অব্ধি এবং কেবল বই পুস্তকেই কেবল পড়েছি । সে ছিল মোদ্দাকথায় সম্প্রসারিত এবং বর্ধিত পরিবাবের এক সম্রাজ্ঞীসম । সর্বজন সমাদৃত শক্তিধর মহিলা ।
বাড়ীতে ফেরে এসে দেখি আব্বার দুই খালাতো ভাই এসে উঠানে বসে আম্মার সাথে কথা বলছেন, একজন কে গতকাল দেখেছিলাম, অন্যজন কে চিনিনা, আম্মা পরিচয় করিয়ে দিল অন্যজন তাজু কাকার সবচে’ ছোট ভাই মিজান কাকা। আম্মা আগের থেকেই তাজু কাকা কে চিনে, উনি আমাদের বাসায় আগে অনেক বার গিয়েছেন । মিজান কাকা মাজু কাকাদের বয়সী হবে , সাথে পাক্কন পিঠা নিয়ে এসছেন, দারুণ হাতের কারুকার্য করা, নারকেলের বানানো, কয়েক টা নরম আবার অনেক গুলো কাঠের টুকরার মত শক্ত , আগেই বলেছি অনেক বার আমি একটু খাইতে ভালবাসি । দাদা মনে হয় তাজু কাকাকে গোপনে বলেছিলেন যে, আমরা এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে চলে এসেছি, তাই আম্মার জন্য পাঁচটা শাড়ী, পেটিকোট, ব্লাউজ নিয়ে এসেছেন, ওনাদের আম্মা (আমার আব্বার খালা ) আম্মার জন্য টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং আমাদের কে ওনাদের বাড়ীতে চলে যেতেও বলে দিয়েছেন । আর সব খবর ও দিলেন , সবার মুখে একই কথা, ভাইসাবের খবর কিতা ? আমারাও একি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি সকলকে যদি ওরা কোন খোঁজ খবর পেয়েছে কিনা । ওনারা বলল ওনাদের দুই ভাই বড় ভাই রফু এবং সেজো ভাই মজল দু একদিনের মধ্যেই ওপারে চলে যাবে , একটা জিনিস অবোলকন করলাম সবাই ইন্ডিয়া কে ওপার বলে ডাকে - প্রথম প্রথম বুঝি নাই ; এখন সব পরিষ্কার বুঝি । কাকারা আমাদের সবাই কে বলল কাউকে না বলাতে আমাদের কি চাকরি করেন । ওরা বেশ চিন্তিত এবং বলল যে, ওনাদের ঐ দিকে নবীনগর - বীটগড় এলাকায় পাঞ্জাবী আর্মি প্রায়ই আসছে - নবীনগরে ক্যাম্প করেছে । কসবা এবং ওনাদের আর ওনার কাকাদের পাটের গুদাম কুঠি বাজারে এলাকায় বিরাট ক্যাম্প করে ফেলেছে । কসবা থেকে এই সব গ্রামে আসতে পাকিস্তানি দের কোন সমস্যাই নেই আর এখন , আস্তে আস্তে সারা দেশ টাই দখল করে ফেলবে মনে হয় । আরও বলল ঢাকায় ওনাদের গ্রামের কয়েক জন কে মেরে ফেলেছে । এসব শুনে আরও একটু ঘাবড়িয়ে গেলাম আমরা সবাই - তারপর আবার বললেন যে, গ্রামে কাউকে বলার দরকার নাই আমাদের পিতা কোথায় এবং কি করেন পেশায় । আম্মা কাকাদের জিজ্ঞেস করলো কি করা উচিত এখন আমাদের ? তাজু কাকা বললেন, ভাবী এখানে না থাকতে অসুবিধা হলে আমাদের বাড়ীতে চলে আসেন ; আমাদের যা হবে আপনাদেরও একই অবস্থা হবে, তবে আমাদের বাড়ী চিহ্নিত আওয়ামী লীগ বাড়ী । ওনাদের বড় ভাই আওয়ামী শ্রমিক দলের নেতা, মজল ওনাদের সেঝো ভাই মজল এলাকার লীগের নেতা অত্র এলাকার সবাই জানে, ওনাদের আরেক খালাতো বোন মমতাজ বেগম (আমেনা ) আওয়ামী লীগের এম এল এ । কসবা থানার আওয়ামী লীগের /কুমিল্লা আওয়ামী লীগের সাথে ১৫ বছর যাবত সক্রিয় নেতা , আজিজ ( মমতাজ বেগমের অনুজ) কসবা ছাত্র লীগের নেতা । তারজন্য, আমাদের ঝুঁকি ও ভয় দুইটাই বেশি। তারপরও আপনি আমাদের ভাইয়ের পরিবার ; উনি বারবার বললেন যে ওনার আম্মা আব্বা দুই জনেই চান যে, আমরা ওনাদের ওখানে গ্রামে গিয়ে ওনাদের বাড়ীতেই থাকি। আরও বললেন যে, ওনারা ওনাদের খালাআম্মা ( আমাদের দাদী) কেও গোপীনাথপুর থেকে সরিয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্তা করছেন সহসা। আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, আমেনা ফুফুর (মমতাজ বেগম এম এল এ ) কথা । বলল ওরা কাল কে পর্যন্ত কসবা ছিল - তবে যেকোন সময় হয়ত ওপারে চলে যাবে । রাতে খাওয়া দাওয়া করে কাকারা বিদায় নিলেন । যাবার সময় আম্মাকে বললেন, পরশু মিজান এসে আমাদের ভাই বোনদের বেড়াতে নিয়ে যাবেন ওদের বাড়ীতে ।
আম্মা রাজী হলেন আম্মা বললেন একদিনের বেশী এই সময়ে ওদের ফেলে আমি থাকতে পারবো না । পরে আমরা সবাই যাবো, ওনারা বললেন, ভাবী চিন্তা করবেন না, আপনাকে নৌকায় করে নিয়ে যাবো । সবাই কে আদর করে অনেক রাত্রে ওনারা দুই ভাই রওনা হয়ে গেলেন । মিজান কাকা বলল আমাকের , ‘' কাকা পরশু দিন দুপুরে এসে তোমাদের নিয়ে যাব । এখান থেকে আমাদের গ্রাম আরও সুন্দর, বাড়ীতে আমাদের অনেক ঘর - সব গুলো খালি । যাবার আগে আম্মাকে দুইজনাই পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে গেলেন । দাদা এতক্ষণ বসে বসে বড় একটা বিশাল নল ওয়ালা হুঁকা টানছিলেন আপন মনে নীরবে ; ওনাদের বিদায় এর পর বললেন, বউমা, বেশী চিন্তা করো না গো , একটা ব্যবস্তা হবে, মরলে সবাই একসাথে মরবো , যা আছে কপালে।
আমরা যখন ঘরে ঢুকবো ঠিক তখনি আজিজ কাকা বললেন ভাবী আপনাদের মামার বাড়ীতে দাওয়াত; ওনারা সবাই বসে আছেন আপানদের জন্য । বিরাট এক পুঁথি পাঠের আসর বসেছে ওখানে, সবাই আপানদের দেখার জন্য অপেক্ষা করছে । আম্মা বলল তাই, তাহলে চলেন, আম্মা মিজান, সাজু ও মাজু কাকা কে তুমি বলে সম্বোধন করে খালি আজিজ ও তাজু কাকাকে আপনে বলেণ । সবাই গেলাম ঠিক পাশের প্লটের বাড়ীটাতে ওনাদের মামাদের বাড়ী । গিয়ে দেখি প্রায় ২০ - ২২ জন মহিলা ও পুরুষ ও বাচ্চারা সব মাদুরে বসে গান শুনছে গায়ক একতারা বাজিয়ে মারফতি গান গাচ্ছে । আমরাও বসলাম, গরম চা এবং টোস্ট বিস্কুট, মেরা পিঠা ( ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের বিখ্যাত ) ও সাথে আমার প্রিয় তেলের পিঠা । শুরু হল, গাজী কালু চম্পাবতির পুঁথি পাঠের আসর । অপূর্ব অভিনয় ও মুখস্থ আবৃতি - দেখার মত, যদিও আমরা অনেক কিছুই বুঝলাম না তথাপিও এনাদের আপ্যায়ন এবং ওদের আনন্দ করার স্টাইল টা খুবি বাঙ্গালী সংস্কৃতি পূর্ণ । পুরা পরিবার, পাড়া প্রতিবেশী সবাই মিলে উপভোগ করছিল একত্রে , গান যে দুইজন গাইল একজন এর নামটা আজও আমার মনে গেঁথে আছে , প্রাণনাথ শীল , বয়স্ক এক জন বাউল গায়ক সবাই ওনাকে কাকা বাবু বলে ডাকেন , অত্যন্ত নম্র ও ভদ্র একজন শিল্পী, আম্মা বলল অনেক দিন পর সুন্দর বাংলায় উচ্চারণ শুনলাম । কিন্তু, আম্মা যেন কোথায় বার বার হারিয়ে যাচ্ছিল , আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম আম্মা কি ভাবছ ? আম্মা বলল, ঘরে যেয়ে বলব, ওইখানেই একজন বলল যে সে কাল রাত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র রেডিও শুনছে ওনার রেডিও দিয়ে , আম্মা খুব আগ্রহ করে ওনাকে বলল আপনার রেডিও টা নিয়ে আইসেন কালকে আমাকে দেখিয়ে দিয়েন কিভাবে স্টেশন টা শুনা যায় আমাদের রেডিও তে , কিছুক্ষণ পর আমরা বিদায় নিলাম ঐ পুঁথি পড়ার আসর থেকে - সাজু কাকার পুঁথি পাঠ শোনার পর, কাকা একটা পার্যোডি পুঁথি পড়ল, আখাউরাত ফড়িং পরছে লাইনের ধারে ( আখাউরা রেল স্টেশন উপড়ে লেখা - কৌতুক জাতীয় পুঁথি ওটা ছিল । ওটা শুনেই আমরা আমাদের ঘরে এসে পড়লাম।
আম্মা ঘরে ঢুকেই বলল, আমার মনে হয় আমাদের এখানে বেশিদিন থাকা টা ঠিক হবে না । কারণ , আমার মন বলছে, এইখানে যে কোন সময় পাঞ্জাবিরা এসে পরবে । এই গ্রামে আমরাই একমাত্র পরিবার যাদের কে দেখলেই সহজ সরল ভাবেই বুঝা যায় যে আমদেরকে দেখা মাত্রই ওরা বুঝে ফেলবে আমরা শহরের এবং এখানে শহর থেকে প্রাণে বাঁচাতে এখানে এসেছি, অপরিচত জায়গায় যেখানে আমদের পরিচয় কেউ জানে না । যত শিগগিরি এখানে থেকে চলে যাওয়া যায় ভালো । আপা আর আমি একদম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম , মাথায় হাত কোথায় যাওয়া যায়, আমাদের আর তো তেমন যাওয়ার জায়গাও নাই , আম্মা বলল, তাজুর কথাই ঠিক, মুন্না তুমি যেয়ে দেখো আসো আগে ওদের ওখানে গিয়ে থাকা যাবে কিনা বা তোমার দাদীর বাবার বাড়ী দাপুনিয়া তে । আর সব যদি ফেল করে তাহলে ইন্ডিয়া যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নাই আমাদের সামনে । আমি বললাম , আমাদের জন্য সবচে’ নিরাপদ হবে ইন্ডিয়া , কিন্তু কেমনে যাবো ? আম্মা বলল আমি তোমার সৈয়দ মিয়া দাদার সাথে কথা বলব । আম্মা বলল, তাজু কাকা নাকি এক ফাঁকে আম্মা কে বলেছে, ঢাকায় অনেক ই,পি, আর লোকদের প্রথম রাত্রেই পাঞ্জাবিরা হত্যা করেছে । আম্মা বলল, যদি তোমাদের আব্বা যদি বেছে আছে তাহলে সে নিশ্চয় ইন্ডিয়া তে আশ্রয় নিয়েছে, আরও বলল, সিলেটের তিন দিকেই ইন্ডিয়া, যেকোন ক্যাম্প থেকে এক - দুই এর ভিতরেই বর্ডার, ইস আমরা যদি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে যদি সরাইল এর দিকে চলে যেতাম তাহলে, নৌকা বা হেঁটে বা রিক্সায় সিলেটের দিকে গেলে ওনাকে খুঁজেও পেতে পারতাম , হয়ত বা, জানিনা । বলেই অনেকটা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল চৌকিতে, ছোট দুই ভাই দিন দিন দুর্বল থকে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ; ওদের দেখলেই রুগ্ন রুগ্ন লাগে , আজ নিয়ে আমরা পাঁচ দিন যাবত গৃহহীন বাস্তুহারা , এরই মধ্যে ওরা একদম কাবু হয়ে গেছে । কোন কথা বলে না , সারাদিন চুপচাপ বসে অথবা ঘুমিয়ে থাকে, আম্মা বলল ওদের দুজনারই রক্ত আমাশা হয়ছে। বলল কালকে বাজারের ফার্মাসি থেকে এন্টিবাইওটিক এনে খাওয়াবে । প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্য ভয়, পশুর মত মেরে ফেলতে পারে যেকোনো সময় এই ভাবনা নিয়ে দিনাতিপাত করা ভীষণ এক যন্ত্রণা ।
আম্মা আরও বলল, জানো প্রকিতস্থ অবস্থায় বাসা থেকে বের হয়ে আসার সময় ব্যাঙ্ক থেকে উঠানো টাকার কথা একদমই মনে ছিল না আনতে। হাতে তেমন টাকায়ও কিন্তু নাই । খালি গয়নার প্যাকেট টা মনে করে নিনিজেদের য়েছিলাম । বাকি এঁর কিচ্ছু মনে ছিলই না রে , আপা বলল, জান নিয়ে যে পালাতে পেরেছি ওটাই ভাগ্য ভাল নইলে শহর দখল করার পর আমদের কি অবস্থা হত ? সবাই জানে আমাদের পরিবারের সবার কাজ কর্ম ও রাজনৈতিক মতাদর্শ । ব্রাক্ষনবাড়িয়া তে প্রচুর বিহারী এবং দাঁড়িপাল্লা ভোটার আর পি ডি পি লোকের অভাব নাই - মুসলিম লীগ তো বললাম ই না । আম্মা বলল চলো রেডিও টা দেখি তো ধরতে পারি কি না ঐ নতুন স্টেশন টা , আমি ঘরের মধ্যে রাখা বালতির পানি দিয়ে হাত পা মুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে পরলাম । বিছানার নাম শুনলেই ভয় লাগে , শুধু কাঠের উপর শোওয়ার মত, বালিশ একটা শক্ত লোহার মত, গন্ধ, ময়লার প্রলেপ পরে বালিশ তেলতেলে - কিন্তু এখন এসব ভাবার অবকাশ নাই - আমরা এখন পরের দয়ার উপর নির্ভরশীল । নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই শঙ্কিত, ভীত, আতংকিত এবং চোখে মুখে সব অন্ধকার । আম্মার কথায় বুঝতে পারলাম - আয় না থাকলে আমরা ওপরের উপর ভরসা করে কেমনে বাঁচব । সংসারের এই সব সমস্যা ১০ বছর ১১ মাস বয়েসে এসে ঘাড়ে পরবে তা’ গুন্নাক্ষরেও ভাবি নাই আজ থেকে ১ মাস আগে , জীবন টা কত সুন্দর, পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন ও সম্মানজনক ছিল । আজ আমরা কোথায় এসে নিপাতিত হলাম ? আম্মা আর আপা কে সব খুলে বলতেও পারছি না আমার মনের কথা, এটা আমার চিরাচরিত অভ্যেস - আমি খুব চাপা স্বভাবের সবসময় , পেটের কথা কাউকে কখনো মন খুলে বলতে পারি না । যার জন্য অনেক বন্ধু আছে কিন্তু কেউ সবচে বিসস্থ বলে কোন বন্ধু নাই আরও সমস্যা হল আমরা এই পর্যন্ত কোন জায়গায় একসঙ্গে এক থেকে দুই বছরের বেশি থাকিই না , না বন্ধুত্ব গাড় হবে কেমনে ? এপাশ ওপাশ করতে এক সময় ঘুমিয়ে পরলাম ।
সকালে উঠে নাস্তা খেয়েই কাকার সাথে গেলাম নিকটস্থ ফার্মাসি তে ডাইরিয়ার জন্য ওষুধ আনতে, আম্মা লিখে দিল ; ওষুধ এনেই , সাজু কাকার সাথে গেলাম একটা নতুন জমিতে ওখানে হাল চাষ করার জন্য । দুপুর পর্যন্ত ওনার সাথে জমিতে কাটালাম - এই জমিটা ওনাদের নতুন বাড়ীর ঠিক লাগানো পিছনে । জমি বেশ ভিজা ছিল একদিকে আর এক পাশে একটু উঁচু জায়গার অংস মাটি গুলো চাক্কা চাক্কা উঠে আসলো একটা বাসের বানানো হাতল ওলা বাসের হাতুড়ি দিয়ে ঐ বড় বড় চাক্কা গুলো পিটিয়ে পিটিয়ে ভেঙ্গে ফেললাম । দুই তিন বার জমিটা চষে ফেলল একেবারে কালো কালো আধো ভেজা মাটির অমসৃণ একটা চাদরে ভরে গেল জমিটা । কাকা সারাদিন নিজের সাথে কথা বলতে থাকলো একা একা । মাঠে কাজ করার সময় অনেক দূরে আর্টিলারির কামানের আওয়াজ শুতে পেলাম দুই - থেকে পাঁচ মিনিট পর পর কাকা বললেন এগুলো উজানিশা’ পুলের থেকে বর্ডারের দিকে মারছে । প্রথম আওয়াজ টা বেশ বড় আর পরের আওয়াজ টা ফাটার সময় শুনতে পাই না । তারপর আবার চার পাঁচ মিনিট পর আরেক টা আওয়াজ । ভয় মনের ভিতর আরও পুঞ্জিভূত হতে থাকলো ক্রমান্বয়ে । এটা একটা ভিন্ন ধরনের ভয় - এই ভয় মনের ভিতর গড়ে তুলে একটা বিরাট নাজুকতা, একটা বিশাল গহ্বর, কেমন জানি একটা গভীর গর্ত, ভাবতে গেলেই গা কেমন জানি পাকড়াও হয়ে যায় ঐ অজানা বিপদের অনুভূতিতে । আমি এইটা নিয়ে খুবি একটা কুস্তি করছি নিজের মনের সাথে । আরও একটা নতুন সমস্যা দেখা দিল ঐ যে যেদিন বিমান হামলা হয়েছিল, সেদিন থেকেই বাম দিকের কান টা বেশ ওজনে ভারী লাগছিল কিন্তু আজ সকাল থেকে কথা শুনতে অসুবিধা হতে লাগলো আর একটু একটু ব্যথাও অনুভূত হতে লাগলো ।
পঞ্চম পর্ব
ভবঘুরে জীবন
বিকালে চলে গেলাম মিজান কাকার সাথে ওনাদের বাড়ীতে হেঁটে হেঁটে ওনার সাথে ; প্রায় তিন ঘণ্টা লাগলো সন্ধ্যার পর অন্ধকারে হেঁটে আসতে । পতিমধ্যে একটা খাল পাড় হতে হোল কাকার ঘাড়ে চড়ে। এসে দেখি এদের এখানে পুরা অন্য জগত, মাইকে গান বাজছে মোহাম্মদ রফির ‘'ইয়ে দুনিয়াকে রাখে ওয়ালি , সামসাড বেগমের ‘' মেরে পিয়া গিয়া রেঙ্গুন ‘', বাচু পান কে দিন ভুলানা দেনা ‘' - ফুল ভলিউমে চলছে , রাত্রে বেলা , গ্রামের মাঝামাঝি প্রবেশ পথে ওদের বিশাল একটা বাড়ী - একান্নবর্তি পরিবার আমার আবার খালুর পাঁচ ভাইয়ের তিন ভাই থাকে এই বাড়ীতে, কত গুলো যে তা মনে নেই তবে অনেক গুলো, রাতের বেলা গুনতে পারলাম না অন্ধকারে । বেশ প্রাচুর্যপূর্ণ পরিবার বলে মনে হলো বাড়ীটাতে ঢুকেই। দাদা দাদী অন্যান্য সবার সাথে পরিচয় হল । রাতের খাবার খেলাম , ওনাদের বড় ছেলে আমার রফু কাকার স্ত্রী আবার আমার ফুফুও হয় , আমার আব্বার মামাতো বোন, ওনার ছেলে আমার এক দুই বছরের ছোট নামটা সুবেহ সাদেক আর ওর একটা ছোট বোন আছে, ফুফু /কাকী খুব আদর করলো । ভাত খাওয়ার পর সুন্দর করে বিছানা করে ওনার ছেলে আর আমি একসাথে ঘুমালাম । এখানে যুদ্ধ বা পাঞ্জাবি দের নিয়ে কোন ভয় বা কোন কথাই শুনলাম না । কিন্তু এই প্রথম ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলাম সেই বিভীষিকামায় বিমান হামলা ; আর দেখলাম পাকিস্তানি আর্মি রাইফেল কোমরে রেখে তাক করে আগিয়ে আসছে আমাদের দিকে আর আমরা সবাই একটা পুকুরের কোণায় বসে আছি কাচু মাচু হয়ে গুলির অপেক্ষায় । পালাবার আর জায়গা নাই , ওদের বুটের আওয়াজ ধপ ধপ ধপ করে আগিয়ে আসছে আমাদের একদম কাছে । লাফ দিয়ে উঠে গেলাম ঘুম থেকে। ঘেমে চপচপা কাপড় চোপড়।
সকালে উঠেই নাস্তা করে চলে গেলাম ওনাদের বাজারে এক বিশাল দোকান ওনাদের এবং ডিজেল দিয়ে চালিত , তিন চার জনে মিলে মিলের হ্যান্ডল ঘুরায়ে মিল এর মটর চালু করা লাগে ঐ জাতিও চালের মিল , চালু হলে সম্পূর্ণ মিলঘর ও পাশের খালের পানিও কাঁপতে থাকে ঐ মিলের ইঞ্জিনের অনুকম্পনে । মিলের নিচে খালের মধ্যে নৌকার লাইন - দূর দূরান্ত থেকে সবাই এদের কাছে আসে ধান ভাঙ্গাতে । রমরমা ব্যাবসা । সাথে বিশাল এক পাইকারি মুদি খানার দোকান। পিছনে টিনের বানানো গুদাম । মিজান কাকা সব দেখালো । এখানের অভিজ্ঞতা ভিন্ন ; আমি কোনদিনই জানতাম না আমাদের এতো গুলো আত্মীয় আছে । সেই বেনাপোল, কালীগঞ্জ , খুলনা , যশোর, রাজশাহী, প্রেমতলি, রামগড়, সিলেট, তেলিয়াপারা, বাল্লা, লাতু তে থাকলে কি আত্মীয়দের দেখা পাওয়া যায় । যদিও আমার বয়েস অল্প কিন্তু আমি অনেক বুদ্ধিমান ছিলাম তখন । পৃথিবীর অনেক কিছুই জানতাম ঐ বয়েসে । আমার সমসাময়িক বয়সীদের অনেক আগিয়ে ছিলাম সাধারণ জ্ঞানে এবং ইতিহাস সম্পর্কে ।
কাকাদের দোকান এবং চালের মিল দেখে দুপুরে চলে গেলাম নৌকা করে ঐ গ্রাম টা দেখতে, গ্রাম বাংলা যে এত বিচ্ছিন জানতাম না আগে কখনো একই গ্রামের এক পারা থেকে অন্য পাড়ায় যেতে হলে নৌকা লাগে । রাস্তা ব্যবস্থা নাই কোন, রাস্তা থাকলে তার অর্ধেক পানিতে নিম্মজিত, আর না হলে রাস্তার মধ্যখানে একটা খাল কিন্তু রাস্তায় কোন পুল বা ব্রিজ বা সাকো নাই পার হবার । খুবি প্রত্যন্ত অঞ্চল । অর্ধেক ফসলের জমি তে হাঁটু পরিমান পানি , এটা কেবল এপ্রিল ( বাংলা বৈশাখ মাস কেবল ) তখনই এই অবস্থা, তখন ভাবলাম এই কারণেই হয়ত এরা ঝুদ্ধ নিয়ে এতো টা ভীত নয়, কারণ এই রকম বন্ধুর জলাশয় এলাকায় আর্মি আর বিশেষ করে পাঞ্জাবীরা আসতে হয়ত চাবে না । হটাৎ ভাবলাম আমার জীবনে কি করব আমি, স্কুল নাই, বই নাই, গত দের মাসে একবারও বই এর পাতা উলটায়ে দেখিনি- বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট টায় এখনো জানতে পারলাম না , বৃত্তি টা পেলে ভালো স্কুলে সিলেট রেসিডেন্টসিয়াল স্কুল অথবা ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হলে আবার উপর খরচ কম পরবে । গ্রামের মধ্যখানে একটা মাটির উঁচু ঢিবি আছে অনেক বড় এলাকা জুড়ে ওখানেই অনাদ্যের ঈদগা এবং বড় একটা পুরানো আমলের মসজিদ ; একশ বছর পুরনো হবে , কাকা বলল, ওনারা এই জায়গায় সামনে একটা বড় বিল্ডিং ওয়ালা বাড়ী বানাবে অনেক বড় করে ।
বিকালে বাড়ীতে ফিরে আসলাম, শুনলাম মান্দারপুরের দুইটা গ্রাম পরেই পাঞ্জাবীরা রাত্রে হানা দিয়েছিল । এবং ওখানে নতুন পিস কমিটি বানাবে ; ঐ গ্রামের মোড়ল জাতীয় এবং আশে পাশের গ্রাম থেকেও ঐ ধরনের লোকদের সাথে এসে আবার বৈঠক করবে সহসা । রাত্রে খাবার পর দেখলাম ওনাদের বাড়ীর এবং পাশের বাড়ীর ( খালের ঐ পারের বাড়ীর ) আট নয় জন মিলে রাত্রে ওনাদের বাড়ী গুলো পাহারা দিবার জন্য ব্যাবস্থা নিচ্ছে , দুই তিনটা একনালা ও দোনালা বন্দুক ও আছে ওদের কাছে । নৌকা এবং পায়ে হেঁটে হেঁটে পাহারা দিবে - এদের প্রধান কম্যান্ডার আমদের রফু কাকা । উনি সবাই কে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছেন । তখন ই জানতে পারলাম রফু কাকার স্ত্রী আমাদের ফুফ/কাকী আগামী কাল কে ওনার বাবার বাড়ীতে যাচ্ছেন এবং দাদী বললেন শাহিন ( আমাকে) নিয়ে যেতে ওদের সাথে । তখন তাজু কাকা বললেন, ‘' তারারে মান্দারপুরে রাখন ডা নিরাপদ না, আমারা ইহানো লইয়া আইতে হইব।'' সবাই এক বাক্যে বললেন , ''অবশ্যই, তাগদা তাগদা গিয়া তারারে লইয়া আও ।’'
মনে মনে ভাবলাম, আমরা সপরিবারে এখানে চলে আসলেই হয়ত ভাল হবে, কিন্তু আব্বার আর ভাইজানের কথা বারবার চিন্তা করে কেন জানি ইন্ডিয়া যাওয়াটাই নিরাপদ মনে করতে লাগলাম। একটাই সমস্যা - ইন্ডিয়া যাওয়ার পথ (রুট) টা বেশ বন্ধুর এবং বিপদজনক ।
এক টা জিনিশ খুবই প্রকট ভাবে উপলব্ধি করলাম, গ্রামের মানুষ গুলো খুবই ভালো, ওনাদের ভিতর টা পরিষ্কার এবং স্ফটিকের মত স্বচ্ছ । কিন্তু অনেক ধরনের কুসংস্কারে এরা নিমিজ্জিত, যেমন পুকুরে একটা সিন্দুক আছে, ওটা মাঝে মাঝে ভেসে উঠে, যেকোন সময় ভেসে উঠে যেকাউকে ধরে নিয়ে যেতে পারে, লোহার চেন দিয়ে উঠানে যেখানে ধান মাড়ানোর জন্য গরু গুলোকে বান্ধার জন্য বাঁশ পুতিয়ে ওটার সাথে একজন বেধে রেখেছে রাত দিন - কারন সে পাগল, পাগল হওয়ার কারণ ওকে জীনে ধরেছে , রাত্রে বেলা মেয়েরা চুল খুলে হাঁটতে নাই ; জীনে / ভুতে ধরতে পারে , কোমড়ে বা বাতের ব্যথা হলে বেদের মেয়েদের দিয়ে ব্লেড দিয়ে কোমড়ে সিঙ্গা দিয়ে টেনে রক্ত বের করে এনে থুথু ফেলে এক গাদা রক্ত বের করে ফেলে দেখাল যে চিকিৎসা কাজ করছে , আমাদের ভাইদের কারো গায়ে কোন তাবিজ বা কমোড়ে কোন কাইতন ( কালো মোটা সুতা) নাই কেন । উমুককে পরী ধরে নিয়ে গেছিল সাত দিন পর ঐ বাড়ীর তাল গাছের ( ত্রিশ ফুট উঁচু) উপর ফেলে রেখে চলে গেছে । এসব আমরা জীবনেই শুনি নাই । আমাদের আম্মা জীবনেও এসব কুসংস্কার এ কোন দিন কান দিত না । তাই আমরা এইগুলো কোনদিন শুনিও নাই আর বিশ্বাস করার প্রশ্নই উঠে না । কিন্তু ওনারা খুবই প্রাঞ্জল এবং খুবই যত্নশীল , মন খোলা, নম্র এবং খুবই পরিবার কেন্দ্রিক । আমাদের জন্য ঐ পরিবেশে খাপ খাওয়ানো বেশ কষ্টসাধ্য - কারণ আমরা একেবারে অন্য ধাঁচে গড়ে উঠেছি, আব্বা এবং আম্মা দুজনায় প্রগতিশীল ও আধুনিক । আমাদের জীবনের আকাঙ্ক্ষা ও পরিপ্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির ।
এখানকার যুবকদের দেশ প্রেম এবং পাকিস্তানিদের অত্যাচারের অতিষ্ঠ হয়ে পুঞ্জিভূত ঘৃনা এবং নিজের বিপন্ন করে রাত্রে রাত্রে গ্রাম পাহারা দেবার সাহস দেখে আমিও অনুপ্রাণিত - মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম বয়েস এর কাছে আমি মুন্না হার মানতে রাজি না ; ভাবলাম এখানে তো আগে আমাকে দেখে নাই তাই এখন থেকে আর সঠিক বয়স কাউকে বলব না বলব ১৪ বা ১৫ । আমার একটাই আফসোস আমার বয়েস আর উচ্চতা টা যদি বেশি হত । আব্বার মুখে শুনেছি কিভাবে ই পি আর এর মেজর তোফায়েল এবং জমাদার আজম কিভাবে শত্রুর বাঙ্কারে ঢুকে শত্রু কে পরাজিত করেছিল এবং পরে আত্মত্যাগ করেছিল, যার নিদর্শন সরূপ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রধান রাস্তার নাম ওদের স্মরণে রাখা হয়েছিল টি এ রোড ( তোফায়েল এবং আজম ) আর আখাউরা সিলেট রেলওয়ে লাইনের সিঙ্গারবিল এর পরের রেলওয়ে স্টেশন এর নাম করন হয়েছিল জমাদার আজমের নামে আজমপুর। রেড, এমম্ব্যুস, পেট্রল, রেকি কি এসব লাঠিটিলা যুদ্ধের সময় জেনেছিলাম আব্বার কাছ , রাত্রে লাতু আব্বার কোম্পানি হেড কোয়ার্টের এর বড় পাহাড়ে উঠতে হলে রাত্রে সেন্ট্রি পাসওয়ার্ড জিজ্ঞেস করতো আব্বাকেও যদিও উনিই ছিলেন লাতু ই পি আরের কোম্পানি কম্যান্ডার । রফু কাকার অনেক জ্ঞান দেখলাম এইসবে , সেদিন রাত্রে মিজান কাকা আমাকে গ্রামোফোন চালানো শিখালো মাইক ছাড়া ছোট স্পিকারে গান বাজালাম - শিখলাম রেকর্ড এ ক্যামনে পিন টা বাসতে হয়, সূক্ষ্মতার সাথে , তার আগে আর, পি এম এর সুইচ রেকর্ডের আর পি এম দেখে সেট করতে হবে । আর পি এম ৭৮, ৪৫, ৩৩ ইত্যাদি সেট করা লাগে চলন্ত রেকর্ডে পিন টা বসানোর আগে। কাকা বললেন তোমরা যখন আমাদের এখানে চলে আসবে তখন তোমাকে কাকা আরও অনেক কিছু শিখিয়ে দিব । কাকাকে তখন জিজ্ঞেস করলাম রফু কাকা যুদ্ধ সম্বন্ধে এত কিছু জানে কেমনে ? মিজান কাকা আমাকে বলল কাউকে বলো না , রফু ভাই এক সপ্তাহ আগে ইন্ডিয়া থেকে আইছে, মুক্তিফৌজ ট্রেনিং লইয়া । আবার যে কোন দিন চলে যাবে ১৫ - ২০ জনের একটা গ্রুপ নিয়ে । কাকাকে বললাম আমিও মুক্তিফৌজে ট্রেনিং নিতে যাবো । আমিও ওদের অত্যাচের প্রতিশোধ নিতে চাই - ওদের কাড়নেই আর আমাদের এই দুর্দশা, গৃহহীন, উদ্বাস্তু আজকে আমরা । কাকা আমাকের অনেক সান্ত্বনা দিলেন ; খুবি ভাল মানুষ উনি , আমি অতি সহজেই কাকার সাথে বন্ধুত্ব গোড়ে তুললাম । রফু কাকার ছেলে সাদেক, আমি , কাকা সারাক্ষণ একসাথে । ও আমার সাথে সাথে সব শিখল ; খুব অল্প কথা বলে আমাকে ভাইসাব বলে ডাকে এই দুইজন আমাকে ভাইসাব বলে ডাকল, এক পারুল আর এই হল সাদেক , নিজেকে অনেক বড় মনে হতে লাগল ।
পরদিন সকালে একটা মাঝারি সাইজের নৌকা আমি রফু কাকী সুবেহ সাদেক ওর ছোট্ট বোন আর মিজান কাকা রওনা দিলাম, প্রথেম প্রায় ৪০ মিনিট একটা খালের ভিতর দিয়ে চললাম আমরা দুজন মাজি একজন সামনে লগি নিয়ে আর পিছনে একজন বৈঠা নিয়ে চালাচ্ছে । কাকী আর ছোট্ট মেয়ে বসে আছে নৌকার ছাইনির ভিতর আরাম করে আমরা তিন জন সামনে নৌকার পাটাতনে বসে যাচ্ছি । পানিতে কোন ময়লা নাই। একদম তলা পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। মাঝে মাঝে মাছ এর বাচ্চা গুলো ঝাঁক ঝাঁক বেধে চলছে দেখা যাচ্ছে, পাশের ধান খেত, পাট খেতের ভিতর দিয়ে খাল তো আকা বাঁকা ভাবে সরীসৃপের মত একেবেঁকে চলছে, ছই এর উপর দিয়ে পিছনে তাকালে দেখা যায় একটা রেখার মত পানি কেটে কেটে এগুচ্ছে নৌকাটা - আগে নদিতে করে নৌকাই চরেছি এই প্রথম খাল দিয়ে চললাম । বার বার হাত দিয়ে পানি স্পর্শ করলাম। দুই / তিনটা গ্রাম পার হওয়ার বড় তিতাস নদীর একটা শাখা নদিতে পরলাম - কিছুদূর যাওয়ার পর আসলাম একটা বড় বাজারের ঘাটে । অত্র এলাকার বড় হাট এবং বাজার - গ্রাম টার নাম বিটগড় - একটা উঁচু ঢিবির মত উচ্চতা গ্রাম টা - লাল জাতীয় মাটি, কয়েকটা বেশ বড় বড় দালান দেখতে পেলাম, মনে হল রাজবাড়ী অথবা কোন দুর্গ বলে মনে হলো , কাকা বলল এইটা এক সময় এই এলাকার রাজধানী ছিল ; আগরতলার রাজা দের এর একটা রাজবাড়ী আছে এখানে , ওরা এখানে আসতো রাজকীয় নৌকার বহর নিয়ে এক দেড়শ নৌকা নিয়ে বছরে দুইবার আসতো । কাকা দুই মাঝি কে নিয়ে নামলো নিচে আমি আর সাদেক ও গেলাম অনার সাথে - ব্যস্ত বাজার, হাজার হাজার লোকে লোকারণ্য । বাজার থেকে মাঝি দের জন্য কিছু খাবার কিনে ফিরলো কাকা , নৌকা ছেড়ে দিল আমরা নৌকাতেই ভাত খেলাম । এর পরে নদীটা এক টা সুন্দর বাক নিয়ে সুন্দর একটা গ্রামের পাস দিয়ে গেল কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম, খুব সুন্দর একটা গ্রাম এইটা - কাকা বললেন এই গ্রামের নাম মহেশপুর , মনে পরল রেডিওতে প্রায়ই একটা নাটক দিতো নাম ছিল মহেস। গ্রামটার বাড়ীগুলো খুবি সুন্দর নদীর পাড়েই কয়েকটা টিনের দোতলা বাড়ী দেখলাম - বেশ পরিপাটি গুছানো বাগান সামনে । খুবই ভালো লাগলো, মাথার উপড়ে কড়কড়া রোড, একসময় ঘুমিয়ে পরলাম নিজের অজান্তে । ঘুম ভেঙ্গে ডেখি আমরা পৌঁছে গেছি দাপুনিয়া ।
