এক দিনে তিন দেশ ভ্রমণ - ইমরান আহমেদ চৌধুরী

এক দিনে তিন দেশ ভ্রমণ 


ইমরান আহমেদ চৌধুরী 



জুল ভার্ন তার বিশ্ব ভ্রমণ করেছিল আশি দিনে শুনলেই গা’ টা কেমন জানি শিউরে উঠত সেই কিশোর বয়সে প্রথম যখন পড়েছিলাম । আসলে জুল ভার্ন কাগজে কলমেই ঘুরে এসেছিল বিশ্বভ্রমান্ধ - বস্তুত পক্ষে সে কখনো ফরাসীর বাইরে কোন দেশেই যায় নি জীবনেও ।
সেই শৈশব কাল থেকেই মনে মনে ইবন - ই - বতুতা কিংবা মার্কও পলো এর দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর সখ ছিল প্রকট । বিলাতে চিরস্থায়ী ভাবে অভিবাসনের আগে কেবল বাংলাদেশেই বসবাস করেছি মোট ২৪ টি স্থানে - ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়তে সর্বেসাকুল্যে মোট ১৪ টি স্কুলে পড়াশুনা করেছি ।
অবচেতন ভাবে কখন যে এই মনটা হয়ে গিয়েছে বিশ্বভ্রমান্ধ ঘুরে বেড়ানোর ভক্ত তা আজ ও নিজেই উপলব্ধি করতে পারি নাই , আর সে জন্যই মনে হয় ভ্রমণের কোন প্রকার সুযোগ পেলে তা আর সহজে হাতছাড়া করতে না করে হারিয়ে যাই - এই একবিংশ শতাব্দীর নব্য পর্যটক মার্কও পলো অথবা ইবন- ই - বতুতার মত । ঠিক এমনি ভাবেই গত ১৩ই অগাস্ট হারিয়ে গিয়েছিলাম জীবনের সকল কোলাহল, নিত্য নৈমত্তিক কাজকর্ম থেকে সন্তর্পণে পালিয়ে গেইয়েছিলাম এক সপ্তাহের জন্য —— গন্তব্য সেই জগত বিখ্যাত পর্যটক মার্কও পলোর শহর ভেনিসে ।



সেই ছোট শিশু বেলা থেকেই মা আর বাবার মুখে শুনেছি প্রাচ্যের ভেনিস হিসেবে পরিচিত আমাদের দেশের বরিশাল নগর এর কথা , এই শহরে প্রথম গিয়েছিলাম স্কুলে পড়াকালীন সময়ে স্কাউট ক্যাম্পিং এ পটুয়াখালী যাওয়ার পথে সেই ১৯৭৬- ৭৭ সনে । স্কাউট টিমের ট্রুপ লিডার থাকাতে বরিসাল শহরের সাথে ভেনিস শহরের মানসিক সেলুলয়েড গুলো প্রতিস্থাপন করার সুযোগ আর সেদিন হয় নাই । ঐ খাল, নদী, হ্রদ, সাগরের উপহ্রদ (লেগুণ), গোনডোলা সমৃদ্ধ ভেনিস শহর পানির উপর দাঁড়িয়ে আছে মনের পর্দায় সেই অনাবিষ্কৃত কৌতুহল হয়ে আজ প্রায় ৫৮ বছর যাবত ।
১৯৮৬ শরৎকাল এর এক সন্ধ্যায় পরিচিত হয়েছিলাম এক জন কম বয়স্ক যুবকের সাথে এক বন্ধুর নতুন বন্ধু - বেশ কিছু দিন পর তাকে প্ররোচিত করে চোরাশিকার করে নিয়ে আসলাম আমার কর্মক্ষেত্রে অনেক পটিয়ে এবং এ ও বলেছিলাম - আমার এখানে আসলে বিদেশ ভ্রমণ এর ও সুযোগ আসতে পারে ভবিষ্যতে । তারপর ক্রমে ক্রমে আমারা পরিণত হলাম বন্ধুতে । খুবই নম্র, ভদ্র এবং হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর । তখনও মাইক্রো সফট এর উইন্ডো এর যুগ আসে নাই - ডস বেইসেড কম্পুটার মাত্র ১৪০ মেগা বাইট মেমোরি একটা ফ্যাক্স বা চিঠি টাইপ করতে গেলে সারাদিন চলে যেত । তাই বিদেশি প্রিন্সিপাল, বাইয়ার, এজেঞ্ছি ধরতে হলে হাত দিয়ে বা ইলেকট্রিক আই বি এম টাইপ রাইটার এ ছিল শ্রেষ্ঠ সম্পদ । সারা দিন হাত দিয়ে লিখে ফ্যাক্স করেই কেটে যেতও ওর সারা দিন , মাথা গুঁজে কাজ করেই যেত - মেঘ না চাইতেই অনেক টা বৃষ্টির মত কাজ পেতে থাকলাম আমরা বিভিন্ন সেক্টরে ; ইন্ডেন্তিং, এজেঞ্ছি , গার্মেন্টস এবং সাপ্লাই এর বিদেশি প্রিন্সিপ্যাল এর অভাব নাই । ক্রমান্বয়ে; ধীর গতিতে বাণিজ্য লক্ষ্মীর দেখা মিলল মনে হল । বসির, জন, সোহরাব এবং ও সবাই একটা ভাল টিম বানিয়ে ফেললাম অবলীলাক্রমে ;
মাথাগুঁজে কাজ করতে লাগলো ফ্রেডী - ফ্রেড্রিক ডি কোস্টা তেজগাঁও হোলি রোসারি রোমান ক্যাথোলিক চার্চের পাদ্রী ফাদার গোমেজ ডি কোস্টার কনিষ্ঠ পুত্র ফ্রেডী । ১৬৭৭ সালে এই গির্জা নির্মিত ওরা ৬ পুরুষ (জেনারেশন) যাবত পাদ্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছে - দারুণ একটা মডার্ন এবং জ্ঞানী পরিবার ওদের । ঢাকার এলিট সোসাইটির একটি বর্ধিষ্ণু পরিবার । স্কয়ার ফার্মা, ঢাকার আর্চ বিসব থেকে শুরু করে বঙ্গভবন থেকে সর্বদাই আমন্ত্রণ পায় ঐ পারিবার । অনেক ধরনের সামাজিক উন্নয়ন মূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত এদের এই পরিবার - বর্গী ( পোর্টোগিজ ) রক্ত বহন করে আসছে ওরা গত ৪ শতাব্দী যাবত । একেবারে মনেপ্রাণে খ্রিস্টীয় ধর্ম অনুশাসন অনুযায়ী জীবন যাপন করে ওরা । ওদের দেখে মনে পরে যেতো আমার বাল্য কালের খ্রিস্টান বন্ধু অলক, কল্পনা এবং ডিঙ্গেদার একদা জমিদার পরিবার রয় চৌধুরী দের কথা ওরা মনে হয় ব্যাপ্টিস্ট ছিল । আর ফ্রেডীর পরিবার রোমান ক্যাথলিক এই যা বিভক্তি । কিন্তু, একদিন কথায় কথায় ও আমাকে বলল যে সে আসলে একজন এগ্নোস্টিক (অজ্ঞানবাদী) অর্থাৎ সে ধর্ম এবং ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে সন্দেহ প্রবণ এবং ধর্ম পালনে তেমন আগ্রহী নয় । ওর এই ধরনের খোলামেলা কথায় আমি আরও ওর ব্যাপারে কেমন জানি আগ্রহী হলাম - বন্ধুত্ব গাঁড় থেকে আর গাঁড় হয়ে গেল ক্রমে ক্রমে - নিজের অজান্তেই সে হয়ে গেল আমার সবচে বিসস্থ বন্ধুতে । অফিস শেষ প্রায়ই আইস ক্রিম খেতে চলে যেতাম কিন্তুকি অথবা ইন্টারকনের সুমিং পুলে বসে বসে কফি পান করতে করতে ওর কাছ থেকে পর্তুগাল, রোমান, জার্মান কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সব প্লেয়ার দের সম্পর্কে ওর ভাষ্য ধারা বিবরিনি শুনতাম । আইকমান, হিম্লার, গয়েবল, হিটলার সম্পর্কে ওর জ্ঞান ছিল অপরিসীম এবং বিভিন্ন আব্রাহমিক ধর্ম গুলোর গোড়াপত্তনের ইতিহাস ও বলেই যেত একটা টেপ রেকর্ডার এর মত । আরও একটা মিল খুঁজে পেলাম আমাদের মধ্যে সেটা হল সে ও আমার মত পর্যটক হতে চায় । সারা জীবন অবিবাহিত একাকী থাকার তার বাসনা ।







