১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস: সিলেটের প্রথম বিদ্রোহ : শমশেরনগর
ইমরান আহমেদ চৌধুরী
৪৬ বছরে ডাইরির পাতা গুলো প্রায় ম্রিয়মাণ । কঠিন হাতের লেখা এক ধরনের ইউনিক এক হাতের লেখা থেকে সারাংশ বের করে লেখা বেশ কষ্টকর ।
৩ উইং ই পি আর এর উইং কম্যান্ডার ২৪ সে মার্চ রাতে হটাত সুবেদার ফজলূল হক চৌধুড়ী ডেকে বললেন চৌধুড়ী সাব গেট ইয়োর কোম্পানি রেডি। এন টি এম টু ( নোটিস টু মুভ) আওয়ার । গো এন্ড ছিকওর শমশেরনগর এয়ার পোর্ট । এই এস ডিউটি ( ইন্টারনাল সিকুরিটি ডিউটি ) । ওকে রিপোর্ট বাই টুমরো লাস্ট লাইট । টু আই ছি ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল উইল জয়েন ইউ সুন । বে রেডি টু রিসিভ হিম । টেক অল আভেলাবেল ম্যানপাওয়ার । থ্রি থ্রি টন ট্রাক এন্ড ওয়ান পিক আপ । ফার্স্ট লাইন পাউছ এমুইনিসন। গো এ এস এ পি । আপ কি উপর হামারা বহুত ভরসা হ্যাঁয় । ইয়ে শালা মালাউন লোগোকি ইয়ে সব বন্ধ হনা চাইয়ে। নেহি তো বহুত পস্তানা প্যাঁরে গি ইয়ে সব কাফির কো । এইসে লেসন দেনা হ্যাঁই তাক্রিবান কাভি বি ইয়ে পাকিস্তান তোর নে কি আওয়াজ নিহে লে না প্যাঁয়ে - আপনে শামযহে না মেরে বাত। যা বলা তাই কাজ - মনে মনে একটু খুশীও হল যে যাক হেড কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে যেতে পারছি এটাই সৌভাগ্য বলতে হবে । ঐ পাঞ্জাবি উইং কম্যান্ডার মেজরের কথায় মেজাজ টা একদম খারাপ হয়ে গেলো - ২৪ বছর এক সাথে থেকেও ওরা ভাবছে আন্দোলন বাঙ্গালি হিন্দুয়াই করছে মসুল্মান না - অথবা ওদের চোখে আমরা এখনো পুরদমে মসুল্মান না ! মনে হচ্ছিল কষে একটা বাম গালে থাপ্পড় মারতে পারলে ভালো লাগত । ওর কথায় বুঝা গেলো পরিষ্কার ওরা আমাদের কতটা অবমাননার চোখে ও ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে । কোন কথা না বলে স্যালুট দিয়ে বেরিয়ে এসে প্লাটুন কম্যান্ডার ও কোম্পানি হাভিলদার মেজর কে ডেকে পাঠাল । ডেকে এনে সব বিফিং দিয়ে দিল ; এক ফাঁকে রুমে যেয়ে পারসোনাল পয়েন্ট থ্রি টু স্মিথ এন্ড ওয়েসন পিস্তল টা সাথে নিয়ে বেরিয়ে এসে ব্যাটম্যান বাতেন কে বলল সব বেডিং এবং সুইটকেস আই এস ডিউটিতে যাবার জন্য তৈরি করার অর্ডার দিয়ে বেরিয়ে পরল সিভিল কাপড় পড়ে । একটা রিক্সা ব্লু বার্ড ৩ উইং হেড কোয়ার্টার থেকে নিয়ে শহরে চলে গেলো - পরিস্তিতি জানার জন্য । অনেক রাতে ফিয়ে এসেই ঘুমিয়ে পরল সকাল রওনা দেবার জন্য ; টাউন এ গুজব আর গুজব ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট খাডিম নগর এ ক্যাম্প করেছে - শহরে টহল দিচ্ছে অবিরত । জিন্দাবাজার এ মিছিল মিটিং নিষিদ্ধ ; হাল্কা ১৪৪ ধারার মত । রাত নয়টার ভিতর সব দোকান পাঠ বন্ধ। শহর প্রায় খালি - প্রাণহীন রিকাবিবাজার, মেডিকেল কলেজ, অ্যাম্বারখানা সব যেন কেমন থমথমে ।