একদম তিতাস নদীর পাড়ের একটা গ্রাম - গুচ্ছ গুচ্ছ বাড়ী দিয়ে গ্রাম টা । সল্প কয়েক টা বাড়ীর গুচ্ছ নিয়ে, বিরাট খোলা প্রান্তর । ওদের বাড়ীর পাশেই খালে এসে নৌকা টা ভিড়ল , সবাই নেমে গেলাম।আম্মা বলে দিয়েছেন জায়গাটা ভাল করে দেখে আসার জন্য - যদি প্রয়োজন হয় তাহলে এখানে আত্মগোপন করে থাকা যেতে পারে । আমরা পৌছুতে প্রায় বিকাল বেলা । এই বাড়ীর একজন আমার আব্বার মামাতো ভাই মুর্শিদ কাকা আমাদের বাসায় থেকে পড়াশুনা করেছেন সেই ক্লাস সেভেন থেকে গ্রাজুয়েশন পর্যন্ত, মুর্শিদ কাকা ছোট বেলা আমাকে অনেক যত্ন করতেন, আমার সাথে ওনার একটা আত্মিক সম্পর্ক ছিল ; আমার আব্বার মামা তিনজন সবাইর সাথে পরিচয় হবার পর মুর্শিদ কাকার আম্মা আমাকে ওনার বাড়ীতে নিয়ে গেলেন । দাদ ও দাদীকে চিনি ওনারা বাসায় গিয়েছেন আগে । াই গ্রামের অনেক মানুষ সব সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গেলে আমাদের কে দেখে আসতেন । প্রায় ই এই গ্রামের মানুষদের কোর্টে মামালার তারিখ পরত, মামলা কোর্টে শেষ করে গোকর্ণ ঘাটে লঞ্চ ই উঠার আগে আমাদের সাথে দেখা করে আসতেন । কথা প্রসঙ্গে আমি বললাম যে, আম্মা আমাকে পাঠিয়েছে আপনাদের বাড়ী টা দেখে যাওয়ার জন্য , আমাদের যদি মান্দারপুর থেকে পালাতে হয় তাহলে, কি আমরা এখানে আসতে পারব কিনা ? জানতে এবং সব ভাল করে দেখতে বলেছে । সব দাদীকে খুলে বললাম সেই প্লেন হামলা, পালানো, সুদীর্ঘ পথ হাটা, আমরা সর্বস্বান্ত, সব কিছু ফেলে এক কাপড়ে পালিয়ে এসেছি, বাসা ভর্তি সব যেভাবে আছে সে ভাবেই ফেলে । বললাম আমি পরশু আবার মিজান কাকার সাথে সিমরাইল হয়ে মান্দারপুর ফিরে যাব, আপনাদের গ্রাম তো একদম অজপাড়া গাঁ ধরনের , এখানে পাঞ্জাবীদের আসার সম্ভবনা খুবই কম । আম্মা চিন্তা করছেন হয় সিমরাইল অথবা এখানে । তাই আমাকের বলে দিয়েছেন , যাতে আমি জেন এখানে এসে মুর্শিদ কাকার আব্বা আর আমার সাথে কথা বলতে পারি। কারন আম্মা জানে, যে মুর্শিদ কাকার পিতামাতা আম্মা সম্পর্কে খুব ভাল ধারনা আছে, কারন কাকা আমাদের বাসায় ৮-৯ বছর ছিলেন, ঠাকুরগাঁও সুগার মিলে একাউন্টেণ্ট হিসাবে চাকরী পাওয়া পর্যন্ত , গত কয়েক মাস আগেও আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাসায় এসেছিল বেড়াতে ওনার স্ত্রী ও বাচ্চা ছেলেটা কা নিয়ে । দাদীও গেছেন বেড়াতে আমাদের বাসায় । দাদা ও দাদী বললেন, এইডা কনু কথা বললেন নি নাতী,
‘' অবশ্যই আফনারা ইয়ানো আইবেন না তো কই যাইবেন , জহন আইতে চান আইয়া পরবেন ।’' আফনার আম্মা আমরার ছেলের লাইজ্ঞা অনেক কিছু করছে, আমরা সারাজীবন ঋণী আফনের আম্মা ও আব্বার কাছে । ‘'
এগুলো কথা বলে ওনাদের ঘর থেকা বের হয়ে এসে মুর্শিদ কাকার ছোট ভাই, মিজান কাকা ও সাদেকের সাথে একটু হাটতে বের হলাম, অপূর্ব নদীটা, নদীর বাক টা দেখলে মনে হয় যেন একটা রূপসী মেয়ে চোখে কাজল দিয়ে বসে আছে কারো অপেক্ষায় । আমি সব সময় ই নদী দেখতে পছন্দ করি । ব্রাহ্মণবাড়িয়া তে প্রায়ই শীতের দিনে বিকালে কালিবাড়ীর ঘাটের ঐদিকে হাটতে যেতাম , ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইস ও দেখেছি একবার, গভর্নর মোনায়েম খান ঐবাড় সি প্লেন নিয়ে তিতাস নদিতে নেমেছিল । প্রাইজ ও সেই দিয়েছিল । রাজশাহী তে থাকাকালীন পদ্মা দেখতে দেখতে নদীর প্রতি আমার এই ভালো লাগাটা জন্মগ্রহণ করে । নদী দেখে আসার সময় আব্বার আরেক মামা র পরিবার কেও দেখতে গেলাম, ওনারা ঢাকায় থাকেন, ঢাকা থেকে পালিয়ে এসেছে, বিরাট এক ক্যামিক্যাল কোম্পানির মালিক, দাদা দাদী এবং ওনার মেয়েরা সিপ্রা ফুফি এবং ওনার বোন রা যাদের আমরা আগে থেকেই চিনতাম, বেশ কিছুকক্ষন আড্ডা মারলাম। দাদা আব্বার কথা জিজ্ঞেস করলো -সবই খুলে বললাম , নদীর পারে ওদের বিশাল এক বিল্ডিং, আট নয়টা রুমওলা বাড়ী সাদা মখমলের মত রং করা বাড়ীটা শ্বেত পাথরের বানানো একটা প্রাসাদ মত দেখতে লাগলো । এখানে কোন প্রকার যুদ্ধের দামামা বা ঐ জাতীয় কোন আভাস ই পেলাম না , খালি ঐ দাদা বলছিলেন , আল্লাহ আমাদের বাছাইছে ওনাদের বাসা নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরি রোডে - সব ট্যাঙ্ক, সব গাড়ী ভর্তি পাঞ্জাবীরা ওনাদের বাড়ীর দুই পাশের রাস্তা দিয়েই সারা রাত দিন চলা ফেরা করেছে । দুই ঘণ্টার কারফিউ এর গ্যাপে সবাই কে নিয়ে কোনরকমে জান নিয়ে পালিয়ে এসেছেন । কিন্তু, নবীনগর এলাকায় এখনো কোন উপদ্রপ হয় নাই । আমি মনে মনে ভাবলাম এটা মনে হয় নিরাপদ হবে । ঐ বাড়ীর দাদা কে আর এই গ্রামে আসার ইচ্ছা সম্পর্কে বললাম না ।
মুর্শিদ কাকাদের বাড়ীতে ফিরলাম, সন্ধ্যার পর । রাস্তায় মিজান কাকা বলল আমরা কালকে থাকবো পরশু সকালে রওয়ানা দিবো তোমাকে একদম নৌকা দিয়ে মান্দারপুর পৌঁছাইয়া দিয়ে ভাবীর বুঝাইয়া দিয়ে আসব । আমি বললাম ঠিক আছে কাকা, যদিও আমি বয়েসে অনেক ছোট তবুও আমার মতামত কে ওরা বেশ প্রাধান্য দেয় , হয়ত আমি শহরের বলে, নয়ত বা আমি বেশ কথায় পটু, তা না হলে হয়ত আমি ঐ বংশের সবচে’ বড় ভাই খোকন (খোকা) ভাইসাবের ছেলে বলে । কারন টা বুঝতে পারলাম না । রাত্রে বসলো এক বিরাট আড্ডা - তখন শুনলাম মুর্শিদ কাকার ছোট ভাই কে নাকি একবার পরী তে উঠিয়ে নিয়ে গেছিলো । বারদিন কোন খবর নাই, ঐ পরী ওকে ঢাকা, চিটাগাং, করাচী এসব সব জায়গা দেখিয়ে নেয়ে এসেছে, আমি ১১ বছর বয়সী তখন প্রায় আমি কোন ভাবেই এইটা বিশ্বাস করতে পারলাম না , আজগুবি মনে হল , তারপরও আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার অনুসন্ধিৎসু মনের সব সন্দেহ দূর করতে সচেষ্ট হলাম । এরপর বুঝলাম এদের পৃথিবী আর আমার পৃথিবী ভিন্ন কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে । শুধু তর্ক করে এই বিপদের সময় কারো অপছন্দনিও হতে চাই না । গভীর রাত পর্যন্ত চলল আড্ডা, পরী কাকা আবার খুব সুন্দর গান গাইতে পারে , অনেক গুলো গান গাইল ও । তারপর পরের দিনের পরিকল্পনা হল যে,সকালে ওনাদের জমিতে বোরো ধান কাটা শুরু হবে - আমরা সবাই ধান কাটাবো এবং আমাকে দেখাবে কিভাবে ধান কাটে । বিশ জন দিন মজুর সকালে এসে ধান কাটা শুরু করবে ; অনেক গুলো জমি একই জায়গায় । আমি মুর্শিদ কাকার আব্বা আম্মার ঘরে ঘুমালাম । সব বাড়ীর প্রধান ঘরে একটা বড় উঁচু খাট দেখতে পেলাম - ওটা কে ওরা খাট না বলে সিন্দুক বলে। সিঁড়ি (মই) বেয়ে উঠতে হয় ওটাতে ।
সকালে উঠে, নাস্তা খেলাম, অনেক আদর যত্ন করে সব বানালো ওনারা , তবুও আমি বাসার সেই ফেলে আসা পরিবেশ এবং মজার খাবার গুলোর অভাব অনুধাবন করতে লাগলাম । অনেক দিন পর গত রাত্রে সিপ্রা ফুফফি দের বাড়ীতে ওনাদের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখলাম - আমি নিজে দেখে নিজেই চিনিতে পারলাম না । গত কয়েক দিনে আমি দেখতে একদম অন্য রকম , বাসায় আমাকে সবাই খালি খোঁচা দিত আমি নাকি সব সময় বেশি খাই, সব কিছু খেয়ে ফেলি আর এই জন্যই আমি নাদুস নুদুস । কালকে চেহারা ছবি দেখে পরিষ্কার বুঝলাম আমি আর সাদুস সুদুস নাই - প্যান্টের কোমরও অনেক ঢিলা হয়ে গেছে, বার বার নিচে নেমে আসে, একটা বেল্ট ও নাই , বার বার টেনে টেনে উপড়ে উঠাই প্যান্টটাকে। আয়নায় দেখে বুঝলাম আমার অবস্থা । নাস্তা খাওয়ার সময় আম্মা এবং বাকি সবার কথা খুব মনে পরল - মিজান কাকাকে বললাম কাকা কালকে কিন্তু আমাকে মান্দারপুর নিয়ে যাবেন অবশ্যই ।
সবাই মিলে বের হলাম দল বেধে, ধান কাঁটা দেখতে , বাড়ীতে মহিলারা সব তৈরি হচ্ছে নতুন বছরের ঢেঁকি ধুয়ে মুছে রেডি করছেন, কাকা বললেন বোরো ধান এই বছরের নতুন ফসল। নতুন ধানে হবে নবান্ন ; অনেক দিন আগে পড়েছিলাম। হেঁটে হেঁটে জমিতে যেয়ে দেখি সবাই তৈরি, প্রথম কাস্তে হাতে নামলেন ঐ বাড়ীর সবচে বড় ভাই আমার দাদীর ছোট উনিই কাটলেন প্রথম আটি ধান , তারপর সবাই শুরু করল লাইন ধরে ধান কাটা প্রায় এক মাইল লম্বা এবং আধা মাইল চওড়া এই জমি অনেক গুল আইল আছে মধ্যে খানে কিন্তু পুরাটা জমিই এদের সব ভাইদের । একদম ঠাঁসা পাকা ধানে , ধান গাছের আগা গুলো অবনত একটু ঝুলে গেছে ধানের ওজনে, একেক টা ধানের থোকাই অগণিত ধান , একেবারে পেকে সোনালি রঙের হয়ে গেছে , পুরা জমিটা সোনালি আর সবুজে ঢাকা, বাতাসে মৃদু দুলছে, মনে হল একটু নাচছে আনন্দে, গাছ গুলো ধানের ভারে ক্লান্ত , আমার কাছে মনে হল, সবুজ একটা শাড়ি তে সোনালি জর্জেট দিয়ে কেই বসে বসে সেলাই করে বানিয়েছে এই বিয়ের শাড়িটা কোন হবু বউ এর জন্য । এত কাছে থেকে আমি এর আগে কোনদিন এই দৃশ দেখি নাই , দাদারা সব বসে আছে আইলে , সবাই একটা হুঁকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে টানছে , মুর্শিদ কাকার ছোট ভাই বলল, এই জমির ধানে আমাদের বাড়ীর সারা বছরের চাউল উঠে আসে, বাকি সব আমরা বিক্রি করে দেই । এই পাতরে ( মানে হল এই মাঠে ) আমাদের মত বড় জমি একসাথে আর কারো নাই , নয় কানি, তিন শতাংশ - আমি ওটা তখন কিছুই বুঝি নাই । এইটুকই বুঝলাম এটা একটা বিরাট ব্লক বা প্লট । নতুন ক্ষেত্রফল এর অঙ্ক কর তার কয়দিন আগেই শিখেছিলাম পায়ে হেঁটে হেঁটে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ মাপলাম , তার পর গুন করে ক্ষেত্রফল বের করলাম - কাকারা আমাকে নিয়ে হাসল বেশ কিছুক্ষণ ; দাদা একজন বলল ‘' শাহিন এর পরের খেতে তুমিই প্রথম আডি (আটি) ধান কাটবা, তুমি আমরার মেজবান ( মেহমান), তুমার আব্বা কলিকাত্ত্যার (কলকাতা) থেইক্কা এইবার পর তোমার থেকে একটু বড় থাকতে আম কাঁঠালের ছুটিতে দাপুনিয়া আইছিল, তখন তোমার আব্বারা নিয়া আমরা ধান কাটছি, ধান মাড়ান দিছিলাম, গাংগে শাত্রাইছি- অনেক মজা পাইছিল তোমার আব্বা ; তারপরই একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন , হেরে , আমার কইলজার টুকরা বইন পূত ডা যে কই আছে, আল্লাহ তারে সহি সালামতে রাখুক, বালা মুসিবত দূর করুক । ‘'
কয়েক মিনিট পরেই প্রথম জমি কেটে ফেলল , দুইজন আটি বানাতে লেগে গেল, তিন/ চার জন কাঁধে ভার (বাঁশের ফালির দুই প্রান্ত ধানের আটির ভিতরে প্রবেশ করিয়ে ঐ বাঁশের ফালি ( যাকে গ্রামের ভাসায় ভার বলে) কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে ধান গুলো বাড়ীর উঠানে এনে স্তম্ভ স্তম্ভ করে করে সাজিয়ে রাখবে আর এর মধ্য থেকে সবচে পাকা সোনালি ধান এর আটি খুলে সোজা ঢেঁকিতে ধান থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল মাড়িয়ে নিবে, যা দিয়ে নবান্নের সিন্নি বা ঝোলা পায়েস বানাবে সবাইর জন্য - এটাই আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতি । এবার আমার পালা আসলো জীবনেও ধান কাঁটার কাস্তে হাতে নেই নাই । হাতে নিয়ে পাচ ছয়টা ধান গাছ হাতের মুঠো তে নিয়ে যেই কাস্তে দিয়ে ঘসে ঘসে কাটতে গেলাম , ওমনি আমার কাস্তে টা পিছলিয়ে আসে আমার বাম হাতের কেনি আঙ্গুল টার আঙ্গুলের ভাজ যেখানে পরে ঐ চামড়া টা কেটে নিয়ে গেল আর ভীষণ ব্যথা পেলাম, ধানের আটি ফেলে এক লাফে সরে এলাম আর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি বেশ জায়গা কেটে গেছে সাদা মাংস দেখা যাচ্ছে একটু ছাল ঝুলে আছে, তখন রক্ত বের হতে শুরু করে নাই , দুইম তিন মিনিত পর রক্ত পরা শুরু হোল । সবাই ব্যাতি ব্যস্ত হয়ে পরল আমাকের নিয়ে ; আমি বেশ সাহস দেখালাম যদিও প্রচণ্ড ব্যথা করছিল আর রক্তও বের হচ্ছিলো । একটা ধান কাঁটার লোক ধান গাছ তেথলিয়ে ঐ তেথলানো গাছের রস আর ধান গাছ ক্ষত স্থানে চেপে ধরল আর এক জন মাথায় বান্ধা গামছা ছিঁড়ে হাত টা ব্যান্ডেজ করে দিলেন । দাদারা এবং মিজান কাকা খুব লজ্জা পেল বলে মনে হল । আমি ওনাদের সান্ত্বনা দুয়ে আসস্থ করতে চেষ্টা করলাম । আর আমার জীবনেও ধান কাঁটা হল না । তার পর যে কয়টা গাছ কেটেছিলাম ঐ গুলো এক জায়গায় করে রুপা কাকা একটা আটি আমাকে উপহার দিল, বলল, এইডা ভাউজ (ভাবী) দেখাইও ।
সবাই আমাকে যদিও বলল বাড়ীতে চলে যেতে, আমি না যেয়ে পুরা দিন ধান কাঁটা দেখলাম, ওনাদের সাথে মাঠেই খেলাম, আটার রুটি জাতীয় পিঠা ধরনের সাথে সুজির হালুয়া আর অল্প অল্প খিচুরি । সবাই বলল আজ রাতে বড় ধরনের খাওয়া দাওয়া হবে ।
পরদিন সকালে রওনা দিলাম ছোট একটা ছোট্ট কোশা জাতীয় নৌকা তে করে আমি আর মিজান কাকা আর এক মাঝি, কাকা বলল, দরকার হলে উনিও বৈঠা ধরবে আর মাঝি লগি দিয়ে ঠেলবে । কোন ছই নাই নৌকাতে । ভাড়া করা, বেশ দ্রুত মনে হল । খালে লগি দিয়ে চালাল- নদিতে এসে বৈঠা, কাকাও উল্টা দিকে বসে অনেকক্ষণ দাড় টানলেন ; একবার টেনে অনেকক্ষণ বসে থাকে । অনেক দ্রুত আমরা বিটগড় পার হলাম তারপর আবার আরেকটা খালে করে বিকালে প্রায় সন্ধ্যা হয় হয় সময়ে চারগাছ এ নামলাম ওখান থেকে হেঁটে হেঁটে আসলাম মান্দারপুরে । এক হাতে আমার ধানের ছরা অন্য হাতে আমার কাপড়ের পোটলা । চারগাছ নেমেই শুনলাম কাল রাত্রে পাঞ্জাবী হানা দিয়েছিল এই এলাকায়, দুই তিন জনকে ধরে নিয়ে গিয়েছে । পাশের গ্রামে আর্মি তে চাকরী করে কয়েক টা পুড়িয়ে দিয়েছে । ওরা মুক্তি খুঁজছে , গ্রামের সব মানুষ ভয়ে ঘর ছেড়ে মাইল কে মাইল দৌড়ে পালিয়েছে রাতের আধারে । এসব শুনেই আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাবার মত অবস্থা । আম্মার আর টুম্পার কথা চিন্তা করেই অস্থির হয়ে পরলাম । একদম মন টা ভেঙ্গে গেলো কি হবে আমাদের । সবই হারলাম , বাবা বেছে আছে কি না ? ঘর ও নেই, আমাদের গ্রামে বাড়ীতে যাওয়াও মনে হয় নিদাপদ নয়, মামনি, খুকুমণি, রোকন ওরাও নিরাপত্তা খুঁজছে, ভাইজান এরও কোন পাত্তা নাই, দাদী গ্রামে এখনও একা , আমরা নির্বাসিত, বাস্তুহারা সব কিছুর পর আমরা এই গ্রামের মানুষের মধ্যে একেবারে কালশিটে বৃদ্ধাংগুলের মত দেখতে লাগি ; যেটা আমাদের জন্য সমূহ বিপদ দেকে আনতে পারে । সিমরাইলে শুনেছি পাঞ্জাবীরা সব গ্রামে গ্রামে- থানায় - মহকুমায়, জেলায় ওদের তাবেদার লোকদের দিয়ে শান্তি কমিটি বানাচ্ছে । গোঁড়া ধর্মীও রাজনীতি যারা করে, মুসলিম লীগ, পি, ডী, পি, নেজামে ইসলামি, জামায়েত ই ইসলামি, বিভিন্ন মাদ্রাসা এবং মসজিদের ইমাম দের কেও নাকি ঐ দলে নিচ্ছে । যাদের কে দিয়ে ওরা সব জায়গায় ওদের গোয়েন্দা গিরি করাবে এবং মুক্তিফৌজ,বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই পি আর এবং আওয়ামী লীগ সহ পাকিস্তান বিরোধীদের বিরুদ্ধে । রফু কাকা ওনার ছাত্র গ্রাম এর প্রহরা দারিদের এই সব কথা গুলো বলতেও আমি নিজে শুনেছি । ভয়ে আর হাঁটতে পারছিলাম না মোটেও। কি হবে আমাদের ? আমার ঐ সময়কার অবস্থা টা কাউকেই বুঝানো সম্ভব না , মাত্র ১১ বছর বয়েসে আমাকে ভাবতে হচ্ছে কেমনে আমি এই কয়জনকে নিয়ে একটা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছেতে পারবো । আজ থেকে পনের বিশ দিন আগে স্বপনেও ভাবি নাই, আমার জীবন টা এইরকম ভাবে উল্টাপাল্টা হয়ে যাবে । অসহায়, নিরুপায়, দিকনির্দেশনা বিহীন হয়ে আতংকে চোখ দিয়ে কখন যে দুই ফোটা অশ্রু নির্গত হয়ে গাল দিয়ে গড়িয়ে মাটিতে পরল তা উপলব্ধিই করার আগেই সাজু কাকাদের বাড়ীতে প্রেস করলাম । সূর্য প্রায় অস্ত গেছে ততক্ষণে । বাড়ীতে ঢুকেই আম্মাকে জড়িয়ে ধরলাম, আমি সবসময়ই আম্মার সঙ্গে অনেক হাসি তামাসা করতাম - বিভিন্ন ক্যারিকাচ্যুর দেখিয়ে হাসাতাম আম্মাকে - এখন আর ঐগুলো আসে না এখন জীবন মরণ সমস্যা । সব ই অন্য রকম হত যদি পরিবারের কর্তাব্যাক্তি আমাদের মাঝে তাখত উপস্থিত । আর সবচে বড় যে সমস্যা সেটা হল আমরা এমন একটা এলাকায় অবস্থিত যেখানে সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক মাথাব্যথা পাঞ্জাবীদের জন্য । ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পুরাটাই ঢাকা - ফরিদপুর - নরসিংদী - মুন্সিগঞ্জ - বিক্রমপুর - নারায়ণগঞ্জ এই পুরা এলাকার সম্ভাব্য মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং নিতে ইন্ডিয়া যাওয়ার একমাত্র সহজ রুট এবং কুমিল্লা কান্টনমেন্ট - থেকে সিলেট এই সম্পূর্ণ অঞ্চলের একমাত্র সাপ্লাই রুট এবং এই মহকুমার যে কোন বর্ডার থেকে ইন্ডিয়ার ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী মাত্র ১০ মাইল দূরে, যার ফলে এই এলাকাটাতে পাঞ্জাবীদের ১০০% প্রতিপত্তি স্থাপন করা ওদের জন্য অত্যন্ত জরুরী হিসেবে দেখা দিয়েছিল বলে মনে হয় । এই এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে, নিরীহ মানুষদের হত্যা করে , হিন্দু গ্রাম এবং হিন্দু বাড়ীঘর পুড়িয়ে, বাজারে বাজারে ক্রামগত আক্রমণ করে, গ্রাম গুলোতে অতর্কিতে রাতের অন্ধকারে তল্লাশি চালিয়ে, দ্রুত ওদের দুই জাতি মতবাদের পৃষ্ঠপোষক এবং সহায়তাকারীদের দিয়ে স্বাধীনতা কামী জনগণ এবং সশস্ত্র যুদ্ধে যোগদান করতে পারে ঐ বয়সীতরুণ দের কে চিহ্নিত করা এবং অত্র এলাকার যারা সামরিক বা আধা সামরিক বা পুলিস কিংবা সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দের এবং তাদের পরিবারবর্গ দের হত্যা করার মাধ্যমে ওরা বাঙ্গালীদের স্বাধীনতা সংগ্রাম টা সমূলে উৎপাটন করতে চাচ্ছিল । নির্বিচারে হত্যা, মহিলাদের উপর যৌন অত্যাচার, মহিলা এবং যুবতী মেয়েদের যৌন ক্রীতদাসী করে ওদের ক্যাম্পে আটকিয়ে রেখে ওরা বাঙ্গালী জাতি টাকে সম্পূর্ণ ভাবে বিলুপ্ত করতেই চেয়েছিল ।আম্মা যেমনে করে আমাদের বলতেন কিভাবে হিটলার জার্মানি তে হলোক্যাস্ট এর মাধ্যমে, ইহুদি ধর্ম অবলম্বী, ইহুদি সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণ ভাবে এই জগত থেকে উৎপাটন করতে চেয়েছিল ; পাকিস্তানি আর্মি ঠিক হিটলারের হলোকাস্ট বই পড়েই সেই রকম ভাবে পদ্ধতিতেই আমাদেরও শেষ চেয়েছিল ।
ষষ্ঠ পর্ব
লং মার্চ
রাত্রে খাওয়া খেয়ে মিজান কাকা বিদায় নিলেন । আম্মাকে বললেন ভাবী সাজু বা মাজু ভাইকে দিয়ে খবর পাঠালেই আমরা এসে আপানদের নিয়ে যাব নাইওর আমাদের বাড়ীতে, কোন ভয় পাইয়েন না । এই বলে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন, বললেন সে হেঁটে হেটেই চলে যাবেন । এদের সাহস ই অন্যরকম, রাস্তা নাই, খালে, বিলে সাকো নেই, ব্রিজ নেই, কোন আলো নেই এরমধ্যেই এত রাত্রে হেঁটে চলে যাবে ছয় সাত মাইল দূরে । ভাবতেই আশ্চর্য লাগে । আমরা আমাদের ঘরে চলে গেলাম ওনাকে বিদায় দিয়ে , কিছুক্ষণ পর দাদা এসে ঢুকলেন চুপিচুপি, আম্মা আমাকে ও আপাকে ডাকলেন কাছে, দাদা বললেন আমরা ৩০ এপ্রিল ইন্ডিয়া যাওয়ার জন্য এখান থেকে রওনা দিব ; ভোর ৫ টার দিকে, প্রায় ২২ -২৩ মাইল পথ, কাউকে কিছু বলার দরকার নাই, মাল সামানা যত কম নেওয়া যায় ততই ভালো । বাড়ীতেও কাউকে বলার দরকার নাই । দাদা বলল গ্রামের কিছু মৌলানা জাতীয় লোকজন রা ইতিমধ্যে শান্তি কমিটি বানাবার কথা বলতেছে । ওরা গ্রামে কোন রকম শহরে অতিথি জায়গা দিতে নারাজ , আরও চায় না কোন যুবকরা মুক্তি বাহিনী তে যোগদান করুক, ওরা দাদাকেও খুব একটা পছন্দ করে না - কারন উনি সব সময় আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু কথা বলেন তাই, উনি সব সময় পাকিস্তানি আর পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে কথা বলাতে ওনাকে ঐ গ্রুপ পছন্দ করে না । অনেককে আবার ইসলাম কে বাঁচাতে হলে পাকিস্তান হিসাবে আমাদের থাকার ব্যাপারে খুব সোচ্চার । এই গুলি সবই তোমাদের জন্য বিপদজনক । তাই আমি নিজে মনে করি তোমরা ইন্ডিয়াতে চলে যাও আর আমি তোমাদের কে নিয়ে যাবো, বাঁচি আর মরি একসাথেই থাকব ; ওখানে পৌঁছাইয়া দিয়া তারপর আমি চলে আসব । তখন শুনলাম, গত পরশু যখন পাঞ্জাবীরা গ্রাম এ হামলা করেছিল, তখন পুরা গ্রাম বাসি রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছেড়ে জমিনে, পাট খেতে, ডোবায়, পুকুরে, খালের পারে, কেউ কেউ খাল অন্ধকারে সাঁতরাইয়া অন্য গ্রামে চলে গিয়েছিল। যদি ওরা সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করত তাহলে প্রাক্কাসে দিবালোকে দেখে দেখে এক এক করে পুরুষ গুলো মারতে পারতো, আর যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যেত পারতো ।আম্মা বললেন আমার মনে হচ্ছিল পাট ক্ষেত থেকে বের হয়ে এসে নিজে নিজে ওদের কাঁচে ধরা দেই কারন আর পারছিলাম না ঐ গভীর রাতে পালাতে কাচা ঘুম থেকে উঠে, এর পরের যে কি করব তা আমি নিজে জানিনা । দাদা তখন বললেন গত রাত্রে ওরা রাইয়ত হাঁট নামে এক গ্রামে অ্যাটাক করেছিল, ঐ গ্রামে ৯০% মানুষ হিন্দু, চর্মকার সম্প্রদায়ের লোক, পাঞ্জাবীরা ঐ গ্রামে ঢুকে সব গুলো বাড়ী জ্বালিয়ে দিয়ছে, ২ থেকে ৩০০ পুরুষ, মহিলা ও শিশু দের হত্যা করে ফেলে রেখে গেছে , প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ জন যুবতী মেয়ে দের ওদের সাথে আনা খালি ট্রাকে করে উঠিয়ে নিয়ে গেছে । এসব শুনে গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে উঠলো ।
দাদা বললেন আমাদের সবচে ভয় হল সি এন্ড বি রোড ব্রাহ্মণবাড়িয়া টু কুমিল্লা রোড পাড় হওয়া আর ভয় হোল কসবা থেকে আখাউরা রেল লাইন অতিক্রম করা । এই দুইটা থেকে বেচে গেলো, আর এতোটা পথ হাঁটতে পারলে আর কোন সমস্যা দেখি না । দাদা বলল উনি সকালে বেশি করে মুড়ি, চিরা, গুড়, কিনে আনবেন পথে খাওয়ার জন্য সময় নষ্ট করা যাবে না । দাদার বয়েস তখন কম করে হলে ৬০ থেকে ৬৫ হবে । তার পরও ওনার আমাদের জন্য এতবড় বিপদজনক ঝুঁকি নেওয়া সত্যই সারাজীবন শ্রদ্ধা ভরে মনে রাখার মত একটা ব্যাপার । দাদার মহানুভবতা স্মরণীয় ।
আম্মা আমাকে এবং ছোট ভাইদের কে বলল কারো সঙ্গে যেন যাওয়া নিয়ে কোন প্রকার কথা বার্তা না বলার জন্য। দাদা বলল উনি তার তিন ছেলেকেই শুধু বলবেন ার যাওয়ার আগে দাদী কাছ থেকে বিদায় নেয়ার আগ পর্যন্ত কোন কিছুই বলবেন না । আম্মা বার বার বলতে লাগলো কাকা আপনাকে এই মহা বিপদে ফেলার জন্য আমি অত্যন্ত লজ্জিত এবং দুঃখিত । আমরা যদি পারতাম টা হলে একলাই চলে যেতাম, কিন্তু আমরা কিছুই জানিনা এবং চিনিনা ; নিজের দেশে আমরা নিজেরাই আগন্তক , অপরিচিত , পরদেশী যেমন ।
