LIBERATION WAR OF BANGLADESH AND WE BECAME A REFUGEE -স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং আমরা রিফিউজি

স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং আমরা রিফিউজি - ১ 
ধজনগর একটা গ্রামে আমরা সেই বিকালে আশ্রয় নিলাম - ইমাম বাড়ি স্টেশন দিয়ে রেললাইন পার হয়ে গোপীনাথপুর আমাদের গ্রামের উপর দিয়ে হেটে চিনাইর নদী পার হলাম - ভয়ে একবারও গ্রামের সেই পুরোনো বাড়িটার কাছে যাওয়ার সাহস পেলেন না ভাইজান এবং আমাদের দলের অন্যানোরা। মুসল ধরে বৃষ্টি - গায়ে শুইয়ের মতো ফুটছে বৃষ্টির বড় বড় ফোটা গুলো। আর কত পথ জানিনা। মান্দার পুর - সয়দাবাদ উজানিশাহার ব্রিজ - সিএনবি রড - আর্মী কনভয় রাজাকারদের প্রহরা দেওয়া। 
একটা স্কুলে আশ্রয় নিলাম বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য। মা, বোন টুলু আপা, ভাই ছোটন - টুম্পা এবং আমাদের গাইড ও একমাত্র ভরসা ভাইজান। 

চপ চপে কাপড় চোপড় - ভীষণ ক্ষুধার্থ - অবশ পা' - হিসেব করে বললেন আমরা প্রায় ১২ মাইল হেঁটেছি এক দিনে। 
চন্দ্রপুর - বাড়াই - গোসাইস্থল হয়ে ভারতের বর্ডারের প্রায় সন্নিকটে আমরা - পথ যেন আর ফুরায় না - দূরে কসবা - মন্দবাগ আর আখাউড়া থেকে ভেসে আসছে কামানের আর আর্টিলারির গলার গগন বিদারী আওয়াজ; ভীত - সন্ত্রস্থ - কাপড় চপের গাট্টি টা তে হেলান দিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিজেও জানিনা।
এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ - ১৯৭১ - সেই ১১ ই এপ্রিল বি বাড়িয়ে তে বিমান হামলার পর আমরা ঘর দোর সব ফেলে রেখে পরনের কাপড় নিয়েই বিভ্রান্তের মতো ভয়ে বিহ্বল হয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম নিরাপদ কোনো আশ্রয়ের উদ্দেশে - সেই দিন থেকে আজ অব্দি- দুই বেলা পেট ভড়ে প্রশান্তিতে খেতে পারি নাই আমরা কেই, পরিষ্কার টিনোপলিন দেওয়া ধোয়া সাদা বিছানার চাঁদর বিছানো বিছানায় আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠিনি। সকালে সবাই একসাথে চা ও খাইনি আজ অব্দি। পরোটা আলু ভাজি দিয়ে খাওয়াও হয়নি প্রাতঃরাশ। নেই কোনো রেডিওতে রোববার দুপুরে ভাত খেয়ে নাটক শুনা। শুনিনি সেই খোকা বাবুর প্রত্যাবর্তন নাটিকা বা কাবুলিওয়ালা। 
লণ্ডভণ্ড জীবন। মৃত্যুর ভয়ে কম্পিত। নিদ্রাবিহীন রাট কাটানো। ঘুমালেই স্বপ্ন আর স্বপ্নে শুনতে পেতাম বুটের আওয়াজ - মনে হতো এই বুঝি দরজাটা এক জোরে লাত্থি মেরে ভেঙ্গে ফেলে রাইফেল তাক করে ঢুকবে ঘরে আর নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলবে আমাদের সবাই কে.
পলাতক জীবন- গ্রামের মানুষ গুলো আমাদের আশ্রয় দিতে শংকিত - আমাদের বাবা মুক্তি বাহিনীতে যোগে দিয়েছে - যদি কেই বলে দেয় যে আমরা একটি মুক্তি বাহিনী পরিবার এই গ্রামে আশ্রিত - তা পাকিস্তানী আর্মি যে কোনো সময় হামলা করবে আর প্রাণ হারাবে নিরীহ গ্রামের মানুষ গুলো। 
ঘুম ভাঙলো মায়ের ও অন্যদের কথা শুনে - ফেল ফেল করে তাকিয়ে দেখি বৃষ্টি নাই আর সবাই রেডি - পোটলা - গাট্টি নিয়ে তৈরী রওনা দিতে - পাঁচ শ গজ দূরে ধজনগর মসজিদের পরেই - ভারতের ( ইন্ডিয়ার ) বর্ডার - এই ঐতিহাসিক লাইন টা পার হলেই আর আমাদের মারতে আসতে পারবে না পাঞ্জাবিরা আর শুনতে হবে না কোনো কানাঘুষা - পান্জাবীদের দোসররা আর চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাবে না আমাদের দিকে - আমরা হবো মুক্ত বিহঙ্গ - হবো রিফিউজি। 
একটি ইন্সুলার জীবনের যবনিকা আর এক নতুন জীবন নাটকের প্রথম অংকের প্রথম পর্ব শুরু। .....