আখালিয়া থেকে তিন থ্রি টন ভর্তি সৈনিক আর ও শেভ্রলে পিক আপ এ চার জন আর সামনে ড্রাইভার রফিক ও চৌধুরী সাহেব । জমাদার স্পিং গুল প্যারেড বুঝিয়ে দিল সর্ব ৯১ জনের কাফেলা নিয়ে ধীর গতিতে বের হয়ে গেলো - কোতে নায়েক ঝুম্মা খান একটু অস্ত্র শস্ত্র দিতে গড়িমসি করছিল - কোম্পানি কমান্ডারের ধমকে ঘাবড়ে যেয়ে সব দিয়ে দিল । রেশন উঠানো হল প্রায় ১৮ দিনের বাকি টা জুরি অথবা তেলিয়াপারার কোম্পানি থেকে নিয়ে আসতে পারবে - ২০ দিনের ফ্রেস এর পয়সা নগদ দিল উইং কোয়ার্টার মাসটার হাভিলদার তাজ মোহাম্মাদ ভাট - একটা বেয়াদব কিসিমের মানুষ সে একটা - । ঠিক সকাল ৮ - ১৫ তে ও কে রিপোর্ট দিয়ে বের হয়ে গেলো ৩ উইং ই পি আর এর ব্রাভো কোম্পানি ৯১ জন কে নিয়ে থেকে গেলো ২১-২২ জন আর ছুটিতে ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে মিলিয়ে আরও ১০ জনের মত - ১৬ এবং ১৭ উইং নতুন দুটো ইউনিট দাঁড় করার সময় অনেক সৈনিক ঐ দুটো উইং চলে যাওয়াতে কোম্পানির লোকবল কম। সামনের পিক আপ এ চৌধুরী সাহেব আর শবে শেষ থ্রি টনে জমাদার গুল ।
শহর একদম ঠাণ্ডা - গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে - পুরাতন মেডিকেল কলেজ - চৌহাটটা মোড় ঘুরে জিন্দা বাজার - কোর্ট কাচারি এর পড় সরীসৃপের মত উঠে গেলো দেশ বিখ্যাত কিন ব্রিজে । রাস্তা খালি - পিচ ঢালা পথ শেষ ফেঞ্ছুগঞ্জের রাস্তায় হেরিংবোন খান্দা কন্দর পাড় হয়ে আস্তে আস্তে সহসা এগুতে থাকলো ফেঞ্ছুগঞ্জের উদ্দেশ্যে - ইচ্ছা করেই প্রধান সড়ক না নিয়ে এই পথে আসলো - রাস্তায় রোড ব্লক , গাছ ফেলে রেখে অনেক রাস্তাই তখন বন্ধ ছিল । অল্প রাস্তা তথাপিও মংলা বাজার স্টেশন পর্যন্ত আসতে লেগে গেলো প্রায় এক ঘণ্টা - সব গাড়ি থামিয়ে বিশ্রাম দিয়ে চা টা পান করে নিলো - আসে পাশের রাস্তার খোঁজ খবর ও সব জেনে নিলো। থমথমে পরিস্থিথি - সবার চোখেই কেমন যেন একটা আতঙ্ক আতঙ্ক ভাব । স্টেশন মাসটার এসে বললেন আখাউরা থেকে সায়েস্তাগঞ্জ পর্যন্ত ট্রেন লাইন অনেক জায়গায় উঠিয়ে ফেলেছে । উত্তাল সময় বংগে । ফরহাদ হাভিলদার মেজর জি ডেকে ক্যানে ক্যানে জিগ্যেস করলো ওরা কয়জন - হাঁতে গুনে বলল স্যার ১ জেসিও , তিন এন সি ও আর ছয় সেপাই পাঞ্জাবি, পাঠান, বালুচ আর বিহারি মিলিয়ে । ফিলিপ্স ছয় ব্যান্ডের রেডিও টা অনেক কসটে অন করে সকাল ১০-৩০ বিবিসি মার্ক টালির সকালের খবর টা শুনার চেষ্টা করেও পারল না । ১১ টার সময় আবার যাত্রা শুরু করলো - দুই ঘণ্টায় আট নয় টা ব্যারিকেড সরিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ আসল । গাড়ি গুলো দেখলেই হুর