দাদা বলল, উত্তর পাড়ার অনেক হিন্দু পরিবার ঘর বাড়ী যেমনে আছে তেমনি ভাবে ফেলে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেছে । মান্দারপুর আর সিমরাইল এর মধ্যবর্তি মেহের জাতিও নাম সমৃদ্ধ একটি গ্রামের প্রায় ১৫ - ১৬ জন যুবক গতকাল ইন্ডিয়া যাওয়ার সময় ধরা পরেছে পাঞ্জাবীদের হাতে । যুবক দেখেলেই এর্যেস্ট করছে ওরা, এসব শুনে আমাদের মনোবল আরও দুর্বল হয়ে পরল । দাদা বললেন, যুবতী মেয়েদের কেও কেরে নেয় পরিবারের কাছ থেকে । অল্প বয়স্ক যুবতী নিয়ে এইসব পথে পালানো ভয়ঙ্কর বিপদ । এসব বলার পর খুবই সন্তর্পণে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন, আম্মা এতক্ষণে ফুরসত পেলো রেডিওটা টুউনিং করার। বেশ কিছুক্ষণ মিডিয়াম ওয়েভ ব্যান্ড ঘুরনোর পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ধরতে সক্ষম হলেন। ভলিউম একদম কমিয়ে রেডিও টা কানের কাছে নিয়ে আম্মা আর আপা শুনলো কিছুক্ষণ , আমিও একটু শুনতে পেলাম। দেশের গান, বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের সেই অমোঘ বানী শুনলাম, আম্মা রেডিওর আওয়াজ একটু বাড়ীয়ে ঘর থেকে বাইরে গিয়ে শুনার চেষ্টা করল, তারপর ঘরের পাশের গলি টা যেয়ে হেঁটে আসলো , এসে বলল, না, কোন কিছু শুনা যায় না । আমরা তারপর অনেক কসরত, টিউনিং, ঘেসঘেস আওয়াজ এর মধ্যেই শুনতে থাকলাম , এর পর এলো রাতের বিবিসির খবর ওটাও শুনলাম, তারপর আকাশবাণী রেডিও আমাদের সময় সাড়ে দশ টায় কলকাতার দশটার খবর শুনলাম গুরু গম্ভীর দেব দুলাল বন্দোপধ্যায় এর গলায়। এর পর আবার শুনলাম স্বাধীন বাংলা বেতারের চরম পত্র । এটা আমাদের এক নতুন ; একটা নতুন জানালা যেন খুলতে সক্ষম হলাম বহির্বিশ্বের সাথে , মারকনিও মনে হয় এতোটা আনন্দ পাই নি রেডিও উদ্ভাবন করে, আমরা যা আনন্দিত হলাম, রেডিওর ভয়েস শুনে। আম্মা মধ্য খানে শুধরিয়ে দিয়ে বলল, আসলে রেডিও কিন্তু উদ্ভাবন করেছিলেন একজন বাঙ্গালি , স্যার জগদীশ চন্দ্র বোস সবার আগে এটা উদ্ভাবন করেছিলেন কিন্তু উনি এই উদ্ভাবন টা ওনার নামে রেজিস্টার করেন নাই । আপা রেডিওর কোন দাগের মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্টেশন টা ধরা যাবে ঐ দাগ গুল ভাল করে দেখে ঠাওর করে নিলো । এদিকে আমার কেটে জাওয়া আঙ্গুল টা বেশ ফুলে উঠেছে আম্মাকে দেখালাম , আম্মা অন্য সময় হলে একচোট নিত , কিন্তু এখন কিছুই বললেন না, বলল এখন সহ্য করে ঘুমাও, সকালে ব্যবস্থা করব । বলল পেঁচানো ন্যাকরা টা খুলে ফেলতে। খুলে আস্তে করে ঘুমিয়ে পরার চেষ্টা করলাম, দাপুনিয়া তে রাত্রে ভালো ঘুম হয়েছিল ওনাদের বিছানা গুলো অনেক আরাম দায়ক ছিল । কিন্তু, এখানকার টা অত্যন্ত অপ্রতুল , তারপরও ভাবলাম, ওসব এখন চিন্তা করার সময় নেই, ওনারা যে দয়া করে আমাদের স্থান দিয়েছে এটাই আমাদের সৌভাগ্য । পরের দিন একটা ছোট ঘটনা আমার জীবনের সবচ’ দুঃখজনক একটা উপাখ্যান ; যার সৃতি বহন করছি আজও । সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাত্যহিক কাজকাম সেরেই দেখি আজিজ কাকা তাদের দুধের গরু দুটোকে দুধ দোহন করতে তৈরি হচ্ছেন, আমি বেশ উত্তেজিত হয়ে গেলাম এবং যেহেতু কিছুই করার নাই , পড়াশুনা, বাড়ীর কাজ, খেলাধুলা কিছুই নাই আমাদের করার । তাই ওনার পাশে গিয়ে ওনাকে সহায়তা করতে গেলাম, উনিও কিছু বললেন না, প্রথম গরু তা শান্ত প্রকিতির সহজেই দুধ দোহন করলেন এবং দ্বিতীয় গরুটা দোহন করতে যেয়ে একটু বেগ পাচ্ছিলেন , হটাৎ উনি আমার উপর রেগে গেলেন এবং সাথে সাথে আমাকে ঐ এলাকার কথ্য ভাষায় একটা অকথ্য গালিগালাজ করলেন । আমি হতবাক এবং আশ্চর্য হয়ে গেলাম । আমাকে জীবনেও কেউ গালাগালি করেন নাই ; আর ওনার গালি টার মানে আমি জানতাম - ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে শুনেছি , কিন্তু আমার আব্বার কাকাতো ভাই যে আমাকে এই অকথ্য ভাষায় অপমান ও বচসা করবে বা করতে পারে তা আমি জীবনেও ভাবি নাই । আমি খুব লজ্জা পেলাম এবং রাগে, ঘৃনায়, অপমানে, দুঃখে বাড়ী থেকে বেড় হয়ে গেলাম। একা একা সারাদিন মাঠের শেষ প্রান্তে মেড়াসানি গ্রামের নিকট একটা পুকুরের পাড়ে কবরস্থানে বসে ছিলাম , এদিকে আম্মা ও শুনে খুবি মর্মাহত হলেন, সারা এলাকা খুঁজেও ওরা আমাকে পেল না , আমি দুঃখে, লজ্জায়, খোবে এবং সর্বপরি ওদের কৃপায় আশ্রিত হওয়ার জন্য উনি আমাকে আজ এইভাবে অপমানিত করল - কিন্তু আমি কোন ভাবেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমার ভুল টা কি? কোন আগাম সূচনা ছাড়াই ওনার এই অন্যায় আচরণ আমি কোনমতেই মেনে নিতে পারছিলাম না । একবার ভাবলাম হেঁটে হেঁটে সিমরাইল চলে যাই - কিন্তু , মধ্যে খানে একটা খাল আছে, আমি সাঁতার খুব একটা ভাল কাটি না আর একা একা এতো বড় প্রসস্থ খাল পাড় হতে পারব না বলে গেলাম না । কবরস্থান এর পাশেই পাকা ঘাট বাধানো সিঁড়ি গুলো আর সিঁড়ির উপড়েই দুটো সিমেন্টের বেঞ্চ- আমি ওখানেই বসে থাকলাম সারা দিন, সন্ধ্যা হয়ে এলো চিন্তা করলাম এমনিতেই আমারা যাযাবর, গৃহহীন, অন্যের উপর নির্ভরশীল, থাকি আরেক জনের বাড়ীতে, খাবার ও খাচ্ছি ওদের কৃপায় । আজ আর কালকের রাত টাই থাকবো এদের মাঝে , যাই ফিরে যাই না হলে আম্মা একদম ভেঙ্গে পরবে আর তার উপর ওনার উপর অনেক টেনশন এমনিতেই , জীবন টা একেবারে উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। এর মধ্যে আমি আর টেনশন যোগ করতে চাইলাম না । আজ ১১ - ১২ দিন যাবত আমরা এই বিছিন্ন, ভবঘুরে জীবনে পদার্পণ করেছি । এখন আর আম্মা ভাইদের আর বোনকে আতঙ্কে ফেলে লাভ নাই । হেঁটে হেঁটে ফেরত আসলাম দাদার বাড়ীতে, আম্মা আমাকে দেখে কাছে ডেকে বলল, কি হয়েছিল ? আমি বললাম, যে আমি বসে বসে ওনার গরু দোহন দেখছিলাম, হটাৎ গরু লাফ দিয়ে আর ওনার দুধের বালতি টা দুই হাঁটুর মধ্যে থেকে পিছলে পরে যায় মাটিতে আমি ওনাকে সাহায্য করতে কাছে যেতেই সে আমার উপর রেগে যায়। এবং আমাকে একটা অকথ্য গালি দেয় । আম্মা বলল যা হবার তা হয়ে গেছে, তোমার কাকা আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে , যাও সব ভুলে যাও, আমি হাত মুখ ধুয়ে সোজা ঘরে ঢুকে পরলাম, আর বের হই নাই, আম্মা আমার জন্য খাবার ঘরেই নিয়ে এসেছিল ওটাই খেয়ে শুতে যাব তখন দাদা আজিজ কাকাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল, কাকা আমাকে আদর করে দিল , তখন আমি লজ্জায়, দুঃখে, খোবে কেঁদে দিলাম। আমি সেদিন খুবি কষ্টও পেলাম এবং উপলব্ধি করলাম যে, বিপদে পরলে মানুষ চেনা খুব মুস্কিল। ঐ সময়কার অনেক কিছুই আমাকে অনেক গুন বেশি পরিপক্ব করে তুলেছিল সেই অল্প বয়সেই। যুদ্ধ লাগার আগে আমি ছিলাম খুবি গোবেচারা, শান্ত, শিষ্ট এক পড়ুয়া বালক, যার চোখে মুখে ছিল অনেক স্বপ্ন ; ওনারা বিদায় নেবার পর আম্মা আবার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনলো, আমাকে আঙ্গুল এর জন্য আয়োডিন মেখে ব্যান্ডেজ করে দিলো, আঙ্গুল টা বেশ ফুলে উঠেছে , প্রচুর ব্যথাও অনুভব করছিলাম সারা দিন, এখন ঘা’ টা দেখে বুঝলাম , ক্ষত টা বেশ বড় এবং এখনো রক্ত আর একটু পুঁজ জমেছিল, আম্মা আয়োডিন দিয়ে তুলা দিয়ে সব পরিষ্কার করে নতুন গজ দিয়ে ব্যান্ডেজ বেধে দিল। আম্মা বললেন এখন এত দূর এর পথ হাটার সময় আর এখন তুমি আঙ্গুলের মধ্যে আরেক টা ইনফেকশন বানানোর পথে । অনেক পথ হাঁটতে হবে আমাদের, বর্ডার এ পৌছার আগে কোন গ্রামেই রাত্রিযাপন করা সমচিন হবে না । খুবিই রিস্কি এবং বিপদজনক । দাদা আম্মার সাথে বসে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম জমিনের ভিতর দিয়ে, মেঠো এবং ইটের রাস্তা, পাকা রাস্তা এড়িয়ে যাওয়ার একটা পরিকল্পনা করেছে, যাতে দাদার ধারনা কম করে হলেও ২১ থেকে ২৫ মাইল হাঁটতে হবে আমাদের । তার উপর দুই দুইটা বড় বিপদজনক জায়গা অতিক্রম করতে হবে ।
কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম জানিনা , স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে লাফ মেরে উঠলাম - ঘুমের মধ্যেই দেখলাম আমি আবার ঐ ডোবায়, পানির মধ্যে গলা পর্যন্ত, আর বিমান গুলো আমার মাথার উপর ডোবার কচুরি পানার পাতার ডগার থেকে এক ফুট উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে আর আমি যেই পাড়ে গলা পানিতে বসে আছি ঐ দিকে গুলি করতে করতে আগিয়ে আসছে ; গগন বিদারী আওয়াজে আমার কানের পর্দা ফেটে মন হল রক্ত বের হচ্ছে , দেখেই ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলাম । গা’ ঘেমে চপচপে, ভয়ে কাঁপছি থরথর করে বাতাসে যেমন বাসের পাতা কাঁপে ওইরকম ভাবে । হ্যারিকেন ডিম করে জ্বালানো থাকতো রাত্রে ওটার ডিম আলোতে উঠেই বাইরে গেলাম প্রকৃতির টানে - যেয়েই দেখি তিন - চারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে বাইরে এত রাতে, একটু ভয় পেতেই মাজু কাকা এগিয়ে এসে বলল, কাকা ''কিচ্ছু মাইত্তো না , আমরা যাইতেছি ইন্ডিয়াৎ, মুক্তিবাহিনী হইতে, ঘরে কাউরে কিচ্ছু কইয়ো না, আমি আর তোমার সাজু কাকা আর আমরার দুই মামাতো ভাই আর আমার বন্ধু, আল্লাহ বাঁচাইয়া রাখলে দেহা হইব , কাকা। ‘' সাজু কাকা আর এসে বিদায় নিলো না , হয়ত ওনার মায়া বেশি বিদায় নিতে গিয়ে হয়ত কান্নাকাটি করে ফেলতে পারে । আমি কোন কথা না বলেই ঘরে ঢুকে আবার ঘুমাবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলাম ।কোন ভাবেই ঘুম আসল না , ভাবলাম, কাকারা যেভাবে যাচ্ছে যুদ্ধ করে বাংলা মাকে শত্রু মুক্ত করতে -তা তে এই প্রমাণিত হচ্ছে, পাকিস্তানিরা সাবধান, নিরস্থ্র পেয়ে আমাদের দেশ টা দখল করে বসেছো তাই না । কিন্তু বেশি দিন নেই এই গ্রামের কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক, দিন মজুর, যুবক, কিশোর রা আসছে আসছে তোমাদের কে এ দেশ থেকে তাড়াবে, তোমাদেরকে যেখানে পাবে সেখানেই মারবে এই বাংলা মায়ের সন্তানেরা । তোমরা হাজার মাইল দূর থেকে এসে বাঙ্গালি জাতিকে অপমান করেছো সবুর কর আর কটা দিন, বুঝবে তোমরা বেইমানরা বাঙ্গালী কি জাতি ? ত্রাহি ত্রাহি করেও জান বাঁচাতে পারবে না । সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর মধ্যে শতকরা ৯৯ জন ই তোমাদের শত্রু, আমার সাজু কাকা আর মাজু কাকার মত ছেলেরা যখন রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যাচ্ছে ঘর ছেড়ে দেশ কে শত্রু মুক্ত করতে তার মানে এ বিজয় আমাদের। ভেতো বাঙ্গালী, মার্শাল রেস ( যুদ্ধ প্রিয় জাতি ) নয় - অপেক্ষা কর - বাঙ্গালী তোমাদের শিখাবে যুদ্ধ কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি ? শুধু অপেক্ষা অল্প কোয় দিনের । গর্বে মনটা ভরে গেল, আমি বয়সের কারণে , পরিবার ফেলে না যেতে পারলে কি হবে, আমার শরীরে সাজু এবং মাজু দের রক্ত প্রবহিত ; এ বিজয় আমদের হতেই হবে । এর মধ্যে দুইদিন স্বাধীন বাংলা রেডিও শুনে বুঝতে পেরেছিলাম, যে বাংলার বীর ছেলেরা, বাংলার বেঙ্গল রেজিমেন্ট ( যাদের কে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া তে দেখেছি ), ই, পি, আর, আনসার, মুজাহিদরা নেমে গেছে যুদ্ধে, মনে মনে ভাবলাম, যদি আব্বা বেচে যেয়ে থাকে তাহলে, উনিও নিশ্চয় এখন যুদ্ধে , ভাবলাম ভাইজান কোথায় ? এত কষ্টের মাঝেও কেমন জানি একটা আশার আলোর রেখা দেখতে পেলাম । যেদিন থেকে ঘরছাড়া হয়েছি সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত কোন কিছুই পড়ি নাই, বই, পুস্তক, পেপার। সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন । তার কোন খবর কেউই দিতে পারলো না । এসব ভাবতে ভাবতে মনে এক সময় ঘুমিয়ে পরলাম অজান্তে ।
আর মাত্র এক রাত বাকি, এই আমাদের শেষ দিন এখানে, সকালে কেউ টের পেলনা সাজু কাকা আর মাজু কাকা যে চলে গেছে , ওরা দুজনাই অনেক দিন যাবত রাত্রে ওদের নির্মাণাধীন নতুন বাড়ীতে ঘুমায়। জমিনে কাজ থাকলে আসে , অথবা ওখান থেকেই স্কুলে জেত । তাই, কেই আর ওনাদের নিয়ে কোন মাথাব্যথা দেখাল না । আমি আম্মাকে কানে কানে বলেছি, যে রাত্রে, আমি দেখছি ওনারা পাঁচ জন জেতে । আম্মা বলল, তুমি কাউকে কিছু বলতে যেও না । দাদা আস্তে আস্তে তার পোটলা রেডি করল, তার ছাতি, লাঠি, ছাতির হাতলে পোটলা তা লাগিয়ে ছাতিটা ঘাড়ে রেখে হাটবার মহড়া ও দিল দু একবার। দুপুরে খেয়ে একটা ঘুম দিলাম, গোপিনাথপুর থেকে খবর আসলো দাদীকে নিয়ে গেছে, ভাইজান ইন্ডিয়া তে ট্রেনিং এর জন্য অপেক্ষা করছে, তাকে লোকবল জোগাড় করবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে , সে বিভিন্ন এলাকাতে যেয়ে যেয়ে যুবকদের কে যুদ্ধে যাবার জন্য উৎসাহিত করছে, সে সিলেট থেকে এসে সোজা ৪-৫ এপ্রিল ইন্ডিয়া তে চলে গিয়েছে তার বন্ধুদের সাথে , এর মধ্যে আর কারো সাথে যোগাযোগ করে নাই। তার খবর পেয়ে একটু আসস্থ হল সবাই , বিকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর কয়েক বার বিদ্যুৎ চমকালো বেশ জোড়ে, আমরা দাদীর ঘরের মাটিতে বসে খেলাম, খাওয়ার সময় শুনলাম আজিজ কাকা ওনার বড় ভাই মৌলানা ( পীর সাব) বজলু কাকার মেয়েকে নিয়ে গেছেন ওনার খানকায় , উনি যেই এলাকায় থাকে সেই এলাকার সে একজন কামেল পীর হিসেবে পরিচিত ।
দাদা তখন দাদী কে বললেন, আমাদের চলে যাবার পরিকল্পনা, দাদী একটু আশ্চর্য হলেন শুনে, তখন আম্মা ওনাকে বুঝিয়ে বললেন । আব্বার কথা, তারপর নিরাপত্তা, আমাদের জন্য ওনাদের উপর বিপদ আসার সম্ভাবনা । সব বুঝিয়ে আসস্থ করলেন , আম্মা প্রায় কান্না কান্না হয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন । আমাদের সবাই কে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে বলল আম্মা, দাদী খুবি কম কোথার মানুষ, সারাদিনে ওনার গলার আওয়াজ এক দম ই শোনা যায় না, খুবি শরীফ, পর্দানশীন এবং মিতভাষী । এই কয় দিনে অনেক কষ্ট করেছেন আলাদা পাঁচ জনের তিন বেলা রান্না করা এবং আনুসাংগিক সব কিছু জোগাড় করা, সিন্দুক থেকে বিছানা পত্র বের করা, নাস্তা, চা, বিস্কুট ব্যবস্থা করা চারটি খানেক কোথা না , ওনারা আমাদের জন্য অনেক কিছু করছে , যখন আমাদের চোখের সামনে আর কোন জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার মত স্থান ছিল না তখন এনারাই ছিলেন আমাদের একমাত্র ত্রাণকর্তা। এদের ঋণ আজীবন স্মরণ করব শ্রদ্ধা ভরে । কিছুক্ষন পর আমরা আমাদের ঘরে চলে গেলাম পরদিন সকালের অনিশ্চিত, বিপদজনক, দৈবাধিন মহাযাত্রার প্রস্তুতি নিতে, জীবন মরণ সংপ্রস্ন , এ যাত্রায় আমরা সফল না হতে পারলে বা পাঞ্জাবীদের হাতে অথবা ওদের দালাল বা শান্তিকমিটির হাতে ধরা পরে গেলে নিহত হওয়া ব্যাতিত আর কোন সুরাহা নাই । একটা জীবন মরণ প্রচেষ্টা । শেষ অবলম্বন - নিরাপদ এলাকায় চলে যাওয়া । অবস্থাদৃষ্টে মনে হল ইন্ডিয়াই আমাদের একমাত্র নিরাপদ স্থান ; কিন্তু, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ যে এলাকায় সংঘটিত হয়েছে সেই কসবা - আখাউরা অক্ষ দিয়ে নিরাপদে এবং শত্রুর হাতে ধরা না পরে নির্গমন করাটা যে কি কঠিন একটা ব্যাপার ছিল , তা শুধু তারাই জানে যারা ঐ এলাকায় অবস্থান করে সম্পূর্ণ যুদ্ধ টা দেখেছে । বাকিদের কাছে এই কাহিনী গল্প এর মত শুনাবে । ব্রাহ্মণবাড়ীয়া মহকুমা ছিল মুক্তি কামী মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ে পালানোর প্রধান অক্ষ,আর এটাই ক্রমান্বয়ে পরিণত হল মুক্তি সেনাদের প্রশিক্ষণ এর জন্য নির্গমন এবং প্রশিক্ষণ শেষে গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে অণুপ্রবেশের প্রধান অক্ষ । এবং পাকিস্তান বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের এক অভয় অরন্যে পরিণত হয়েছিল কসবা - আখাউরা এক্সিস ।
তাই তো রওনা দিবার আগে আমাদের এত ভয়, এতো ভীতি, এতো পরিকল্পনা, এই এলাকায় মানুষ দের ঐ পথ অতিক্রম করতে সাহায্য করতে যেয়ে অনেক গাইড ( পথপ্রদর্শক) জীবন হারিয়েছে । আর আমরা আনকোরা কয়জন একজন ষাটোর্ধ বৃদ্ধের সাথে রওনা দিতে যাচ্ছি , কারন আমাদের ঐ বিপদে অন্য কাউকে পাই নাই আমাদের কে অতটুকু সহায়তা করার জন্য, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আশ্বাস এর অনেকটাই বোধহয় লোকদেখানো ছিল কি ?
আম্মা সবাই কে কাছে ডাকল, বললেন সকালে, খুব সকালে আমরা বাড়াই নামের একটা গ্রামে যাবো, ওখানে আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়ীতে, আত্মীয় আমাদের দাদা হয়, নাম তার ডেঙ্গু ভুঁইয়া ( ডেঙ্গু মেম্বার), আমাদের বাবার নাম খোকা মিয়া, মান্দারপুর প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক । উনি বাড়ীতে আমরা আমাদের দাদা সাথে ওনার ভাই এর বাড়ীতে বেড়াতে যাচ্ছি এক সপ্তাহের জন্য ।
কয়েক বার এই বুলি গুলো মুখুস্ত করানো হল । তারপর, পোটলা তৈরি করা হল । সবাই ঘুমাতে গেলাম, রওনা দিতে হবে সকালে দিন ফর্সা হবার আগেই। সকালে উঠেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নাস্তা খেয়েই বের হয়ে যেতে হবে । সবাই গুমিয়ে পরার ব্যবস্থা করতে লাগল সাথে সাথে, দাদা চলে গেল ঘর থেকে । ধুরু ধুরু বুক, নিজেকে নিয়ে যতটা না ভাবছি তার থেকে বেশী ভয় ১৫ বছর বয়সী বোন কি নিয়ে, আর ভয় আমার এই ছোট দুইটা ভাই পারবে কি এতো বড় দূরত্ব হেঁটে যেতে ? আর দাদা কি নিয়েও ভয়, সে সময় খুবি বেশী অহেতুক তাড়াহুড়া করে । আমি সব সময়ই একটু আসতে আসতে চলাফেরা করি এবং একটু এক কম ত্রসন করি স্বভাবতভাবে । এইটা একটা চিন্তা আমার মাথায় কাজ করছিল সর্বক্ষণ ।
আম্মার মৃদু ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল , সবাই উঠে পনের বিস মিনিটের মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে গেলাম, সবাই খালি পায়ে, আমার স্যান্ডেল ইতিমধ্যে ছিঁড়ে গেছে, ওটাই সযত্নে ঢুকালাম পোটলা ( গাঁটটি) টার মধ্যে , মাথায় নিয়ে দেখলাম ওজন বেশি না , গাঁটটিটা বাসা থেকে নিয়ে আসা সেই গুলটেক্স চেক চেক স্ত্রাইপ সবুজ আর লাল রঙের বিছানার বেড সিট টা বানানো একটা মাথা একটু খোলা যেটা ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কাঁধে নিয়েও হাঁটা যাবে , ওটাও দেখে নিলাম , আমি নিলে কাঁধে নিলে অনেক নিচে নেমে যায় গ্যাঁটটি টা তাই আমার জন্য মাথায় নেওয়াই ভালো আম্মা বলল । মাথায় নিয়ে ঘরের মধ্যেই কয়েক চক্কর দিলাম, ওজন টা বুঝার জন্য । বাইরে তখনও অন্ধকার , আম্মা বাইরে গেল, আপা গেল ওরা দুজনাই ছেঁড়া, ময়লা, পুরানো শাড়ী পরল আটপৌরে ভাবে, আপা এবং আম্মা দুজনায় মুখে, হাঁতে, গলায় পায়ে কয়লা জাতিও কি যেন মেখে আসলো ওদের দুজন কে চিনার উপায় আর থাকলো না , বলতে দ্বিধা নেই, ওদের কে দেখতে মনে হচ্ছিল কুৎসিত, বাসা বাড়ীর কাজের মেয়েদের মত, ছোট ভাইদের কে করা নির্দেশ দেওয়া হল, কোন রকম শুদ্ধ ভাষায় কথা না বলার জন্য, আম্মা আমার হাতের ব্যান্ডেজ টা বদলিয়ে দিল একটু ডেটল ন্যাকড়াতে ঢেলে পরিষ্কার করে দিয়ে নতুন ব্যান্ডেজ করে দিল । এমন সময় দাদা দরজায় আস্তে আস্তে দুইটা টোকা দিল, আমি উকি মেরে দেখলাম দাদার হাঁতে প্লেট আর বাঁটি কয়েকটা , দরজা খুলে দিলাম উনি পাঁচটা প্লেট আর বড় একটা বাটিতে চিড়া দই আর গুড় নিয়ে এসেছেন । ঢুকেই ওনার স্বভাবগত ভাবে বললেন ,'' তাগদা তাগদা কইরা হাইয়া লাও ‘' সবাই একটু একটু করে খেলাম, কারোই মুখে তেমন কথা নাই, আপা সেই প্রথম দিন থেকেই একদম কিমি. কথা বলছেন লক্ষ্য করলাম, আম্মা ওকে কয়েক বার জিজ্ঞেস ও করেছেন কেন এত কম কথা বলছে সে । দাদা বেরিয়ে গেল ঐ সব প্লেট বাটী নিয়ে আর বললেন, ''বউমা, আমি আইলেই যাত্রা শুরু করমু, সবাই তৈয়ার হইয়া লও’'।
সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই দুই মিনিটেই রেডি হয়ে গেলাম, আমার মাথায় গাঁটটি যাবে এই যাত্রায়, দাদা আসলেন এক টা পোটলা কাঁধে ছাতির ডাণ্ডায় ঢুকিয়ে দিয়ে ঘাড়ে আর হাঁতে একটা পোটলা বলল ''এইডার মইদ্ধে চিড়া আর গুড় লইয়া লইছি, পোতও ভুক লাগলে হাওন যাইব।’' আমার কাছে ভারী বোঝা আর আপার কাছে ছোট টা, আই আমাদের সংসার । দাদা বললেন , ‘' চল বিসমিল্লাহ কইরা বাইর হি’'। প্রথমে দাদা তারপর বোন আরে সবচে’ শেষে আম্মা, তখনও বেশ অন্ধকার, একটু হাল্কা বাতাস, অল্প ঠাণ্ডা ও অনুভূত হল । ঠিক বাড়ী থেকে বের হবার সময় দেখি দাদী দাঁড়িয়ে আছে ওনাদের বাড়ীতে গেটের কাছে একটা ডালিম গাছের নীচে - শারীর আচল হাতে নিয়ে মুখটা ঢেকে রেখেছে । আমাদের সবাই কে উনি এক ধরনের নীরব বিদায় সম্ভাষণ দিলেন মনে হল । দাদা খালি কি যেন বুঝলাম না ।
তের দিন যাবত আমরা গৃহহীন, মধ্যখানে কয়টা দিন ছিলাম নিজের বাবার আপন কাকার বাড়ীতে আর এই মুহূর্তে পদার্পণ করলাম এক নতুন দিগন্তের উদ্দেশ্যে - অজানা জায়গা, নতুন দেশ, যাদের সম্পর্কে বাসার বাইরে লোকজন সব সময় ভয়ার্ত ধারনা দিত - যাদের সাথে কয়েক বছর আগে আমাদের যুদ্ধ হয়েছে , পাঠ্য বইতে মেজর আজিজ ভাট্টি ,স্কোয়াড্রন লিডার আলম বীরোচিত কাহিনী পড়তে হয়েছে ওদের বিরুদ্ধে আর আজ যাচ্ছি ওদের দেশে । যদিও আম্মা বলতো সব সময়
কিভাবে, উনি নানী কে দেখতে কলকাতা যেত প্রায়ই কোন পাসপোর্ট, ভিসা কিছুই লাগতো না , সোনা মামা, নানী এসে আমদের কাছে থাকতো, বেড়াতো কয়েকদিনের জন্য, যা নাকি ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর সব বন্ধ হয়ে গেল । আজ আমরা যাত্রা শুরু করলাম ঐ দেশের উদ্দেশে , ওদের ওখানে না গেলে দেশের অভ্যন্তরে এভাবে গা ঢাকা দিয়ে থাকা আমাদের জীবন এর জন্য ঝুঁকি, এবং আমাদের কে যারা স্থান দিবে তাদের ও জীবন নাশের সম্বাভনা । নিজেদের আপন বাড়ী তে যেয়ে থাকা আর আত্মহত্যা করা সমান কারণ গ্রামের ভৌগলিক অবস্থান একেবারে শত্রুর চলাচলের অক্ষের উপড়ে - ঐ গ্রামে সকলে আমাদের চিনে আমরা কারা এবং ছোট একটা কানাঘুষা দালাল, শান্তি কমিটি, জামায় তে ইসলামি অথবা পই, ডি, পি ( পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি - নুরুল আমিনের) যে কোন লোক যদি কোন রকমে পৌঁছাতে পারে পাকিস্তানীদের কানে তাহলে নির্ঘাত মৃত্যু ছারা আর কোন উপায় নাই - তাই বাধ্য হয়ে আজ আমাদের এই পদক্ষেপ । অনেক ভয় অনেক সংকোচ, অনেক হৃদয় কম্পন নিয়ে আমরা চলেছি আজ এক আজানা গন্তব্যের উদেশ্যে । ঢুকতে পারব কিনা, ধরা না হয় না বা পরলাম কিন্তু ইন্ডিয়া কি আমাদের প্রবেশের অনুমতি দিবে । কারণ আমরা একদমই ছিলাম বিছিন্ন সকল প্রকার সংবাদ থেকে ।
বাড়ী থেকে বেড় হয়েই দাদা অন্য পথ নিলো, গ্রামে মাঝামাঝি পূর্ব দিকে থেকে আমরা আসার দিন প্রবেশ করেছিলাম আজ আমরা গ্রামের দক্ষিণ দিকে হাটতে শুরু করলাম , গ্রামের মেঠো পথ হাতের দু পাশেই ঘর বাড়ী, মনে পরল এই দিকেই এসেছিলাম কুমার দের বাড়ী গুলোতে । প্রথমে একটু ঠাণ্ডা লাগছিল । গাঁটটি টা বার বার মাথা থেকে সামনের দিকে এসে দৃষ্টি বিঘ্ন ঘটাচ্ছে । থামার উপায় নাই, পথিমধ্যে কোন প্রাণীর দেখা পেলাম না , ঐ রাস্তা একটু সামনে গিয়েই আমরা নেমে পরলাম গ্রামের শেষ প্রান্তে দিয়ে খোলা জমিনের উপর দিয়ে যাওয়া পথ বামে মোড় করাতে আমরা আবার পূর্ব দিকে হাঁটছি । কারো মুখে কোন কথা নাই দাদা আগে আগে আমরা ওনাকে অনুসরণ করছি । আধা ঘণ্টা ঐ রাস্তা দিয়ে হেতেরই পেলাম হাতের দানে ছোট্ট একটা গ্রাম একটা ছোট্ট উঁচু জায়গায় গ্রাম টা, গ্রামের ভিতর প্রবেশ না করে গ্রাম টাকে বাঁয়ে ফেলে ঘুরে পাস কাটিয়ে হাটতে থাকলাম দক্ষিণ পূর্ব দিকে , গ্রাম টা ফেলে কিছুদূর যাবার পর দুরে গ্রামের মসজিদে আজানের আওয়াজ শুনতে পেলাম বেশ ক্ষীণ স্বরে । একটু পরেই সূর্য উঠতে সুরু করল আমাদের বাম পাশে, সবুজ গ্রামের উপড়ের সবুজাভ দিগবলয় ভেদ করে । লাল রঙের - দিন টা ছিল ৩০ সে এপ্রিল ১৯৭১। দাদা একটু দাঁড়াল আর আমাদের সবাই কে জিজ্ঞেস করল আমরা ঠিক আছি কিনা ? ওনাকে আর বললাম না যে, ঠাণ্ডা মাটির রাস্তায় ঐ সাত সকালে খালি পায়ে হাটতে যেয়ে জান ওষ্ঠাগত। বললাম সব ঠিক আছে, উনি বলল আমরা হাতুরা বাড়ী গ্রাম পার হলাম এর পর আরও এই রকম পাচ থেকে ছয় টা গ্রাম পার হলেই আমরা পৌছব সি এন্ড বি সড়কে, তবে আমরা গ্রাম এড়িয়ে জমিনের মধ্যে দিয়েই হাঁটবো - একটু কষ্ট বেশি হবে তাও ভালো কিন্তু এই গ্রাম গুলো তে না যাওয়াই ভালো । দাদা আবার আমাদের সামনে চলে গেল। এদিকে বৈশাখ মাসের সূর্য বেশ প্রকট হয়ে উঠতে লাগল । দুই তিন বার পিছন ফিরে আম্মা দের দেখলাম - গাঁটটি টা মাথার উপর বহন করা বেশ সহজ লাগতে লাগল ক্রমশ । গায়ে অল্প অল্প ঘাম বের হচ্ছে তখন। সূর্য বেশ প্রকট এখন আর বাম দিকে নয় সোজা সামনে সূর্য এগিয়ে যাচ্ছি সূর্য অভিমুখে । এক জায়গায় এসে পথ শেষ দাদা এবার জমিনের ভিতর দিয়ে কোনাকোনি হাঁটা শুরু করলেন । বৃদ্ধ হলে হবে কি হাঁটায় এখনো অনেক সামর্থ্য , আসলে এই এলাকায় যাদের বসবাস তাদের হাটা ছারা কোন উপায়ই নাই ; সব খানে নৌকা চলে না, না আছে রিক্সা , না আছে সাইকেল, না আছে গরু বা ঘোড়ার গাড়ী, একমাত্র সম্বলই কেবল হাঁটা। এবার বুঝলাম আব্বা কেন কোনদিন এই এলাকার আত্মীয়দের বাড়ীতে বেড়াতে আসে না গ্রামে ছুটিতে আসলে । প্রায় ১ থেকে দের ঘণ্টা হেঁটে ফেলেছি ইতিমধ্যে, মান্দারপুর বা হাতুরাবাড়ী দেখা যায় না আর । তৃতীয়, চতুর্থ গ্রাম পার হবার পর আম্মা খবর দিল পিছন থেকে একটু সামনের গ্রামের কাছে একটু বসার জন্য , ছোটন- টুম্পা কোন কথা বলছে না। দাদা থেকে আম্মা পর্যন্ত দূরত্ব হবে দশ বার ফুট, আমি, আপা, দুই ভাই ও সবচে শেষে আম্মা । একটু কিচ্ছুক্ষণ হেঁটেই উপস্থিত হলাম একটা আগলা বাড়ী গ্রামের বাইরে বেশ বড় বাড়ী, পুকুর পার ভরা নারিকেল গাছে ঘেরা বাড়ী একটা । ঐখানে আধা ঘণ্টা বিরতি নিলাম, পুকুরের পানি পান করে, মুখে পানি দিয়ে ধুয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম, আম্মা কে জিজ্ঞেস করলাম কয়টা বাজে, আম্মা বলল ঘড়ি গাঁটটির মধ্যে । আম্মা আর বোন কে কাছের থেকেও অপরিচিত লাগে ; আম্মা
সব সময় বেশ সাজগোজ করতে পছন্দ করতেন, যখন আমরা আঁক সাথে কোথাও বেড়াতে যেতাম আম্মা সানগ্লাস, সুন্দর করে খোপা, করতেন, আলাদা খোপা ব্যবহার করতেন, কাস্টমস চাকরী তে ওনার অনেক সুনাম ছিল, প্রচুর ভাল ভবিষ্যৎ থাকা সত্ত্বেও, তার শিক্ষক হবার স্বাদ ও বাসনা ছিল অনেক পুরনো তাই গত তিন বছর আগে নতুন পেশা শিক্ষকতায় মননিবেশ । বাংলা এবং ইংলিশ দুটো বিষয়েই সমান ভাবে পারদর্শী । কিন্তু, আজ সেই আম্মাকে খুঁজে পাচ্ছি না এই আদলে।
বেলা বাড়তে তাখলো, আবার শুনতে শুরু করলাম সেই প্রথম দিনের মত সেই কামানের গোলার আওয়াজ, মেশিন গানের গুলির শব্দ, কিন্তু এখন মনে হল যেন, গোলাগুলি এক পক্ষের না , কেমন জানি দুই তরফা মনে হল। এখনাকার জমি তে ফসল, ধান নাইলে পাট তাই ক্ষেতের মধ্য দিয়া হাঁটা সম্ভব না, আইল এর উপর দিয়ে হাঁটা বেশ কষ্টকর , টুম্পা আর ছোটন বার বার পা পিছলিয়ে জমিনে নেমে যাচ্ছে, আর দু এক বার ব্যথা ও পেল , আর উপড়ে রোদ ও গরম হতে লাগল, পাট খেত মাইলের পর মাইল দুই টা পাট ক্ষেতের মধ্যে হাঁটা বেশ কষ্টকর ভ্যাপসা একটা গরম আর পাট গাছের পাতা বার বার চোখে এসে লাগে, হাঁতে পাতা থেকে বেশ বড় বড় শুঁয়োপোকা লেগে থাকে, কাল, সোনালি, লাল আর হলুদ ( মাল্টি কালারের) রোমও ওয়ালা শুঁয়োপোকা গুলো, আর চুলকাতে সুরু করে, আর মধ্যে ভয় যখন পাটক্ষেত শেষ হবে তখন কি বা কাকে পাবো দাঁড়িয়ে আছে, বন্দুক উঁচু করে । দাদা একটা কথাও বলছেন না , আম্মা বার বার জিজ্ঞেস করল ওনার কষ্ট হচ্ছে কিনা, একটা কাজ ভাল করেছিলাম পুকুরওয়ালা বাড়ীতে বিশ্রাম নেবার সময়, আমার গাট্টি টা ভাল করে বেঁধে নিয়েছিলাম যার জন্য এখন গিট্টুর ভিতর হাত ঢুকিয়ে কাঁধে করে ভন করতে পারছি, এখন আমি সবার পিছনে, টুম্পা দের সাহায্য করছি, টুম্পা একদম ক্লান্ত, বড় বড় শ্বাস ফেলছে, ছোটন একটু'' খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম - ও বলল সব ঠিক আছে । প্রায় চার - পাঁচ ঘণ্টা হবে আমরা হাঁটা শুরু করেছি, দাদা বললেন আমরা সোজা সি এন্ড বি রোড এর দিকে যাব না, সোজা নাক বরাবর ঐ জায়গা টা তে পাকিস্তান আর্মি ক্যাম্প বানিয়েছে - উজানিসাহ - তিন লাখ পীর এলাকায় - চেকপোস্ট ও বসিয়েছে । আমাদের কে এমন জায়গা দিয়ে কুমিল্লা - ব্রাহ্মণবাড়িয়া - সিলেট রোড পার হতে হবে - দাদা বললেন আমরা সৈইয়দাবাদ অথবা আরও একটু কুমিল্লার দিকে যেয়ে রাস্তাটা পার হবার চেষ্টা করব । কারো মুখেই তেমন কোন কথা নেই সবাই খুব মনযোগ দিয়েই হাঁটছে । পথ তো আর ফুরায় না । ক্রমে ক্রমে গোলাগুলি আর কামানের আওয়াজ বাড়তেই থাকছে এবং পুনরাবৃত্তির হারও বৃধি পেতে থাকল । হটাৎ একটা খোলা জায়গায় এসে আমরা দাঁড়ালাম - চতুর্দিকে পাটক্ষেত মধ্য খানে একটা ছোট একটা বিলের মত গোলাকৃতি জায়গায় বসতে বলে দাদা, আস্তে আস্তে ওনার পোটলা আর ছাতি রেখে চলে গেলেন বললেন , ''তোমারা কদ্দুরা জিরাইয়া লও, আমি দেইখা আই , ‘' আমরা বসে পরালাম, বসা যে এতো আরামের জিনিস তা আগে উপলব্ধি করি নাই । আম্মা টুম্পা ও ছোটনের হাত মুখ ধোওাইয়া দিল , বিলের পানি দিয়ে, সবাই ঐ পানি হাতের মুঠোয় করে নিয়ে নিয়ে খেলাম । ঐদিকে অনবরত গুলি চলছে, আওয়াজ শুনেই বুঝা যাচ্ছে যে আমরা গোলাগুলির নিকটবর্তি প্রায় । পনের বিশ মিনিট পর দাদা এসে বললেন সামনের গ্রাম এখান থেকে বেশী দূরে না , কিন্তু এই গ্রামে না যেয়ে আমরা আরও দক্ষিণ দিকে যাব তারপর ওইদিক থেকে যেখানে রাস্তার একদম নিকট পর্যন্ত ওয়াট ক্ষেত দুইদিকে পাব ঐ রকম জায়গায় রাস্তাটা ক্রস করলে ভালো হবে , বলল চলো দক্ষিণ দিকে আরও মাইল দুয়েক যাই, তারপর তোমাদের কে রেখে আমি গিয়ে দেখে এসে তোমাদের নিয়ে গিয়ে একে একে রাস্তা পার করাব - এই পাশের পাট ক্ষেত থেকে সবাই লুকিয়ে থাকবে আর এক জন জন পার হয়ে ঐ রাস্তার ঐ পাশের পাট ক্ষেতে গিয়ে লুকিয়ে পরবে, সবাই পাড় হলে আবার এক সাথে পূর্ব দিকে হাঁটা শুরু করব । রাস্তার পর আরেক পুল সেরাত পার হবে সেটা হল রেল লাইন - ওটা পার হলে সহি সালামতে তারপর আরও তেমন কোন আর বড় ভয় নাই । সন্ধ্যা হবার আগেই পৌছতে হবে ধ্বজনগর । আমাদের ঐ দিনের গন্তব্য -