স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং আমরা রিফিউজি
​ - ২


হাটা  শুরু হলো পাহাড়ের দিকে ধজনগর থেকে ইন্ডিয়া অভিমুখে - সবাই চুপ চাপ বেশ উঁচু তে উঠতে হলো হেটে হেটে ; সামনেই একটা সমতল ভেলী একটা ছোট্ট নালা তার পাশেই একটা কানায় কানায় পরিপূর্ণ পুকুর আর পুকুরের ওপর পারে বেশ কয়েক শতাব্দী পুরোনো একটা জরাজীর্ন মসজিদ তারপর ১ থেকে ২০০ গজ সমতল জায়গা পাহাড়ের পাদদেশে মিশে গেছে - পাহাড়ের পাদদেশ থেকেই ইন্ডিয়া শুরু।  

পথ তো আর ফুরায় না - প্রায় গোধোলির সময় - আমরা কেই জানিনা কোথায় যাচ্ছি ; কোথায় কাটাবো আজ রাত।  

আমি ১২ বছর প্রায় ; ছোটন ৯ আর টুম্পা তখন ৫ ক্লান্ত সবাই - আমাদের জীবনেও এত পথ হাঁটিনি কোনোদিন তার পর কাল বৈশাখীর ঝড় ও শিলা জাতীয় প্রকট বৃষ্টি। সবাই নেতিয়ে গিয়েছিলাম।  জীবনেও আমরা ভাবিনি এইরকম অবস্থা কারো হতে পারে।  

মসজিদ পার হলাম - মাগরেবের নামাজের জন্য কয়েক জন মুসুল্লি তৈরী হচ্ছেন - মনে মনে ভাবলাম - পাকিস্তানিরা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে যখন অগ্রসর হচ্ছিলো ভৈরব এর দিক থেকে তখন ওরাও বলছিলো '' ইয়া আলী, আল্লাহ হু আকবর ''- আর আমরা যারা জান - প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলাম আমরাও অতীব জোরে গলার সব শক্তি দিয়ে সেই একই আল্লাহ কে ডাকছিলাম আর দোআ পড়ছিলাম '' লা' ইলাহা ইল্লা আন্তা। ....... মিনাজ যা লি মিন '' - এই তা আবার কি ধরণের যুদ্ধ - দুই পক্ষই একই সৃষ্টি কর্তার বানানো কিন্তু এক দল আরেক দল কে মারার জন্য মরিয়া হয়ে ধাবিত করছে। কেন? বিচিত্র এই মানব জাতি।

আমাদের কাফেলা টা ধীরে ধীরে অতিক্রম করলো মসজিদ আর উপনীত হলাম ভারতের সীমান্তে ; ভয়- ভীতি - নতুন একটা দেশে পদার্পন - কি হবে জানিনা। 

যোগাযোগ এর মধ্যে একটাই খবর আমরা জানতাম যে আমাদের পিতা ১-২ এপ্রিল থেকেই ইন্ডিয়াতে প্রবেশ করেছে যদিও উনি এখনো শ্রীমঙ্গল ইন্ডিয়া সীমান্তের এক প্রত্যন্ত গভীরের একটা ইপিআর বিওপিতে এখনো থাকছেন।  বিপদ আশঙ্কা দেখলেই প্রবেশ করবেন ভারতে - কৈলাস শহর নাম এক তা শহর ই উনি আমাদের আসতে বলেছেন।
উনার এক সহকর্মী উনার কোম্পানির একজন সিপাই মোস্তফা ভাই  কে উনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন - সে প্রথমে হেটে- বাসে - নৌকায় - রিক্সায় করে আসে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে না পেয়ে আবার গিয়েছিলেন আমাদের গ্রামের বাড়িতে - ওখানে জানতে পারযেন যে আমরা আমাদের আরেক আত্মীয়ের বাড়ী তে আশ্রয় নিয়েছি।  বেচারা অনেক পথ পার হয়ে আমাদেরকে বাবার সংবাদ দিয়ে উনি চলে গেলেন উনার বাড়ির উদ্দেশে - চোদ্দগ্রাম এলাকায় উনার বাড়ি ছিল - আজ অব্দি আমরা জানিনা শেষ পর্যন্ত ওনার কি হয়েছিল - উনি আর ফিরে আসেন নাই - স্বাধীনতার পর আর কখনো আমরা উনাকে দেখি নাই - নামটা জানতেন কিন্তু ওনার গ্রাম ঠিকানা তো আর কারো মুখস্থ ছিল যার জন্য আর কনো প্রকার খোঁজ নেওয়াও সম্ভব ছিল না - কত জীবন যে ঝরে গেছে এই ভাবে আমাদের স্বাধীনতার জন্য।  