বিজনেস সম্প্রসারিত হতে লাগলো - ছোট বেলার বন্ধু আলিম এর সাথে একটা ফ্যাক্টরি তে একসাথে কাজ আরম্ভ করলাম ১ লক্ষ পিস লেডিস টপ এর ইতালিয়ান কোম্পানি এসিয়াটেক্স এর জন্য । বিরাট অর্ডার । আলিম রিকুয়েস্ট করলো ওর অফিসে কাজের অনেক চাপ তাই ওর ফ্রেডী কে দরকার - টেলেক্স এবং বাইয়ার দের সঙ্গে যোগাযোগ এর জন্য জাস্ট দিনে দুই ঘণ্টা পাঁচটার পর থেকে । আলিম ফ্রেড আর আমি এক কড়কড়া রোদেলা দুপুরে হোটেল সোনারগাঁ তে ক্যাফে বাজার রেস্তরাতে বুফে লাঞ্চ এর জন্য নিয়ে গেলাম ইতালিয়ান কোম্পানির বাইয়ার মারথা বিয়াঙ্কা কি সাথে নিয়ে । ভীষণ প্রচণ্ড গরম বাইরে আমার গাড়ী থেকে নামার সাথে সাথে মনে হল যেন আগুনের চুলার মধ্যে প্রবেশ করালাম - মারথা বলল এই গরম কিছুই না ওদের দেশে - শুনে আমরা অবাক । রেস্তরাঁতে আমরা এক টেবিল আর একটা মাত্র টেবিলে ছয়জন গেস্ট বাকি সব খালি - চুঁটিয়ে আড্ডা মারলাম সেই সন্ধ্যা পর্যন্ত গরমে আর ঐ শিতাতাপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে বের হতে ইচ্ছা হচ্ছিল না । প্রায় আমার থেকে এক ইঞ্চি লম্বা পাঁচ ফুট এগার ইঞ্চি লম্বা স্লিম তম্বী তরুণী মারথা অলিভ অয়েলের মত গায়ের রং বেশ খোলামেলা পোশাক পরনে তবে খুবই মার্জিত ; আধো আধো ভাঙ্গা ইংরেজি বলে বেশ সুন্দর ভাবে কথা বলে । পারিবারিক ব্যবসা ওর দাদার বানানো এই কোম্পানি - অনেক গল্প করলো - ১ বছর যাবত কাজ করছে মিলান ইউনিভার্সিটি এর বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইন ফ্যাকাল্টি থেকে সদ্য গ্র্যাজুয়েট হয়েই নিজেদের কোম্পানি তে যোগদান করেছে - ওর বাবা, ওর মা, তিন ভাই এবং ওর বড় বোন সবাই মিলে কয়েক মিলিওন মার্কিন ডলার টার্নওভার এর এই ব্যবসা চালায় - বাংলাদেশে এটাই ওদের প্রথম কাজ । শুনে আমার আরে ফ্রেড এর বুক টা ফুলে গেল - কারন ওদের সাথে আমরাই প্রথম যোগাযোগ স্থাপন করে নিয়ে এসে প্রথম অর্ডার আনি । আলিম এর তো চক্ষু চরক গাছে । আমাদের কে সর্ব সাকুল্যে প্রায় ৮ থেকে ১০ পারসেন্ট কমিশন পেতে শুনে ও প্রায় অপ্রকিতস্থ । মারথা যখন জানতে পারল যে ফ্রেড ও রোমান ক্যাথলিক তখন ওর আমাদের উপর আরও কেমন জানি আস্থা বেড়ে গেল - অবলীলায় প্রকাশ করে ফেলল যে ওরা আগামীতে আরও তিন চারটা কাজ আমাদের দিতে চায় - সব গুলোই ১ লক্ষ পিস এর মত । শার্ট, মেয়েদের শর্টস, ব্লাউস এবং মেয়েদের জিনস - ওরা শুধু মেয়েদের ফ্যাশন নিয়েই কাজ করে । গল্পে গল্পে ফ্রেড যখন বলতে লাগলো প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস, ক্লিওপেট্রা , মারক এন্থনি , জুলিয়াস সিজার, অগাস্টাস, কনস্টান্টিনোপল এর সম্রাজ্ঞী কেথেরিন, বিযেন্টাইন এবং অটোম্যান এর ইতিহাস মারথা এসব একজন বিদেশির মুখে শুনে হতভম্ব, বিহ্বল ও স্থম্ভিত হয়ে শুনতে থাকল সারাক্ষণ - ফ্রেডির দিকে ওর চোখের মায়াবী চাহনি দেখেই বুঝে ফেললাম কেল্লা ফতে। অভিজ্ঞ জহুরির তো আর খাঁটি সোনা চিন্তে ভুল হওয়ার কথা না । গল্পে গপ্লে মারথা বলল ওদের ফ্যামিলি অনেকতে অনেক মিশ্রণ দ্রবণে - ওর দাদী ইহুদি পোল্যান্ড এর, ওর দাদা ইতালিয়ান রোমান ক্যাথলিক, ওর মা জার্মান প্রটেস্টান্ট খ্রিস্টান, বোন এর বয়ফ্রেন্ড ব্রাজিলের এবং ভাই রা দুজনাই ইতালিয়ান সঙ্গী এবং দুজনাই রোমান ক্যাথলিক । ও নিজেও এতটা ধর্ম তে বিশ্বাসী না - কিন্তু সে খুবই গর্বিত একজন ইতালিয়ান রোমান হেরিটেয হিসেবে । ইতিহাস সম্পর্কে জানার খুবই তার আগ্রহ । তারপর সবই আজ বাস্তব অতীত সব আজ ইতিহাস - মারথা আর ফ্রেডী এখন দুই দুইটি কন্যার মাতাপিতা …।।
সেই ফ্রেডির আমন্ত্রণে আজ আমি ইতালির ভেনিসের উদ্দেশে রওয়ানা দিচ্ছি ……… ত্রিশ বছর পর ওর সাথে দেখা হবে আবার … ত্রিশ বছরের জমে থাকা কত কথা ……। হতে যাচ্ছে আমাদের মোলাকাত আবার ত্রিশটি বসন্ত পরে