দাদা বললেন আমরা রাস্তা পার হয়েই চিড়া খাব , কি বল ? আমাদের কারো মুখ দিয়ে তেমন কথা বের হচ্ছিল না তেমন, কিন্তু ঐ দিন গোলাগুলির আওয়াজে আগের মত ভয় লাগছে না, মনে হয় একটু সাহস বেড়ে গেছে , উঠার আগে সার্টের বোতাম খুলে দেখি আমার কাঁধের চামড়া উঠে গেছে - লাল হয়ে আছে দুই ইঞ্চি জায়গা , একবারে ছুলে গেছে গাঁটটির ঘষায়, এবার অন্য কাঁধে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম , আপা কোন কথা বলছে না একদম, আম্মা বারে বারে ওকে কথা বলানোর চেষ্টা করেও বেশী কথা বের করতে পারল না । মুখ দেখেলেই বুঝা যাচ্ছে যে সে ভয়ার্ত। কারন, যুবতী মেয়েদের জন্য এই
প্রতিবন্ধকএর কথা সবার মুখে মুখে । পাকিস্তান আর্মি এক মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ ইস্ট পাকিস্তান টাকে ওদের করায়ত্ত করে ফেলেছে , আমরা আমাদের নিজের দেশেই বন্দী । এ কেমন বর্বরতা, দাদা বলল উনি যখন এলাকা টা দেখতে গিয়েছিল তখন দেখেছে রাস্তার পাশের খালে দুইটা লাস ফুলে ফেঁপে পানিতে ভাসছে । আজ আমরা নিরীহ, নিরস্ত্র বাসিন্দারা নিজের দেশেই চলাফেরা করতে পারছি না । সেই ছোট বেলায় শুনতাম আমরা হিন্দুদের সঙ্গে থাকতে চাই নাই তাই আমরা দুই মসুল্মান প্রদেশ মিলে একটা মসুল্মান দেশ বানিয়েছি আর আজ একই দেশের অন্য প্রদেশের মসুল্মান রা আমাদের প্রদেশের মসুল্মান - হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই কে বন্দী করে খাঁচার পাখির মত নিধন করতে চাচ্ছে কারণ আমরা শুধু নিজেদের প্রাপ্য অধিকার চেয়েছিলাম বলে । এমন হবে আমরা কেউ দুঃস্বপ্নেও দেখি নাই কোনদিন । আমার মনে পরল এই বি বাড়ীয়া - কুমিল্লা রোড দিয়ে একবার বড় শালগড় গিয়ে ছিলাম, কোন ভয়, ভীতি কিছুই ছিল না, এইত কয়েক মাস আগে মিনি অস্টিন গাড়ী চালিয়ে কুমিল্লা থেকে রোজী বুবু - দুলাভাই আর ওনাদের দুই ছেলে কে নিয়ে আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল আর আজ সেই একই রাস্তা পার হতে গিয়ে জীবন বাঁচা নিয়ে চিন্তা করছি । কবে যে, আমরা পাবো মুক্তি এই পাপিস্ট, মসুল্মান নামের কলঙ্ক পাকিস্তানি - পাঞ্জাবীদের হাত থেকে ? ওদের কে যেভাবেই হউক আমাদের কে বিতাড়িত করতে হবে বাংলা থেকে ।
অনেক খানি হেঁটে আসলাম- পাট ক্ষেতের আড়ালে যাতে করে মেইন রোড থেকে না দেখা যায় । মধ্যখানে অনেক দূর এলাকা খালি ধান ক্ষেত, দাদা বলল যে ঐ দূরের গ্রামের হাটতে, রাস্তা থেকে দুরে ঐ গ্রামের আড়াল দিয়ে যেয়ে গ্রামের অপর পারে রাস্তা ঘেঁষা পাট ক্ষেতের ঐ খান দিয়ে রাস্তা পার হব । আবার আমরা রাস্তা থেকে দুরে চলে যাবার জন্য ঐ দূরের গ্রাম অভিমুখী হয়ে হাঁটা শুরু করলাম । এতক্ষণে সূর্য একদম মাথার উপর , সবাই আমরা ঘামছি, সার্ট ঘামে ভিজে চপচপে। আম্মা অনেক পিছনে পরে গেছে ; দেখে একটু আস্তে হাঁটা শুরু করলাম - সারা রাস্তা সেই একই দোয়া পড়ছি মনে মনে অনবরত । সবাই একসাথে হয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম - এতক্ষণ হাঁটার মধ্যে এক জন মানুষ ও দেখলাম না জমিতে কাজ করতে - পুরা এলাকার মানুষ ই মনে হল গ্রাম ত্যাগ করে পালিয়েছে আর যারা যেতে পারে নাই বৃদ্ধ পুরুষ রাই রয়ে গেছে । সম্পূর্ণ এলাকা টা একটা সীমাবদ্ধ অংকিত সামরিক অঞ্চল । এক ধরনের মিলিটারি এঙ্কলেভ একটা । আম্মা আপার কাছ থেকে গাট্টি টা নিলো ; আমরা গ্রামটা কে বামে রেখে আবার পাট ক্ষেতে ঢুকে পরলাম - এই ক্ষেত গুলো একদম ম্যান রোডের কাছে ( ১০০- ১৫০ গজ) গিয়ে শেষ হয়েছে । আমরা ভ্যাপসা গরমে ঐ ক্ষেতের ভিতর কার আইল দিয়ে হাটতে থাকলাম । আস্তে আস্তে । রাস্তা দিয়ে তখন অনেক মিলিটারি গাড়ীর কণভয় পার হল , আমরা প্রায় ১০০০ গজ দূরে রাস্তা থেকে , মনে হচ্ছে মাথার উপর দিয়ে কামানের গোলা গুলো যাচ্ছে । সারা মাঠে একটাও কৃষক দেখতে পাচ্ছি না । রাস্তার নিকটের শেষ জমিন টা তে আমরা রাস্তার একদম লাগানো জমি তে হাঁটু গেড়ে বসলাম সবাই ; দাদা বললেন উনি প্রথমে রাস্তার কিনারায় গিয়ে দেখে ইশারা দিলে প্রথমে আম্মা আরে ছোট দুই ভাইকে পাঠাব, তার পর দাদা ওদের কে ঐ পারে সেফ জায়গায় রেখে এসে আমাকে আর আপাকে সিগনাল দিলে আমরা উঠে রওনা দিব রাস্তা অতিক্রম করতে ; কয়েক মিনিট পর পর ই একতা জিপ, নইলে ট্রাক বা পিক আপ আসছে । দুই দিক থেকেই, দূরে অবিরাম মেশিন গানের গুলি, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া - গঙ্গাসাগর এর দিকে । দাদা বেচারা ঘেমে চুপসে গেছে , একতা সিগারেট ধরালো, টেনশন এ দুই তিন টান মেরে নিভিয়ে ফেলল আবার, আমরা জমিনের রাস্তার দিককার আইল থেকে ৪ - ৫ ফুট ভিতরে ঘন পাট ক্ষেতের ভিটরে ক্যামোফ্লাজ । রাস্তা থেকে আমাদের দেখার উয় নাই , পাট গাছের ডালের ফাক ফোকর দিয়ে উপড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি আকাশটা বেশ কাল হয়ে আসছে , সূর্য দেখা যাচ্ছে না । দাদা উঠে গেলেন, রাস্তা টা জমিন থেকে আট - দশ ফুট উঁচুতে, দাদা উঠল আস্তে আস্তে অনেক তা হাঁটু গেড়ে , কয়েক মিনিট লাগল, ভয়ে আমাদের কলজে ধপ ধপ করছে, মুখে দোয়া অনর্গল বলেই যাচ্ছি, রাস্তার পাশের ঘাসে গাছ লাগানোর জন্য গোল একটা ইট সিমেন্ট দিয়ে ঘেরা একটা ঘের ওটার পিছনে দাঁড়িয়ে দাদা ভাল করে রাস্তার দুই দিক দেখেই ইশারা দিল যাওয়ার - আম্মা হাতে পোটলা নিয়ে টুম্পাকে এক হাতে ধরে অনেকটা দৌড়িয়েই উপড়ে উঠতে সুরু করল । ছোটন পিছে পিছে , গায়ের লোম সব শিউরে উঠল, আম্মা যাবার সময় বলল, দেখা হবেরে ঐ পারে , দাঁত কিড়িমিড়ি খেয়ে তাকিয়ে আছি আম্মার দিকে, আকাশ টা আরো কালো হয়ে উঠেছে , মনে হল এই বুঝি একটা বৃষ্টি নামলো বলে। চোখ আর অন্য কোন দিকে ফেরানোর ফুরসৎ নেই, আম্মার দিকে, আম্মা ওদের দুজন কে নিয়ে দাদার কাছে গেলো দাদা টুম্পা কে এক টানে অনার ঘাড়ে উঠিয়ে নিয়ে এক দৌড় মেরে হারিয়ে গেলো ওরা চার জন আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে । ঐ পারে রাস্তা থেকে এইরকম পাট ক্ষেত কত দূরে তা জানিনা , দাদা নিশ্চয় দেখে নিয়েছেন । আপা বলল, দাদা না থাকলে এই জায়গা আমরা পাঁচ জন জীবনেও পার হতে পারলাম না । আপার দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখটা একদম ছোট হয়ে গিয়েছে ভয়ে । এই বয়সী মেয়েদের কে পেলে পাকিস্থানী পাঞ্জাবীরা নাকি সাথে সাথে ধরে নিয়ে যায় গত আঁক মাসে এই এলাকার কয়েক শ মেয়েদের জোড় পূর্বক উঠিয়ে নিয়ে গেছে ওদের গাড়িতে উঠিয়ে । পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, পনের মিনিট দাদা আসার আর কোন নাম গন্ধ নাই , ভয়ে আমরা দুজনায় কাঁপছি, হে আল্লাহ, দাদা আসে না কেন ? কিছু হল না তো রাস্তার ঐ পাড়ে ? ভয়ে যে উঠে যেয়ে দেখব সেই সাহস ও নাই । এই রাস্তার নাম গ্রামের মানুষ দিয়েছে 'পুল এ সেরাত ‘। যেই ভাবা সেই আমাদের বাম দিক থেকে অর্থাৎ ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিক থেকে একটা ট্রি টন লরি ( এই গুলো চিনতাম আব্বার চাকরির বদৌলতে ), তারপর কয়েক মিনিট পর আরেকটা, তারপর একটা ক্রেন এবং তারপর একটা জীপ পার হল, তারও প্রায় দশ মিনিট পর দাদাকে দেখলাম, আবার ঐ গাছের গোল গেড়ের কাছে এসেই আমাদের ইশারা দিল । আমরা তো ঐ রাস্তার দিকেই তাকিয়ে আছি তীর্থের কাকের মতন এই পুরা সময় টা , উঠেই এক দৌড়, আপা আগে আর আমি গাট্টিটা দুই হাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে দৌড়াতে লাগলাম, অল্প জায়গা কিন্তু সেদিন মনে হল এই টুকু ত্রিশ ফুট দূরে রাস্তা আর আট - দশ ফুট উচ্চতা মনে হল আমি একটা পর্বত আরোহণ করছি , রাস্তা ফুরায় না, ভয়ে কাঁচুমাচু যদি এখন চলে আসে একটা গাড়ি আর আমাদের দুজনকেই ধরে ফেলে হাতেনাতে । গলা শুকিয়ে কাষ্ঠ, ক্ষিদেও পেটে, মুখ দিয়ে শব্দ ও বেরুচ্ছে না , লা ইলাহা আনতা ……জালেমিন বলতে বলতে আপার সাথে সাথে উঠে এলাম দাদা পাশে, মনে হল দাদার হাতের ইশারা থেকে ওনার নিকট পর্যন্ত আসতে আমাদের সময় লেগেছে কম করেও হলেও দশ মিনিট । দাদা আমাদের ওনার পাশে আসার আগেই উঠে দাঁড়ালেন আর বললেন চলো দেরং কইরো না, আবার আমরা রাস্তার দুই দিক ভালো করে দেখে আরেক দৌড় দিয়ে পীচ ঢালা আট - দশ ফুট চওড়া রাস্তা পার হলাম তার পর আরও ছয় সাত ফিট ঘাসের রাস্তা পার হলাম, আর দৃষ্টি শুধু দুই দিকে , ঘাসের অংস টুকু শেষ হতেই একটা ঢালু আট দশ ফুট নিচে নামতে হল , ভয়, আনন্দ এবং উল্লাসে পিছলে পরে গিয়ে তিন চার বার উলট পালট খেয়ে নিচে গেলাম - ওখান থেকে দেখলাম নিকটস্থ পাটের ক্ষেত প্রায় তিনশ গজ দূরে । পিছন ফিরে বার বার দেখছিলাম রাস্তার দিকে - আর বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, আমরা দুইজনই একসাথে কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই পার হতে পেরেছি । কিন্তু, এখনো একদম খোলা মাঠের মধ্যে দিয়ে দৌড়াতে হবে আরও কয়েক মিনিট পাট ক্ষেতে লুকানোর আগে । বুকে ধড়ফড়, চোখে সর্ষে ফুল, গলা শুকনা, পানি পিপাসা, আতঙ্কে গায়ের রোম শিউরে ওঠা এর মধ্যে দৌড়াচ্ছি, দাদা বেচারা পিছনে, আর ভাবছি আল্লাহ একটু শক্তি দে দয়া করে। একসময় পিছনে তাকিয়ে দেখি রাস্তাটা অনেক দূরে, জমিনের মধ্যে কাদা কাদা মাটি পা গেড়ে যায়, গতি শ্লথ হয়ে পরছে - আর ভাবছি এই বুঝি পিছন এ রাস্তায় এসে থেমেছে একটা লরি আর রাইফেল তাক করছে আমাদের তিন জনের দিকে । এক সময় ঢুকে পরলাম পাট ক্ষেতের ভিতর । একটু কয়েক ফুট ভিতরে ঢুকেই তাও আবার আইল বরাবর ঢুকল দাদা, বলল জমিন এর ফসল আওলা ঝাওলা কর না , আইল দিয়া ঢুক - সে যে কি সময় আর কি যে পরিস্থিতি - একেক বার মনে হচ্ছিল, ধুর আর ভাল লাগে না - মারলে মেরেই ফেলুক আর সহ্য হচ্ছে না এই সব । আইল দিয়ে কয়েক ফুট ঢুকেই আমার হাতের ডান দিকে পাট ক্ষেতের মধ্যে শুয়ে আছে আম্মা আর ওরা দুজন । আমরাও দাঁড়ালাম। আম্মা উঠেই আমাদের দুজন কে জড়িয়ে ধরল । দাদা বললেন, এখানে বেশিক্ষণ বসা উচিৎ না । পানি পিপাসায় অস্থির । দুই মিনিট পর ই আবার হাতা সুরু করলাম বেশ অনেক জায়গা জুড়েই আমরা পাট ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে হাঁটলাম প্রায় আধা মাইল খানেক । এর পর সব খোলা প্রান্তর কোন ফসল নাই । সোজা পূর্ব দিকে হাটতে থাকলাম, আসে পাশে কোথাও কোন পানির দেখা পেলাম না । প্রায় ৩৫ - ৪০ মিনিট হাটার একটা বেশ বড় বট গাছের নিচে আমরা বসলাম ; দূরে দেখতে পেলাম কয়জন মানুষ হেটে হেটে যাছে সামনেই একটা মেঠো পথ বলে মনে হল কিন্তু আমরা যাব পূর্ব দিকে আর রাস্তা টা উত্তর দক্ষিণে ; দাদা বলল, বস ওরা চলে যাক আগে তারপর রওনা আমরা রউনা দিব, পিছনে তাকালে সি এন্ড বি রোড দেখা যায় সেই দিগন্তে দুই মাইল দূরে হবে হয়ত । তার পরও ভয় দূর হচ্ছে না । আমরা ওখান থেকে হাটা শুরু করলাম সোজা পূর্ব দিকে খোলা জমিনের মধ্য দিয়ে, চতুর্দিকে খোলা প্রান্তর আর খোলা প্রান্তর কোন গাছ নেই, কোন ঘর বাড়ী নেই সামনে দুই থেকে তিন মাইলের মধ্যে । আকাশ আবার ফর্সা হয়ে গেছে , রোদ নাই তেমন , ভ্যপ্সা গরম দাদা বলল এই খোলা জায়গাটা একটা বড় বিল আর কয় দিন পর এখানে দুই মানুষ সমান পানিতে ভরে যাবে, এক দুই মাসের মধ্যে । এই খান থেকে নৌকা তে উঠে আখাউরা তিতাস নদী , গঙ্গাসাগর এর নদী হয়ে অথবা বামনগাও ব্রিজের নীচ দিয়ে চিনাইর নদী দিয়ে একদম ইন্ডিয়ার আগরতলা যাওয়া যায় । আগে ওনারা বর্ষা কালে আগরতলা যেত নৌকা নিয়া, যখন এই এলাকার সবচে বড় নিকটতম শহর ছিল আগরতলা । আমার কাছে মনে হল আমরা কোথায় আমরা নিজেরাই জানিনা । দাদা বুঝিয়ে দিল আমরা রাস্তা সহজে পার হবার জন্য একটু বেশি দক্ষিণে চলে গেছি এখন যদি এই প্রান্তর( পাত্থর - গ্রামের ভাষায়) তাহলে আমরা মজলিসপুর - রাইয়তহাট গ্রামের পৌঁছিব । ছোট একটা আধা শুকনা খালে থেকে পানি খেলাম , এখন আমরা একটু সাছন্দে হাটতে সাহস পাচ্ছি কারন আমরা মোটামুটি মেন রোডের আওতার বাইরে । পানি খেয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে রওনা দিলাম আবার ।
আগরতলার নাম টা শুনার পর থেকেই মনে পড়লো আব্বা আমাকে একদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে হাটতে হাটতে দেখিয়েছিল কোর্ট আর ব্রিজের ঠিক মাঝখানে একটা স্মৃতিসৌধ আর ঐ সৌধের ইতিহাস , ১৯৫৬ - ৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল আর ইন্ডিয়ান বাহিনীর সাথে সিঙ্গার বিল - আখাউরায় একটা ছোট স্ক্রিমিস ( বিছিন্ন খণ্ড যুদ্ধ ) হয়েছিল । ঐ যুদ্ধের ইন্ডিয়ান বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আগারতলার রাজার ছোট ভাই ( একজন ব্রিগেডিয়ার সম রাঙ্কের মনে হয়) এবং সিঙ্গার বিল এলাকা সীমানা বণ্টন নিয়ে সমস্যা থাকায় দুই দেশের মধ্যে এই বিচ্ছিন্ন যুদ্ধ হয় - ইন্ডিয়ান বাহিনী সিঙ্গার বিল দখল করে নেয় এবং সাত /আট দিন অত্র এলাকার বেশ বড় অংশ ইন্ডিয়ার দখলে চলে যায় । আগরতলার রাজার ছোট ভাই বেশ বীর দর্পে ঐ বিচ্ছিন্ন যুদ্ধ পরিচালনা করেন - পরে পূর্ব পাকিস্তান মেজর তোফায়েল এর নেতৃত্বে একটি ছোট রিএনফরস্মেট ট্রুপ্স পাঠায় । তোফায়েল অন্তন্ত বীরত্বের সাথে ঐ যুদ্ধ করে এবং আগরতলার রাজার ভাইকে অনেক দিন যুদ্ধ করে পরাভূত করে , রাজার ভাইকেও কব্জাও করেছিলো বলে মনে হয় , এবং ঐ যুদ্ধে তোফায়েল আর আঁক প্লান্টুন কমান্ডার জমাদার আজম আহত হয় অনেক শত্রু সৈন্য এবং রাজার ভাইকে কেপচার করে আনে আহতবস্থায় পরিশেষে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে রেল লাইনের স্টেশন এই মারা যায় ; তাই ওর নামে প্রবর্তিতে ঐ স্টেশন এর নামকরন করা হয় আজমপুর ( আখাউরা - সিলেট লাইনে স্টেশন ) হিসেবে । আর ওদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই প্রধান সড়কের নাম করন করা হয় টি, এ রোড ( তোফায়েল - আজম রোড ), বেশ কয়দিন পর রাজার ভাইকে হস্তান্তর করা হয় ইন্ডিয়ান দের কাছে ; আব্বা যদিও গল্প বলেছিলেন নিরপেক্ষ ভাবে - কিন্তু আমার মনে দাগ কাটে, যাদের সাথে আমাদের এতো শত্রুতা , যাদের ধর্ম সম্পর্কে এতো বাজে কথা শুনে আসছি, পাকিস্তান বাহিনীর যেসব অফিসার রা ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ইন্ডিয়ার এত ক্ষতি সাধন করেছে যেমন মেজর আজিজ ভাট্টি এবং স্ক্বোয়াড্রন লিডার আলম কথা আমাদের পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি - আমাদের কে কেমন যেন বাধ্য করা হয়েছে ইন্ডিয়া কে ঘৃণা করার জন্য আর আজ আমরা ছুটছি ওদের কাছে আশ্রয়ের জন্য - যদি আমাদের ফিরিয়ে দেয় ? আশ্চর্য হয়ে আবার ভাবলাম, হুহু এতো কথা ধর্ম নিয়ে, দেশ ও তো হল ধর্মের নামে কিন্তু আজ তো ঐ আলম আর ভাট্টি রাই তো মুসলমান হয়ে মুসলমান কে মারছে । আব্বা কিন্তু গল্প বলার সময় বার বার বলেছে আগারতলার যুবরাজ ( রাজার ছোট ভাই অনেক বড় সাহসী মানুষ ছিল - অনার কথায় আমি কোন হিংসা দেখি নাই ), আব্বা একজন ইতিহাসের পোকা ছিলেন । সারাক্ষণ
খালি ইতিহাস এর গল্প বলতেন, স্যামসন ডি লায়লা তার প্রিয় গল্প ছিল, আর ছিল সোহরাব এবং রুস্তম, আলেক্সজান্দার । আব্বা রাজকীয় পরিবার - জমিদার- রাজা ( বাংলাদেশের ) /নবাব দের সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান রাখতেন । সে ছিলেন একজন রয়েলিস্ট - যদিও আমাদের দেশে বেশী পরিমাণ জনগণ ওদের কে এক ধরনের ঘৃণা করে থাকে, সেখানে আমাদের আব্বা সব সময় ওদের কথা ভালো বলতেন । তবে উনি মন থেকে পাঞ্জাবীদের কে পছন্দ করতেন না , তার আবার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল জমাদার সেপারিন ( সেফারিন) গুল - এক পাঠান - সিপাই রা তাকে ডাকতো স্প্রিং গুল বলে - সেপারিন নাকি উর্দুতে স্প্রিং এ বলে ।
অনেক ক্ষণ হাটার পর আমরা একটা গ্রাম দেখতে পেলাম হাতের বামে - বাতাসে একটা দুর্গন্ধ ; যতই কাছে গেলাম ততই প্রকট হতে লাগলো দুর্গন্ধ টা , আকাশে অনেক অনেক গুলো শকুন উড়ে বেড়াচ্ছে । অনেক গুলো কুকুরের ডাক আসছে ঐ গ্রামের দিক থেকে , দাদা বললেন এই গ্রামটা হিন্দুদের ছিল, নাম রাইয়ত হাট - তোমাদেরকে সেইদিন বলেছিলাম , এখানে পাঞ্জাবীরা কম করে হলেও এক শ থেকে দুই শ মানুষ মেরেছে কয় দিন আগে, গ্রামে একটা বাড়ীও দাঁড়িয়ে নেই kothaসব ঘর গুলো পুরে ছাই, খালি অর্ধদগ্ধ বাঁশের বা কাঠের খুঁটি গুলো দাঁড়িয়ে আছে । আম্মা প্রায় বমি করেই দিল । অসম্ভব দুর্গন্ধ । দাদা বলল এরা হিন্দু বলেই এই গ্রাম টা ইচ্ছা করে পুড়িয়ে দিয়েছে , আর ট্রাক ভর্তি করে করে যুবতী মেয়েদের নিয়ে গেছে । দারুণ হৃদয় বিদারক দৃশ্য - সব ছোট ছোট বাচ্চাদের কেও রেহাই দেই নাই ওরা । আপা একদম কেঁদেই ফেলল দাদার বর্ণনা শুনে, ওখানে নাকি একসময় একটা বড় সাপ্তাহিক হাট বসতো এলাকার মধ্যে খুবি প্রসিদ্ধ - ঐ গ্রামের সবাই ছিল একই হিন্দু সম্প্রদায়ের - চর্মকার । এই হাটে ওদের অনেক জুতার মেরামত এবং চামড়ার জুতার দোকানও ছিল । খুব মনঃকষ্ট নিয়ে সামনে গিয়েই পেলাম একটা ছোট্ট নদী - কোন খেয়া পারাপার করার লোক - নৌকা - মাঝিও নাই, দাদা বললেন বিজলা নদী এটা - এই নদী আমাদের গ্রামের নদী চিনাইর আর হাওড়া নদীর সাথে মিলেছে - এক সময় এই নদী অনেক বড় ছিল - এই নদী দিয়ে মগ রা এসে আমাদের এলাকায় ডাকাতি করতো - ওনাদের পইর দাদার আমলে নাকি । নদীর পার দিয়ে হেটে হেটে আরেক টা বাজারে গেলাম মনে হয় নামটা মজলিশপুর - এই গ্রামে আমাদের আত্মীয় আছে । আম্মা বললেন এখন কাকা এই সব বাদ দেন - একটা কোষা নৌকা পেলাম দড়ি বান্ধা দুই পারে নদীর পানি কম - সম্ভবত ১০ - ১২ ফুট পানি কিন্তু গভীরতা জানি না । দাদা দুই বারে আমাদের সবাই কে পার করালেন । নদী পার হয়ে আমরা একটা মেঠো পথ এর ধারে বসে চিড়া খেলাম সাথেই একটা বাড়ীতে দেখতে পেলাম একটা টিউবওয়েল । চিড়া আর গুঁড় চাবিয়ে খেতে যেয়ে দাঁত আর চোয়াল এ ব্যথা হয়ে গেলো । কিন্তু, ঐ সময় ওটাই ছিল সবচে’ মজার খাদ্য । সবাই চুপচাপ , আমার ফ্যামিলি কে কোন দিন এত নীরব দেখি নাই এর আগে - আমাদের কে সবাই বলতো আমরা নাকি নিজের মত প্রকাশে অতল এমন কি ৭ বছরের টুম্পাও । কিন্তু কারো মুখে টু শব্দটিও নাই । ইচ্ছামত পানি খেয়ে নিলাম ঐ কলটা থেকে ।
তারপর পার হলাম নেমতাবাদ - ওখানে কয়েক জন যুবক ছেলের দেখা পেলাম ওরা ঢাকার, ইন্ডিয়া যাচ্ছে - কিন্তু বেশী কথা বলতে চাইলো না । ওদের দল এর পাঁচ - ছয় আর আমরা সবাই মিলে একে একে রেল লাইন এর নীচে ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে হেটে কসবার দিকে যেয়েই পেলাম ব্রাহ্মণগাও ব্রিজ নদীর পার দিয়ে হেটে ব্রিজের নীচ দিয়ে রেল লাইন পার হলাম - ভাগ্য ক্রমে তেমন কোন ভয়ের কিছুই ছিল না - ঐ ছেলে গুলো বলল সকাল থেকে তিন বার ট্রলি দিয়ে পেট্রল করেছে আধা ঘনটা একটা ট্রলি গঙ্গা সাগরের দিকে গেছে । গ্রামের লোকজন বলল দুই - তিন ঘণ্টা পর পর আসে । ব্রিজ পার হয়ে এই যুবকদের গাইড ওদের কে নিয়ে গেলো অন্য দিকে আর আমরা ঢুকলাম আমার দাদাদের গ্রামে । সময় তখন প্রায় তিনটা - সাড়ে তিনটা । দাদা বলল গ্রামে ঢুকে লাভ নাই আমাদের আরও অনেক পথ যাইতে হবে, বাড়ীর পাশ কেটে আমরা চলে গেলাম নদীর পার দিয়ে হেটে বিলের দিকে বিশাল এক বিল এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত দেখা যায় না , গুদারা ( ফেরি) দিয়ে নদীটা পার হবার এক বিশ মিনিট হেঁটেছি বিলের মধ্যে জমির আইল দিয়ে আকাশ তখন কালো হয়ে গেলো আর দুই তিন মিনিট পর ই শুরু হল এক তাণ্ডব লীলা - মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেলো সব ! প্রচণ্ড এক ঝড়, এক অসম্ভব ধরনের দমকা হাওয়া আমাদের কে ঘিরে ফেললো, সে যে ক শক্তিশালী বাতাসের জোড়, জায়গায় আমরা বাধ্য হলাম মাটিতে শুয়ে পড়তে, আমার গাট্টি টা সহ মাটিতে সটান হয়ে শুয়ে তাকিয়ে দেখি ওরাও সবাই খেতের আইলে সাথে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে, আমি জেন উড়ে চলে যাবো মনে হল,যেখানে আমি শুয়ে পরেছি সেখানকার ঘাস করে আঁকড়ে ধরলাম দুই হাত দিয়ে, যাতে উড়ে না যাই , সম্পূর্ণ বিলের মধ্যে ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে গোল একটা চিমনির মত ঘুরে ঘুরে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে আঁক ক্ষিপ্র বেগে , আমাদের থেকে বেশই হলে আধা মাইল দূরে , গাছ, বিলের মাছ ধরার বাস দিয়ে বানান জাল দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে ছুরমার খেতে পানি দেওয়ার জন্য পা দিয়ে দাঁড়িয়ে এক অংশ যেটা পানিতে চুবিয়ে ঐ ছোট নৌকা আবৃতির ওটা পানিতে ভরে গেলে ওটা থেকে পা সরিয়ে নিলে জমিনের দিকে লাগানো ওজন ঐ নৌকা জাতীয় পানি নিষ্কাসনের ওটা ওজনের ভারে জমির দিকে নেমে গেল পানি গুল সন জমিতে প্রবেশ করে(ওটার নাম আমার জানা নাই ) - ঐ গুলকে বাতাসের ঘূর্ণিপাকে ভেঙ্গে, মুচড়িয়ে, উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে , মনে হল এই সারা বিলে আমরা ৬ জনই, মনে হয় এই সাইক্লোনের মধ্যে পরেছি , বিলের পানি গুল ঘড়ি খাচ্ছে , আমি দূরে একা আর ওরা একটু দূরে, ঘাস ছিঁড়ে হাতের মধ্যে চলে আসছে , বাতাসের জোরে আমাকে ঠেলে উঠিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে , উড়িয়ে নিয়ে মনে হয় ফেলে দিবে , উপায় না পেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে নেমে গেলাম আর ওদের ওলটা পাশে একই জমির আইলের ওনয় পাশে আমি শুয়ে পরলাম আইলের সাথে গা ঘেঁসে, বাতাস এখানে একটু কম, এরই মধ্যে শুরু হল বিদ্যুৎ চমকানো এস যে কি আওয়াজ, আর আলো চতুর্দিক দিনের আলোয়ের মত ফর্সা করে বিশাল গর্জন করতে থাকল কম করে হেলও - আমরা যাচ্ছিলাম পূর্ব দিকে এখন শুয়ে আছি পূর্ব দিকে মাথা দিয়ে আর ঝড় আসছে উত্তর দিক থেকে ; এরপর শুরু হল শিলা বৃষ্টি, একেকটা এক থেকে দুই ছটাক ওজনের শিল পরা শুরু করল কোনাকুনি হয়ে এসে হাতে, পায়ে, গায়ে পরতে থাকলো আর শুরু হোল বৃষ্টি । সেদিনের সেই মুহূর্ত কাউকে আমার পক্ষে ভাষায় বর্ণনা করা কোন ভাবেই সম্ভব না । সে এক নিদারুণ বিপদ, আসে পাশে কোন বাড়িঘর নাই - আমরা সর্ষেডুলী বিলের মধ্যে গোপীনাথপুর - চন্দ্রপুর - বাড়াই নামক তিন টি গ্রামের মধ্যে চিনাইর নদীর উপদ্বীপ আর অববাহিকার ঠিক মধ্য খানে । দুপুর চারটে এর একটু পরে , হাহাকার, কোন জনমানব এর নিশানাও দেখা যাচ্ছে না , আমার gaট্টি ভিজে, কাদা লেগে চপচপে, একবার মনে হল ফেলে দেই, তাহলে জানে তো বাঁচতে পারব , দাদা অনেক কষ্টে আমার কাছে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল; আমি ঠিক আছি কিনা - আর বলল তোমাকে বলছি সাথে সাথে হাঁটো এতো দূরে গেলা কেমনে, দাদা কে ধরে আমি ফেরত আসলাম সবার কাছে । আম্মা বলল, একটা কাল বৈশাখীরঝড়, ইংলিশ এ বলে নড়ওয়েস্টার - হ্যারিকেন এর মত ঝড় এটা - বাতাসে সব ঘূর্ণিপাক খায় ওর ঐ ঘূর্ণিপাকের মধ্যে যাই পরুক না কেন ভেঙ্গে চুরে নিয়ে যায় সব দলিত মথিত করে , ভাগ্য ভালো এটা আমাদের থেকে একটু দূরে ছিল , এটা উত্তর পূর্ব বাংলাদেশে আর ইন্ডিয়ায় হয় বৈশাখ মাসে। শুরু হল মুসল ধারে বৃষ্টি, দাদা বলল এখন এইভাবে না শুয়ে থেকে চল হাটতে থাকি , অনেক পথ বাকি আছে এখনো, অনেক কষ্টে উঠে হাঁটার চেষ্টা করলাম , আমার হাতের গাট্টী ওজনে কম করে হলে আরও ১০ সের বেড়ে গেছে ভিজে, দাদা বলল আমি নিচ্ছি এটা আম্মা আপার টা নিলো । অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে, ক্ষেতে গোড়ালি পর্যন্ত পানি হয়ে গেল আর আইল গুল হয়ে গেল পিচ্ছিল প্রতি দুই তিন কদম দিবার পর পরই পা পিছলে আইল থেকে জমিতে পা পড়ে যাচ্ছিল। জমিতে গোড়ালি পর্যন্ত পানিতে ঢুকে যাচ্ছিল আর জমির কাদা গুলো ছিল একদম আঠালো মাটি, পা কাদা থেকে বের করে পরের কদম দিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল । তার মধ্যে বৃষ্টির ফোটা গালে ,মুখে হাঁতে এসে শুইয়ের মত খোঁচা দিচ্ছিল প্রত্যেক টা ফোটায় , আস্তে আস্তে আমরা একটা রাস্তা পেলাম জমি থেকে প্রায় তিন চার ফুট উঁচু , ঐ উচ্চতা টুকু উঠটেই অনেক কষ্ট পেতে হল স্লোপ টা লাল মাটির আর লাল মাটি যে কি ধরনের পিচ্ছিল হতে পারে তা যে না গিয়েছে বৃষ্টির পড় তাকে বুঝানো খুবি অসাধ্য একটা কাজ। রাস্তা টা আরও পিচ্ছিল, টুম্পা আর ছোটন কয়েক বার পিছলিয়ে ধপাস করে পরল রাস্তায়, অনবরত বৃষ্টি, এই এক মিনিট আস্তে আবার দুই মিনিট পর জোড়ে, তাপমাত্রা কমতে থাকলো, ঠাণ্ডা অনুভত হতে শুরু করল সবার, সন্ধ্যাও প্রায় হয়ে এলো, আমার, টুম্পা আর ছোটন দাঁতে দাঁতে বারি খেতে লাগল ঠাণ্ডায়, শীতে কন্কন হয়ে কাঁপতে লাগলাম আর পা চলে না । সেই ভোর রাত থেকে হাঁটা শুরু আর তখন সন্ধ্যা - পিচ্ছিল মেঠো পথ লাল রঙের মাটি আর এর মধ্যে আরম্ভ হোল পাহাড়ি পথ, পাহাড়ের উপড়ের দিকে উঠতে শুরু করলাম, পা দেওয়ার সাথে সাথেই পা পিছলে যায় আর মধ্যে উপড়ে উঠা যে কি কষ্টের । লম্বা লাইন হয়ে গেল দাদা আগে আর আমি একদম পিছনে, বার বার আমাকে ডাকছে ওদের কাছে যাওয়ার জন্য আমার আর কোন শক্তি ছিল না ওর থেকে জোড়ে হাঁটার, একে ক্লান্ত, পা পিছলে যাচ্ছে, তারপর মাথায় আমার অত বড় বৃষ্টি তে ভিজে চপচোপা একটা এক মন ওজনের গাট্টি - আমি মাত্র ১০ বছর ১১ মাস বয়সী ননির পুতুল সম এক বালক । ভয়, ঠাণ্ডা, শীত, দাঁতে দাঁতে কাঁপুনি, ক্লান্তিম ক্ষুদা এইসব মিলিয়ে আর পারলাম না এক পা ও এগুতে - রাস্তার মধ্যেই বসে পরলাম আর আমার মনে নেই এর পর কি হয়েছিল সেই সন্ধ্যায় অল্প কয়েক মিনিটের জন্য । যখন প্রকিতস্ত হলাম দেখলাম আম্মা, দাদা, আপা সবাই আমাকে ঘিরে বসে আছে, আমি তখনো দাঁতে দাঁতে বারি খাচ্ছে, তখনো থর থর করে কাঁপছি ঠাণ্ডায়, ওরা সবাই মিলে দাঁর করালো আম্মা আর দাদা আমাকে অনেকটা টেনে হিঁচড়েই সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, আমি মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের করতে পারছি না । রাস্তাটা অন্ধকার একেবারে উপড়ে উঠে গেছে বেশ উঁচুতে , অনেক কষ্টে পাহাড়ের একটা স্যাডেল এর মত একতা মাঠের মত লম্বা লম্বি আমরা ঠিক মধ্য খানে রাস্তাটা দিতে উঠে এলাম, সামনেই দেখতে পেলাম একটা সাদা একতালা ইংলিশ আই অক্ষরের মত বিল্ডিং, কয়েকটা আলো জ্বলছে ভিতরে, জানালায় শুধু শিক আছে কপাট নাই , তখনো বৃষ্টি হচ্ছে অল্প অল্প । আমরা হেঁটে হেঁটে গিয়ে ঐ দালানের বারান্দায় গিয়ে উঠলাম । বারান্দায় পানি , বৃষ্টির ছিটায় থেক থেকে পানি , জানালা গুলোর কাছে একটু শুকনা ওদিকেই নিয়ে আমাকে বসালো । টুম্পা, ছোটন আমার সাথে বসে পরল, সবার গায়ের কাপড় গুলো একদম চপচপে ভিজা , গাট্টিটা আমার পাশেই , ওটাও একদম ভিজা , আম্মা আর দাদা কার সাথে কথা বলতে শুরু করলো , আমরা তখনো কাঁপছি , বৃষ্টি একটু কমলো ইতিমধ্যে ।