হুর করে লোক একত্র হয় আর স্লোগানে স্লোগানে এলাকাটাকে মুখরিত করে তুলছিল - সবাই মিলে কৃষক, বৃদ্ধ , আবাল বনিতা সবাই সরব। অত্যন্ত বিশাল বাজার এবং নদীর পাড় ঘেরে গড়ে উঠেছে এক নতুন শহর । টিনের দোতলা - তিনতলা আরত, গদি ঘর, দোকান - নদীর ঘাটে অনেক নৌকা, লঞ্চ, বার্য আর কারগো জাহাজে জনাকীর্ণ । একটা রেস্তরাতে অফিসার রা মধ্যাহ্ ভোজন শেরে নিলো - সৈনিক আর সাথে প্যাক লাঞ্চ জাতীয় কিছু ছিল - কোম্পানি কোয়ার্টার মাসটার হাভিলদার গনি - অনেক বছর যাবত এই কোম্পানিতে - পুরানা ই পি আর এর প্রায় আনপর জাতীয় কিন্তু অত্যন্ত পেশাদার সৈনিক । ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে রওনা হয়ে রাজনাগর ফেলে দুপুর সাড়ে টিন টায় শমশেরনগর এয়ার পোর্ট এ আসলেন অনারা । গেট খুলে দিল এম ও ডী সৈনিক দেখে মনে হল মণিপুরি বা ত্রিপুরা জাতীয় ।
ম্যানেজার গোছের একটা লোক এসে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাল - সবার বেবস্থা দেখিয়ে দিল - হাভিলদার মেজর ফরহাদ আর কিউ এম গনি লেগে গেলো থাকা, শোয়া, লঙ্গর ইত্যাদির জোগাড়ে।
জানতে পারল যে শহরের ডাক বাংলো তে আরই বেঙ্গল রেজিমেন্ট এসেছে - এই দিক এ এসে নাই এখনো ।
ডাইরির পাতা থেকে নেওয়া - ক্যাম্প সেট করে ফেলতে বললাম আমার লোকদের । ১৯৫৮ সাল থেকে কম্পানির অর্ধেকের এর বেশি জওয়ান এবং এন সি ও দের চিনি । ব্যাটমান বাতেন চৌধুরী কে বললাম আমার জন্য ওয়াচ টাওয়ার বেড রুম রেডি করতে । টাউন থমথমে । দোকান পাঠ খুবই তারাতারিই বন্ধ হয়ে গেছে । জমাদার সাফিন গুল ( স্প্রিং গুল বলে পরিচিত ) অনেক পুরানা বন্ধু সেও নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রদেশের পুলিশ থেকে ১৯৫৮ ই পি আর এ এসেছে । ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা টক টকে লাল চেহারা এক পাঞ্জাবি মেজর উইং কমান্ডার রাতে ওর ক্যাম্পে মদ্যপ অবস্থায় এসে খুব বকা ঝকা করে ওকে অপমানিত করতে চেয়েছিল । হটাত গুল ক্ষেপে যেয়ে ঐ মেজর কে এরেস্ট করে রেখে দিয়েছিলো তাই সুবেদার থেকে ডিমোসন করে জমাদার হয়ে গেছে ; বহু পুরানা বন্ধু । সব সময় ছুটি তে গেলে আমার জন্য পেশওয়ার থেকে চপ্পল নিয়ে আসতো। ওকে সালাম দিলাম রানার গোলাম রসুল কে দিয়ে ; অনেকক্ষণ কথা বললাম - বুঝলাম ওরা সব কয়জনই শঙ্কিত এবং একটু ভীত । আমার সবচে বিশ্বস্ত হাভিলদার মেজর ফরহাদ কে ডাকলাম - সিগারেট খেতে খেতে রান ওয়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে বেশ দুরে যেয়ে জিজ্ঞেস করলাম সব সংবাদ । ফরহাদ আমার সাথে খুলনা ৫ উইং, রামগড় এ কাসালং ফায়ারিং এ ছিল তার লাতুতে আমার কোম্পানির কোঁত নায়েক ছিল, ১৯৬৯ এ আমার এ সি আর এর রেকোমেন্ডএসন এ লাঠি টিলা যুদ্ধে ওর কৃতিত্ব সেক্টর কমান্ডার সিতার ই জুরাত লে কর্নেল আব্রার হাসন আব্বাসি সাহেব কে রিকুয়েস্ট করে ওর প্রমোশন টা বেবস্থা করে ছিলাম । বাঙ্গালি হাভিলদার মেজর খুবই কম হত পাঞ্জাবিরা সব ভালো ভালো পোস্ট গুলো নিয়ে নিত । গেঁড়াই বাজী নামে অতীব পরিচিত শব্দ । ১৩ বছর এ ও এখনো ই পি আর এর পলিটিক্স বুঝে উঠতে পারি নাই। ফরাহদ বলল স্যার অবস্থা কিন্তু মোটেও ভালো না , পাঞ্জাবি, বালুচি, পাঠান গুলা কে কোন ভাবেই গার্ড পোস্টে বা বাইরে পাঠানো যাবে না। স্যার পাঞ্জাবিরা কিছু একটা করবেই করবে। ভীষণ হারামি এরা । আমাদের এই আন্দোলন কোন ভাবেই বরদাস্ত করবে না । জিজ্ঞেস করলাম ওয়ার লেস সেট কি সেট কড়া হয়ে গেছে ? বলল স্যার রাত ৯ টার ভিতর হয়ে যাবে । বললাম এরিয়া পেট্রল ছাড়া ও রুমে ১ তিন গার্ড লাগাতে - আমার ওয়াচ টাওয়ারে দুইটা হাতিয়ার আর আমার থ্রি এইট রিভলভার এ ২৪ রাউন্ড গুলি সহ বাতেন দিতে আর গোলাম রসুল কে বিস্তারা লাগাতে বল । কোঁতের দরজায় চার পায়া দিয়ে ব্লক করে ওর বিছানা লাগাতে বললাম । মেন গেঁটে লেস নায়েক আরব আলী কে গার্ড কমান্ডার করবার জন্য । ও বলল স্যার সিপাই রা ওগো সাথে কোথা ও বলতে চায় না ।সম্পর্ক প্রায় ভঙ্গুর । সব জওয়ান রা ক্ষুব্ধ ও ঘৃণা করছে সব গুলোকে । বারবার ওকে সাবধান করে দিলাম যাতে কোন রকম অঘটন যেন না ঘটে । ফরহাদ কে বিদায় করে আরেক টা সিগারেট ধরালাম আর পায়চারি করতে করতে করতে ভাবলাম অনেকক্ষণ । ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সাত টা ১১ মিনিট বললাম বাজারে একটা দোকান ও খোলা নেই , অনেক গুলো কুকুর কাঁদছে করুন সুরে , দুরে কোথাও ট্রেনের আওয়াজ শুনতে পেলাম । জুড়িতে মান্নান কোম্পানি কমান্ডার,লাতুতে কোবাদ আলি আর তামাবিলে বি আর চৌধুরী । বাকি কোম্পানি কমান্ডার সবাই ই পাঞ্জাবি । আরও এক দুইজন বাঙ্গালি থাকলে থাকতেও পাড়ে কিন্তু ঐ মুহূর্তে আর কারো নাম মনে করতে পারছিলাম না । কেবল ঢাকা থেকে বদলি হয়ে আসলাম - ১৬ উইং ই পি আর রেইজ করে - সদ্য ঘোষণা হয়েছে আমাকে পি পি এম ( পাকিস্তান পুলিস মেডেল ) নাকি দেওয়া হবে । সুবেদার মেজর রব আমাকে এর মধ্যে রাতের বেলা গোপনে নিয়ে গিয়েছিল নেতার সাথে - কি বিশাল তার বেক্তিত্ত এবং কণ্ঠস্বর । বলল রেডি থেক - ওদেড় কে কোন প্রকারেই বিশ্বাস করা যাবে না । বুঝলাম রব সাহেবের সাথে ওনার নিত্য যোগাযোগ আছে । রব সাহেব সেন্ট্রাল সুবেদার মেজর ই পি আর এর বিশাল ক্ষমতাধারী সে । প্রথম দেখাই অপরিসীম আনুগত্য নিজের অজান্তেই সমর্পণ করে নিরদ্ধিআয় ।রব সাহেব বললেন খুব সাবধান থাকতে । আর কাউকে না জানাতে ঐ মিটিং এর ব্যাপারে । ওরা সবাই বি, বাড়িয়া ওদের মায়ের গার্লস স্কুলে তে নতুন চাকরী, নতুন জায়গা, বাবুলের সামনে মেট্রিক পরীক্ষা, মুন্না অন্নদা স্কুলে যাচ্ছে । এর মধ্যে এই সব বেশ ভাবনার ব্যাপার ।