-০- 
ভেনিসে  


দ্বিতীয় পর্ব 
 ফাতেমা হচ্ছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অবতার সে কোথা থেকে যেন শুনছে যে, ভেনিসের খাল গুলোর পানিতে নাকি খুবই দুর্গন্ধ তাই ওকে কোন ভাবেই ভেনিসে নিয়ে যেতে রাজী করাতে পারি নাই কিন্তু, ওদের সবাই কে এভাবে ফেলে রেখে একা একা ভেনিস এর মত এত প্রসিদ্ধ পর্যটন ডেসটিনেশন এসে সম্পূর্ণ আনন্দ টা পাচ্ছিলাম না ; মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম ভেনিসে একা একা সবই করবো কিন্তু ওদের সবাই কে ফেলে স্বার্থপরের মত ভেনিস এর সবচে বড় আকর্ষণ গন্ডোলা তে চড়বোনা  

স্টেশন এর লাগেজ রাখার বক্সে সাইড বাগ হোল্ডল টা রেখে লক করে দিয়ে বেরিয়ে পরলাম - ওহ ভীষণ গরম রোঁদ টা অত্যন্ত প্রকট , হাঁটতে হাঁটতে পঞ্চাশ গজ হাঁটতেই পেলাম একটা ছোট্ট বাংলাদেশিই টং জাতীয় দোকান - অনেক রকমারি জিনিস বিক্রি করছে - শুভ্যেনির, ব্যাগ, হেট, থেকে শুরু করে খেলানা, শ্যাল, সেলফী স্টিক সবই আছে আই দোকানে ; দোকানদার ৩০-৩৫ বয়সী এক যুবক ; ফ্রেডী আর অনর্গল ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলল আর এই ফাঁকে আমি একটা স্ট্র্ব জাতীয় একটা হ্যাট পছন্দ করলাম - আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল লোকটার নাম ঝন্টু  বাড়ি ফরিদপুরের শরিয়তপুরে , ১৮ বছর যাবত আছে এখানে রকম আরও পাঁচটা টং দোকান আছে তার ভেনিসে সপরিবারে বসবাস করছে এখানে - বউ, ছেলে এবং মেয়েরা সবাই একেক তা দোকান চালায় বেশ ভালোই আছে ঝন্টু সাহেব   একটু অপ্রুস্তুত মনে হচ্ছিল যদিও নিজেকে তবুও বিশ্বের অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ এই ভেনিসে আমার বাংলার এক বাঙালি কে দেখে বেশ গর্বই বোধ করলাম কুশলাদি বিনিময় শেষে কিছুতেই পয়সা নিতে চাইল না জোড় করে ইউরো দিয়ে আসলাম এবং ওর দেশপ্রেম আতিথেয়তা দেখে খুবই মুগ্ধ হলাম চলে আসার সময় বলল যাবার সময় যেন আবার দেখা করে যাই - তেলের পিঠা পাটালী গুড় দিয়ে বানানো ওগুলো খেয়ে যেতে বলল - শুনে মনটা ভরে গেলো বাঙ্গালীর অতিথি পরায়নতা বিশ্ব বিখ্যাত - এই জন্যই মনে হয় বাঙ্গালীদের রেস্তোরাঁ ব্যাবসা এত সফল সব খানেই  

হাঁটতে থাকলাম দুজনা ভেনিসের ক্যানালের পাড় দিয়ে প্রধান সেন্ট মার্ক স্কয়ার এর দিকে কিন্তু প্রত্যেক কদমে কদমেই থেমে থেমে আই ফোন অথবা আমার প্রিয় সনি সাইবার শট ক্যামেরা দিয়ে তুলতে লাগলাম ছবি তুলতে - ছবি তোলা আমার অন্যতম প্রধান সখ এই বিল্ডিং এর ছবি নেই, নয়ত খালের ছবি, অথবা স্পিড বোটে করে ছুটে যাচ্ছে একদল পর্যটক দেড় ছবি, কিংবা গন্ডোলা তে বসে আছে এক রোমান্টিক যুগল এবং নিপুণ হাঁতে লগি দিয়ে নিলিপ্ত  ভাবে নৌকার মাঝির চাতুরী - দুইটা দালানের মধ্যে খানে সরু খালের ভিতর দিয়ে কি সুন্দর ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে বা বয়ে যাচ্ছে তার প্রমোদ নৌকা - ভেনিসের অন্যতম প্রদান বৈচিত্র্য ময় এই নৌকা ( ওদের দেশে এটা কে বলে গন্ডোলা ) - একটু খারাপ লাগল আমি নিজে চরলাম না বলে - আমি দেখতে চাচ্ছিলাম নৌকায় বসলে নৌকা থেকে শহর টা কেমন দেখায় কিছুক্ষণ পড় পড় একেকটা ছোট্ট সাঁকো জাতীয় পুল এই খাল থেকে   খালে, এই দালান থেকে দালানে যাবার জন্য প্রায় ১৬০০ বছর যাবত এই নগরী টা দাঁড়িয়ে আছে পানির উপড়ে - সেই ৪২১ খ্রিস্টাব্দে ২৫সে  মার্চ শুক্রবার উচ্চ দ্বিপ্রহরের সময়   গোড়াপত্তন হয়ে ছিল এই শহরের ১১৮ টা  ছোট ছোট দ্বীপ জেগে উঠেছিল হয়তোবা কোন আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে এই অ্যাড্রিয়াটিক সমুদের শেষ পাড়ের কিনারে সেই কয়েক লক্ষ বছর আগে - সমতল  ভূমি থেকে  সাগরের পানি দ্বারা বিছিন্ন ; কেউ কি চায় এই রকম বিছিন্ন জায়গায় বসবাস করতে ? কিন্তু, জীবন মানেই সারভাইভাল ফর দি ফিটেস্ট ( শক্তিবান কেবল বেঁচে থাকতে পারে ) বর্বর দের আক্রমণ এবং আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্য এর এই দ্বীপমালায় বসতি গড়ে তুলে কিন্তু সমস্যা দেখা দিল জায়গার স্বল্পতা এবং পানির এত নিকটে কিভাবে টেকসই আবাস গড়ে তোলা যায় বর্বর রা পদাতিক আগ্রাসনে পটু ছিল ওদের সেই আমলে নৌ কেদ্রিক চলাচল পারদর্শী হয়ে উঠে তখনো তাই এই দ্বীপমালায় যারা বসতি গড়ে তুলেছিল তারা বর্বরদের তীক্ষ্ণ তরবারির কোপ থেকে রক্ষা পায় সে যাত্রা তারপর তারপরই সেই জনগণ আসতে আসতে গড়ে তুলে এই বিশাল নগরী , যেখানে এখন প্রতি বছর আড়াই কোটি পর্যটক পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এখানে বেড়াতে আসে জাহাজ ভড়ে ভড়ে, প্রমোদ তরী নিয়ে , প্লেন ভড়ে বছরের বারো মাসই  এখানে লোকে লোকারণ্য জলাশয়ের মধ্যে কাঠের স্তম্ভ পুতে পুতে সেই কাঠের স্তম্ভের উপর দালানের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করে ভিত্তি প্রস্তরের উপর নির্মাণ করে সব দালান এবং রাজ প্রাসাদ তুল্য অট্টালিকা গুলো - থরে থরে সাজানো দালান গুলো দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে - সেই সব কাঠের স্তম্ভ গুলো সেই মধ্য যুগের মিস্ত্রি রা এতই সুনিপুন ভাবে একটা স্তম্ভের গাঁ লাগিয়ে আরেকটা স্তম্ভ মাটিতে পুঁতেছে যা নাকি যাতে কাঠ ভেদ করে পানি দালানের পাদদেশে প্রবেশ করতে না পারে কাঠ সচরাচর পানিতে পচে না তাই এখন অনেক দালানের ভিত্তির কাঠ এর বয়েস এক হাজার বছরের অধিক প্রথম আগত পলাতক লোকজন জলবন্দী এলাকায় মৎস্যজীবীদের সাথে বসবাস করতে থাকে ক্রমান্বয়ে আরও মানুষরা আসতে থাকে বর্বর আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্যতখন দেখা দেয় জায়গার সংকুলতা - সবাই মিলে সমুদ্রের উপহ্রদ কাটে অনেক গুলো সংযোগ খাল আর আস্তে আস্তে গড়ে তুলে কাদায় পরিপূর্ণ জলাভূমিতে গড়ে তুলে এক বিশাল জনপদ ।ভরা জোয়ার এর সময় এক্যুয়া আলটা কারণে প্রায়শই এই নগরী প্লাবিত হয়   আজ অনেকেই ভেনিস কে নিম্মজিত শহর বলে ডাকে কিন্তু দালানের ভাঁড়ে কাদা এবং ময়লা গুলোকে সংকোচিত হয়ে একেবারে শক্ত ভিত্তি প্রস্তর হিসেবে কাজ করছে এবং  যার ফলে দালান গুলো এখনও দাঁড়িয়ে আছে আপন মহিমায় যদিও ১০০ বছরে এই শহর প্রায় ইঞ্চির সম পরিমাণ মাটিতে দেবে  গেছে এবং বিশেষজ্ঞ রা মনে করছে ২০২১ সালে হয়ত  এড্রীয়াটিক সাগরের এই উপহ্রদ টা প্রায় নিম্মজিত হয়ে যেতেও পারে এই শহর দেখে রাশিয়ান নামকরা এক লেখক আলেক্সজান্ডার হেরযেন একদা বলেছিলেন, ‘’ যেখানে শহর বানানো সম্ভব নয় সেখানে শহর বানানো পাগলামি , আর জায়গায় সবচেমার্জিত এবং এই রকম মহীয়ান  নগরী বানানো একটা  প্রতিভাবান  পাগলামির কাজ ‘’