আম্মা আমাদের ডাকল, আপা দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ আমাদের পাশেই, মুখটা দেখা যাচ্ছিলো না আধো আলো আধো আধারিতে , ছোট ভাইরা উঠলো আমাকে ওরা ও আপা মিলে টেনে উঠাল, আমি একাই হেঁটে আম্মা ও দাদার কাছে গেলাম, আম্মা বলল এইটাই ধ্বজনগর । এখান থেকে ইন্ডিয়া মাত্র আধা মাইল দূরে , এইটা স্কুল, অনেক গুলো আমাদের মত ফ্যামিলি আশ্রয় নিয়েছে , আমরাও আজ এখানই থাকব, ভিতর থেকে একজন মানুষ একটা সলতে ওয়ালা কুপি বাতি নিয়ে বেরিয়ে এলো, এসেই দাদাকে চিনে ফেললো, আরে মামা আপনে ? সালাম, দাদা সম্পূর্ণ আশ্চর্য, আরে ভাগনা তুমি বকুল না ? উনি বললেন জি, আপনারা ? এনারা কারা ? দাদা পরিচয় করিয়ে দিলেন, ওনার আম্মাও বেরিয়ে এলেন, উনি আমার দাদাদের বোন হয় সম্পর্কে, ওনারা থাকেন নরসিংদী, নরসিংদী থেকে পালিয়ে এসেছিলেন গ্রামে, কিন্তু গ্রামে থাকা নিরাপদ নাই তাই ইন্ডিয়া চলে যাবেন, এই খানে এক দুই রাত বিশ্রাম নিয়ে , বকুল কাকা আমাদের নিয়ে ওনাদের পাশেই জায়গা করে দিলো, অন্ধকার প্রায় ভিতরে , কুপির আলো অপর্যাপ্ত, আমাদের সব কিছু ভিজা, ওনারা তিনজন কাকা, কাকার স্ত্রী আর দাদি, ওনাদের বড় ভাই স্ত্রী, বড়ভাই নরসিংদী কলেজের ছাত্র নেতা, উনি এক সপ্তাহ আগেই চলে গেছেন ইন্ডিয়া তে মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিতে । দুই ভাইয়ের কোন বাচ্চা হয় নাই। ওনারা দুই এক দিনের মধ্যেই ঢুকে পরবেন। কাকা আমাকে একটা গামছা আর লুঙ্গি দিলো একটা, দাদা ও পেল একটা শাড়ি, সবারই কাপড় পরার ব্যবস্থা হল। একটা খেতা তে আমারা ছয় জন ঘুমানোর জন্য তৈরি হলাম , স্কুলের পিছনের জানালা দিয়েই দেখা যাচ্ছে এক বিশাল বিশাল জলাধার সাদা পানি অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে যতদূর দৃষ্টি যায়। কোন খাওয়া দাওয়া ছাড়াই আমরা শুয়ে পরলাম , আম্মা শাড়ির আচল দিয়ে ছোট ভাইদের নিয়ে ঘুমালো, আমি ঐ দিন প্রথম লুঙ্গি পরলাম, গামছা গায়ে দিয়ে ঘুমাতে শুয়ে পরলাম । দাদা এরই মধ্যে সব গুলো গাট্টি খুলে জিনিস গুলো মেলে দিলো শুকানোর জন্য , আমার পোটলা আর রেডিওটা আম্মাকে দিলো। শীতে( ঠাণ্ডায় ) কাঁপতে কাঁপতেই এক সময় ঘুমিয়ে পরলাম । জীবনের সবচে কঠিন দিনের অবসান,
দাদা; আমাদের আব্বার কাকা ; ওনার কাছে আমরা আজীবন কৃতজ্ঞ । উনি যদি আমাদের না নিয়ে আসতেন তাহলে আমাদের যে কি অবস্থা হত তা আমাদের কারোর পক্ষেই বের করা সম্ভব নয় । অন্য কোন মানুষ এই বয়সে এই ধরনের ঝুঁকি নিত না , তা আমি ১০০% ভাগ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, আমি হলেও অন্য কারো জন্য এই রকম জীবনের ঝুঁকি নিতাম কিনা সন্দেহ ।
ঘুম থেকে উঠেই দেখি দাদা ঐ সাত সকালে দাদা উঠে যেয়ে ঐ গ্রামের একটাই মাত্র দোকানদার কে ঘুম থেকে উঠিয়ে টোস্ট বিস্কুট, মুড়ি, সাগর কলা আর দুইটা মাটির হাড়ি, একটা পোটলায় চাল আর ডাল কিনে নিয়ে আসছে । জীবন কোথা থেকে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেই যেদিন বিমান হামলা হয় তার আগের রাত্রে খেয়েছিলাম পোলাউ, মাংস, পায়েস - পোলাঊ আমার সবচে প্রিয় খাবার । আজ তিন সপ্তাহ এখনো পোলাউ খাই নাই, পেট ভরে একদিনও খাই নাই, ভালো বিছানায় ঘুমাই নাই আরাম করে , সকালে উঠে বাটার মেখে গরম গরম পাউরুটি খাই না কত দিন ! চন্দ্রপুর - বাড়াই - গোসাইস্থল হয়ে ভারতের বর্ডারের প্রায় সন্নিকটে আমরা - দূরে কসবা - মন্দবাগ আর আখাউড়া থেকে ভেসে আসছে কামানের আর আর্টিলারির গলার গগন বিদারী আওয়াজ; না. এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ - ১৯৭১ - সেই ১১ ই এপ্রিল বি বাড়িয়ে তে বিমান হামলার পর আমরা ঘর দোর সব ফেলে রেখে পরনের কাপড় নিয়েই বিভ্রান্তের মতো ভয়ে বিহ্বল হয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম নিরাপদ কোনো আশ্রয়ের উদ্দেশে - সেই দিন থেকে আজ অব্দি- দুই বেলা পেট ভড়ে প্রশান্তিতে খেতে পারি নাই আমরা কেই, পরিষ্কার টিনোপলিন দেওয়া ধোয়া সাদা বিছানার চাঁদর বিছানো বিছানায় আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠিনি। সকালে সবাই একসাথে চা ও খাইনি আজ অব্দি। পরোটা আলু ভাজি দিয়ে খাওয়াও হয়নি প্রাতঃরাশ। নেই কোনো রেডিওতে রোববার দুপুরে ভাত খেয়ে নাটক শুনা। শুনিনি সেই খোকা বাবুর প্রত্যাবর্তন নাটিকা বা কাবুলিওয়ালা।
লাতু থেকে সিলেট ট্রেনে এসে রাত্রে যখন নামতাম তখন দেখতাম অনেক অনেক লোক সিলেট স্টেশন এর প্লাটফর্মে কাঁথা মুরি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে, লাইন ধরে, আর আজ আমরাও একটা দরজা, জানালা ছাড়া স্কুল ঘরের মেঝেতে ঘুমাচ্ছি । যুদ্ধ হবে সৈনিকে সৈনিকে কিন্তু আমরা সাধারণ জনগণ কেন এতো বিপদ, সারা জীবন শুনে আসলাম মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই । কিন্তু, মুসলমান ভাইরাই মারছে আমাদের কে আমরাও মুসলমান , মনে পরল যখন কয়েক মাসের জন্য আমাকে খুলনা শিপইয়ার্ড এর কাছে, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির পাশে রূপসা প্রাইমারী স্কুলে পড়তে হয়েছিল - ওরে বাবা সে কে কি এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা, আট, নয়, দশ বছরের বিহারী/পাঞ্জাবী ছেলেরা ঐ বয়সেই চাক্কু নিয়ে স্কুলে আসত আর কথায় কথায় বাঙ্গালী ছাত্র দের সাথে ঝগড়া লাগিয়ে দিত আর একটু কথা কাটাকাটি হলেই সঙ্গে সঙ্গে পকেট অথবা কোমরের বেল্ট সাত ঘাট ওলা চাক্কু বের করে ফেলত । সে এক ভয়ানক ব্যাপার, এখন বুঝি, ঐ বিহারী আর এই পাঞ্জাবি ছেলেরা এবং ওদের বাবারা কেউই আমাদেরকে মন থেকে গ্রহণ করতে পারত না - যার প্রমাণ এই যুদ্ধ ।
এতো দূরে এসেও কিন্তু, আর্টিলারির শব্দ আর বিচ্ছিন্ন গোলাগুলির শব্দ থেকে রেহাই পেলাম না । অনবরত সারাদিন সারারাত চলছে একই আওয়াজ । কোনটা অল্প আওয়াজ আবার কোনটা ব্যাপক এবং বিকট শব্দ । আধা ভিজা আধা শুকনা এক্সট্রা পেন্ট পরলাম আর সার্ট স্যাতস্যেতে অনেকটা, পুরোপুরি শুকায় নাই , ইট দিয়ে স্কুলের পিছনে চুলা বানিয়ে ফেলল আম্মা , আপা অন্যদের দেখাদেখি, আমি - দাদা পাশের পাহাড়ে বিলের পানির দিকের কাঁঠাল বাগানের মধ্যে ঢুকে শুকনো ডাল আর শুকনো ধরনের পাতা কুড়িয়ে এনে দিলাম তা দিয়ে আরেক জনের বাশের ফুকনি দিয়ে ফু দিয়ে খিচুরি রান্না করল ওটা খেকেই আমরা আবার রউনা দিলাম দুপুর তিন টার দিকে ইন্ডিয়া প্রবেশ করার জন্য, স্কুল এর দালান থেকে সোজা রাস্তা, পাঁচ গজ দূরে পাহাড়ের নিচেই মসজিদ আর মসজিদের ছোট পুকুর টার ওপর পারেই যে পাহাদের পাদদেশ সেখান থেকেই শুরু আমাদের নিরাপদ আশ্রয় ইন্ডিয়া । আমরা বিদায় নিলাম বকুল কাকাদের পরিবারের নিকট থেকে , হাঁটতে লাগলাম এক অজানা গন্তব্যের দিকে ! অনেক ভয়, সংকয়, সন্দেহ, আশা, নিরাপত্তার সংকল্প নিয়ে এক নতুন জীবনের প্রথম অঙ্কের প্রথম অধ্যায়ের দিকে । পাঁচ শ গজ দূরে ধজনগর মসজিদের পরেই - ভারতের ( ইন্ডিয়ার ) বর্ডার - এই ঐতিহাসিক লাইন টা পার হলেই আর আমাদের মারতে আসতে পারবে না পাঞ্জাবিরা আর শুনতে হবে না কোনো কানাঘুষা - পান্জাবীদের দোসররা আর চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাবে না আমাদের দিকে - আমরা হবো মুক্ত বিহঙ্গ - হবো রিফিউজি। হাটা শুরু হলো পাহাড়ের দিকে ধজনগর থেকে ইন্ডিয়া অভিমুখে - সবাই চুপ চাপ বেশ উঁচু তে উঠতে হলো হেটে হেটে ; সামনেই একটা সমতল ভেলী একটা ছোট্ট নালা তার পাশেই একটা কানায় কানায় পরিপূর্ণ পুকুর আর পুকুরের ওপর পারে বেশ কয়েক শতাব্দী পুরোনো একটা জরাজীর্ন মসজিদ তারপর ১ থেকে ২০০ গজ সমতল জায়গা পাহাড়ের পাদদেশে মিশে গেছে - পাহাড়ের পাদদেশ থেকেই ইন্ডিয়া শুরু। পথ তো আর ফুরায় না - প্রায় গোধোলির সময় - আমরা কেই জানিনা কোথায় যাচ্ছি ; কোথায় কাটাবো আজ রাত। আমি ১১ বছর প্রায় ; ছোটন ৯ আর টুম্পা তখন ৭ ক্লান্ত সবাই - আমাদের জীবনেও এত পথ হাঁটিনি কোনোদিন তার পর কাল বৈশাখীর ঝড় ও শিলা জাতীয় প্রকট বৃষ্টি। সবাই নেতিয়ে গিয়েছিলাম। জীবনেও আমরা ভাবিনি এইরকম অবস্থা কারো হতে পারে।
মসজিদ পার হলাম - নামাজের জন্য কয়েক জন মুসুল্লি তৈরী হচ্ছেন - মনে মনে ভাবলাম - পাকিস্তানিরা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে যখন অগ্রসর হচ্ছিলো ভৈরব এর দিক থেকে তখন ওরাও বলছিলো '' ইয়া আলী, আল্লাহ হু আকবর ''- আর আমরা যারা জান - প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলাম আমরাও অতীব জোরে গলার সব শক্তি দিয়ে সেই একই আল্লাহ কে ডাকছিলাম আর দোআ পড়ছিলাম '' লা' ইলাহা ইল্লা আন্তা। ....... মিনাজ যা লি মিন '' - এই তা আবার কি ধরণের যুদ্ধ - দুই পক্ষই একই সৃষ্টি কর্তার বানানো কিন্তু এক দল আরেক দল কে মারার জন্য মরিয়া হয়ে ধাবিত করছে। কেন? বিচিত্র এই মানব জাতি।
আমাদের কাফেলা টা ধীরে ধীরে অতিক্রম করলো মসজিদ আর উপনীত হলাম ভারতের সীমান্তে ; ভয়- ভীতি - নতুন একটা দেশে পদার্পন - কি হবে জানিনা।
ইতিমধ্যে আমরা প্রবেশ করে গেছি হাটতে হাটতে ইন্ডিয়া তে - পাহাড়টা উঠেই একটা কাঁঠাল বাগান টিলার উপরে। তার পরই ঢালু পাহাড় শেষ প্রায় মাইল খানেক প্রশস্ত সমতল ধানের জমি - আর জমিগুলোর ওপর পারে লোকালয় ঘর- বাড়ি দেখতে পেলাম
পিচ্ছিল জমির আইলের উপর দিয়ে হাটা যে কি কষ্ট - জমিগুলো হাটু পানি পূর্ণ - পা পিছলে প্রতি তিন চার কদমে ই আবার হাটু পানিতে ডুবে যাওয়া ভীষণ কর্দমাক্ত জমি - পিছলে যাওয়া পা'টা টেনে উঠিয়ে আনা বেশ কষ্ট কর।
কিন্তু সকল কষ্টের ফসল হলো - যাক বাবা আর পাবে না পাকিস্তানী আর্মি আমাদের - আমরা এখন নিরাপদ।
গ্রাম তার নাম পাণ্ডপপুর - ভয়ার্ত জাতীয় একটি গ্রামের নাম ।
সপ্তম পর্ব
ইন্ডিয়াতে রিফ্যুজি
এক থেকে দেড় মাইল ঐ জমিনের আইলের উপর দিয়ে হেটে হেটে শেষ পর্যন্ত প্রবেশ করলাম গ্রামের ভিতর - জরাজীর্ণ বাড়ী গুলো ছনের ঘর - গরুর গোয়াল - ফসল মাড়ানোর গোলাকৃতি উঠান পেরিয়ে দেখতে পেলাম একটা পায়ে চলা মেঠো পথ । অঝোরে বৃষ্টি পড়তে লাগল আবার । একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া চাইয়ি করছি এখন কি করবো ? মুখে কথা বলার শক্তি প্রায় নাই বললেই চলে - ক্ষুদার্থ - গলা শুস্ক - বৃষ্টি ভেজা সিক্ত পোশাক আর ঝোড়ো হাওয়ায় ঠান্ডা - সবাই আমরা হাইপো থার্মিয়া আক্রান্ত। আহা রে আজ ও মনে পরে আমাদের সবচে ছোট ভাই টুম্পা - পারছে না আর এক কদম ও হাটতে শীতে আর ঠান্ডায় ওর মুখ অনবরত কাঁপছে আর কাঁদছে - দাঁতে দাঁতে বারী খেয়ে খট খট আওয়াজ করছিলো। ওর দিকে তাকানো যাচ্ছিলো নো। নাদুস নুদুস ( আদর করে সবাই ওকে ভোটলা বলে ডাকতাম) টুম্পা ৩ সপ্তাহে শুকিয়ে মাংস আর হাড্ডি গুনা যাওয়ার মতো ওর অবস্থা। আমার বোন ওকে ধরে ধরে পথ চলতে সাহায্য করছিলো আর শান্তনা দিচ্ছিলো - কিন্তু ঐ আশাবিহীন সময়ে কি কোনো প্রকার আশা কি কাউকে দেয়া যায় কিনা তা আমার জানা ছিল না।
নেই কোন পথিক - নেই কোনো ঘর বা বাড়ি - রাস্তাটা টিলা কেটে বানানো - লাল মাটি - অনেকটা দেখতে আমাদের গ্রাম গোপীনাথপুরের কবরস্থান টিলার মতো - পুকুর পারের ওপর প্রান্তে কবরস্তান - ছোট বেলায় ঈদে পর্বনে গ্রামে গেলে এই রকম লাল মাটির পথ ধরে কিছু দুর হাঁটলেই হাতের বা' দিকে আমার দাদার কবর - জিয়ারত করতে যেতাম। হাটতে হাটতে মনে পড়লো অনেক কথা - দাদির মাথায় জোট বাধা চুল। হয়তো; ক্লান্তিতে হিলুসিনেশন হচ্ছিলো কি না জানিনা। হঠাৎ পাশ দিয়ে হেটে গেলো কাঁধে ভার নিয়ে টিপরা জাতীয় ( মঙ্গোলিয়ান অবয়বের) তিন চার জন লোক - ওদের সাথে একটা বিশাল হাসি দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলাম - কিন্তু ওরা টু শব্দটিও না করে আমাদের পাস কাটিয়ে উল্টোপথে চলে গেলো দ্বিধাহীন ভাবে। খালি পায়ে পিচ্ছিল পথ আর মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাথরের টুকরায় পাড়া দেওয়া যে কি কষ্ট তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছিলাম। আম্মা একটা কথাও বলছে না। রাস্তাটা সম্পূর্ণ কাদা ই কাদা শুধু একটা লিক ( চুয়াডাঙ্গায় ( উত্তর বঙ্গে) লিকপড়ছে মানে হচ্ছে যে গরুর গাড়ির চাকার পেষণে কাদা শক্ত হয়ে উঠেছে একটা চাকার পরিমান জায়গা) পরিমান পথ শুষ্ক ১২ থেকে ১৮ ইঞ্চি চওড়া মাত্র। কতক্ষন পর আবার একটা টিলা - উঁচুতে উঠা যে কষ্টের তা সেই জানে যে সারাদিন যাবৎ কিছুই খাইনি। একেকটা কদম মনে হচ্ছিলো - ধরণী তুমি দ্বিধা হও আর আমি প্রবেশ করি ; যাতে না বের হতে হয় চিরতরে ;
এই জনপদে মনে হলো আমরাই প্রথম উনুপ্রেবেশ করি শরণার্থী - এর আগে কোনো দল এখানে আসছে বলে মনে হলো না। যে দুই সপ্তাহ আত্মীয়দের আশ্রয়ে ছিলাম
তখন নিজেদের এতটা অসহায় মনে হয় নাই - জীবনে এই প্রথম আমরা কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলাম - মনে মনে বেশ কয়েকটা দিন ফুর্তিতে কাটিয়েছিলাম প্রথম প্রথম। কিন্তু গ্রামের মানুষ রা আমাদের কে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে গেলো সহসা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানা সবচে বেশি যুদ্ধ দেখেছে এবং ওখানকার বাসিন্দারা খুবই বিপদে ছিল নয় টি মাস - আমাদের কে লুকানো ওদের জন্য বিপদজনক বৈ কিছুই ছিল না - উপায়ান্তর না পেয়েই আমাদেরকে পালিয়ে যেতে হলো ভারত অভিমুখে - এক অজ্ঞস্ত যাত্রায় - আমরা কেই ই জানিনা ভবিষ্যৎ কি আছে সামনে। জীবন যে কারো জন্য এত কঠিন আর পথ চলা যে এত বন্ধূর হতে পারে তা সেই বলতে পারবে যে এই রকম একটা বিপদজনক অবস্থায় পড়েছে।
''এ' তুফান ভারী দিতে হবে পারি - কান্ডারি হুশিয়ার ''
উঁচু টিলায় উঠেই দেখা পেলাম হাতের বামে একটা বড় ফুটবল খেলার মাঠ আর তারই কোনায় উঁচু মাটির পাঁচিল ঘেরা বি এস অফ এর চৌকী।
আমরা বামে মাঠের মধ্যে খান দিয়ে হেটে হেটে হাজির হলাম - বি এস এফ সেন্ট্রির সম্মুখে - হল্ট হ্যান্ডস আপ - রাইফেল তাক করে ধরে ব্যাংকার থেকে উঁকি মেরে শুধু ওঁর বেল্ট থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা গেলো- আম্মা বললো - দাঁড়িয়ে পর সবাই - আস্তে আস্তে বললেন ওর গোঁফ এর পাঁকানো দেখে মনে হচ্ছে এই বেটা ঝাট সম্প্রদায় ভুক্ত হবে।
দাদা আর আম্মা এগিয়ে যেয়ে - কথা বললো সেন্ট্রির সাথে - অবাক হয়ে দেখলাম আম্মা অনর্গল নির্দ্বিধায় হিন্দিতে কথোপকথন করছে - টুলু আপা এর মধ্যেই নীচু স্বরে বললো - মা ' কাস্টমসে যখন চাকরি করতেন তখন হর হামেশা ইন্ডিয়ান কাস্টমস অফিসারদের সাথে বেনাপোল - গোদাগাড়ী - প্রেমতলী - আখাউড়া - তামাবিল চেক পোস্টে হিন্দিতে কথা বলে অভ্যস্থ ।
সবাই ভুলেই গিয়েছিলাম যে আম্মার জন্ম কলকাতায় - ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আসা - কত হাজার বার যে আমাদের সাথে আর আব্বার সাথে গল্প করতো সেই ট্রামে চড়া - এসপ্ল্যানেড - পার্ক সার্কাস- হাওড়া ব্রিজ- গড়ের মাঠ আর সেন্ট পৌলস বা ফোর্ট উইলিয়াম এর স্মৃতি।
পা ' গুলো আর পারছিলো না দাঁড়িয়ে থাকতে - ভিজা ঘাসেই বসে পড়লাম মনের অজান্তে - একটু ভয়ার্তও ছিলাম বই কি - যে বিশাল দস্যু ধরণের মোছ ওই প্রহরীর - দেখলে কার না ভয় লাগবে ?
'ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো ; ক্ষমা করো ; প্রভু। ....পথে যদি পিছিয়ে - পিছিয়ে পড়ি কভু - ক্ষমা করো ; প্রভু। ''
বসা থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙতে যেয়ে পশ্চিম দিকে তাকাতেই দেখলাম ওই বহুদূরে ফেলে আসা দেশের বিশাল জলাশয় গোপীনাথপুর - বাড়াই গ্রাম বিস্তৃত সরিষা ডুলির বিল এ আস্তে করে অস্ত গেলো লাল রাতুল আলো বিকিরণ করে জলের উপরে - মনে মনে ভাবলাম -
আবার কি আসিব ফিরে
এই বাংলার - খাল - বিল বা নদীটির তীরে ?
একজন সুদর্শন শিখ হাভিলদার মাথায় এক টা পাগড়ী পরা এগিয়ে এসে কথা বলল । আম্মা আমাদের পরিচয়, আব্বার নাম, রেঙ্ক, ই পি আর সব বললেন ওনাকে, অত্যন্ত নম্র, ভদ্র এবং নিম্ন স্বরে কথোপকথন করলো আম্মার সাথে , আমাদের বসতে দিলো, পানি দিলো , তারপর চা খেলাম, আমাদের ই পি আর মতই বি ও পি টাইপের ঐ চৌকি টা। দুইটা লম্বা লম্বা ব্যারাক এর মত আর আমরা যেখানে বসলাম ওটা একটা খোলা ঘর উপড়ে ছনের চাল আর বসার জন্য চেয়ার আর দুটো বেঞ্চ । কিছুক্ষণ পর অফিসার আসলেন , ঐ পাঞ্জাবী শিখ হাভিলদার ঐ অফিসার কে একটু দূরে নিয়ে কি সব বললেন, উনি এসে আম্মার সাথে কথা বলল ইংলিশে, আম্মা ওনাকে সব বললেন আবার । অফিসার ভদ্র লোক বললেন , ''কই ধিক্কাত নেহি হে, সব ঠিক হো জায়েগা, ঘাব্রাইয়ে মত । ‘'
খাকী কাপড়ের চেয়ে ওদের সবুজ ড্রেস আর সবুজ মাঙ্কি ক্যাপ খুব সুন্দর, কিন্তু ওদের হাতিয়ার এর লম্বা বার্যেল ওলা রাইফেল এই প্রথম দেখলাম, দাদা চুপ করে বসে একের পর একই স্টার সিগারেট টানছে আর জোরে জোরে চায়ে চুমুক দিচ্ছে , দূরে আই প্রথম জীবনে দেখলাম এক জন পুরুষ তার অনেক বড় আঁচড়াচ্ছে, আম্মা আমাদের সব সময় শিখ দের পাঁচটা ‘'কে'' থাকে, কেস, কংগন, কৃপাণ, করা, কাচেরা ( কাচ-অন্তর্বাস) - এগুলো আমাদের কে অনেক কিছুই আম্মা শিখাতো - যার অনেক কিছুই শিখতাম না বুঝেই, এখন দেখলাম কাজে লাগে, উর্দু যেমন অনেক কথাই বলতে পারতাম, কারণ বাসায় অনেক সময় পাঞ্জাবী, বিহারী, পাঠান সিপাই রা আসতো আব্বার সাথে দেখা করতে অথবা আব্বা বর্ডার থেকে কেই আসলে এটা ওটা পাঠিয়ে দিত, তাই কিছু কিছু উর্দু বলতেও পারতাম আর বুঝতাম ও অনেক কিছু, সেপারিং গুল আব্বার বেস্ট ফ্রেন্ড পাঠান ছুটি যাবার আগে আমাদের পায়ের মাপ সাদা কাগজে দাড় করিয়ে একে নিয়ে জেত আর আসার সময় পেশওয়ারই চামড়ার চপ্পল বানিয়ে নিয়ে আসতো , ওর কাছ থেকে দু একটা পশতু ভাষার শব্দ ও জানতাম। আম্মা আরও শিখাতো উৎকল ( দ্রাবিড় ও উৎকলে ) মানে উড়িষ্যা, মেঘনাদ বদ কাব্যের কঠিন কঠিন বাংলা শব্দ, ইরানী, কাবলিওয়ালা দের কালচার, মজতুবা আলীর আফগানিস্থান এর গপ্লের ফালুদা কি, এই সব হাবিজাবি গল্প, ইরানী দের সংস্কৃতি, সেদিন শিখ সম্বন্ধে এগুলো জানা থাকাতে নিজেকে অনেক বিজ্ঞ মনে হল, আর ভাবলাম, জীবন যতই বিপন্ন হউক না কেন, মনবল এবং চোখ, কান, বুদ্ধি এই গুল সর্বদা সজাগ রাখতেই হবে, গত ১৪ দিনে যা দেখেছি আর যা কষ্ট সহ্য করেছি তা অনেকে সারা জীবনেও পায় কিনা জানিনা , তারপরও শত বিপত্তির মাঝে আশার আলো নিভতে দেই নাই ।
বিএসএফ আমাদের ঐ রাতে তাদের কেম্পে খাওয়ালো - পিতার চাকরির বদৌলতে মনে হয় এই আতিথেয়তা টা পেলাম আমরা। পুরা পৃথিবীতেই মনে হয় এই পেশার লোকদের মধ্যে একটা অমোঘ সহানুভূতি কাজ করে - শুধু এটা কাজ করে না ওই পাপিষ্ঠ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর মাঝে ওদের নিকট সব বাঙালিই হিন্দু, এবং বাঙ্গালী মুসলমানরা ওদের থেকে কম মাপের মুসলমান এবং তাই সব বাঙালিই ওদের নিশানা - হত্যা করাই যেন ওদের একমাত্র পেশা। বাঙ্গালী হত্যা যেন ওদের এক ধরনের ধর্মীও দায়িত্ব ।
তাড়াতাড়ি করে ওই রাতেই বি এস এফ এর মহানুভব মানুষ গুলা আমাদের কে ক্যাম্পের থেকে অর্ধ মাইল দূরে এক হিন্দু বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিলো; সারাজীবন আমি এবং পরিবার ঐ বি এস এফ দের নিকট ও ঐ হিন্দু পরিবারের নিকট ঋণী - এই মানবিকতার ঋণ আমরা জীবনেও পরিশোধ করতে পারবো না।
যখন আমার পরিচত অনেক উগ্র জাতীয়তা বাদী পন্থী রা বলে যে ভারত তার স্বার্থের জন্য আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে উপকার করছে - তাদের কে বলতে চাই - হয়তো তারা সত্যি কিন্তু ভারতের সরকার না হয় স্বার্থ সিদ্ধির জন্য করেছে কিন্তু আমাদের কে যারা ঐ দিন থাকতে দিয়েছিলো ওরা সেদিন করেছিল একান্তই মানবতার জন্য - যে যাই বলুক না কেন আজ - আমি আজীবন ভারতের কাছে এবং ভারতের জনগণের কাছে ঋণী ; যখন মুসলমান পাকিস্তান লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী মুসলমান দের পশুর মত হত্যা করছে আর ঠিক তখনি এক মুসলমান পরিবার কে হিন্দু বিদেশি এক পরিবার আশ্রয় দিয়েছে , এটাই মানবিকতা ; মানবিকতায় মনে হয় ধর্ম অনেক উন্নত এক টি গুন। ধর্মের উপড়ে মানবিকতার জয়জয়কার ।
রাতটা ঘুমালাম - বি এস এফ এবং ঐ বাড়ীর মালিক ও মহিলারা আমাদের বিছানা বালিশ দিলো - সকালে চা- মুড়ি- চিড়া নাস্তা ও দিলো ; মা কে আসে নিয়ে গেলো অন্দর মহলে - বেশ বর্ধিষ্ণু পরিবার বলে মনে হলো - অনেক গুলো ঘর - পুকুর - টুকুর পাড়ে বেঞ্চি তে বসার জায়গা - অনেক বড় একটা গরুর গোয়াল - বিশাল আকৃতির তিন তিনটা খড়ের পালা - কোণ আইসক্রিমের মতো উপরে । সোনালী খড়। পুকুরের পরেই বিশাল আনারস বাগান আর কাঁঠাল বাগান - বাড়ির অন্যপাশে প্রধান সড়কের পাশেই ওনাদের বিশাল মুদি খানা দোকান - হাড়ি পাতিল থেকে শুরু করে সব পাওয়া যায় ; বড় মুদিখানার দোকান - তিন চার জন মানুষ কাজ করছে দেখতে পেলাম।
অনুগ্রহ আর উপগ্রহেঃ বেঁচে থাকা জি কি অসস্মানজনক তা আজ ও বেশ মনে আছে। মা' - সব কয়টা সোনার অলংকার দিয়ে দিলো বিনিময়ে পেলো ইন্ডিয়ান রুপি ঐ দিয়ে হাড়ি পাতিল কয়েকটা কিনা হোল - চাল - ডাল আর কয়েকটা বালিশ ও মাদুরের বিছানা এবং লেপ তোষক - জীবন যে কত প্রকট তা হাড়ে হাড়ে টের পেতে লাগলাম। একটা বোরো বিশ ফুট লম্বা - দশ ফুট চওড়া ঘরের এক কোণায় আমরা থাকি আর বাকি সবটাই খালি। ওঁদের বাড়ির বৈঠক ঘর ওটা - চার পাঁচটা চেয়ার আর একটা মস্ত বড় কাঠের টেবিল এই হলো আসবাব পত্র - আমরা মাটিতে মাদুর অরে তোশক পেতে ঘুমাই ;
পরে ছনের ছাউনি - দেয়াল টা লাল মাটির ২০ ইঞ্চি দেয়াল ছোট্ট দুইটা জানালা আর চারটা দরজা - আধো আলো আর আধো আঁধারি ঘর ; ভাগ্গিশ শেতসেতে ছিলোনা।
চুলাটা বাইরে প্রায় অনেক দূরে - একটা ছাপড়া এক চালা ওখানেই রান্না করে ঘরের ভিতর বসে খাওয়া দাওয়া করা - সারা দিন আর কোনো কিছু করার নাই - জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই আর পাহাড়ের শেষ প্রান্তে এসে তাকিয়ে তাকিয়ে দূরে আমার সোনার বাংলাকে দেখি - নয়ন ভরে , আর ভাবতাম ইশ কবে যে যাবো ফিরে নিজ গৃহে ?