১৯৪৬ পর্যন্ত কলকাতার স্কুলে থাকাকালীন সময়ে কি না দেখলাম পাকিস্তান পাকিস্তান চিল্লাচিল্লি আর আজ সব যেন কেমন তাসের ঘরের মত টলটলায়মান । ২৮ দিনে এক কাপড়ে আব্বা, আম্মা, আর ছোট ওবায়েদ সহ আধ পেটা খেয়ে না খেয়ে কলকাতা থেকে পূর্ব বাংলায় আসতে লেগেছিল । রাস্তায় হিন্দু কিবা মসুল্মান দুই পক্ষই সমান ভাবে নিগৃহীত করেছিল আমাদের । হিন্দুদের কাছে আমারা ছিলাম বাঙ্গাল আর মসুলমান দেড় কাছে ছিলাম '' ঐ দেখো কলিকাতার লাট সাহেব রা আসছে ।'' অনেক চড়াই উতরাই পাড় হয়ে নতুন ভাবে জীবন শুরু করলাম বাবা কপর্দকহীন হয়ে গেলো,তার সেই স্যুট টাই পড়া গ্র্যান্ড হোটেলের চাকরী হারিয়ে সে দিন দিন কেমন যেন প্রাণহীন হয়ে পরল । ১৯১১ সালে সে সিলচর স্কুল থেকে বের হয়ে বিদেশ বিভূঁইতেই তার নিবাস - ১৯১৮ থেকে ১৯২৩ পর্যন্ত জার্মানি ও বিলাত তে থেকে তারাপর ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কলাকাতাই ছিল তার বাড়ি ঘর সংসার, বন্ধু, বান্ধব, তাস খেলা , রেস কোর্সে ঘোড়ার রেস এবং দু এক টা ঘোড়ায় বাজী ধরাও ছিল তার অভ্যাস । সেই সব ফেলে অজ পাড়া গাঁয়ে আব্বা নিজেকে আর আগের মত খুঁজে পেত না ।সব সময় বিষণ্ণ । অভাব সংসারে উপায় না পেয়ে পুলিস এ জয়েন করতে বাধ্য হলাম । এক সময়কার নাম কড়া ছাত্র, মেধাবী বলে পরিচিত খোকা আজ কোথায় আর তারই প্রিয় বন্ধু, কলেজ হোস্টেলের রুম মেট ফৌজদার ক্যাডেট কলেজের ফিজিক্স এর প্রভাষক। খুবই প্রিয় বন্ধু ছিল ওরা। ১9৪৯ বি, বাড়িয়া কলেজের প্রথম ব্যাচ - এলাকার সবার প্রিয় খোকা ভাই । পান্না চাঁচার বুদ্ধিতে সকলকে না জানিয়েই জয়েন করে ফেলেছিলাম পুলিশে - অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টর হিসেবে - নাম সর্বস্ব একটা চাকরী , কাজ কড়া লাগে সব লিটারেট কনস্টেবলের মত । কোন দাম নাই কেবল একটা আশা যে ডিপারট্মেন্টাল প্রমোশন পেয়ে পেয়ে এক দিন এসডিপিও পর্যন্ত ও হয়ত পৌঁছেতে পারবো হয়ত বা । কেমন যেন কি আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার বালুচরে। হটাত পুড়তে থাকা সিগারেট এর শেষ অংশ দুই আঙ্গুলের ফাঁকে আগুনে ঝলসে যাবার প্রাক্বালে প্রকিতস্থ হলাম । ফিরে আসলাম বাস্তবে ।