জীবনের প্রথম আমি এই  রকম নগরী অবলোকন কর ছিলাম  আর প্রতি মুহূর্তেই হারিয়ে যাচ্ছিলাম চিন্তার অতল গর্ভে ; কিভাবে সম্ভব ; এরকম একটা কিছু বানানো মানুষের দ্বারা সেই ১৬০০ বছর আগে - অনেক গলি, অনেক ছতর, অনেক দালান, অনেক কোঠা, অলি গলি, নদীনালা, ফুটব্রিজ, সাঁকো, মূর্তি, ম্যুরাল, ইহুদি দেড় গেঁটও, খ্রিস্টান গির্জা, ইহুদিদের উপাসনালয় সিনেগগ দেখতে দেখতে হাজির হলাম সেন্ট মার্ক চত্বর ভেনিসের প্রধান মাঠ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী সেইন্ট মার্ক এর গির্জা - উপাসনালয় এটা শুধু চার্চ বা গির্জাই নয় এটাকে বলে  ব্যাসিলিকা ( রাজপ্রাসাদ)  - তার মানে হচ্ছে রোমান ক্যাথোলিক ধর্মের এই গির্জা টা একটি প্রধান উপাসনালয় অত্র প্রদেশের প্রধান ধর্মীয় যাজকের আসন ; একটা অপরূপ রাজ প্রাসাদ সম দালান এটা যা নাকি ইটালীয় - বাইজেন্টাইন  স্থাপত্য শিল্পের একটা উদাহরণ চোখ জুড়িয়ে যায় এই ব্রাসিলিকা টার অপূর্ব কারুকাজ খচিত নির্মাণ শৈলী দেখে নিজের অজান্তেই হারিয়ে গিয়েছিলাম অনেকক্ষণ ; একটা কোমল গলার আওয়াজে ভেঙ্গে গেলো আবার হারিয়ে যাওয়া টা অকপটে - পাশে দাঁড়িয়ে এক অপরূপা মহিলা প্রশ্ন করলো, আমি তার কয়েক টা ছবি তুলে দিতে পারব কিনা ? অত্যন্ত নম্রতার সঙ্গে উত্তর দিলাম অবশ্যই - নীল প্রিন্টের লঙ ড্রেস পরিহিত স্লিম, অনেক লম্বা, একেবারে স্বর্ণকেশী নারী - প্রায় অনেক গুলো পোজে প্রায় গোটা ত্রিশ ছবি তুলে দিলাম, বার বার সে ক্ষমা চাচ্ছে আমাকে বিরক্ত করার জন্য - সে একা এসেছে আর্জেন্টিনা থেকে প্রমোদ তরীতে করে সঙ্গে মা আর বাবা এবং সে , তরী ভিড়েছে ভেনিসের তীরে আজ সকালে আবার যাত্রা শুরু করবে ক্রোয়েশিয়া মুখী আগামী কাল রাত্রে মা বাবা অনেক বয়স্ক ওরা ক্লান্ত হয়ে জাহাজে ফিরে  গেছে ঘণ্টা খানেক আগে - আর একা সারারাত কাটাবে রাতের ভেনিস এর সৌন্দর্য দেখে  দেখে কিন্তু কিছুক্ষণ আগে সেলফি ষ্টীক টা মাটিতে রেখে হাত ছবি তুলতে গিয়ে ওটা পানিতে পড়ে গেছে তাই অগত্যা আমার শরণাপন্ন হতে হয়েছে কুশল বিনিময় করার সময় বলল তার নাম জুলিয়েটা ; বুয়েনেস আইয়ারস থাকে ; মার্চেন্ট ব্যাঙ্কে চাকরী করে - আমি যখন বললাম আমি লন্ডনে থাকি   বলল সে খুব শিগ্রিই লন্ডন আসবে বেড়াতে ; ওর খুব সখ স্কটল্যান্ড এবং লন্ডন শহর দেখার , কথা প্রসঙ্গে এও বলল যে ওর বাবা ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় আর্জেন্টাইন আর্মি তে লেফটেন্যান্ট ছিল এবং যুদ্ধে ওর বাবা ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে রেড ক্রস এর মাধ্যমে ছাড়া পেয়েছিল মাস পর - ওর বয়স তখন বছর আমিও বললাম আমি তখন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমী তে ট্রেনিং রতঃ হবু লেফটেন্যান্ট এই সব বলতে বলতেই ফ্রেড এসে বলল চলেন আইসক্রিম খাই - আমি বললাম চলো - জুলিয়েটা কেও আমন্ত্রণ করলো আমাদের সাথে আইসক্রিম  খাবার জন্য  

ফ্রেডী কে গেয়ে শুনালাম, ‘’ জলকে চলে লো কার ঝিয়ারি রূপ ছাপে না তার নীল শাড়ী ( গাউন) ‘’ - দুজনাই অনেক ক্ষণ মনখুলে হাসলাম - মহিলাটা জিজ্ঞেস করলো কেন আমরা এত জোড়ে হাসছি - নজরুল ইসলামের কবিতা টা কে মার্চেন্ট অফ ভেনিসের মত ইংরেজি তে অনুবাদ করে শুনালাম - শুনে বেশ সংকোচিত হয়ে লজ্জা পেল যেন মনে হল এই আজে বাজে কথা বলতে বলতে একটা বেশ নামীদামি হোটেলের লবিতে ঢুঁকে গেলাম আমরা তিন জন - লবির শেষ প্রান্তরেই আইসক্রিম পার্লার টা দেখতে পেলাম - হোটেল এর লবি দেখলে চোখ ধাধিয়ে যাওয়ার অবস্থা - চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ফুট উপর থেকে ঝুলিয়ে এসেছে ঝাঁর বাতি গুলো, ওক কাঠের চকচকে ভারনিস কড়া কাঠের প্যানেল দিয়ে ঘেরা দেওয়াল , বিশাল বিশাল ভেনিসের বিশ্ব বিখ্যাত চামড়ার সোফা গুলো, পিতলের দরজার হান্ডেল গুলো চকচক করছে যেন এই মুহূর্তেই কেউ এগুলো পলিস করে দিয়ে গেছে ; সব অতিথি রা নিচু গলায় কথা বলছে আর লবির আরেক প্রান্তে এক বিশাল পিয়ানোর সামনে বসে মনের সুখে  লুছিয়ানো পাভারতির সেই প্রসিদ্ধ  ইতালিয়ান অপেরা টেনর এর ‘’ চে গেলিদা মানিনা ‘’ গান টা বাজ্জাছে আর গাইছে উচ্চ মর্গে এক অপূর্ব পরিবেশ - সৌন্দর্য, প্রাচুর্য, নীরবতা, মহীয়ানতা, সম্পদের বহিঃপ্রকাশ এবং এরিস্টোক্রেছী এর সংমিশ্রণ করে তুলেছে হোটেল টা কে দারুণ রোমান্টিকতার স্বর্গে। 





একটা খালি সোফায় বসলাম - বসে বসে অপেক্ষা করছিলাম ওয়েটার এর অর্ডার দিবার জন্য প্রথমে কথা সেই শুরু করলো অনেক গল্প করলাম - তিনটা আইসক্রিম অর্ডার দিলাম ওকে অফার করলাম এক গ্লাস লারয ইতালিয়ান কিয়ানতি ক্লাসিকো রেড ওয়াইন সে খুব আশ্চর্য হল আমি ওয়াইন নিলাম না - ফ্রেডী নিলো একটা বিয়ার আর আমি শুধু বাদাম বিহীন লেবু ফ্লেভার এর আইসক্রিম খাচ্ছি দেখে - ফ্রেডী কে বুঝাল যে আমি একজন রেস্তোরাঁর এবং ওয়াইন বারের মালিক ছিলাম একদা তাই আমার ইতালিয়ান এবং আর্জেন্টাইন সহ সকল দেশের ওয়াইন সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান আছে যদিও আমি নিজে কখনো ওয়াইন পান করি না  