শুরু হলো আমার এক নতুন জীবন, রান্না করতে হলে দরকার লাকড়ির, লাকড়ি কিনে আমার হাতে যে কয়টা পয়সা আছে তা শেষ হয়ে গেল কি উপায় হবে আমাদের ? ভেবে আম্মা আমাকে বলল, কালকে থেকে তুমি জঙ্গল থেকে লাকড়ি কেটে আনবা, শুকনো ডাল পালা, রাস্তার পাশে এই যে আগাছা জাতীয় চিকন মরিচা গাছ এই গুলোর ভিতরে অনেক শুকনো গাছ আছে ঐ গুল কেটে কেটে আটি বানিয়ে নিয়ে আসবা, কাঁঠাল গাছে অনেক শুকনো ডাল আছে ওগুলো কেটে বা দুমড়ে মুচড়ে বা ভেঙ্গে নিয়ে আসবা । একটা দা ধার করলাম ঐ বাড়িওয়ালা দের কাছ থেকে, ওটা নিয়ে প্রথম দিন চলে গেলাম যে বাড়িতে থাকি সেই বাড়ীর পুকুরের পিছনে ওদের বিশাল কাঁঠাল বাগান - কয়েক শ গাছ ওনাদের, এই এলাকা কাঁঠালের জন্য প্রসিদ্ধ । সব গুলো টিলা, বা পাহাড় গুলোতেই কেবল কাঁঠাল আর আনারস এর বাগান , খুবি ছোট একটা গ্রাম আমরা গ্রামের মধ্য খানে , বি এস এফ ক্যাম্পের সবচে নিকটবর্তি । আমরা যে ঘরে আছি ঐটার পরেই এই বাড়িওয়ালাদের একটা বিশাল মুদিখানা দোকান , গ্রামের একমাত্র । রাস্তার সাথে লাগানো, দাস বাবু আর ওনার দুই ভাই চালায় এটা , ওনাদের বাড়ীতে সর্ব মোট ১২ /১৩ টা ঘর, সব গুলোই ছনের এবং মাটির দেওয়াল , বাড়ীর বাইরে এদের একটা খোলা ঘর পূজার মণ্ডপ । এই এলাকায় প্রায় সারদিনই টিপ টিপ করে বৃষ্টি পরে তারপরও ওনাদের ঘর বাড়ী একদম ঝকঝকে পরিষ্কার । প্রত্যেক লেপালেপি চলছেই সর্বদা । খুবি চুপাচাপ পরিবার, আমাদের কে খুব ই আদর করতে লাগল তারা, দাস বাবুর স্ত্রী আম্মাকে খুবই পছন্দ করতে শুরু করলেন আর আম্মা ও সব মনের কথা, পেটের কথা, দুঃখ, সুখ, সব বলতে শুরু করলেন সানন্দে । কিন্তু ওদের ঘরের ভিতর ঢুকা নিষেধ , আম্মা ওনাদের বারান্দায় পিরি তে বসে গল্প করে সব জেনে নিলো এলাকা সম্বন্ধে , আমি লাকড়ি আনি সারা দিন একা একে, জোক, শুঁয়োপোকা, বিচ্ছু, চ্যালা, সাপ, বেঁজী দেখে লাফিয়ে উঠি, দৌড়ে পালিয়ে যাই ওখান থেকে আরেক দিকে, দুরুদুরু ভয় সর্বদা, এর আগে আমি জীবনেও কোনদিন গাছে চড়ি নাই, আমি এমনিতেই একটু আরামপ্রিয়, ধীর গতি সম্পন্ন, কষ্ট করতে অভস্থ নয় ধরেনের আর আমার উপড়েই এসে পরেছে সব চেয়ে কষ্টের কাজ খানা, আমাদের একমাত্র খাওয়া হল, সকালে রুটি, আর ডাল নয় চিনি বা গুড়, দুপুরে ভাত আর ডাল আর রাতে আলু ভর্তা ও ডাল । প্রত্যেক দিন ই এক খাওয়া, প্রায় এক সপ্তাহ যাবত, বিকালে ঐ বাড়ীর দুটো আমার বয়সী ছেলের সাথে বি এস এফ ক্যাম্পের মাঠে ফুটবল খেলা দেখতে যাই , এদিকে দাদা বাদ সাধলেন উনি বাড়ীতে চলে যাবেন ফেরত - স্বাভাবিক, উনি কত দিন থাকবেন এই ভাবে, এদিকে প্রতি দিন শত শত মানুষ, পরিবার। ভারে করে বহন করে আনা বৃদ্ধ মহিলা, পুরুষ দের বাংলাদেশ থেকে রিফ্যুজি আসতে লাগলো , তিন চার দিনের মধ্যে ঐ গ্রামের পাশেই খোলা পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত স্কুলের মাঠ, স্কুলের বারান্দা, তারপর স্কুল বন্ধ ঘোষণা দিয়ে ভরে গেল মানুষে । একদিন পর বি এস এফ একজন বলল এসে কাল কে থেকে ঐ স্কুলে ইন্ডিয়া সরকারের কর্মকর্তারা আমাদের সবাই কে রেশন দিবে । এই খবর শুনার পর আমাদের যে কি আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না । আমরা কেবল পাচ /ছয় দিন হোল এখানে এসেছি । আম্মা সোনা বিক্রি করে অল্প কয়টা টাকা পেয়েছিল, খুবই ভয়ে ছিল কেমনে কিনে খাবে চাল, ডাল তেল ইত্যাদি । রেশন দেওয়ার কথা শুনে আমরা হাফ ছেড়ে বাচলাম।
পরদিন দাদা চলে গেলেন, ওনাকে আমি ধ্বজনগর মসজিদ এর পুকুর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসলাম - দাদা যে কি এক মহা মানব তা প্রকাশ করার মত শব্দ আমার অভিধানে নেই , আমাকে আদর করে, চোখ মুছতে মুছতে উনি রওনা দিলেন আর আমি পাহাড়ের পাদদেশে ইন্ডিয়ার সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকলাম যতক্ষণ ওনাকে দেখতে পাচ্ছিলাম । এখন থেকে আমিই এই সংসারের একমাত্র পুরুষ, এত দিন দাদা ছিলেন সব দায়িত্ব ওনার ছিল, সব সিধান্ত আম্মা আর দাদা মিলে নিতেন , টুলু আপা সারাদিন আমদের দেখাশুনা আর রান্নায় আম্মাকে সাহায্য করতেই ব্যস্ত । ঘর গুছানো আরেক জনের বাড়ী অপরিষ্কার রাখা ঠিক তা, ঝাড়ু, গোবর দিয়ে লেপা, ছুলার এলাকা ধুয়ে মুছে রাখা করতে করতেই ওর দিন শেষ - সারাদিন সে টুম্পা আর ছোটন নিয়েই ব্যস্ত । আম্মা একেবারে বিমর্ষ হয়ে গেল দাদা চলে যাওয়াতে - কেমন জানি ভেঙ্গে পরল দুই দিন ।
ইতিমধ্যে আগের দিন ঘুম থেকে উঠেই চলে গেলাম স্কুলে, রেশন আনার জন্য , ও মা গিয়ে দেখি কম করে হলে দুই তিনশ মানুষ, আমি দুইটা ব্যাগ, একটা শিশি আর একটা বস্তা ওনাদের দোকান থেকে নিয়ে গেলাম । আমার কোন ধারনাই নাই কি পাব, ওনারা বলল বোতল নিতে, চাল, ডাল দিবে , তেল দিবে আর পেয়াজ। সবাই লাইন ধরে বসে থাকল আমি জায়গা পেলাম প্রথম দিকে, কিছুক্ষণ পর দেখি আম্মা এসে আমাকে খুঁজছে , আমি বেশ সবার সাথে গল্প মাতোয়ারা এমন সময় দেখি আম্মা । আম্মা এসে আমার সাথে বসল মাটিতে কয় মিনিট পর দেখি আম্মা শাড়ির আচল দিয়ে চোখের পানি মুচছে । আমি নিজেই লজ্জা পাচ্ছিলাম এভাবে লাইন ধরে বসে থাকতে, জীবনেও কোন দিন বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাজারে যাই নাই। আম্মার কাস্টমস অফিসের পিওন, নইলে আব্বার ব্যাটম্যান মস্তফা কাকা বা ইলিয়াস কাকা বাজার করে আনত সব সময় , রবি বারে আম্মার সঙ্গে নিউমার্কেটে যেতাম বাজার করতে । আব্বা নিয়ে যেত সঙ্গে কিন্তু একা এভাবে এই প্রথম , তাও আবার রিলিফের জন্য । আমরা এমন কোন আহামরি বড়লোক পরিবার ছিলাম না, কোন বিরাট কর্মকর্তা ও ছিল না আমাদের পিতা বা আম্মা , নেহায়েত ছোট খাট একটা চাকরি করতেন তারা দুজনেই, কিন্তু, আমাদের জিবন এ ছিল অনেক আরাম, পাকিস্তান আমলে যে সব পরিবারের স্বামী স্ত্রী দুজনেই চাকরীজীবী ছিল তাদের জীবন ব্যবস্থা টা অন্য দশটা পরিবাবের মত ছিল না, তা ছাড়া, আমাদের আম্মা ছিলেন একজন ঢাকা ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট, বড় হয়েছেন কলকাতায় তখনকার বিশ্বের অন্যতম বিশাল কসমোপলিটান নগরী তে ।
রেশন এর গাড়ী আসতে দেরী হচ্ছিলো, রিলিফের কর্মকর্তা রা বার বার এসে ক্ষমা চাচ্ছিলেন ; বিশৃঙ্খলা দেখা দেবার কারন হতে পারে তাই - ওরা বলল, আমাদের সাহায্য দরকার , আম্মা উঠে গিয়ে কথা বলল ওনাদের সাথে, সঙ্গে সঙ্গে কর্মকর্তাদের প্রধান একটু পরে আম্মাকে ডেকে বললেন আপনি আমাদের একটু সহায়তা করেন নাম গুলো লেখতে আর পরিবারের সদস্য কয় জন তা লেখতে ওদের মাস্টার রোলে ( ঐ দিন এই নামটা শিখলাম ) আম্মা ওনাদের দুই জন কে সাহায্য করল ইংলিশে নাম গুলো লেখার, ইতিমধ্যে দুইটা ট্রাক বিশাল বিশাল উঁচু কাঠের বানানো বডি এই প্রথম দেখলাম , বেলা ১ টার দিকে শুরু হল রেশন দেওয়া, প্রায় ৭০ টি পরিবার, মানুষের হাহাকারে মুখর হয়ে গেল ঐ শান্ত, ঘুমন্ত গ্রাম টা, এর মধ্যেই এসে হাজির হল রেডক্রস এর একটা জিপ, পাউডার মিল্ক দিল প্যাকেট প্যাকেট করে, ইন্ডিয়ান রিলিফ কর্মকর্তাদের ধৈর্য দেখে অবাক সবাই । এত স্নেহ এবং এত মার্জিত আচরণ অবিশ্বাস্য- আম্মা ওদের সাথে স্কুলের বারান্দায় চেয়ার টেবিলে বসে বসে কাজ করতে লাগলো, আমি রেসন নিয়ে আম্মার জন্য অপেক্ষা করলাম কারন অতো কিছু নিয়ে আমার একার পক্ষে আসা সম্ভব হত না । আবার দুই দিন আসবে ওনারা , আম্মাকে আস্তে বলল, আম্মা ওনাদের কাছ থেকে অনেক কিছু জেনে নিল, আগরতলা কেমনে জেতে হবে, ওরা বলল কোথায় জয় বাংলা অফিস ইত্যাদি ।
রাতে রেডিও তে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনলাম অনেকক্ষণ । সকালে আবার লাকড়ি কাটা, দুপুরে আম্মা বলল কালকে সকালে আম্মায়ে সাথে যাওয়ার জন্য , আমাদের ওখান থেকে সাত মাইল হেঁটে গোকুল নগরে যেয়ে ওখান থেকে বাসে আগরতলা, ওখানে জয় বাংলা অফিসে যেয়ে আব্বার খবর, এবং আমাদের ফুফু মমতাজ বেগম এম এল এ খোঁজ নিবার জন্য । সকালে উঠেই রওনা দিলাম যে রাস্তা দিয়ে রিলিফ এর ট্রাক এসেছিল ঐ রাস্তা ধরে হাটা সুরু করলাম, সারা রাস্তাই কাদায় ভরা, স্যান্ডেল হাতে নিয়ে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে পোঁছলাম গোকুলনগর, ঐ গ্রামের পাস দিয়েই চলে গেছে আরগতলা - সাভ্রুম রোড, ওখান থেকে বাসে উঠলাম সেই ব্রিটিশ আমলের মিলিটারি লরি দিয়ে বানানো বাস , আমরা উঠতেই বলল জয় বাংলা নাকি? আম্মা বলল জি, আর ভাড়া চাইলো না ; অনেক পথ আগরতলা- ওখানে যেয়ে হেঁটে হেঁটে গেলাম জয় বাংলা অফিসে, অনেক কষ্টে দেখা পেলাম ওখানকার প্রধান জহুর আহমেদ চৌধুরী সাহেবের সাথে , আম্মা আব্বার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল না কোন খোঁজ দিতে পারব না, বলে উঠে যাওয়ার সময় আম্মা বলল আমাকে কি আমার ননদ মমতাজ বেগম এম এল এ ঠিকানা দিতে পারবেন ? উনি বলল আপনারা বাইরে অপেক্ষা করেন উনি যে কোন সময় আসবে এখানে , উনি থাকেন বিশালগড় এ । আমরা দুইজন অফিসের নিচে ঘাসে বসে থাকলাম , অনেক মানুষ, চৌধুরী সাহেব খুবই ভাল মানুষ মনে হল , আমাদের কিছুক্ষণ পর ডেকে আম্মার সাথে কথা বলল, আমাদের কে পাঁচ টা টাকা দিলেন আর বললেন কিছু খেয়ে আসেন আর এই নেন দুটি কম্বল । আমরা সামনের দোকান থেকে বন রুটি আর কলা খেলাম , সেই প্রায় বিকেলের দিকে ফুফু আসল, একটা জিপে করে , শাল গায়ে জড়ানো, আম্মাকে দেখে জড়ায়ে ধরল, আজিজ কাকা আম্মাকে সালাম করলেন , আমাকে ও হ্যালো বলল, আমি ওনাদের আগে কখনো দেখছি বলে মনে পরল না , ফুফু জিজ্ঞেস করল সব খবর , বলল ভাইজান মতিনগরে ট্রেনিং নিচ্ছে , অনেক কথা বলল তার পর বলল আমাদের কে অপেক্ষা করতে, আমরা ওনাদের গাড়ীতে ফেরত আসলাম আমাদের ঘরে পৌঁছে দিল। অনেক কথা বলল, ভাবি দুই দিন পর বিশালগড় আসেন, ভাইসাব রে খুঁজে বের করছি আর আপনাদের জন্য রিফ্যুজি ক্যাম্প ব্যবস্থা করছি , দুই দিন পর যাইতে বলল , ওনার আব্বা এবং আম্মা সবাই আছে বিশালগড়ে, ওনার বাসায় অনেক লিডার রা আসবে ঐ দিন, আম্মাকে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় নিলো । আমরা হাফ ছেড়ে বাচলাম , আমাদের বাড়ী ওয়ালা রা সবাই জিজ্ঞেস করল কারা এনারা । আনন্দে আমরা সবাই সেদিন কেঁদে ফেললাম , আমেনা ফুফু ( ওনার ডাক নাম ) যে কি এক মহীয়সী ত্রাণকর্তা তার বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব । ঐ দিন থেকে উনি আমাদের সম্পূর্ণ দায় দায়িত্ব গ্রহণ করল । হাতে আকাশের চাঁদ পাওয়ার সমান, ওনাকে যদি না পেতাম তাহলে আমাদের পরিবারের ইতিহাস অন্য ভাবে রচিত হত আজ । কৃতজ্ঞতা মত ধৃষ্টতা আমার নাই, মমতাজ ফুফুর কাছে আমার পরিবার আজীবন কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ।
আজিজ কাকা গাড়ী চালাচ্ছিল ফুফু ফুফু আর আম্মা সামনের ছিটে আর আমি আজিজ কাকার ছিটের পিছনে বসা । আগরতলা থেকে গাড়ীটা যাত্রা শুরু করলো সন্ধ্যা হয় হয় সময়, রাস্তায় অনেক গল্প হোল । আমি মাঝখানে বললাম যে আমি ওনাদের গ্রামের বাড়ীতে গিয়েছিলাম , রফু কাকার কথা বললাম, উনি কি ভাবে ওখানকার যুবক দের কে ট্রেনিং দিচ্ছে, ইত্যাদি । ফুফু তখন বলল কিভাবে উনি আর আজিজ কাকা কর্নেল ওসমানী সাহেব কে মুরাদনগর থেকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিল এবং তার পর আজিজ কাকা ওনার ৫০ সি সি হোন্ডা তে করে উনাকে আগরতলায় পৌঁছিয়ে দিয়েছিল । আমরা যখন আমতলী পার হয়ে একটু সামনে গেলাম তখন ফুফু বলল হাতের ডান দিকে একটা জঙ্গল দেখিয়ে, এই জায়গায় একটা নতুন রিফ্যুজি ক্যাম্প খোলা দশ বারো দিনের মধ্যে , এটা স্পেশাল ক্যাম্প সব শীর্ষ স্থানীয় নেতা, রাজনীতিবিদ, সরকারী কর্মকর্তা, এবং অন্যান্য ভি আই পি দের জন্য। একটা স্পেশাল ক্যাম্প, উনার জন্য তিনটা রুম বরাদ্দ হয়েছে , কিন্তু উনি বিশালগড়েই থাকবেন , ঐ বাড়ীটা ওনার আব্বার খুবই প্রিয় বন্ধুর বাড়ী ওরা আগরতলায় থাকে আর ওদের বিশালগড়ের বাড়ীতে ফুফু, আজিজ কাকা, ফজলু কাকা , দাদা , দাদী আর ফুফুর দুই ছেলে লিটন ও চন্দন থাকে , ওখান থেকে ফুফুর সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন উনি, যাদের ঐ বাড়ীটা ওনাদের কসবার বাড়ীটা দাদা ক্রয় করেছিল দেশ বিভাগের পর । এই পরিবার এক সময় কসবার জমিদার ছিল । ওনাদের কসবার বাড়ী এবং কুঠি বাজারের গুদাম দুটোই ফুফুর আব্বা আমাদের গনি মিয়া দাদা কিনে নিয়েছিল ; উনি কসবায় জুতার দোকান চালাতেন ওনারা দুই ভাই মিলে , উনি এক সময় আমার দাদার সাথে কলিকাতায় চাকরী করতেন । এই সব শুনলাম গাড়ীতে বসে । আমার কথাবার্তা শুনে এবং আমার স্মার্টনেস দেখে প্রথম দেখাতেই আজিজ কাকা আমাকে খুব পছন্দ করে ফেললেন , এবং উনার সাথে আমার সম্পর্ক সেই দিন থেকেই খুব সুন্দর একটা চাচা ভাতিজা হৃদ্যতায় পরিণীত হল ।যা পরে আরও আদরের এবং স্নেহের বন্ধনের হয়েছিল ; আজিজ কাকা আমাকে অত্যন্ত মায়া করতেন সব সময় ।
আবার দ্বিতীয় দিন গিয়ে রিলিফের রেশন আনলাম, আম্মা আর ছোটন সাথে গেল, আমি আর আমার ছোট ভাই লাইনে দাঁড়ালাম, ইতিমধ্যে আরও ১৫০ - ২০০ পরিবার এসে গেছে , সে এক হৃদয় বিদারক অবস্থা, শত শত মানুষ, কারোরই পড়নে ভালো কাপড় চোপর নাই, পুরুষ রা খালি গায়ে, বাচ্চারা শুধু হাফ পেন্ট পরা খালি গা, না খেয়ে সব শুকিয়ে কাঠ, একেকজন ঢাকা, ফরিদপুর, কুমিল্লা, নবীনগর, নাসিরনগর, হোমনা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মুনশিগঞ্জ, বিক্রমপুর, মতলব, কসবা , ব্রাহ্মণবাড়ীয়া থেকে এসেছে, অনেকেই সর্বস্বান্তহীন, অনেকের বাড়ী ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, কারো পরিবাবের সদস্য কে গুলি করে হত্যা করেছে , গ্রাম কে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, শত শত পুরুষ দের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, অনেক যুবতী মেয়ে, গৃহ বধূ দের উঠিয়ে নিয়ে গেছে । এদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষিত, শিক্ষক, সরকারীজীবী, ব্যবসায়ী, পেশাদার - সবাই লজ্জায় শরমে দৈনতায় বিহ্বল, রাস্তার পাশে, মাঠের মধ্যে, পরিতেক্ত ভিটা বাড়ীতে ছন, গাছের পাতা, বাস, গাছের ডাল পালা কেটে তা দিয়ে ছাপরা ঘর বানিয়ে দিনাতিপাত করছে । না আছে পানির ব্যবস্থা, না আছে গোসল করবার জায়গা, না আছে পয়নিষ্কাসনের ব্যবস্থা । কেই একদম নীরব। চুপচাপ বসে আছে, আবার কেউ ক্লান্ত, চোখে মুখে এক অনিশ্চয়তার ছাপ, আবার কেউ কেউ উগ্র, মারমুখী এ যে কি ধরনের পরিস্থিতি তা না দেখলে কাউকে লেখে বুঝানোর কোন উপায় আমার জানা নাই । ইতিমধ্যে এই বারের রেশন দেবার সময় গোকুলনগর থেকে দুই একজন নেতা ধরনের মানুষ রিলিফ কর্মকর্তা দের সাথে এসছে , ওনারা সবাই অনেক সাহায্য করছেন , জনগণ কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, এনারা সবাই ই আওয়ামী লীগ এর নেতা গোছের মানুষ - তারা সত্যিই খুব সদয় মানুষ ছিলেন , রেশন মাপা থেকে, লাইন ঠিক রাখা, সবাইকে সঠিক ভাবে মেপে দেওয়া, বাচ্চাদের মিল্ক পাউডার এর প্যাকেট বিতরণ এই সব ওনারা ইন্ডিয়ান রিলিফ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করছিল। আম্মা রিলিফ কর্মকর্তা দের খুবই প্রিয় ভাজন হয়ে গেলেন দুই দিনেই , বাংলা - ইংলিশ এ সব নাম, বাচ্চাদের নাম, বয়স, পরিবারের সদস্য সংখ্যা লেখা লেখি নিয়ে রীতিমত ব্যাস্ত হয়ে পরলেন । সম্পূর্ণ স্কুল এর আসে পাশে, বি এস এফ ক্যাম্পের নিকট বর্তি মাঠে, কাঁঠাল বাগানে জয় বাংলার মানুষের পদচারণায় ঘুমন্ত এই গ্রাম টা চোখের পলকে মুখরিত হয়ে গেল - আশ্চর্য হবার বিষয় হল যে, এলাকার গ্রামবাসীরা , ব্যবসায়ীরা, জমিনের মালিকরা, কাঁঠাল বাগানের ইজারাদাররা কেউই একটা উচ্চবাচ্য করলো না বা কাউকে বাঁধা দিল না - সে এক অপূর্ব দয়াশীলতা । কাউকে কোন প্রকার প্রশ্ন করা ছাড়াই রিলিফ দেওয়া, রেশন দেওয়া , ওষুধ দেওয়া এবং কারোর সাথে কোন রকম বাক বিতণ্ডা, ঝগড়া ঝাটি না করে ইন্ডিয়ান কর্মকর্তা রা যে ভাবে ঐ প্রথম কয় দিনের মধ্যেই সকল শরণার্থী দের মন জয় করে নিলো । ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে কারোর অনুকম্পায় খাবারের চাল, ডাল, তেল, লবণ, পেয়াজ পাওয়া যে কি ধরনের লজ্জ্যা জনক একটা ব্যাপার তা আর কেউ উপলব্ধি করুক আর না করুক আমার কাছে খুবই লজ্জাজনক মনে হল - কিন্তু, আমাদের আর কোন উপায়ও ছিল না সেই সময় , আত্মসম্মান কে বিসর্জন দেওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না তখন আমাদের সামনে ।অন্যের কৃপায় জীবন বাঁচা মনে হয় এই পৃথিবীর অন্যতম লজ্জাস্কর একটি কাজ । আম্মা কে রেখেই আমি আর আমার ছোট ভাই রেশন অনেক কষ্টে নিয়ে ঘরে ফিরলাম সেই দিন, বাসায় সব কিছু রেখে আমি একা আবার ছুটে গেলাম স্কুলে আম্মাকে নিয়ে আসার জন্য ।
পরদিন খুব সকালে উঠে আবার ৭ মাইল হেঁটে পৌঁছে গেলাম গোকুলনগর, ইতিমধ্যে গোকুলনগর আমাদের মানুষে একে বারে ভরে গেছে । রাস্তার দুই পাশে শত শত ছাপরা ঘর উঠে গেছে রাতারাতি , আহ মানুষের কষ্ট দেখে মন টা কেঁদে উঠল । কেই ই কোন কথা বললাম না , সোজা চলে গেলাম মেন রোডে , গিয়েই সঙ্গে সঙ্গে বাস পেয়ে গেলাম, উঠে বসলাম, আই বার টিকেট এর পয়সা নিলো কন্ডাক্টার । অনেক পথ হেঁটে এসে ঘামে ভিজে গেছিলাম, বাসে উঠেই জানালা দিয়ে দেখতে লাগলাম নয়ন ভরে দেখতে লাগলাম প্রাকৃতিক দৃশ্য, অপূর্ব সুন্দর পাহাড় গুলো একদম আমার দেশের মত তেলিয়াপারা থেকে ট্রেনে সিলেট জাওয়ার পথে এ রকম জায়গা আমি অনেক বার দেখেছি , রাস্তায় দেখলাম দুই পাস ভরতি আমাদের শরণার্থী কেই হাঁটছে আবার একদল বসে আছে উলটো দিকের বাসের জন্য, কয়েক হাজার মানুষ। যতই দেখি ততই মনে পরে যায় আমার পলায়ন এর কথা, প্রথম রাত্রের সেই দৌড়, দুপাশ থেকে গোলাগুলির ভয়ঙ্কর আওয়াজ, বিমান হামলার সেই বিভীষিকা, সেই পচা ডোবার পানি খাওয়ার কথা, আর ভাবি কেমনে যে আসলাম এই পর্যন্ত ? আম্মা বাসে তেমন কোন কথা বলল না খুব একটা । এসে নামলাম বিশালগড়ে, দু এক জায়গায় জিজ্ঞেস করেই পেয়ে গেলাম ফুফুদের বাড়ী । একটা আলাদা বাড়ী চার ভিটায় চারটা ঘর , এর মধ্যে একটা ঘর টিনের দোতলা, সেই যেরকম দোতলা ঘর । ঘরে ঢুকেই দেখি বিরাট মিটিং চলছে , আমরা ভিতরে গিয়ে বসলাম , তারপর সবাই এক সাথে মাটিতে বসে ভাত খেলাম , তারপর আম্মা কে পরিচয় করিয়ে দিলেন অনেক শীর্ষ স্থানীয় নেতা দের সাথে , শেখ মনি ও ঐ দিন ওখানে ছিল ( আমি ওঁনার নাম এই প্রথম শুনলাম , আগে কখনো শুনি নাই - আজিজ কাকা আস্তে করে বললেন উনি , বঙ্গবন্ধুর বোনের ছেলে ) ফুফুর দুই ছেলে লিটন ও চন্দন আমার বন্ধু হয়ে গেল। দাদা আম্মাকে খুবই স্নেহ করতেন , আম্মাই নাকি দাদা কে অনুরোধ করেছিল ফুফু কে কলেজে পড়তে দেবার জন্য, আমাদের বর্ধিত পরিবারের মধ্যে আমার আম্মাই সবচে বেশি শিক্ষিত বউ ছিল তাই সবাই আম্মার পরামর্শ নিতেন । আম্মা এবং ফুফুর সম্পর্কও ছিল খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ, আম্মাকে খুবই সম্মান করতেন আমেনা ফুফু , আমি এদের নাম ই শুনেছি - এই দ্বিতীয় বার দেখলাম অনাকে , অনাদের সবাইর সাথে মিলিত হলাম এই প্রথম, খাবার সময় ফুফু ঘোষণা দিল, বললেন , ভাবী তোমারা যত তাড়াতাড়ি পার সূর্যমণিনগর স্পেশাল ক্যাম্পে উঠে পর। তোমাদের জন্য দুইটা রুম আর আমাদের জন্য একটা রুম খালি রেখো অন্য কেউ আসলে জায়গা দেওয়া যাবে । রুম এ - ১ - ২ - ৩ তোমাদের , দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে ওখানে উঠে পর । আমার নাম বললেই ওরা তোমাদের ঢুকতে দিবে, আর অহ ভালো কথা, অনেক কষ্টে বাবুল কে ছুটির ব্যবস্থা করেছি ও কালকে যাবে তোমাদের ওখানে । আরও বলল যে, আমি সব খানে খবর পাঠিয়েছি খোকা ভাই খোঁজ বের করে দিতে ; তিন চার দিন এর মধ্যে সব পেয়ে যাব। আজিজ কাকা আমাদের ক্যাম্পের ঠিকানা লিখে দিল, বলল, ভাবী আমিই আপানাদের নিয়ে যেতাম আমার গাড়ী করে কিন্তু আমার অনেক জায়গায় মনি ভাই ( শেখ মনি ) কে নিয়ে যেতে হবে । আজিজ কাকা শেখ মনি অন্যতম বিসস্থ সহচর ছিল যুদ্ধ কালীন সময়ে । আমরা সন্ধ্যার আগে আগেই রওনা দিতে চাইলাম কিন্তু যেতে দিল না ।
পরদিন আমরা বাসে করে চলে আসলাম , এসেই সংবাদ গুলো দিলাম সবাই কে , বাড়ীওয়ালা জিজ্ঞেস করলাম ঐ জায়গাটা কত দূরে, উনি আমাদের বলল একটা ভার ওয়ালা নিয়ে দিবে যেদিন আমরা যাবো - ঐ ভার ওয়ালা আমাদের রাস্তা চিনিয়ে ওখানে নিয়ে যাবে কোনাকুনি গেলে ৬ মাইল আর নাহলে ৭ মাইন হেঁটে গোকুলনগর যেয়ে তার পর বাসে ৫ মাইল আগরতলার দিকে যেতে হবে এর থেকে হেঁটে গেলে তাড়াতাড়ি পৌছতে পারবেন বললেন দাস বাবু । এনারা যে কি মহান মানুষ তা বলে শেষ করা যাবে না , বলল আপনদের যে সব তোশক, আর লেপ, কাঁথা দেওয়া হয়েছে ওগুলো ফেরত দিতে হবে না। আর থালা, বাসন, হাড়িম গ্লাস, ও অন্যান্য যা কিছু আমরা ওনাদের দোকান থেকে নিয়েছি ওসবের পয়সাও দিতে হবে না । ওনার স্ত্রী আম্মাকে দিদি বলে ডাকতেন , একদম জড়িয়ে ধরে বললেন দিদি তুমি আমার ছোট বোনের মত, আমরা এখানে আছি কোন সময় কোন কিছু প্রয়োজন হলে চলে এসো, আর শরণার্থী শিবিরে ভাল না লাগলে আমাদের ঘর খালি থাকবে সব সময় তোমাদের জন্য ।
পরদিন সকালে উঠেই দেখতে পেলাম হাজার হাজার মানুষ এসে ঢুকে পরেছে আমাদের আসে পাশে। যে যেখানে পারছে গাছের নিচে, রাস্তার পাশে, ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে, বৃদ্ধ মা বাবা দের নিয়ে আসছেই ক্রমাগত । অনাদের দুর্দশা এবং অনাদের চোখে মুখে ভয়, অনাহার, অস্থিরতা দেখে মনটা খুবি খারাপ হয়ে গেল, তবে ইন্ডিয়ার জনগণ খুবি সাহায্য প্রবণ ছিলেন, তাদের কাঁঠাল বাগান, আনারস বাগান, পুকুর পার, অনাবাদী জমি, পরিত্যাক্ত ঘর বাড়ী শরণার্থীরা যে যেমনে পারছে প্রবেশ করছে,তাতে মালিকরা কোন প্রকার বাধা বা কোন রকমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল না । অনেকের মুখেই শুনলাম, ওদের পরিবারের যুবতী মেয়েকে উঠিয়ে নিহে গেছে পাঞ্জাবীরা । অত্যাচার করে হত্যা করে ফেলে গেছে , ঢাকা এলাকার খ্রিস্টান একটা পরিবার তাদের দুর্দশার কথা আমাদের কে বলল। আম্মা, আমি এবং আপা অনেক পরিবার দের কে পানি দিলাম, ছাপরা ঘর বানাবার জন্য, আমাদের বাড়িওয়ালা কে বলে ওনাদের খেড়ের পালা থেকে খেড় নিয়ে দিলাম। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, একই গ্রামে ত্রিপুরা (মঙ্গোলিয়ান ) সম্প্রদায় এর মানুষ রা খুবই অসহযোগিতা করেছে আমাদের মত সকল শরণার্থী দের সাথে, একটা হাসিও কোনদিন দেয় নাই , সাহায্য তো দূরের কথা, ওদের জমিনে, ওদের বাঁশ ঝাড়ে, ওদের আনারস বাগানে বা ওদের বাড়ীর ত্রিসীমানায় ঢুকলেই তাড়িয়ে দিত দুর্ব্যবহার করে । আসলে তখন ই বুঝলাম, জাতিগত এথনিসিটি কি প্রয়োজনীয় । আরেক টা অসামঞ্জস্য উপলব্ধি করলাম, যে, ইন্ডিয়ান মুসলমান রা আমাদের প্রতি কেমন জানি উন্নাসিক ছিল । ওরা আমাদের ব্যথায় কেমন জনি কম ব্যাথিত ছিল বলে মনে হল । আশ্চর্য ! আমরা যেই গ্রামে ছিলাম ঐ গ্রামে চার পাঁচ ঘর মুসলমান ছিল - ওরা কাউকে ওদের বাড়ীতে আশ্রয় দেয় নাই, ওদের বাড়ীর আশেপাশে কোন শরণার্থী পরিবার রা খালি জায়গা বা পরিত্যাক্ত বাড়ীতে প্রবেশ করতে দেয় নাই । একটু অবাক হবার মত ব্যাপার। ইতিমধ্যে আম্মা উনার ১৯৪৬ সালের কলকাতার দাঙ্গার সময়কার নার্সিং জ্ঞান এর প্রয়োগ করা শুরু করে দিলেন ঐ সব নতুন আগত বাংলাদেশী দের উপর , বাচ্চাদের কে কাটা কাটি ধুয়ে, ডেটল দিয়ে আর আয়োডিন দিয়ে পরিষ্কার করে পরিষ্কার নাক্যরা দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিতে শুরু করলো । অনেক বৃদ্ধ মানুষের অত পথ হাতার কারণে পা, গোড়ালি ফুলে গ্যাছে ঐসব বৃদ্ধ দের জন্য পান খাওয়ার চুন আর হলুদ বাটা মিশিয়ে তা কুপি দিয়ে গরম করে পায়ে, গোড়ালি, বা হাঁটুতে প্রলেপ দিয়ে দিতে শুরু করল, পানি কিভাবে গরম করে তারপর ঐ পানি পান করা উচিত। কোন স্কুলের মাঠে গেলে রেশন এবং রিলিফ পাওয়া যাবে এসব সবাইকে অবগত করে দিতে শুরু করে দিলো শাড়ীর আচল শক্ত কোমরে বেঁধে, টুলু আপা সবচে বেশী কষ্ট করতে শুরু তখন, আম্মাকে সব কাজে সাহায্য, আমাদের সবার রান্না করতে আম্মাকে সাহায্য, পুকুর থেকে সব ধুয়ে মুছে আনা, আমার সাথে পানি আনতে সাহায্য করা, আমি জংগল থেকে যেই সব লাকড়ি কেটে আনতাম ও সেগুলো আবার শুকাতো রোঁদে, তারপর যে আগাছা জাতীয় গাছ গুলো কেটে আনতাম ঐ গুলো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দিয়ে শুকানো এসব সব ওকেই করতে হত । ছোট দুই ভাই সারাক্ষণ আপাকে টুকটাক সাহায্য করতো, ওরা দুই জনেই শুকিয়ে হাড্ডি সর্বশ । হাতে, পায়ে, কুঁচকিতে শুরু হল এক ধরনের চুলকানি , সারাক্ষান চুলকাতে থাকতো অনবরত । চোখ উঠাও শুরু হল ইতিমধ্যে ।