আজ আবার ভাগ্যাকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা কেমন যেন একটা থমথমে ভাব । এয়ার পোর্ট এর সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্লেভ লেবার হিশেবে এলাকার জনগণ দেড় দিয়ে বিমানবন্দর বানানো মেন বিল্ডিং টাই ক্যাম্প - শেষ প্রান্তে সিঁড়ি ঘর আর ওর উপড়েই ওয়াচ টাওয়ার দুইটা গোলাকৃতি রুম - একটা বাথরুম ও আছে - এক রুমে আমি আর অন্য রুমে ওয়ারলেস সেট অপারেটর মোস্তাফা আর বাতেন দেড় সবার জায়গা । সোজা উপড় এ উঠে এসে মোস্তাফা কে জিজ্ঞেস করলাম কত দেরী ? বলল স্যার ২০ মিনিটেই ও কে হবে সব । বললাম আমাকে মান্নান সাব অথবা বি আর চৌধুরী সাহেব কে পারলে মিলায়ে দিতে। এখানে প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো পাকিস্তান আমলে একমাত্র ই পি আর এর কাছেই সারা দেশ ( পূর্ব পাকিস্তান বাপী) এর সব ই পি আর ক্যাম্পে টর এ টাঁককা টেলিগ্রাম ছিল যা দিয়ে সারা দেশের যে কোন ক্যাম্পে যোগাযোগ কড়া যেত। পোশাক আর খুল্লাম না , নিচে নেমে এসে বললাম রোল কল ডাকো ফল ইন কর সবাই কে । সেন্ট্রি ছাড়া সবাই একত্রিত হল একটা ছোট বক্তৃতা দিলাম আর বললাম আমারা সরকারী চাকরীজীবী । সকালে পেট্রল এ গেলে কোন পাবলিক এর সাথে যেন কোন প্রকার দুর্ব্যবহার না কড়া হয়। সিপাই আবু বকর আর সিপাই দারু মিয়া দুইজনাই সিলেটী বললাম তোমরা দুইজন সকালে মুফতি ড্রেস লাগায়ে আমার সাথে দেখা করতে বলে । রোল কল ডিসমিস করতে না করতেই মোস্তফা এসে বলল স্যার রেডি , মান্নান সাহেব প্রস্থুত কথা বলতে । উঠে গেলাম সিঁড়ি বেয়ে সেটের কামড়ায় । মান্নান ভাই এর সাথে অনেক কোড ল্যাঙ্গুয়েজে বাংলা , কুমিল্লা, ঢাকাইয়া এবং কুট্টি ভাষায় কথা বললাম - সেও খুবই আতঙ্কিত - কি হবে , কি করবো। সে আমাকে ক্লিয়ারলি বলল চৌধুরী খবরদার টু আই সি কাপ্টেন গোলাম রসুলের তোমার কোম্পানি কে ভিজিট করতে আসা টা খুবই রহস্যময় । কেয়ারফুল ।আমি ওকে বললাম আমি সিগনাল সেটের পাশেই থাকবো - কোন রকম খবর পেলেই যেন আমাকে জানায় । কথা বলতে বলতেই দুরে কুকুরের কান্না শুনতে পেলাম - নিদারুণ করুন সুরে অনেক গুলো কুকুর কাঁদছে দুরে সেই মনে হলো ট্রেন স্টেশন আর কাছে । হাভিলদার মেজর ফরহাদ কে ডেকে বললাম তিন সিপাই আর এক জন এন ছি ও হাতিয়ার সহ তৈরি করতে দশ মিনিটের মধ্যে । চতুর্দিকে কেমন যেন থমথমে একটা পরিস্থিতি মনে হল ; বাজার এর প্রহরী কয়েক টা উচ্চস্বরে ডাক দিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো ; কেন জানি সেই ১৯৪৬ সালের কলকাতার থম থমে রাইঅট এর দিন গুলোর কথা মনে পড়েতে লাগল, একবার বাচ্চাদের চেহারা গুলো ভেসে উঠল মনের পরদায় । বসে বসে ডাবলু ডি ও হেইছ ডি উইলিস এন্ড ব্রিসটল এর প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে আগুন টা জ্বালিয়ে বাইরে ওয়াচ টাওয়ারের টারেট এর ক্যানটিলিভার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টা পান করতে লাগলাম । অনেক দুরে দেখতে পেলাম চা বাগানের আলোকিত প্রজ্বলিত বাংলোগুলো আর ফ্যাক্টরির চিমনি গুলো ; নিয়ন লাইটের আলো তে