এক গ্লাস থেকে - - - গ্লাস ওয়াইন আর ফ্রেডীর বিয়ার প্রায় টা তে যখন তখন বিল দিয়ে বের হয়ে আসলাম সেই প্রাসাদোপম হোটেল থেকে দিব্বি হেঁটে বেড়াতে লাগল জুলিয়া কথার ফুলঝুরি তার মুখে - অনর্গল কথা বলতে লাগলো, নিয়ন বাতির আলোতে ওর মুখটা লাগছিল অস্পরা দের মত আর যখন প্রাণ খুলে হাসছিল তখন রাতের আলোর বিকিরণ ওর দাঁত গুলো মনে হচ্ছিল যেন সাগরের পাড়ে মুক্তা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে সে বেশ টলটলায়মান মনে হল ; ফ্রেডী আবার এইসব সময়ের জন্য ওস্তাদ বিদেশীনি মহিলার স্বামীতো সব জানে ; ঘড়িতে রাত প্রায় নয়টা - বলল চলেন সলিড কোন খাদ্য খাই - তাহলে প্রকিতশ্ত হয়ে যাবে - তিন জনে মিলে ডিনার করলাম একটা কোশার রেস্টুরেন্টে - দারুণ মজার হমুস আর সবাই আমার পছন্দ মত ব্রেইসড কর্ণ বিফ ব্রিস্কেট খেল সাথে আলু এবং সালাদ  সঙ্গে ব্রেড  

খেতে খেতে সময় ঘনিয়ে এলো আবার বিদায় নিবার পালা - সমুদ্রের মধ্যে খানে ওর বিশাল নয় তালা প্রমোদ জাহাজে একটা স্পিড বোট ভাড়া করে ওকে ওর জাহাজে উঠিয়ে দিয়ে আমরা আরও ঘণ্টা খানেক হাঁটাহাঁটি করলাম সমুদ্র তটে, রাতের আলোয় স্পিড বোট থেকে আলোকিত ভেনিস নগরীর রূপে পাগল প্রায় আমি ; দুচোখ জুড়িয়ে দেখলাম এই অপূর্ব ঐতিহাসিক নগরী - ইতিহাসের পাতায় পাতায় কত বার যে বারংবার হোঁচট খেয়েছি এই নগরীর গল্পের কাছে , সেই রোমান আমলের পড় মধ্য যুগে মার্কও পলো পর্যটকের বই ট্র্যাভেলশ অফ মার্কও পলো - সে কিভাবে বাংলার বানানো মসলিন দেখেছিল দামাস্কাসে, অটোমান সাম্রাজ্যের সময় ভেনিসের প্রসিদ্ধ প্রকাশক আলাসেন্দাড়ো পাগানিনি ১৪-১৫  শতকে পবিত্র কোরান ছাপাতো এই  ভেনিসে এবং পৃথিবীর অন্যতম প্রসিদ্ধ কাঁচের শিল্প গড়ে উঠেছিল এই নগরীতে এখানেই শুরু হয় ভেনিসিয়ান গ্লাস এবং অরনেট ( অলংকৃত ) কাঁচ এর শুভযাত্রা এখানেই শুরু  


রোমান্স বিহীন রোমান্টিক নগরীকে আস্তে আস্তে পিছনে ফেলে যাচ্ছে আমাদের ওয়াটার ট্যাক্সি টা প্রধান ক্যানেল ধরে একের পর এক ব্রিজের নিচ দিয়ে ভেনিস ট্রেন স্টেশন এর দিকে রাতের আলোতে জ্বল গুলো ঢেউএ ঢেউয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে আলোর ধারা গুলো - সে যেন স্বর্গীয় প্রিস্মের প্রতিছবি মৃদু মন্দ দোলায় ঢেউ খেলা আলোর রশ্নিতে ভেনিসের প্রতিচ্ছবি পানিতে ; এভাবেই ক্রমশ পাড়ে নোঙ্গর কড়া পন্টুনে এসে থেমে গেলো আমাদের ওয়াটার ট্যাক্সি .....…. তড়িৎ উঠে  গেলাম স্টেশনে ট্রেন ছাড়তে মিনিট সেকেন্ড কেবল বাকি - লকার খুলে হোল্ডল টা কাঁধে নিয়ে দৌড়ে গেলাম প্লাটফরমে - স্ক্যানারে টিকেটের গন্ধ শুকিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই আলাউদ্দিন আর চল্লিশ চোরের মত দরজা টা ছিছিম ফাঁকের মত খুলে গেলো আর আমরা দুজন হুমড়ি খেয়ে ট্রেনে উঠে বসলাম পারদোনোনা যাবার উদ্দেশ্যে।। বিদায় ভেনিস ..….









পারদোনেন  কোভোলি পর্বত চূড়ায়


  