আম্মা সিধান্ত নিলো আমারা পরশু দিন রওয়ানা দিব এখান থেকে আমাদের নতুন আভাশস্থলে । দাস বাবু কে বলার সাথে সাথে উনি এক টা ভার বহনকারী কে ডেকে আনালো এবং দামদর চুকিয়ে উনিই ঐ লোককে বলে দিলো পয়সা উনিই দিবেন, আম্মা বাধা দিতে চেষ্টা করল কিন্তু উনি কিছুতেই শুনলেন না । অপূর্ব ছিল ওনাদের আতিথেয়তা । আজীবন মনে থাকবে তাদের কথা শ্রদ্ধাভরে । আমাদের সব জিনিস দেখেই ভারওয়ালা বলল এক ভারেই হয়ে যাবে - দাস বাবু ওকে কোথায়, কোন পথ দিয়ে নিয়ে যেতে হবে তা সব বুঝিয়ে দিলেন সুন্দর ভাবে ।জিনিস এর মধ্যে, তিনটা বালিশ, একটা লেপ,একটা চাঁদর , চারটা কেথা, মাদুর, পাটি ২ টা , আমাদের সেই দুইটা কাপড়ের গাট্টী, সানকি ৬ তা, মাটির তিন চারটা হারি, আল্যমিনিয়ামের পানির গ্লাস, দুইটা হাড়ি, আর অল্প কিছু টুকটাক মসলা পাতি এই আমাদের সংসার । ওজনে আধা মন হবে মনে হল। আম্মা আব্বা দুই জনের চাকরিই ছিল বদলী যোগ্য , এখনও স্পষ্ট মনে পরে আমাদের বাসায় কত জিনিশ ছিল, খাট, জাজিম, কত ফার্নিচার, কত বই, ইজি চেয়ার, আম্মার এজমার জন্য স্পেশাল চেয়ার সেই বেনাপোল থেকে কাঁঠাল গাছ কেটে বানানো হয়েছিল ঐ স্পেশাল চেয়ার গুলো। বদলী হবার সময় আব্বার কোম্পানির লোকেরা এসে ফেটিক পার্টি ( ইংলিশ শব্দঃ ফ্যাটিগ দল) এসে সযত্নে , সব ফার্নিচার খুলে পাটের বস্তা দিয়ে পেঁচিয়ে লাল কালি দিয়ে নাম ও কোথায় যাবে এবং কোথাকার ঠিকানা থেকে এসেছে সব ঐ পাটের হেসিয়ান ক্লথের উপর লিখে তারপর ঠেলা গাড়ী করে রেলস্টেশন এ নিয়ে গিয়ে গুডশ ট্রেনে পাঠানো হত আবার আনেক সময় আমাদের সঙ্গেই একই ট্রেনে নিয়ে যেতাম , সেই রাজশাহী থেকে খুলনা, খুলনা থেকে নীলফামারী, বেনাপোল থেকে রাজশাহী, যশোর থেকে সিলেট , জগন্নাথগঞ্জ ফেরি - সিরাজগঞ্জে নামা - প্যাডেল স্টিমার এ করে সারা রাত জার্নি, রেলের বুফে কার এ অর্ডার দিয়ে মাটন কারী, ওহ সে জি কি মজার ছিল সেই মাটন, বুফে কারের কয়লার চুলায় রান্না করা মাংসের আঁক আলাদা স্বাদ, সব শেষে এগ পুডিং আহা মুখে পানি চলে আসার মত । বাহাদুরাবাদ ঘাট এ নেমে বালু চরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে হেঁটে উঁচু ব্রড গেজ রেলের বগির হাতল ধরতে পারতাম না এত উঁচু ছিল ও গুলো, আব্বা বা আম্মা বা মুরশিদ কাকা কোমরে ধরে উঁচু করে হাতল টাকে নাগালের মধ্যে এন দিলে উঠতাম বগীতে - তখন ট্রেনে ইন্টার ক্লাস বলে একটা ক্লাস বলে একটা ক্লাস ছিল । ওটাতে করেই আমরা যেতাম । স্পষ্ট মনে পরে লাহিড়ী মোহন পুড়ের সন্দেশ, আখাউরা তে ট্রেনে উঠত বজলু মিয়া তার বাতের বড়ি বেচতে, ঘোড়াশাল এ সাগর কলা কিনে খাওয়া, দর্শনায় খেজুরের রস, পার্বতীপুরের শিক কাবাব ও পরোটা, কুলাউরা স্টেশনের রিফ্রেশমেন্ট রুমে লম্বা বিশাল কাঠ আর বেতের বুনানো ইজি চেয়েরে হেলান দিয়ে শুয়ে লাতুর ( শাহবাজপুড়ের ) ট্রেন এ এসে সিলেট গামী গাড়ীর জন্য গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা - উঠে যেয়ে প্লাট ফর্মের এই মাথা থেক ঐ মাথা পর্যন্ত পায়চারী করা আর আজ আমরা কোথায় , জীবনের কি ছন্দপতন। একটা মাত্র ভার সর্বশ আমাদের পাঁচ জনের সংসার । কি এক অনিশ্চিত জীবন, যোগাযোগ বিচ্ছিন সবার সাথে, আব্বা বেছে আছে কিনা জানিনা, মানু আপার কি অবস্থা ? আম্মা প্রায়ই বলত পৃথিবীর অনেক দেশ যেমন আমেরিকায় কৃষ্ণরা ওদের অধিকারের জন্য অনেক দিন যাবত লড়ছে, ভিয়েতনাম এ স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে অনেক দিন যাবত, আম্মা কিউবার কথা বলত আর এটাও বলত সবাই তৈরি হও কারণ এই যুদ্ধ অনেক বছর চলতে পারে । আর বলত, আমাদের জীবন্দশায় হয়ত আর কোন দিন ফিরে যেতে পারব না । রাতারতি আমি ঐ অল্প বয়েসেই শিখে ফেললাম অনেক কিছু, মুখে মুখে শুনে শুনে । জাতিসংঘ, মার্কিন, যুক্তরাজ্য, কিউবা( নাম টা আগে জানতাম শুধু চে গুভারাকে দিয়ে ) , ভিয়েতনাম এর নাম কোন দিন শুনি নাই এর আগে, গেরিলা শব্দটি ও নতুন, রিলিফ আরেকটা শব্দ, শরণার্থী, রেডক্রস মানে মিল্ক পাউডার আর ওষুধ, এবং সুরমা কচু ; এক ধরনের কচু যেটা জংগলে হয় ওটা ছিঁড়ে বা কেটে আনলে ওটা দিয়ে সবজি রান্না করা যায়, কোন কাঁঠাল বাগানে গেলে অনেক সময় কাঁচা কাঁঠাল পরে থাকলে নিয়ে আসতাম আম্মা ঐ কাঁঠাল দিয়ে বেশ মজার একটা ঘণ্ট জাতীয় কি একটা রান্না করত, এসব সব শিখলাম রাতা রাতি, ও সবচে’ কঠিন যে কাজটা শিখলাম সেটা হল গাছে উঠা, দা দিয়ে কাটা এবং সাপ চিনা - কোনটা ধোড়া সাপ আর কোনটা বিষাক্ত সাপ । যখন আমার শিখার কথা ক্লাস সিক্স সব নতুন নতুন বিষয় শিখার - এলজেব্রা, জ্যামিতি, বাংলা এবং ইংলিশ ব্যকারন এবং গদ্য আর ঠিক কিনা আমাকে করতে এবং শিখতে হচ্ছে এই সব , গত এক মাসে পড়াশুনা কি জিনিস তা বেমালুম ভুলেই গেয়িছি । আম্মা বাড় বাড় বলতো, মনে রাখিস তোরা সবাই,
‘' হয়েন গোয়িং গেটস টাফ, অনলি টাফ গেটস গোয়িং । ‘'
আম্মার আরেকটা প্রিয় কথা ছিল পড়ার সময় বলত, ‘' হয় মন্ত্রের সাধন, নয় তো শরীর পাতন ‘' এখন আর ওটা বলে না , আর বলেনা রবার্ট ব্রুসের কথা, এখন কেবল, একই কথা বলে সারাদিন ; শক্ত হও নাইলে এই পথ অতিক্রম করতে পারবে না । মনে রেখো । আম্মাকে এক বারো ভেঙ্গে পরতে দেখি নাই এই অনিশ্চিত যাত্রায় ।
ঠিক বিকালের দিকে গিয়ে আমরা তিনজন বিদায় নিলাম বি এস এফ ক্যাম্পের সবার কাছ থেকে, ওনাদের সবাই কে আমরা ধন্যবাদ জানিয়ে আসলাম । আম্মা বেশ সুন্দর করে হিন্দিতে ওনাদের সবাই তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন । আমারা সূর্যমনিনগর যাচ্ছি তা ওনাদের কে বললাম , ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার সময় দেলথে পেলাম স্কুল এর সামনে অনেক গুলো গাড়ী এবং বেশ লোকজন, তাই না দেখে আমরা ওইদিকে গেলাম; গিয়ে দেখি স্কুল টা কে আপাতত রিফ্যুজি ক্যাম্প বানানোর পরিকল্পনা করছেন রিলিফ কর্মকর্তারা । আম্মা ওনাদের জানালেন যে, আগামী কালকের রিলিফ দেওয়ার সময় উনি থাকতে পারবেন না এবং আমরা কাল সকালে এখান থেকে চলে যাবো আমাদের নতুন জায়গায় । একজন পুরুষ আর অন্য জন মহিলা অফিসার খুবই দুঃখ প্রকাশ করল আর আমাদের রিলিফ নিবন্ধন নাম্বার টা খাদ্য অফিসের প্যাডে লিখে সিল ও সই করে দিলো; বলল এটা ক্যাম্পে দেখালে আর রেশন পেতে দেরি হবে না তা না হলে এক দুই দিন সময় নিতে পারে । বিদায় নিয়ে ঘরে ফিরলাম, ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেল , তাড়াতাড়ি খেয়েই ঘুমিয়ে পরবার আগে আম্মা আমাদের চুলকানি গুলো ভালভাবে দেখল, গরম পানি করে ভালো করে নিমের পাতা দিয়ে ধুয়ে দিলো, নিম পাতা বেটে ঐটা হাতে আর পায়ে প্রলেপ দিয়ে দিল - ঐ প্রলেব সহই ঘুমিয়ে পরলাম । রাতে আবার সেই একি অসুবিধা, দুঃস্বপ্ন দেখে লাফ মেরে জেগে উঠাটা এখনও বন্ধ হোল না , প্রায়সঃ রাতেই একরকম হত , ঘুমালেই দেখি লাইন ধরে রাইফেল তাক ক্রে এগিয়ে আসছে এক দল খাকি পোশাক পরিহিত পাকিস্থান আর্মি, এই গ্রামের রাস্তা দিয়ে কাদা পানির মধ্যে দিয়ে ধপ ধপ শব্দ করে এগিয়ে আসছে আমাদের এই ঘরের দিকে গুলি করতে করতে, আর আমরা পালিয়ে যাচ্ছি, দৌড়াচ্ছি প্রাণের ভয়ে এলোপাথাড়ি, সবাই বিচ্ছিন্ন, আমি এক দিকে, আম্মা আরেক দিকে, বোন আর ভাইরা অন্যদিকে । চতুর্দিকে কোলাহল; চিৎকার, বাচ্চাদের কান্না, মেয়েদের ভয়ার্ত আকুতি মিনতি আর এরই মধ্যে একের পর আঁক ব্রাশ ব্রাশ ফায়ার, আর ওদের অট্টহাসি খান খান হয়ে আছড়ে পরছে আর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমাড় কানে , অবিরাম দৌড়ে চলেছি পাহাড়ের শেষ প্রান্তে যে কোন মুহূর্তে পাহাড় শেষ হয়ে যাবে আর আমি নিক্ষিপ্ত হতে চলেছি এক বিশাল খাদে আর খাদের নিচেই অনেক গভীরে একটা নদীতে পরে যাবার সম্ভাবনা - ঐ ভয় , দুই দিকেই জীবনের পরিসমাপ্তির উন্মাদনায় ঘুম থেকে লাফ মেরে জেগে উঠলাম ঘামে ভিজা কাপড় চোপড় নিয়ে, আর পিপাসায় শুকনো গলা, ভয়ে শরীর কাঁপছে বাঁশের পাতার মত থরথর করে ।চোখে এক ভীত সন্ত্রস্ত, জ্ঞান বিলুপ্ত, প্রায় সংজ্ঞাহীন চাহনি ।
অষ্টম পর্ব
ভারতীয় শরণার্থী ক্যাম্পে
সকালে রওনা দিয়ে গ্রামের মেঠো পথ আর পাহাড়ের উঁচু নিচু চরাই উৎরাই, ছোট ছোট নালা, গিরিখাত পেরিয়ে প্রায় দুপুরের দিকে এসে পৌঁছলাম আমদের নতুন গন্তব্যে । সূর্যমনিনগর এ , আগরতলা থেকে মাত্র ৫ - ৬ মাইল দূরে। আগরতলা - সাভরুম রোডের পাশে - আগরতলা থেকে সাভরুম যেতে হাতের ডানে , রাস্তা থেকে ৫০০ গজ ভিতরে , একটা পাহাড়ের স্যাডেল এর মত সমতল ভূমিতে ক্যাম্প টা বানানো হচ্ছে- এটাকে নাম দেওয়া হয়েছে , ‘' সূর্যমনিনগর স্পেশাল ক্যাম্প ‘' অফিসিয়ালি এই নামেই এটা পরিচিত । স্পেশাল এই কারণে যে , এই ক্যাম্প টা বানানো হয়েছে বাংলাদেশের সকল উচ্চ পদস্থ লোকদের জন্য - এম এল এ , এম পি এ , সরকারী উরধপদস্থ কর্মকর্তা, ব্যাবসায়ী, রাজনিবিদ, কলা কুশলী, শিক্ষাবিদ, সঙ্গীতশিল্পী, বিশেষজ্ঞ এই ধরনের ক্যাটাগরির জনবল এর জন্য । আমরা এই সব রাঙ্কিং এ স্থান পাবার মত অত শত বড় কিছু ছিলাম না সত্যিকার অর্থে । ভাবতেও সত্যি আশ্চর্য লাগে যে , ইন্ডিয়ান সরকার আমাদের শরণার্থীদের কি পরিমাণ সম্মান প্রদর্শন করেছে - ওদের দেশে এতো সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তারা জয় বাংলার মানুষের জন্য কি না করেছে ঐ দুর্দিনে । ভাবতে অবাক লাগে , ক্যাম্প এর চতুর্দিকে ৪ ফুট বাসের তর্জার বেরা দেওয়া । মধ্যে খানে একটা বিশাল মাঠ প্রায় ২০০ ফিট প্রস্থে আর ৬০০ ফিট দৈর্ঘ্যে মাটি কেটে সমান করে একটু ঢালু ; দুই লাইনে সারি সারি বেরার ঘর এর লাইন - গেট দিয়ে ঢুকেই বাম থেকে প্রথম লাইন - এক লাইনে দুইটা লাইন মধ্যে একটু ফাক রেখে , একেক লাইনে চারটা চারটা করে আট টা ঘর - অন্যান্য রিফ্যুজি ক্যাম্পের মত নিচু ছিল না ওখানকার ঘর গুলো , উচ্চতা ছয় থেকে সাত ফুট, উপড়ে ছনের দোচালা ঘর , একটা ছোট জানালা , উপর দিকে খোলে বাঁশের তর্জা দিয়ে বানানো বাঁশের একটা খুঁটি লাগিয়ে খোলা রাখা লাগে ঘর গুলো বারো ফুট দৈর্ঘ্য এবং বারো ফুট প্রস্থে । বাঁশের একটা দরজা তাও বাঁশের খুঁটি একটা বেঁকা করে দরজার তর্জায় ঠেক দিয়ে রেখে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করা লাগে, ভিতরে বাঁশ দিয়ে বানানো দুইটা চৌকি ববা বেদ সিঙ্গেল বেড । রান্নাঘর ঘরের লাইন গুলোর ষে ছোট ছোট রুম রুম করা একেক পরিবারের জন্য একেকটা রান্নাঘর , ষেই প্রায় আমাদের রুম থেকে ২২০ গজ দুরে রান্নাঘর । প্রত্যেক টা ঘরের লাইনের সামনে আরেকটা ঘরের লাইম ওদের মুখ অন্য দিকে মাঝখানে দশ ফুট এর মত ফাকা । এই রকম গেট দিয়ে ঢুকেই বাম দিকে মাঠের সাথে সমান্তরাল বাম আর ডানই দিকে ঘর গুলোর লাইন - বামে ছিল ৭ লাইন ঘর মানে ৭ লাইন , একেক লাইনে ৪ টা ৪ টা ৮ টা মোট ৫৬ টা নাম দিকে, আর ডান দিকে ৫ টা লাইন সর্বমোট ৪০ টা ঘর আর মাঠের শেষে উঁচুর দিকে তিন লাইনে আরও ৭২টা ঘর , সর্বমোট ১৭০ টা ঘর , মনে হয় ৮৫০ থেকে ১০০০ লোকের জন্য বানানো, বেশ খোলামেলা, পরিষ্কার পরিছম্ন একটা রিফ্যজি ক্যাম্প - একটা শো রুম জাতিও একটা রিফ্যুজিদের আবাসন ; ক্যাম্পের প্রধান গেঁটের সামনে দিয়ে একটা মেঠো পথ চলে গেছে ঘন জঙ্গলের দিকে, সামনের রাস্তা থেকে আরেকটা শাখা পথ চলে গেছে আমারা যেদিক থেকে এসেছিলাম ষেই দিকে - ঘন না হলেও বেশ বসতিহীন এলাকা। আমাদের ক্যাম্পের শ্যাডেল টার এক দিকে পাহাড় আর পাহাড় আর পাহাড় আর স্যাডেলটার দুই পাশে এই একটু উপত্যকার মত ঢালু এলাকা যেখানে বানানো হয়েছে পানির কল, গোসল খানা এবং শৌচাগার । ছয় সাত টা কল আর বিস টা গোসলের তর্জার বেড়া ঘেরা মেয়েদের আর পুরুষদের গোসলখানা আর দূরেই সর্ব মোট চল্লিশ তা শৌচাগার । দুই আসের উপত্যকাতেই একই ব্যবাস্থা । ক্যাম্পের সামনের রাস্তার শাখা রাস্তা টা দিয়ে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই একটা পুকুর ছিল ; আর সাকনের রাস্তা দিয়ে দশ বার মিনিট হাঁটলেই ছোট একটা পাহাড়ি নালা ছিল; সব সময় কোমর পর্যন্ত পানি থাকতো । আগরতলা - সাভরুম সূর্যমনিনগর বাস স্ট্যান্ডে রাস্তার সুই পাশে সর্বমোট ৪- ৫ টা দোকান ছিল । মুদিখানা, চায়ের স্টল, ফার্মেসি , ভাতের হোটেল ( রেস্তোরাঁ) ( সকল ধর্মের জন্য ) । আর ছিল একটা বাঁশের আরত , বাঁশ, লাকড়ি, তক্তা এইসব বিক্রি করতো , একটা কামারের দোকান ছিল, কোন বিদ্যুৎ ছিল না । রাস্তার ঐ পারে দোকান গুলোর পিছনে একটা গ্রাম ছিল । আর আমাদের ক্যাম্পের সামনের শাখা রাস্তা দিয়ে গেলে আধা মাইল এর প্র একটা ত্রিপুরাদের বস্তি ছিল , পাহাড়ে টং জাতীয় মাচাঢ় উপর ঘর একটা গুচ্ছ গ্রাম - প্রায় ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ টা মাচার উপর ঘর । আর অনেক গুলো হস্ত চালিত তাঁত সব ঘরের বারান্দার পাটাতনে ।
ভিতরে ঢুকে পরলাম আমরা ক্যাম্পের , মাঠের শেষ মাথায় হাতের ডান দিকে একটা অফিসে মত মনে হল , সাইন বোর্ড এ লেখা , কি সব বুঝলাম না ইংলিশে , দরজা খোলা ভিতরে দুইটা টেবিলে দুজন লোক কাজ করছে । ভার ওয়ালা সহ আমরা দাঁড়ালাম বাইরে আম্মা আর আপা ভিতরে ঢুকল , কয় মিনিট পর একজন আমাদের নিয়ে গিয়ে আমাদের গর গুলো দেখিয়ে দিল ।। পর পর তিনটা রুমই আমাদের। এ ১, ২, ৩, সব গুলো রুমই খালি , ভার ওয়ালা ভারের মাল গুলো ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল ।
ঠাণ্ডা , স্যাত স্যাতে ঠাণ্ডা ঘরের ভিতর একদম সদ্য বানানো ঘর, ভিতরে এখনও কাঁচা বাঁশের সোঁদা গন্ধ । মেঝে তা বালু বালু, এর ধুলা এবং ঠাণ্ডা । জানালা বাঁশের ঠিকা দিয়ে খুলে দিয়ে পাশের রুম তা তে ঢুকলাম সে একই অবস্থা । কর্মকর্তা বলেছিল রুমে জিনিস পত্র রেখে ওদের অফিসে যাবার জন্য , দুইটা বাঁশের বানানো চকি তে সব জিনিস রেখে আম্মা চলে গেল অফিসে , আমরা বিছানায় বসলাম বেশ উঁচু চকি গুলো , বাঁশের তর্জা দিয়ে বানানো পাটাতন সমান না , আপা এরই মধ্যে একটা চকি তে একটা কেথা দিয়ে একটা বালিশ দিয়ে একরকম বিছানা বানিয়ে ফেলল , তারপর অন্যটাও বানিয়ে ফেলল , হাড়ি পাতিল এক কোনায় , ঝাড়ু দিয়ে একটু ঝাড়ু দিয়ে বালু আর ধুলা গুলো পরিষ্কার করল। আমরা তিন জন হেল্প করলাম । আমাদের ঘর রা ক্যাম্পের গেট থেকে ঢুকেই প্রথম ঘর আর আমরা ঐ ক্যাম্পের প্রথম বাসিন্দা । একদম চুপচাপ, নীরব, নিস্তব্ধ, চতুর্দিকে ঘন জংগল, আর মাঝখানে সদ্য বানানো যে আন তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা। ছন এর চাল ছাড়া বাকি সম্পূর্ণ সব কিছুই বাঁশের তৈরি । দরজা , জানালা, খুঁটি, চালের কড়ি, বীম সবই বাঁশের আর সব বাধন গুলোও বাঁশের ছাল দিয়ে পেছানো । দুইটা না তিন তা ঘর আমাদের , আমরা ৫ জনের দুইটা ঘরই দরকার । আমি আর ছোটন এক রুমে আর ওরা সবাই এক রুমে । ঘর গুলো দিনের বেলাতেও অন্ধকার ; ভিক্ষার চাল, কাঁড়া আর আকাঁড়া । মানুষের জীবন টা বড়ই বিচিত্র ধরনের , আমার আম্মা সারাজীবন সব কিছু তে খুত খুতে ছিল ; প্রচণ্ড রকমের সূচিবায়ু, সারাদিন খালি ঘর মুছা, ঝাড়ু দেওয়া, মাকড়সার জাল পরিষ্কার করা, কাঁসার বাসন কশোন তেঁতুল দিয়ে পরিষ্কার করা । টিনোফেলিন দিয়ে কাপড় ধোওয়া, এরারুট দিয়ে মাড় দিয়ে আমাদের ড্রিল অথবা টুইল প্যান্ট গুলো কে কয়লার ইস্ত্রি দিয়ে ইস্ত্রি করা , সাদা কাপড়ে নীল দেওয়া এসব ছিল আমাদের সংসারের নিত্য নৈমতিক ব্যাপার আর আজ আমরা কোথায় ? যুদ্ধ হবে সৈন্য সৈন্য তে আমাদের কে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে ? কেন আমার মা এবং বোনের সম্ভ্রম নিয়ে এতো ভাবতে হবে, কেন তাদের কে ধর্ষণ করবে ঐ পাপিষ্ঠরা; কি আমাদের দোষ ? কত স্বপ্ন ছিল ক্লাস এইটেও ক্লাস ফাইভের মত বৃত্তি পাবো, তারপর একদিন আব্বার মত ব্রাক্ষনবাড়ীয়া কলেজে পড়ে, আম্মার মত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ন্যূনতম এম, এ পাস করে আমাদের পাশের বাসার প্রফেসর মল্লিক স্যার, অথবা তালুকদার স্যার এর মত বা আসাদ চৌধুরীর মত কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হব । কারণ সেই ছোট বেলা থেকেই শুনে এসেছি আমার নানা এবং ওনার বাবাও শিক্ষক ছিল, সেই পথ ধরে আম্মাও সব কিছু ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজেও পুনরায় শিক্ষকতা পেষা বেছে নিয়েছেন । ওনাদের পথ অনুসরণ করেই আমিও মনে মনে একদিন হতে চেয়েছিলাম একজন গর্বিত চতুর্থ জেনারেশন শিক্ষক । কিন্তু, আজ আমরা শরণার্থী, অন্যের কৃপায় বেছে আছি, আত্মসম্মান সব বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি । আম্মা এবং আব্বা সব সময় বলত, জীবনে আর যাই করনা কেন , কোনদিন নিজের আত্মসম্মান কে কোন কারণে ক্ষুণ্ণ করবা না , আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা, সততা এবং ব্যাক্তিত এর ব্যাপারে সব সময় সকাগ থাকবে । প্রায় তিন মাস হয়ে গেল কোন স্কুল নেই, বই নিয়েও বসি নাই , কেউ বলেও নাই, আর এখন তো বই ও নেই, পড়ার টেবিল চেয়ার ও নেই , আমরা সর্বস্বান্ত, কপর্দকহীন, ভবিষ্যৎ তো দূরের কথা আগামীকালকে কি হবে তাই জানিনা । অনেক মনের কথাই আমার পরিবারের সাথে আলোচনা করি না । হয়ত, একটা ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিবে নয়ত ওদের কে আমার দুর্বলতা প্রকাশ করে নিজেকে বোকা বানাতে চাই না, আবার ভাবি যদি এখন আমি এইসব মনভাঙ্গা কথাবার্তা বলি, তাহলে ওরা আরও ঘাবড়ে যাবে । আমার উপর অনেক গুরু দায়িত্ব এখন , আমার কিছু হলে, কে আনবে রেশন, কে আনবে বাজার সদাই করে, কে আনবে কেটে লাকড়ি , আম্মার হাতে কোন তেমন পয়সা নাই, শুধু কয়েকটা সোনার অলঙ্কার শুধু , আমার আম্মা সব সময় ই একটু সাদাসিদে জীবন পছন্দ করতেন, সব সময় বলতেন, আমি বাবা এতো সোনা গয়না চাই না , আমি চাই একটা পরিছন্ন, ফিটফাট, সুন্দর জীবন, বেশী আহামরি প্রাচুর্য আমার দরকার নাই - আমরাও ঐ ভাবেই ভাবতে শিখেছি । পরিবারের মাতা শিক্ষিত হওয়া একটা বিরাট মূল্যবান সম্পদ, তার পর শিক্ষিত তার উপর সরকারী চাকরিজীবী, যে কিনা কয়েক জন পুরুষ এবং মহিলা সহকর্মীদের ম্যানেজার, অফিস থেকে মাঝি, পিওন এবং বন্দুকধারী গার্ড সিপাহী দের পরিচালনা করে অভ্যস্থ । আমাদের শিক্ষার সব বিষয়েই উনি ছিলেন পটু, বাংলা, ইংলিশ, ইতিহাস, ধর্মীও পুরাণ, অঙ্ক বাংলা শব্দকোষ থেকে ইংলিশ অভিধান থেকে শব্দ শিখা, উচ্চারণ করা, অর্থ জানতে হত ব্যাধতামূলক ভাবে । আমারা সবাই তার জন্য লেখাপড়ায় অত্যন্ত ভাল ছাত্র ছাত্রী ছিলাম, ক্লাসে শিক্ষক বইয়ের বাইরে সাধারণ জ্ঞান সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করলে সবচে আগে আমরা ভাইবোনরাই হাত উঠাতাম । বোনের বালিকা স্কুলে নাটকে ছেলের অভিনয় করে দিয়ে আসতাম - আর আমরা কোথায় নিপাতিত ? মন কে কোন ভাবেই বোঝানো যায় না । আমি সবসময়ই একটু সংবেদনশীল প্রকিতির তাই আমার মনে হয় আমাদের এই দুর্দশাগ্রস্থ জীবন আমি মেনে নিতে পারছিলাম না , খাওয়ার কষ্ট আর সহ্য হচ্ছিল না , প্যান্টে এখন আমাকে একটা দড়ি বাধতে হয় তা না হলে প্যান্ট নিচে নেমে যায় অনবরত ; আয়না তো নাই, কিন্তু উপলব্ধি করতে পারি আমার সুস্থতা, বুকের হাড্ডি গুলো দেখা যায় দুস্তর মত, আমাকে সবাই ভেংগাতো যে আমি আমার ওজনের জন্য তাড়াতাড়ি চলাফেরা করতে পারি না আমি নাকি শামুকের মত আস্তে আস্তে ঠেলে ঠেলে শ্লথ গতিতে চলি । আর সেই মানুষ আমি মাথায় করে লাকড়ি কেটে আনি জংগল থেকে, গাছে উঠে ডাল পালা ভেঙ্গে বয়া দা দিয়ে কেটে আনতে পারি, বেশ ওজন বহন করতে পারি, ঘণ্টার ঘণ্টা রিলিফ নেবার জন্য লাইনে বসে কিংবা দাঁড়িয়েও থাকতে পারি, বয়স্ক মানুষদের সাথে একই কাতারে দাঁড়িয়ে রেশন নিয়ে ঐ রেশন গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে মাথায় এবং হাতে নিয়ে এক থেকে দুই মাইল পথ হেঁটে ঘরে নিয়ে আসতে পারি, ঘন জংগল পেতে হলে ঘর থেকে অনেক দূর গহীন বনে একা একা ঢুকতে হয় । সাপ, চেলা, শিয়াল, বানর, শুঁয়োপোকা, জোক, বিছা, গুই সাপ, বড় বড় ইঁদুর এসব কে অতিক্রম করে, নিজের মনের ভয় কে দূর করে লাকড়ি কেটে, লতা জাতীয়ও একটা কিছু দিয়ে ঐ কাটা লাকড়ি গুলোকে বেঁধে ঐ বোঝা গুলো মাথায় উঠিয়ে পাহাড়, নালা, পিচ্ছিল মেঠো পথ, ঘন ঝোপঝাড়ের গুল্ম ভেদ করে, লাজ্জাবতি কাঁটা আর বিছুটিগাছের পাতার ঘর্ষণের চুলকানি / নিস্পিশ সহ অতবড় বোঝা নিয়েই ঘরে ফিরে কেমনে আসি তা শুধু আমিই জানতাম , এসে আম্মা আর বোনের কাছে বড় বড় বীরত্বপূর্ণ গল্প বলতাম অথচ আমি যখন যেতাম ঐ সব জংগলে আমি তখন একা একা ভয়ে কাঁপতাম, জোড়ে জোড়ে গান গাইতাম ভয় দূর করবার জন্য। তারপর আবার ভয়ও ছিল , কে এই জংগলের মালিক যদি ধড়া পড়ে যাই ওদের হাতে , যদি ওরা বাঙ্গালী না হয়ে ত্রিপুরা জাতী হয় ? ত্রিপুরা দের খুবই ভয় পেতাম কারণ ওরা কোনদিন একটু হাসিও দেই নাই, কোনদিন একটা বাক্যও উচ্চারণ করে নাই । সপ্তায় আমাকে প্রায় চারদিন লাকড়ি কেটে আনতে হত, আম্মা এবং বোনের গোসলের জন্য পানি এনে দিতাম অনেক দূর থেকে, ঘরের রান্না বান্না, ধুয়া মোছা, লেপালেপি করার জন্য পানি, মাটি অনেক সময় গোবর ও কুড়িয়ে আনতে হত । জীবনের কি যে বিচিত্রতা তা ভাষায় বা কোথা দিয়ে লিখে বা বলে সেই দিনগুলোর চিত্র অঙ্কন করা অসম্ভব । আমার জীবনের একেটা দিন ছিল একেকটা অভিযান । আমার বয়সী অন্যদের এত কষ্ট করতে হত না - কারণ হয় ওদের বাবা রা ছিল পরিবারের সাথে, না হয় বড় ভাই ছিল, নয়ত ওরা অনেক পরিকল্পনা করে ঘর থেকে হয়ত পালিয়েছে তাই ওদের কাছে অনেক টাকা ছিল জা দিয়ে হয়ত ওরা ত্রিপুরা ট্রাইবাল লোকদের কাছ থেকে লাকড়ি কিনে আনত । আবার অনেক কেই আমার মত লাকড়ি আহরণ করত ।
আম্মা এসে বলল, সব ব্যবস্থা করে এসেছি, কাল মুন্না তোমাকে সকালে সকাল সকাল উঠে রেশন আনতে যেতে হবে, আজকে আমাদের সাথে যে টুক চাল আর ডাল আছে টা দিয়ে খিচুরি বানিয়ে খেয়ে ফেলব । ক্যাম্পের বাইরে বেড়া ঘেঁষে অনেক গুলো লাকড়ির প্যাকেট রাখা দেখতে পেয়েছিলাম - একজন লোক রাস্তার অন্য পারে বসে থাকে খদ্দের এলেই উঠে এসে দাম দর করে বেচে । আমি আর আপা যেয়ে একটা বোঝা কিনে আনলাম দাম দুই টাকা মাত্র - এই এক থেকে দের ইঞ্চি ব্যাস গাছের ডাল লম্বা ৪ সাড়ে ৪ ফুট আর ঐ আঁটি তে বেশী হলে দশটা ডাল হবে । তাড়াতাড়ি আমরা যেয়ে চর দখল করার মত করে যেয়ে সাবচে নিকটবর্তী এবং সহজ এ পৌছা যায় এমন একটা রান্নাঘর বেছে নিলাম , এখন চুলা নাই, চুলা বানাতে গেলে তো এক দিন লেগে যাবে , ভাগ্য ভাল আমরা আগে যেই গ্রামে ছিলাম ঐ গ্রামে থাকতে একটা বটি এবং একটা কাঠের আছাড় ওলা দা কিনেছিলাম লাকড়ি কাঁটার জন্য , ওটা এনে ওটা দিয়ে চার টুকরা শক্ত মাটির ঢেলা অতি সযত্নে আম্মা, আমি, টুলু আপা আস্ত টুকরা উঠিয়ে আনলাম যাতে না ভেঙ্গে যায় - তিনটা ভাঙ্গার পড় তিনটা উঠাতে পারলাম - ঐ তিন টা মাটির ঢেলার উপর ই পাতিল বসিয়ে, অনেক কষ্টে খিচুরি বানিয়ে খেলাম ঐ বিকাল/ সন্ধ্যায় । প্রথম কয় রাত সবাই একই ঘরে ঘুমালাম । সারা রাত প্রচণ্ড গোলাগুলি শুনলাম। আমাদের ক্যাম্প টা আগরতলা - কসবা এবং আখাউরা এই তিনটা জায়গাগুলোকে দিয়ে একটা ত্রিভুজ আঁকা হয় তাহলে আমাদের অবস্থান টা হবে ত্রিভুজের বেইজ থেকে উচ্চতার অর্ধেক এর সমান জায়গায় অবস্থিত হবে হয়ত । কসবা থেকে আখাউরা ১৬ কিলোমিটার , আখাউরা থেকে আগরতলা ৯ কিলোমিটার । কসবা থেকে আগরতলা ২২ কিলোমিটার আর এই তিনটা জায়গার মাঝামাঝি জায়গায় সূর্যমনিনগর । কসবা - থেকে সালদা নদী - আখাউরা থেকে কসবা এই করিডোরে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সবচে বেশী সংঘর্ষ হয়েছে । যার জন্য রাতের বেলার যত সব গোলাগুলির আওয়াজ থেকে মুক্তি পাওয়া গেল না ।অনেক রাত পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার শুনলাম , চতুর্দিকে মুক্তি যোদ্ধাদের গল্প শুনি বীর গাথা শুনি আর ভাবি এই সবের মধ্যে কি আমাদের পিতা জীবিত আছেন না অনেক আগেই হয় টাকে হত্যা করা হয়েছে অথবা যুদ্ধে নিহত হয়েছে কিবা । ইয়া আল্লাহ যদি আব্বার কিছু হয় তাহলে এই সম্পূর্ণ সংসার আমি এত অল্প বয়েসে কেমনে চালাবো? রাতে আমি আর ছোটন মাটিতে মাদুর বিছিয়ে তার উপরই ঘুমালাম । সুরু হোল আমাদের পরিবারের এক নতুন জীবন । সূর্যমনিনগর স্পেশাল ক্যাম্পে …।