ইতিমধ্যে আমরা প্রবেশ করে গেছি হাটতে হাটতে ইন্ডিয়া তে - পাহাড়টা উঠেই একটা কাঁঠাল বাগান টিলার উপরে।  তার পরই ঢালু পাহাড় শেষ প্রায় মাইল খানেক প্রশস্ত সমতল ধানের জমি - আর জমিগুলোর ওপর পারে লোকালয় ঘর- বাড়ি দেখতে পেলাম 

পিচ্ছিল জমির আইলের উপর দিয়ে হাটা  যে কি কষ্ট - জমিগুলো হাটু পানি পূর্ণ - পা পিছলে প্রতি তিন চার কদমে ই আবার হাটু পানিতে ডুবে যাওয়া ভীষণ কর্দমাক্ত জমি - পিছলে যাওয়া পা'টা  টেনে উঠিয়ে আনা  বেশ কষ্ট কর। 

কিন্তু সকল কষ্টের ফসল হলো - যাক বাবা আর পাবে না  পাকিস্তানী আর্মি আমাদের - আমরা এখন নিরাপদ। 

গ্রাম তার নাম পাণ্ডপপুর  - ভয়ার্ত জাতীয় একটি গ্রামের নাম  



স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং আমরা রিফিউজি - 
বিএসএফ আমাদের ঐ রাতে তাদের কেম্পে খাওয়ালো - পিতার চাকরির বদৌলতে মনে হয় এই আতিথেয়তা টা পেলাম আমরা। পুরা পৃথিবীতেই মনে হয় এই পেশার লোকদের মধ্যে একটা অমোঘ সহানুভূতি কাজ করে - শুধু এটা কাজ করে না ওই পাপিষ্ঠ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর মাঝে ওদের নিকট সব বাঙালিই হিন্দু এবং সব বাঙালিই ওদের নিশানা - হত্যা করাই যেন ওদের একমাত্র পেশা। 
তাড়াতাড়ি করে ওই রাতেই বি এস এফ এর মহানুভব মানুষ গুলা আমাদের কে কেম্পের থেকে অর্ধ মাইল দূরে এক হিন্দু বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিলো; সারাজীবন আমি আবং পরিবার ঐ বি এস এফ দেড় নিকট ও ওই হিন্দু পরিবারের নিকট ঋণী - এই মানবিকতার ঋণ আমরা জীবনেও পরিশোধ করতে পারবো না। 
যখন আমার পরিচত অনেক উগ্র জাতীয়তা বাদী পন্থী রা বলে যে ভারত তার স্বার্থের জন্য আমাদের স্বাধীনিতা যুদ্ধে উপকার করছে - তাদের কে বলতে চাই - হয়তো তারা সত্যি কিন্তু ভারতের সরকার না হয় স্বার্থ সিদ্ধির জন্য করেছে কিন্তু আমাদের কে যারা ঐ দিন থাকতে দিয়েছিলো ওরা সেদিন করেছিল একান্তই মানবতার জন্য - যে যাই বলুক না কেন আজ - আমি আজীবন ভারতের কাছে এবং ভারতের জনগণের কাছে ঋণী ;
রাতটা ঘুমালাম - বি এস এফ এবং ঐ বাড়ীর মালিক ও মহিলারা আমাদের বিছানা বালিশ দিলো - সকালে চা- মুড়ি- চিড়া নাস্তা ও দিলো ; মা কে আসে নিয়ে গেলো অন্দর মহলে - বেশ বর্ধিষ্ণু পরিবার বলে মনে হলো - অনেক গুলো ঘর - পুকুর - টুকুর পাড়ে বেঞ্চি তে বসার জায়গা - অনেক বড় একটা গরুর গোয়াল - বিশাল আকৃতির তিন তিনটা খড়ের পালা - কোণ আইসক্রিমের মতো উপরে । সোনালী খড়। পুকুরের পরেই বিশাল আনারস বাগান আর কাঁঠাল বাগান - বাড়ির অন্যপাশে প্রধান সড়কের পাশেই ওনাদের বিশাল মুদি খানা দোকান - হাড়ি পাতিল থেকে শুরু করে সব পাওয়া যায় ; বড় মুদিখানার দোকান - তিন চার জন মানুষ কাজ করছে দেখতে পেলাম। 
অনুগ্রহ আর উপগ্রহেঃ বেঁচে থাকা জি কি অসস্মানজনক তা আজ ও বেশ মনে আছে। মা' - সব কয়টা সোনার অলংকার দিয়ে দিলো বিনিময়ে পেলো ইন্ডিয়ান রুপি ঐ দিয়ে হাড়ি পাতিল কয়েকটা কিনা হোল - চাল - ডাল আর কয়েকটা বালিশ ও মাদুরের বিছানা এবং লেপ তোষক - জীবন যে কত প্রকট তা হাড়ে হাড়ে টের পেতে লাগলাম। একটা বোরো বিশ ফুট লম্বা - দশ ফুট চওড়া ঘরের এক কোণায় আমরা থাকি আর বাকি সবটাই খালি। ওঁদের বাড়ির বৈঠক ঘর ওটা - চার পাঁচটা চেয়ার আর একটা মস্ত বড় কাঠের টেবিল এই হলো আসবাব পত্র - আমরা মাটিতে মাদুর অরে তোশক পেতে ঘুমাই ; 
উপরে ছনের ছাউনি - দেয়াল টা লাল মাটির ২০ ইঞ্চি দেয়াল ছোট্ট দুইটা জানালা আর চারটা দরজা - আধো এল আর আধো আঁধারি ঘর ; ভাগ্গিশ শেতসেতে ছিলোনা। 
চুলাটা বাইরে প্রায় অনেক দূরে - একটা ছাপড়া এক চালা ওখানেই রান্না অরে ঘরের ভিতর বসে খাওয়া দাওয়া করা - সারা দিন আর কোনো কিছু করার নাই - জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই আর পাহাড়ের শেষ প্রান্তে এসে তাকিয়ে তাকিয়ে দূরে আমার সোনার বাংলাকে দেখি - নয়ন ভরে - আর ভাবতাম ইশ কবে যে যাবো ফিরে নিজ গৃহে ?...