তৃতীয় পর্ব 


ভেনিস থেকে রাত দুটার সময় এসে পৌঁছলাম পারদোননে  - স্টেশন এই গাড়ী পারকিং করা ছিল ; সোজা ফ্রেডীর ভিলা তে চলে গেলাম ; কাপড় চোপড় খুলে চেঞ্জ করেই শাওওার টা সেরে নিলাম চটপট একটা  স্ত্রং কাপ চা নিয়ে বসে শুরু হল আমাদের গল্প - সেই গুলশান ২৫ নম্বর রোডের বাড়ির সেই অফিস, থেকে ইতালির ভিসা , প্লেনে উঠিয়ে দেওয়া থেকে প্রথম কয়েক মাস চিঠি পত্র আদান প্রদান, তারপর ফ্যাক্স, এবং দু একটা ফোন কল অতঃপর সব শেষ - এক বছর পর আমি চলে আসলাম লন্ডনে - যোগাযোগ ওইখান থেকেই বিচ্ছিন্ন ; ঢাকায় বসিউর এর কাছে মাঝে মাঝে শুনতাম গল্প কিন্তু ব্যাটে আর বলে সংযোগ আর হয় নাই গত ত্রিশ টি বছর ধরে ; ইতিমধ্যে বুড়িগঙ্গায়  অনেক জল গড়িয়ে গেছে সেই ঢাকা আর ঢাকা নাই - এয়ারপোর্ট রোডে উত্তরা তে আগের মত আর ১২০ মাইল বেগে গাড়ী চালানোর কোন সুযোগ নেই আর মানিক মিয়া আভ্যুনে তে ১৮০ ডিগ্রি টার্ন করার কথা স্বপ্নেও ভাবা যায় না মহাখালীতে ফ্লাই ওভার শুনলে ক্যামন লাগে , কামাল আতাতূরক আভ্যনুতে দুপাশেই বিশাল বিসাল হাই রাইজ বিল্ডিং বনানী বাজার কোথায় যেন হারিয়ে গেছে ; ভূতুড়ে বনানী ১১ নম্বর এখন সারাদিন রাত  লোকে লোকারন্নন্য চিনার কোন উপায়ই নাই ওর মাথায় উস্খখো খুস্খো সাদা পাক চুল, চোখে চশমা, কত যে চেঞ্জ ; টগবগে একটা ২০ - ২১ বছরের তরুণ সেই ছিপচেপে মানুষ টা আজ প্রায় ৫৫ বছরের মধ্য বয়সী বেক্তিত্ত এক্সট্রিম ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির ছি ডি ( কম্পুটার এইডেড ডিজাইন )   এর ডিরেক্টর ; লন্ডন ওয়েম্বলি স্টেডিআম আর রিট্ট্রাক্টএবেল ছাউনি বানিয়েছে ওদের   কোম্পানি, ওর পরিবার আমাদের পরিবার, মা, বাবা, ভাই দের কথা বলতে বলতে সকাল :৩৫ মিনিটে ঘুমাতে গেলাম দুইজন দুপুর বারো টায় ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার ; উঠেই এক কাপ লেমন চা বানালাম আর আমার উঠার আওয়াজে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল দুজনা এক সাথে চা পান করেই ড্রেস পরেই বেড়িয়ে পরলাম ; পারদোনেন শহর টা দেখতে নদী একটা আছে খুবই সুন্দর একদম ছবির মত দেখতে ; ভীষণ খরস্রোতা ; পাহাড়ের চূড়ার সব বৃষ্টির পানি এই নদী দিয়েই নেমে আসে একদম ভিউ কার্ডের মত একটা শহর - নেই কোন কোলাহল, নেই কোন ব্যস্ততা, নীরব ছিমছাম পরিছন্ন একটা শহর, দেখা হলেই এক আগন্তক আরেক পথচারী কে অভিবাদন দিচ্ছে , বনজ জি বলে ; কি সুহৃদ সম্পর্ক আমাদের দেশের মত 
এক জন আরেক  জনের দিকে কর্কশ নেত্রে চাহনি  দেয় না লন্ডনের চেয়ে অনেক গরম ওখানে ; হাঁটতে হাঁটতে শহরের মধ্য খানে চলে আসলাম ; বিশাল এক টা গির্জা আর গির্জার পাশেই ২৭০ মিটার উঁচু চার্চের টাওয়ার সেই ১২শ খ্রিস্টাব্দে বানিয়েছে  








ভাবতেই আশ্চর্য লাগে ; টাওয়ার এর নিচের তলায় হল ওই শহরের ক্ষুদ্র জেলখানা ; অল্প কয়জন ২০ জনের মত লোক এর জায়গা হবে মন হল ; বিবিলীওটেকা  মানে হল লাইব্রেরি থ্যাকে থ্যাকে ইতালীয় ভাষায় বই সাজানো, বাচ্চাদের এবং বয়স্ক দের আলাদা আলাদা সেকশন ; নীরব নিশ্তব্দ চারপাস নেই টু শব্দটিও যে যার মত বই এর পাতায় নিমগ্ন ; অনেক হাঁটলাম সেই প্রসিদ্ধ রোমান ইট বিছান কব্যল স্ট্রিটে ; ক্লান্ত এবং গরমে দুস্তর মত ঘেমে কর্দমাক্ত ; উপায়ান্তর না পেয়ে একটা বারে ঢুকে দুজনা দূটো আইস ক্রিম খেলাম পেভমেন্টে বসে বসে সম্পূর্ণ একেবারে পর্যটক দের মত হালফ শর্টস পরা মাথায় হ্যাট, গলায় ঝুলান ক্যামেরা, রাক্সাকে ভরা পানির বোতল, সান ক্রিম, ওয়াকিং স্টিক এবং অন্যান্য সামগ্রী ইতালির প্রত্যেক শহরেই পাবলিক দের পানি পান করার জন্য রয়েছে পানির ফোয়ারা  

মানুষ মানুষের সৌহার্দ পূর্ণ  সম্পর্ক দেখে আমি অভিভূত ; আমাদের কে ওরা শুভেচ্ছা জানাতে কোন প্রকার কৃপণতা দেখাচ্ছে না আরও অনেকক্ষণ হেঁটে শহরের  আরেক প্রান্তে এসে একটা লেবানিস রেস্তরা তে


ঢুকে হমুস আর ব্রেড সাথে ল্যাম্ব শওারমা কেবাব খেলাম দুই বন্ধু মিলে   আশ্চর্য হলেও সত্যি বন্ধু আমার মানিব্যাগে হাত দিতে দিচ্ছে না - দেখে বিব্রত এবং রাগান্বিত হলাম ওর উপর একটু কিছুতেই শুনল না আমার কথা খেয়ে দেয়ে আবার বের হলাম হাঁটতে হেঁটে চলে শহরের জাদুঘরে ; সেই রোমান, গ্রিক, খ্রিস্টান, বর্বরদের আক্রমণ এবং পারটিসান হয়ে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ইতিহাস থেকে শুরু করে ওশট্র হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য  হয়ে হ্যবসবারগ ডাইনাস্টির  ইতিহাস সহ এই এলাকার কোন খুটিনাটি কোন কিছুই বাদ পরে  নাই এদের সংরক্ষণ থেকে - একেবারে অভিভূত  হয়ে গেলাম ; রোমানদের পোশাক এবং ওদের খাঁদি কাপড় দেখে মনে পরল ২৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার তাঁতিদের বানানো খাঁদি কাপড় রোমান দের নিকট রপ্তানি করা হতো - টলোমির বই তে কোথায় জানি একবার পড়েছিলাম আবার আরেকটা বড় লাইব্রেরী একটা দেখে ঢুঁকে পরলাম - কি পরিচ্ছন্ন - এখানেও তাই বাচ্চাদের আলাদা পড়ার জায়গা আর এক পাশে বয়স্ক দের - ১০০% বই ইতালিয়ান ভাষায় লেখা ; সেই খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ইতিহাস ভরা এই বিব্লিওটেকা ( ইতালিতে লাইব্রেরি কে তাই বলে ) ঘণ্টা খানেক বসে বসে চতুর্দিক অবলোকন করলাম আর ওদের লাইব্রেরির ওএইচ পি তে দেখতে লাগলাম ইতিহাস সমৃদ্ধ ছবি সেই ক্যামেরা আবিষ্কার হওয়ার আদি কাল থেকে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ এর ইতিহাস এবং দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ফাসিস্ট মুসলিনি এবং হিটলার - হলোকাস্ট এসব নিয়ে অনেক ছবির সংগ্রহ এই বেবিলিওটেকা তে মনে হল এটা মনে হয় এই শহরের পাবলিক লাইব্রেরি বোধ হয়। 