এভাবে কেটে গেলো সপ্তাহ খানেক, একদিন আজিজ কাকা আসলেন একটা লাল মটর সাইকেল হোন্ডা ৫৫ সি সি নিয়ে সন্ধ্যা বেলা , এসে খবর দিলো আব্বার খোঁজ পাওয়া গেছে উনি ত্রিপুরা রাজ্যের শেষ প্রান্তে কৈলাসশহর নামক জায়গায় আছেন ওখান থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন । উনি ওনার ই পি আর কোম্পানি নিয়েই এখনও আঁক সাথে আছেন ; অন্য কোন কমান্ডার নাই ওনার কাছ থেকে দায়িত্ব নেবার মত তাই উনি আমাদের কে বলেছেন ওনার এলাকায় চলে যেতে । কাকা সব ঠিকানা এবং কিভাবে যেতে হবে তা সব বলে দিলেন আম্মাকে । আরও বললেন যে , উনি এবং মমতাজ ফুফু খুবই ব্যস্ত প্রত্যেক দিন হাজার হাজার শরণার্থী ক্রমাগত আসছে ই আসছে - এখানকার সরকার খুবই চিন্তিত এবং হিমসিম খাওয়ার মত অবস্থা, ফুফু এবং কাকা এনারা সবাই আগরতলা তথা ইন্ডিয়ান সরকারের সাথে কাজ করছেন যাতে করে সব শরণার্থী দের কে ঠিক মত সব কিছু ব্যবস্থা করা যায় অল্প সময়ের মধ্যে । আরও বলল আমাদের ভাইজান একটা ছোট দল নিয়ে নবীনগর - নাসিরনগর এলাকায় ৭ দিনের জন্য গেছে - আসলেই ও আমাদের সাথে দশ দিন কাটাবে । কাকা রাগ করে বলল, বাবুল কে আমি অনেক বার বলেছি আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকার জন্য কিন্তু সে কিছুতেই শুনে না - ওর কথা হল আমি যুদ্ধ করার জন্য মুক্তিবাহিনী তে যোগ দিয়েছি , আমি ভিতরে যেয়ে যুদ্ধ করতে চাই । কাকা রাত্রে অনেকক্ষণ গল্প করে চলে গেলেন , বললেন পরের সপ্তাহে আসবে আগরতলা থেকে যাওয়ার পথে । কাকার পড়নে ইন্ডিয়ান আর্মির মত সবুজ ড্রেস , বুশ শার্ট দুই পকেট ওলা বুক পকেট না, পকেট কোমরের কাছে , সবুজ প্যান্ট, মাথায় ইন্ডিয়ান আর্মির মাংকি ক্যাপ, কাঁধে একটা জালি জালি স্টেন গান আর কোমরে চাইনিজ পিস্তল সার্টের নীচে - কাকাকে অনেক লম্বা এবং মোটা লাগল , যাবার সময় বলল এর পড়ে আসলে খালি যে রুম টা ওটার জন্য একটা /দুইটা বিছানা করার মত জিনিস নিয়ে আসবে আর আমাদের জন্য কম্বল কয়েকটা নিয়ে আসবে । ঐ দুর্দিনে আজিজ কাকা আসলেই আমাদের কে প্রাণ থেকে মায়া করতেন এবং আব্বার বেচে থাকার খবর আনাতে উনি আমাদের আরও প্রিয় কাকা হয়ে গেলেন , বলল আজ উনি এই ক্যাম্পের ঘর বণ্টন মিটিং এ ছিল - বলল প্রায় ৭০- ৮০ টা ঘর আজ দেওয়া হয়ে গেছে - দু এক দিনের মধ্যই সব ভরে যাবে । আম্মা ওইখানেই বলে ফেলল আমি তিন চার দিনের মধ্যেই কৈলাসশহরে যাবো ওনাকে দেখার জন্য মুন্না কে নিয়ে । কাকা আম্মাকে বলল ঠিক আছে যান ভাবী দেখে আসেন ভাইসাব কে । আমি তো আনন্দের উম্মাদনার আতিসজ্যে অস্থির হয়ে গেলাম ।
রেশন আনতে কোন প্রকার লাইন নেই , ওখানকার লোকদের সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠল দু এক দিনে , রেশন, পানি আনতে হয় একটা বালতি তে করে কয়েক বার, জংগলে যাই প্রায় দুদিন পরে পরে । আসতে আসতে ক্যাম্পে শরণার্থী আসা শুরু হোল, প্রত্যেক দিন দশ বার ঘর করে নতুন বাসিন্দারা এসে এসে ঘর গুলো ভরে ফেলতে লাগল , আমাদের লাইনে আরও পাঁচ টা পরিবার এসে সব গুলো রুম ভরে ফেলল। সবাইর সাথেই পরিচিত হতে লাগল আম্মা এবং টুলু আপা , সে পেয়ে ওর সম বয়সী কয়েক জন, আমিও পেলাম কয়েকটা নতুন বন্ধু , কেউ ঢাকা থেকে , কেউ চট্টগ্রাম, কেউ কেউ ময়মনসিংহ থেকে , কেই টাঙ্গাইল, ভারতেসশরি হোমস থেকে, কেউ কুমিল্লা, মতলব, নোয়াখালী, চাঁদপুর, নরসিংদী, ভৈরব থেকে, সব ধরনের লোকেরা আসতে ই থাকলো প্রত্যেক দিন , জমজমাট হয়ে গেলো খালি ক্যাম্প টা ক্রমান্বয়ে । নতুন নতুন ফ্যামিলিগুলোর সাথে পরিচিত হতে শুরু করলাম আমরা সবাই । একেক টা পরিবারের এক এক টা কাহিনী - পলায়নের এবং জীবন বাঁচানোর মহাকাব্য । আম্মা নীরবে শুরু করে দিলেন ওনার কাজ, সবার সাথে নেটওয়ার্ক করে ভাবতে সুরু করলেন কিভাবে একটা স্কুল খোলা যায় ক্যাম্পে ; ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস এর রিফ্যজি ক্রাইসিস, আলজেরিয়ান মুক্তিযুদ্ধের র্যিফুজি ক্রাইসিস , দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইউরোপের র্যিফুজি সমস্যা এই সব সারাক্ষণ শুনতাম বড়দের মুখে, আমাদের ক্যাম্পে অনেক পেশার মানুষের অভিবাসন ছিল এবং ওনারা সবাই অত্যন্ত জ্ঞানী এবং পড়ালেখা করা ছিলেন, কেউ আমেরিকাতে ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক, কেউ ডক্টরেট, কেউ বহুজাতিক কোম্পানির নির্বাহী, কেউ ইস্ট পাকিস্তানের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার, প্রগতিশীল অবসরপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদ এনারা সবাই একেক জন পণ্ডিত সম বিশাল ব্যাক্তিত্ত ছিলেন । ক্রমে ক্রমে ক্যাম্প টা ভরে যেত লাগলো । যেন, ঠাই নাই, ঠাই নাই, ছোট এ তরী…… ।
একদিন সকালে আম্মা রওনা দিলেন আব্বাকে দেখার জন্য, সেই সুদূর কৈলাসশহরে - এক বন্ধুর সেই পথ, আমাদের জীবনের এক ভয়ানক অধ্যায় এই পরিব্রজ্যা যা না বললে আমার এই কাহিনী সম্পূর্ণভাবে অপূর্ণ থেকে যাবে , হাতে মাত্র ইন্ডিয়ান ৩০ রুপি, এই আমাদের শেষ সম্বল,। সূর্যমনিনগর থেকে বাসে চড়ে ভোর বেলা আগরতলা, আগরতলা যেয়ে আখাউরা রোডে কয়েক জন কে জিজ্ঞেস আম্মা গেল ধর্মনগর বাস স্ট্যান্ডে । ওখান থেকে বাসে করে ধর্মনগর - রাস্তার একপাশে পাহাড় আর অন্য পাশে গভীর খাদ - বাসে কোন ভাড়া নিলো না । ধর্মনগর থেকে ট্রেনে করে গিয়ে পৌছাল কৈলাসশহরে ; খুঁজে বের করল মুক্তি বাহিনী ক্যাম্প , ওখানে যেয়ে পরিচয় দিলো, আব্বা সেদিন অপারেশন এ গিয়েছে ; বার মৌজা - চাতলা পুর এলাকায় । পরদিন আব্বা আসলেন ; মুখে দাড়ি, শুকিয়ে গেছে অনেক, খাকি প্যান্ট, সবুজ একটা সার্ট, পায়ে ইন্ডিয়ান আর্মির জঙ্গল বুট , মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ। আম্মা নাকি প্রথমে চিনতেই পারেনি ।
সূর্যমণিনগরে আমরা চারজন , এদিকে আমাদের ক্যাম্পের সামনে দিয়ে , আগরতলা - সাভরুম রোডে প্রত্যহ হাজার হাজার শরণার্থী আসছে , হেঁটে যাচ্ছে , নিদারুণ অবস্থা একেক টা পরিবারের । দেখলেই চোখে পানি আসে । করুন অবস্থা , গোলাগুলি চলছে রাত দিন, আমাদের ক্যাম্পে অনেক গুলো নতুন পরিবার এসে পড়লো ক্যাম্প সমাগম , বেশ কয়েক জন আমার বয়সী পেয়ে গেলাম , নতুন নতুন বন্ধু বানাতে শুরু করলাম, অনেক দিন পর সমবয়সী পেয়ে ভুলে গেলাম অনেক কিছু , খেলা ধুলা করতে শুরু করলাম অল্প , লুকোছুরি, সাতচারা, ইত্যাদি, বিকেলে সব কাজ সেরে, আপাকে রান্নায় সাহায্য করতে শুরু করল ছোটন, ও আমাকেও রেশন এবং লাকড়ি কাটায় ও বেশ সাহায্য করতে শুরু করল । গায়ে, হাতে, পায়ে সব জায়গায় চুলকানি বারতেই থাকল , আর এক নতুন প্রকপ সুরু হল চোখ উঠা , চোখ এ সারাক্ষণ চুলকায়, অনবরত পিচুটি নির্গমন হচ্ছে , চোখ গুলো সারাক্ষণ লাল আগুণের মত - অনবরত হাত দিয়ে চুলকাতে ইচ্ছা করে । রেশন কয় দিন দেরি হল আসতে, সেই সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে যেতো নিয়ে আসতে আসতে । লক্ষ লক্ষ শরণার্থী আসতেই আছে , মানুষের আর তো কোথাও পালাবার জাইগা নাই, স্বাধীন বাংলা রেডিও তে কেবল বলেই চলেছে কি রকমের অত্যাচার, হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে ঐ পাপিষ্ঠ পাকিস্তানি আর্মি। গ্রামে গ্রামে শান্তি কমিটি বানিয়ে ফেলেছে, রাজাকার নামে নতুন একটা বাহিনীও শুরু করে দিয়েছে ; বাংলার প্রায় প্রত্যেকটি শহর, জেলা, মহকুমা, থানা, ইউনিয়ন এবং গ্রাম ওদের কব্জায় এবং অবরুদ্ধ । বাংলাদেশ এখান একটা বিরাট আর্মি পরিবেষ্টিত ক্যাম্প ।
ক্যাম্পে সারাক্ষণ বড় দের কোথা শুনতে শুনতে অনেক পেকে গেলাম ইতিমধ্যে, যখন আমার থাকা দরকার বই পুস্তক তখন বসে বসে বড়দের গল্প শুনতাম সারাদিন , জাতিসঙ্ঘ এর সেক্রেটারি জেনারেল উু টান্থ কি বলল, রাশিয়ার প্রধান মন্ত্রী এলেক্সি কসেগিন কি বলল, প্রেসিডেন্ট নিক্সন, রাশিয়ার ব্রেযনেভ, কিসিঞ্জার , চাইনিজ প্রধানমন্ত্রী চো এন লাই এর নাম মুখস্ত হয়ে গেল কয়েকদিনের মধ্যে, ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পরিগণিত হলেন এক ত্রাণকর্তা মাতৃস্থানীয় আসনে ।
ইতিমধ্যে, একদিন দুপুরে লাকড়ি কেটে এনে ঘরে ঢুকেই দেখি ভাইজান বসে আছেন । সব দুঃখ, সব কষ্ট, সন ব্যথা ভুলে গিয়ে ভাইজান কে জড়িয়ে ধরলাম , অনেক আদর করল, অনেক গল্প করল, আমাদের জন্য হাপানিয়া থেকে এসেছিল এক ধরনের পাতায় করে । গোগ্রাসে খেলাম আর ভাইজান কে নিয়ে গল্প করতে লাগলাম, শয়ে বলল ও কিভাবে সিলেট হোস্টেল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে আমাদের না পেয়ে ওখানকার কয়েক জনের সাথে কসবা হয়ে মতি নগরে যেয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয় । ওখান থেকে সে এই পর্যন্ত দেশের ভিতরে চারবার চারটা অপারেশন করে এসেছে , ব্রাহ্মণবাড়িয়া তে দুইবার, একবার নবীনগরে, আর এক বার কসবার কুঠিতে একটা ব্রিজ উড়াবার বোমা ও বারুদ পৌঁছে দিয়ে এসেছে । এখন সে পনের দিনে ছুটি নিয়ে এসেছে, আমাদের সাথে থাকার জন্য, ভাইজান অনেক বদলে গেছে, আগের মত এত বেশি কথা বলে না, আব্বার খবর জিজ্ঞেস করল, আমরা বললাম আম্মা ওখানে গেছে দেখা করতে, এক দুই দিনের মধ্যেই আসবে । ভাইজান অনেক লম্বা হয়ে গেছে , পা গুলো একদম যাচ্ছে তাই অবস্থা, পায়ের পাতার নিছে চামড়া ফেটে চুরমার- দাড়ি এখনও ঠিক মত উঠে নাই, চুল লম্বা ঘাড়ের উপর লম্বা হয়ে নেমে গেছে , স্বাস্থ্য অনেক ভালো হয়ে গেছে, পেশী গুলো বেশ সবল। বলল যে এক এক রাতে ওরা কখনো বিস মাইল ও হাটে। আমরা ওকে আমাদের এখানে ক্যাম্পে আসার সব গল্প খুলে বললাম । আমরা চারজন ভাইজান কে আনন্দের আতিশয্যে দিশেহারা হয়ে গেলাম, আর বাইরে যেয়ে নতুন বন্ধু দের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দিলাম। ভাইজান পরদিন আমাদের জন্য কয়েকটা কাপড় চোপড় কিনে আনল একা একা গিয়েই , হুহু সে এক বিশাল লম্বা মানবে পরিণত হয়ে গেছে ভাইজান, দূর থেকে দেখলে হয়ত ওকে আমরা চিনতেই পারতাম না । অনেক বদলে গেছে সে - গম্ভীর গলার আওয়াজ, বলল, আমাদের সবাই কে দরকার হলে যুদ্ধে যোগদানকরতে হতে পারে , ঐ পাকিস্তানী দের যেমনে করে হউক বিতাড়িত করতে হবে ।
পরদিন, অর্থাৎ পাঁচ দিনের দিন আম্মা রাত্রে প্রায় আট টার দিকে এসে হাজির । অনেক জিনিস হাতে তিন চারটা ব্যাগ । সবাই আম্মাকে জড়িয়ে ধরলাম ।আব্বার খবর নিলাম , আব্বার খবর শুনে সবাই প্রায় কান্না কান্না । সে যে কি এক অনুভূতি ! রাতে আম্মার সাথে এক সাথে ভাত খেলাম - ভাইজান বাজার থেকে ডিম নিয়ে এসেছিল - ও আবার মাছ মাংস কিছুই খাই না , নিরামিষভোজী শুধু ডিম খায়, ডিম দিয়ে ভাত খেলাম। আপা এই অল্প কয় দিনেই খুবই সুন্দর রান্না করা শিখে ফেলেছে । খাবার দাবারের পর আম্মা বলতে শুরু করলেন আব্বার সব বৃতান্তঃ
সিলেট ট্রি ইউং ই পি আর এ আব্বা যোগদান করল মার্চের ১৬-১৭ তারিখে , আব্বাকে দায়িত্ব দেওয়া হল - উইং হেড কোয়ার্টার এ অবস্থিত বি ( ব্রাভো) কোম্পানির ; আব্বা এর আগেও ঢাকা পিলখানায় ১৬ উইং দাড় করাতে বদলী হবার আগে ট্রি উইং এই ছিল - ব্রাভো কোম্পানির সব লোক ই আব্বার পরিচিত । ইতিমধ্যে দেশের পরিস্থিতি বেশ উতপ্ত । উইং কমান্ডার আব্বাকে বেশ পছন্দ করেন, কিন্তু উইং এর স অধিনায়ক ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল এর সাথে সম্পর্ক ওতটা ভাল না প্রথম দিন থেকেই । আব্বা ওকে এড়িয়ে চলে যতটুকু সম্ভব ; ২৩ সে মার্চ আব্বাকে উইং কমান্ডার ডেকে বলল, আপনি আপনার কোম্পানি নিয়ে কাল সকালে রওনা হবেন শমসেরনগর এর জন্য । আই এস ডিউটির জন্য ( আই এস মানে ইন্টারনাল সিকুরিটি) । যত বেশি ম্যান পাওয়ার নিতে পারেন তাই নিয়ে চলে জান, এস এ পি । প্লিজ ফলো এস ও পি ( স্ট্যান্ডিং অপারেটিং প্রসিডিওর ) জা বলা রাই কাজ, আর বলল যে, টু আই সি আসবে যে কোন সময় আপনার কোম্পানির সাথে দেখা করতে , বাকি টু আই সির আদেশেই চলবে । সর্ব সাকুল্যে ৭৫ জন লোকবল নিয়েই দুই ট্রি ত্মন লরি আর সেভ্রেলেট পিক আপ নিয়ে রউনা দিল শমসেরনগর এর উদ্দেশে । দুপুর নাগাদ এস গেল শমসেরনগরে - রাস্তায় দেখল বেশ উতপ্ত পরিস্থিতি সারা শহরে এমনকি গ্রামে, ফেঞ্চুগঞ্জ বন্দরে, মোগবাজার, কুলাউরা সব খানেই ; দেশের মানিসের মাঝে এক নব উদ্দীপনা, প্রতিবাদ এর বাসনা ।
ক্যাম্প করল এয়ার পোর্টের মেইন বিল্ডিং এ, তারপর এলাকা ঘুরে দেখে আসল । রাত্রে ঘুমাবার আগে পার্শ্ববর্তী জুরি তে কোম্পানি কমান্ডার মানান সাহেবের সাথে এবং তামাবিলে কমান্ডার বি, আর চৌধুরীঢ় সাথে ( ঐ আমলে ই, পি , আর এর ওয়ারলেস সেট দিয়ে সারা ইস্ট পাকিস্তান এ কথা বলা যেত) । ওনারাও বেশ চিন্তিত এবং অস্থির , ওরাও বলল, সামনে একটা কিছু হতে পারে । আনারা সবাই ই গত ১২- ১৩ বছর যাবত ই, পি, আর এর কোম্পানি কমান্ডার - অনেক অভিজ্ঞতা এবং এনারা সবাই ই বিভিন্ন ধরননের বৈস্যমের শিকার ; মনে প্রাণে পাঞ্জাবী দের ঘৃণা করে । অনেকই তার ন্যায্য পদোন্নিত থেকে বঞ্চিত - সব প্রমোশন ঘুরে ঘুরে ফিরে সংখ্যালঘু পাঞ্জাবী কোম্পানি কমান্ডার রাই পায় । তারপর অনেক ধরনের দুর্নীতি ও উইং কমান্ডার রা করায় কোম্পানি কমান্ডার দের দিয়ে ।যাহা তারা কেউই পছন্দ করে না।
একটা কথা বাড় বাড় ওনাকে খোঁচা দিতে লাগল - কেন টু আই সি ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল আসবে এবং তার পর থেকে সব ওর নির্দেশ মোতাবেক চলবে । আম্মা বললেন , আব্বা এই কথা টার কোন মানে খুঁজে পেল না । পরদিন ২৫ সে মার্চ ঢাকা তে ক্র্যাক ডাউন এর খবর ২৬ তারিখে পেলেন আব্বা , শুনতে পেলেন যে শমসের নগরে আর্মি আছেন । আব্বা ২৬ তারিখ সন্ধ্যায় ওখানে যেয়ে মেজর খালেদ মোসারাফ এর সাথে দেখা করলেন, মেজর খালেদ আব্বাকে কোন রকম উপদেশ দিতে পারলেন না । তবে আব্বা ওনার ব্যাপারে খুবই উচ্চ মানের মন্তব্য করেছিলেন আম্মার কাছে , আম্মা তখন বি, বাড়িয়ার কথা আব্বাকে বললেন । রাতের বেলা পিক আপ নিয়ে প্রিত্তিমপাশা গেলেন ওখানকার নবাব আব্বার অনেক পুরনো পরিচিত ওনার সাথে দেখা করতে , অনেক কথা বললেন , আব্বা বুঝে নিলেন উনি আমাদের পক্ষে , কিন্তু কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না । রাতে শহরে একটা ১/৫ পেট্রল পাঠিয়ে দিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন - বিবিসি, আকাশবাণী, ভয়েস অফ আমেরিকা সব রেডিওতেই একই খবর ঢাকায় পাকিস্তানি আর্মির আক্রমণ , হাজার লাশের খবর, সুবেদার মান্নান জানালেন ওয়ার লেসে যে , ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল কে কুলাউরা তে দেখা গেছে । সিলেটে থ্রি উইং হেড কোয়ার্টার এর সব বাঙ্গালী সৈনিক এবং এন সি ও এবং জে সি ও দের কে অস্ত্র বিহীন করা ফেলা হয়েছে । ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ, ছাত্ররা, আনসার,। মুজাহিদ রা এসে আব্বার সাথে কথা বললেন, মুজাহিদ কয়েক জন আব্বার কোম্পানির সাথে যোগ দিতে চাইল আব্বা ওদের অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিদায় করে দিলো , রাত তখন দুইটা বাজে তখন ওয়ারলেস অপারেটর মেসেজ নিয়ে আসল যে, সকালে ১০-০০ এ টু আই সি আব্বার কোম্পানির দরবার নিবে এবং ইন্সপেকশন করবে ।
আব্বা তার কোম্পানির সব সিনিয়র দের ডাকল তার রুমে এবং শুধু বাঙ্গালী গুলোকে । আস্তে আস্তে গলা ছোট করে সবাই কে অবগত করল । আব্বা সবাই কে বললেন, আর বিশ্বাস করা যায় না , কি বল ? সবাই এক বাক্যে রাজী, হয়ে গেল । আব্বা বলল যে কয়টা বিহারী আর পাঞ্জাবী, পাঠান ও বালুচি আছে এখনি সবাই কে এরেস্ট করে একটা কোয়ার্টার গার্ড বানায়ে ঢুকাও ওখানে । আর ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল এর কনভয় কে এম্বুশ করতে হবে বাজারের শেষে তিন রাস্তার মোড়ে । সকাল আট টার ভিতর এম্বুশ লাগাতে হবে । বলেই প্রথমে ওদের কে ক্লোজ করে এরেস্ট করা হল। বিছানার দড়ি দিয়ে বাঁধা হল এবং ১ এন সি এবং তিন সিপাই কে দিয়ে গার্ড লাগিয়ে দিয়ে উপর তলায় বসে এম্বুশ এর প্লান করে ফেললো । সূর্য ওঠার সময় যেয়ে বিভিন্ন গ্রুপের পজিশন দেখিয়ে দিয়ে এসে - সবাই মোট ২৮ জন কে নিয়ে এম্বুশ লাগাল ষেই সকাল সাড়ে আটটার সময় । তিন জনে কে সিভিল ড্রেসে বাজারে আর দুই জনকে আর্মির ডাকবাংলো এলাকায় পাঠিয়ে দিল । তারপর অপেক্ষা, এম্বুশে থাকা অবস্থায় খবর পাঠাল যে আর্মি মুভ করার ( মেজর খালেদ সাহেবের) জন্য তৈরি হচ্ছে ।
ঠিক সকাল নয়টা ১৭ মিনিটে দুরে দেখা গেল ই পি আর এর জিপ এবং তিনটা থ্রি টন লরি … অপেক্ষা অপেক্ষা যেই পুরা তিনটা গাড়ী এম্বুশ এর মধ্যে ঢুকে গেল আর তখনি আব্বা তার থ্রি এইট রিভলভার দিয়ে প্রথম গুলি করাঢ় সঙ্গে সঙ্গে দুপাশ থেকে গুলী আর গুলী তে এলাকা প্রকম্পিত হয়ে উঠলো , ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল সহ ২১ নিহত । এই দিয়ে আব্বার মুক্তিযুদ্ধ শুরু। সম্পূর্ণ তৎকালীন গ্রেটার সিলেট জেলার মধ্যে আব্বাই প্রথম শুরু করল একটি নিয়মিত বাহিনীকে নিয়ে প্রথম বিদ্রোহ । তারপর অনেক ঝর, অনেক যুদ্ধ, অনেক ত্যাগ , অনেক মৃত্যুর মুখোমুখি সংঘর্ষ যেমন মৌলভিবাজারে প্রথম ৩১ পাঞ্জাব ক্যাম্পে অ্যাটাক, তারপর সিলেট আক্রমণ করে তারপর অনেক গুলো বাঁধা অতিক্রম করতে করতে এসে চাতলাপুর ( মুক্ত এলাকা হিসেবে ছিল - উনিই এক সময় এই স্পেশাল বি ও পি টা স্থাপন করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেবার একজন ছিলেন ) বি ও পি তে ক্যাম্প এবং কৈলাসশহরে যৌথ ভাবে অবস্থান করে চালিয়ে যাচ্ছেন তার যুদ্ধ । সঙ্গে এখনো আছে তার বিশ্বস্ত সিপাই ( ততদিনে তাকে নায়কে পদন্নিতি দেওয়া হয়েছে ) গোলাম রসুল, নায়েক ফরহাদ, সিপাই মস্তফা, , ব্যাটম্যান নুরু মিয়া আরও কয়েক জন তার থ্রি ইউং ই, পি, আর এর ব্রাভো কোম্পানির জনবল প্রায় ৫৫ জন আছে, অনেকই ইতিমধ্যে নিহত হয়েছেন যুদ্ধে , অনেকে সিলেট অপারেশন এর পর পাকিস্তান আর্মির হাতে ধরা পরেছেন আবার অনেকে চলে গেছে তাদের গ্রামের বাড়ীতে পরিবাবের সাথে মিলিত হয়ে তার গ্রামের বা এলাকার নিকটবর্তী সেক্টরে যোগদান করেছে ।
আব্বার এই গল্প শুনে সাহসে বুক ট ভরে গেল, আমি ভাইজান, আপা, ছোটন ও টুম্পা সবাই গোগ্রাসে শুনলাম আব্বার সেই গল্প । আব্বা চেষ্টা করবেন এই সেক্টরে চলে আসাতে । আম্মা বলল, আব্বা বি এস এফ ডাইরেক্ট আন্ডারে কাজ করছে কারণ এখনো অন্যান্য এলাকার মত সব কিছু অরগানাইজ হয় নাই, কমান্ডেন্ট মানিক
চৌধু রী এবং মেজর সি আর দত্ত ওনারা সব ব্যবাস্থা করছেন আব্বা তার ই, পি, আর দিয়ে দুইটা টা ট্রেনিং ক্যাম্প শুরু করেছেন আর এই শহর যাতে করে পাকিস্তানি আর্টিলারির বোমার রেঞ্জে না পরে তাই চাতলা এবং বাড় মৌজা এলাকা যে কোন মূল্যে মুক্ত এলাকা রাখতে হবে । প্রত্যেক দুই দিন পর দুই দিনের জন্য অপারেশন যেতে হয় , বিভিন্ন এলাকায় হিট এন্ড রান করে ফেরত আসে, ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে আসে, রেলওয়ে ব্রিজ, রোড ব্রিজ, ইলেকট্রিক লাইন, শাহজিবাজার বিদ্যুৎ কেন্দ্র এই সব ওনার এলাকা, আর কোন অফিসার নাই এই এলাকায় তাই উনি বললেই চলে যেতে পারবেন না । আম্মাকে অবশ্য মানিক চৌধুরী ও বলেছেন যাতে আমরা ঐ এলাকায় যাই যেন , শুনে আমারা সবাই এক বাক্যে রাজী হয়ে গেলাম ।
এদিকে ভাইজান বলতে লাগল তার নতুন জীবন সম্পর্কে - তার মুখে খালি যুদ্ধের বীর দের নাম - খালেদ মোসাররফ ; এক বিশাল সাহসী বীর, মেজর সাফফাত জামিল, মেজর হায়দার, ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন, ক্যাপ্টেন গাফফার। সে এনাদের কথা আর বলে শেষ করতে পারে না ; আমরাও আমাদের শরণার্থী ক্যাম্পে প্রত্যহ ওনাদের নাম শুনছি আর জানতে পারছে যুদ্ধের অগ্রযাত্রা । কিন্তু একজন সক্রিয় মুক্তি যোদ্ধার মুখে শোনা সে ভিন্ন ধরনের অনুভূতি । ভাইজান অনর্গল বলেই যাচ্ছে তার নতুন শিখা শব্দ গুলো আর আমরা সবাই শুনছি ওর কাহিনী দুই বার তাকে রিজেক্ট করে দিয়েছিলো ট্রেনিং থেকে কারণ তার হাঁটু তে ফুটবল খেলে ব্যথা পাওয়ায় কারণে রাইফেল ড্রিল করতে পায়ে ব্যথা লাগতো আর হাঁটুর ণী জয়েন্ট কয়েক বার ব্যথা পাওয়াতে তাকে রিজেক্ট করা হয়েছিল । তার পর ও সে ক্যাম্প থেকে যায় নাই , আবার কয়দিন পর এক অফিসার তার সাথে কথা বলে, ওকে হাল্কা ট্রেনিং করার অনুমতি দিয়েছিল । ঐ অফিসার তার কথাবার্তা শুনে বেশ আশান্বিত হয়েছিল। তারপর মতি নগর থেকে প্রথম অপারেশনে যায়, দেশের ভিতরে গিয়ে বিভিন্ন গ্রামের ছেলেদের সাথে যোগাযোগ করে অনেক নতুন নতুন ছেলেদের মুক্তিবাহিনীতে নিয়ে আসে, দশ জনের এক এক টা দল নিয়ে কসবা - নবীনগর এলাকায় অপারেশন এ গিয়েছে চারবার । সামনে সে চলে যাবে মেলাঘর এ ওখানে সে নতুন ডিনামাইট সম্বন্ধে ট্রেনিং নিয়ে ঢাকা বা আসে পাশের এলাকায় প্রবেশ করবে । মুক্তিযুদ্ধের বীরগাঁথা শুনতে শুনতে আমরা সবাই ঘুমিয়ে পরলাম ।
দুই দিন পর ভাইজান চলে গেল বলল দুই মাস পর আবার আসবে । ভাইজান যাবার আগে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেল , কিভাবে গাছে উঠতে হয়, দা দিয়ে কেমনে কাটতে হয়, কত গুলো সহজ তরিকা , একসাথে যেয়ে ধার একটা বড় হাতল ওলা দা ও কিনে আনলাম । সেই বলল, দুই ঘরে থাকার দরকার নাই , এক রুমেই সবাইকে থাকার কথা বলল, আমি মাটিতে ঘুমাই - কোন অসুবিধা আর হচ্ছিল না । দা কিনার সময় দেখলাম হাজার হাজার শরণার্থী রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে আগরতলার দিকে যাচ্ছে। দেখে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল, আমরা না হয় একটা ঘঢ় পেয়েছি এবং প্রত্যেক দুই দিন পর পর রেশন পাই , যদিও অনেক না সবার দুই দিন পেট ভড়ে খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত নয় তথাপিও আমরা তো অনেক ভালোই আছি কিন্তু এনারা কি করবে, কবে পাবে ঘর, রেশন । দেখেই মনে হচ্ছিল বেশ কয়েক দিন যাবত ওনারা হাঁটছে এই পথ ধরে ।
আম্মাকে এসে সব বললাম, আম্মা বলল, এভাবে আরও শরণার্থী আসলে খুবই বড় অসুবিধা হবে , আম্মা আমাদের বার বার বারণ করলো ক্যাম্পের বাইরের এই এলাকার জনগণের সাথে যেন কোন রকম বেয়াদবি যাতে না করি, আমাদের ক্যাম্পে এ নাকি অনেক কানাঘুষা হচ্ছে - এত লোক আসছে তার মানে পাকিস্তানিরা কাউকেই রেহাই করছে না , সবাই ব্যাথিত এবং সংকিত, নোয়ামুড়া এলাকায় দুই দিন যাবত রেশন দিতে পারে নাই - কারণ এতো লোক এসে পরেছে সেই পরিমাণ চাল ওদের মজুদে নাই , পেপারে পড়েছে ইন্দিরা গান্ধী সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কাছে জয় বাংলা শরণার্থীদের জন্য সাহায্য চেয়েছে । ত্রিপুরায় মে মাসের মধ্যে তিন লক্ষ শরণার্থী ঢুকে পরেছে ; ওদের সব রিলিফ, ও যানবাহন ব্যবস্থা কোন ভাবেই পেরে উঠছে না । আম্মা আরও বলল যে, ইন্ডিয়ান সরকারের অনেক ধৈর্য এবং এরা আসলেই অনেক মানবিক গুনাবলি সম্পন্ন । আম্মা আরও বলল সে ত্রিপুরায় সর্বমোট জনগণ ই হল ১৪ লক্ষ । এতো লোক কোথায় জায়গা দিবে । সবটাই তো জংগল এখনও। আম্মার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ , যদিও আব্বার সাথে দেখা হওয়াতে আমারা সবাই ধড়ে প্রাণ ফিরে পেয়েছি । ভাইজান কে কাছে পেয়েও অনেক বেশী জোড় বেড়ে গেছে । এদের ক্যাম্পে অনেক যুবকই রয়েছে ভাইজান এর থেকেও বয়েসে বড় ওরা দিব্বি মা বাবার সঙ্গে ক্যাম্পে দিন কাটাচ্ছে আর আমার ভাইজান মাত্র ১৭ বছর বয়েসে মুক্তিযুদ্ধা ৪ টা অপারেশন অলরেডি করে ফেলেছে । সব অস্ত্র চালাতে জানে , আমি ম্নিজেকে নিজে একটু গরবান্নিতই বোধ করতে লাগলাম ; বন্ধুদের মধ্যে, ইতিমধ্যে বেশ ছয় সাত জন নতুন নতুন বন্ধুও জোগাড় হয়ে গেছে, আমার ঘরের কাজ কামেও মাঝে মাঝে আমি ফাকি দিচ্ছি, তা নিজের কাছেই মনে হল । সন্ধ্যা হলেই এক গাদা বড়রা আমাদের ঘরের সামনে বসে রেডিওর খবর শুনে, বিবিসি মার্ক টালির পড়া সংবাদ- যা নাকি সবচে বিশ্বাসযোগ্য, তারপর আকাশবাণী কলকাতা থেকে দেব দুলাল
বন্দপোদ্ধ্যায় এর খবর আর তার পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরম পত্র এবং সংবাদ এর পর চা, কেই কেই ঝাল মুড়ি , খাস্তা বিস্কুট, টোষ্ট বিস্কুট খাওয়া আর গল্প চলত অনেক রাত অবধি। আস্তে আস্তে আমারা সবাই একে অপরকে চিনতে শুরু করলাম । হৃদ্যতা বাড়তে তাখল পরিবার গুলোর মধ্যে ।
বার, মাস, তারিখ এসব আর আমাদের গুনাগুনির মধ্যে নেই, জীবন এর সেই হিসাব কিতাব বেতন, চাকরী, ব্যবাসা , স্কুল, পরীক্ষা এসবের কোন বালাই নাই । ক্যাম্পে আমাদের সাথে পরিচয় হতে থাকলো অনেক মানুষের সাথে ;
কয়েক জনের না বললেই না , ক্যাম্পে আসলো দুই ভাই মোস্তফা ভাই আর তার যমজ ভাই দুজানাই চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র - বাকি পরিবারের সবাই নিহত পাকিস্তানি আর্মির হাতে মার্চের শেষ দিকে , চট্টগ্রাম শহরে বাবাও ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার , মা ও বাবাকে ঘরে ঢুকে হত্যা করেছে, ওরা দুই ভাই হোস্টেলে থাকাতে জানে বেঁচে গ্যাছে । অত্যন্ত মেধাবী দুই ভাই ই , মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ।
ওনাদের পাশের কয়েক টা রুম পরেই থাকতো ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর পরিবার, ওনার তিন বোন সহ। ওদের লাইনেই একটু ভিতরে স্নান করা, কলতলা এলাকার কাছেই থাকতো শামিম আহমেদ, ফরহাদ আহমেদ। নাফিজ আহমেদ
Comments
Post a Comment