অন্ধকার সেই পারিপার্শ্বিকতার মাঝে মনে হল - যেন গভীর রাতে হুগলী নদীর মাঝে কোন ইংরেজ কোম্পানির প্রমোদ তরি ভেসে বেড়াচ্ছে আলো বিচ্ছুরিত করতে করতে ; অপূর্ব সেই দৃশ্য। অনেক দুরে রাতের আঁধারের মাঝে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল খাসি পাহাড়এর ছায়াগুলো । ভাবলাম সকালে একবার মণিপুরি বস্তিতে যাবো ; চাতলাপুর এবং আসে পাশের এই সব এলাকা আমার খুবই পরিচিত ; সেই কয়েক বছর আগে আমি এই এলাকা ই পি আর এর কোম্পানি কমান্ডার ছিলাম শায়েস্তাগঞ্জ থেকে কুলাউরা পর্যন্ত - কমলগঞ্জ - মনু - ভানুগাছ এলাকার সব মণিপুরি বস্তির ব্রাহ্মণ আর মন্ত্রী গুলো সবাই আমার অতি পরিচিত । ভাবলাম কালকে সময় পেলে পিক আপ টা নিয়ে এক চক্কর ঘুরে আসবো আর প্রিতিম্পাশার নবাব সাহেব কে ও হ্যালো বলে আসব - অনেক গল্প করতে পছন্দ করেন - লাঠি টিলা যুদ্ধের সময় অনেক হেল্প করেছিল ; এই এলাকার ইতিহাস সম্পর্কেও অনেক কিছু জেনেছি নবাব সাহেবের কাছ থেকে । আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে কখন যে হাতের সিগারেট টা শেষ হয়ে গেছে জানতেই পারলাম না - হটাত ফরহাদ ডাকল স্যার আসবো - শুনেই বাস্তবতায় ফিরে এলাম । ও বলল স্যার , আপনার কথা মত ১ তিন পেট্রল পার্টি রেডি । শুনেই নিচে শিরি বেয়ে নেমে আসলাম - সামনে দাঁড়ান ওরা চারজন -আস্তে করে ডেকে কাছে এনে বললাম তোমরা চার জন বাজারের ক্যামোফ্লাজ অবস্থায় টহল দিবে ফাস্ট লাইট পর্যন্ত । কোন রকম সন্দেহজনক কিছু দেখলেই সোজা ক্যাম্পে ২ জন কে পাঠিয়ে দিবা ১ মাইলে বেশি দুরে যাবা না । ওরা সোজা গেঁটের সেনট্রি দেড় বলেই সবার ঘুম ভাঙ্গিয়ে টাওয়ারে পজিশন নিবে - বাকি দুজন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবসারভ করে তারপর এয়ারপোর্টের অন্য পাশ দিয়ে প্রবেশ করবে - পাসওয়ার্ড আবার মনে করিয়ে দিয়ে বললাম এসেই যেন আমার কাছে রিপোর্ট করে - ওদের বিদায় করলাম - নায়েক বাছিত মিয়া আ আমার ফাইভ উইং এর পরিচিত - বললাম বাছিত খুব সাবধান । পরিস্থিথি সন্দেহ জনক । ঐ পাকিস্তানি উর্দু ওয়ালা দেড় কে কেন জানি আর বিশ্বাস করতে পারছি না । মনটা কেমন যেন বিষিয়ে গেছে ওদের উপর । ইতিমধ্যে ২৫ সে মার্চ আমার ঘড়িতে সকাল তখন প্রায় ২ টা পাঁচ বাজে ।
চলবে ……
ইমরান আহমেদ চৌধুরী
লেখক একজন বিলাত এ বসবাসকারী ইতিহাসবিদ - বক্তা এবং যুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষক ।
লেখকের পিতা ফজলুল হক চৌধুরীই ছিলেন সেই শমশেরনগর বিদ্রোহের ই পি আর কোম্পানি কম্যান্ডার ।
সূত্র- Major General Md Sarwar Hossain, 1971 Resistance, Resilience & Redemption ( Priyomukh prokashon, 2018) pages 84- 87.
Comments
Post a Comment