বাইরে ভীষণ কড়া রোদ রাস্তা ঘাট জনশূন্য - অগাস্ট মাস মানেই হোল সবার হলিডে - পুরা দেশ ছুটি কাটাচ্ছে ওদের দেশের লোকেরা অন্য দেশে যায় আর অন্যান্য দেশের মানুষেরা ওদের দেশে আসে ইউরোপে বছরে দশমিক বিলিয়ন মানুষ ট্যুর করে কম্যুনে ( ওদের পৌরসভা অফিস) একদম শুন্য - মনে মনে ভাবলাম - চুয়াডাঙ্গা পৌর সভার কথা - কারণে অকারণে অফিসে কম করে হলেও থেকে ৩শ মানুষ ঘুরে বেরাতো ; নাই কোন দালাল, ফড়িয়া , নাই মুহুরি, নাই কানভাসার বা প্রদীপ চানাচুর ওয়ালা নিশ্তব্দ নিসচুপ পরিছন্ন একটা পরিবেশ - ওইখানে বোর্ডে থরে থরে ছবি গুলো সুন্দর করে সাজিয়ে বাধিয়ে রেখেছে যেই সব জনগণ অতি সম্প্রতি কালে মৃত্যু বরন করেছেন - তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি ; কি সুন্দর ওদের কালচার  





বেলা প্রায় টা বাজে রওনা হলাম শহর থেকে ২০ - ২৫ কিলোমিটার দুরে আলপাইন পর্বত মালার প্রথম নিকটবর্তী চুড়া উদ্দেশ্যে সেই ১৯৮২ সালে বি এম তে ওডিটোরিওয়াম মিলিটারি জিওগ্রাফীর ক্লাস নিচ্ছিলো লেফটেন্যান্ট সারওার - সম্পূর্ণ ক্লাস মাত্র আমরা হাঁতে গোনা ছাড়া সবাই গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন তখন সারওার বলেছিল আলপাইন পর্বত মালা একটি টারসিয়ারী পর্বত মালার অংশ - টারসিয়ারী পর্বত মালার বংশ শেষ হয়েছে হিমালয় পর্বতে - বেশ ভালোই লাগল যে আজ ৩৬  বছর পরও লেসন টা ভুলি নাই ; আজ আমিও দ্রুত গাড়ি হাঁকিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আলপাইন পাহাড় মালার একটি চুড়া মাউন্ট কোভালির দিকে - ফ্রেডি বলল বস আজ রাতে আমরা পাহাড়ের গহীন একটা গুহার নিকট যেয়ে তাঁবু গাড়বো সন্ধ্যা হওয়ার পড় - খানেই বার বি কিউ করে রাতের খাবার খেয়ে গাড়ির ভিতরে ডিঁকি তে করে নিয়ে আসা একটা তাঁবুতে ঘুমাবো - জিজ্ঞেস করল কোন অসুবিধা নাই তো  



পাহাড়ের চুড়া প্রায় হাজার ছয় ফুট আমরা প্রথম রাতে সন্ধ্যা হবার আগ পর্যন্ত ১২ থেকে ১৫শ ফুট উপড়ে উঠেই রাত নামার আগেই তাঁবু গাড়ব ; গাড়ি এসে থামল মাউন্ট কোভোলা পর্বতের স্কি শ্লোপের পাদদেশে - গাড়ি পার্ক করে সব নামালাম - দুজনার কাছে ওজন প্রায় ৬০ - ৭০ কেজি নিয়ে উঠতে শুরু করলাম পর্বতে ; সে এক কঠিন যাত্রা - গ্রীষ্ম কালে সব সবুজ পাতায় ঢাকা আর শীত সব সফেদ সাদা বরফে আচ্ছাদিত পাঁচ থেকে ছয় ফুট বরফে সব ঢাকা পরে যায় বছরের - মাস লক্ষ লক্ষ স্কিয়ার এসে এখানে স্কি করতে আর এখন আসে পর্বত আরোহী রা যারা হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের চুড়ায় যেয়ে আবার হেঁটে নেমে আসে কয়েক হাজার লোক , বাচ্চা, আবাল , বৃদ্ধ, বনিতায় একাকার পুরা এলাকা পা গুলো ক্লান্ত হয়ে গেলো ঘণ্টা খানেক হেঁটেই ; তার জিপি এস দেখল আমরা প্রায় ফিট উপড়ে উঠে গেছি অনেক জায়গায় পাহাড়ের উঠার পথ প্রায় ৬০ ডিগ্রি খাঁড়া স্লোপ, উঠতে খুবই কষ্ট হয় , তার উপর অনেক বছরের অভ্যাস নাই পাহাড় উঠার   








সন্ধ্যা প্রায় সমাসন্ন - সহসা উপলব্ধি করলাম প্রচণ্ড ঠাণ্ডা - নিচে ছিল ২৭ ডিগ্রি আর ওর জি পি এস ওখানে তাপমাত্রা মাত্র . ডিগ্রি   ঘাড় থেকে সব কিছু নামিয়ে সেই আগের জীবনের স্কাউট এর মত দুজনাই ব্যাস্ত হয়ে পরলাম আলো শেষ হবার আগেই তাঁবু গাড়ার এর শুকনো লাকড়ি - কাঠ বা শুকনো পাতা যোগাড় করতে - বার বি কিউ করে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য তাঁবু ঠিকঠাক দুটো পাহাড় চুড়ার ভ্যালিতে লাগালাম যাতে রাতে ঠাণ্ডা বাতাস কম লাগে আর কাছেই পেয়ে গেলাম একটা ঝর্নার নালা - একদম স্ফটিক এর মত পরিছন্ন পানি - একটা স্যাডেল জাতীয় প্লেটু মনে হল জায়গাটা গ্রিড রেফেরনেস নিয়ে আই ক্লাউুডে সেভ করলাম আর আপন পজিশন ফাতেমা কে এমেল করে দিলাম সঙ্গে সঙ্গে তাঁবু গাড়ার পর এক ঝলক সূর্যের আলোর দেখা পেলাম কয়েক মিনিটের মত ; তার পর কখন যে কালো রাত নেমে আসল তা আর টের পেলাম না - রাতের আহার বানাতে ব্যস্ত হয়ে পরলাম দুজনাই .........










চলবে …….


Comments