স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং আমরা রিফিউজি - ৩
এক থেকে দেড় মাইল ঐ জমিনের আইলের উপর দিয়ে হেটে হেটে শেষ পর্যন্ত প্রবেশ করলাম গ্রামের ভিতর - জরাজীর্ণ ওয়ান গুলো ছনের ঘর - গরুর গোয়াল - ফসল মাড়ানোর গোলাকৃতি উঠান পেরিয়ে দেখতে পেলাম একটা পায়ে চলা মেঠো পথ - ততক্ষনে গোধলী প্রায় সন্ধ্যায় নিমজ্জিত হতে চলেছে। একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি এখন কি করবো ? মুখে কথা বলার শক্তি প্রায় নাই বললেই চলে - ক্ষুদার্থ - গলা শুস্ক - বৃষ্টি ভেজা সিক্ত পোশাক আর ঝোড়ো হাওয়ায় ঠান্ডা - সবাই আমরা হাইপো থার্মিয়া আক্রান্ত। আহা রে আজ ও মনে পরে আমাদের সবচে ছোট ভাই টুম্পা - পারছে না আর এক কদম ও হাটতে শীতে আর ঠান্ডায় ওর মুখ অনবরত কাঁপছে আর কাঁদছে - দাঁতে দাঁতে বারী খেয়ে খট খট আওয়াজ করছিলো। ওর দিকে তাকানো যাচ্ছিলো নো। নাদুস নুদুস ( আদর করে সবাই ওকে ভোটলা বলে ডাকতাম) টুম্পা ৩ সপ্তাহে শুকিয়ে মাংস আর হাড্ডি গুনা যাওয়ার মতো ওর অবস্থা। আমার বোন ওকে ধরে ধরে পথ চলতে সাহায্য করছিলো আর শান্তনা দিচ্ছিলো - কিন্তু ঐ আশাবিহীন সময়ে কি কোনো প্রকার আশা কি কাউকে দেয়া যায় কিনা তা আমার জানা ছিল না।

নেই কোন পথিক - নেই কোনো ঘর বা বাড়ি - রাস্তাটা টিলা কেটে বানানো - লাল মাটি - অনেকটা দেখতে আমাদের গ্রাম গোপীনাথপুরের কবরস্থান টিলার মতো - পুকুর পারের ওপর প্রান্তে কবরস্তান - ছোট বেলায় ঈদে পর্বনে গ্রামে গেলে এই রকম লাল মাটির পথ ধরে কিছু দুর হাঁটলেই হাতের বা' দিকে আমার দাদার কবর - জিয়ারত করতে যেতাম। হাটতে হাটতে মনে পড়লো অনেক কথা - দাদির মাথায় জোট বাধা চুল। হয়তো; ক্লান্তিতে হিলুসিনেশন হচ্ছিলো কি না জানিনা। হঠাৎ পাশ দিয়ে হেটে গেলো কাঁধে ভার নিয়ে টিপরা জাতীয় ( মঙ্গোলিয়ান অবয়বের) তিন চার জন লোক - ভাইজান ওদের সাথে একটা বিশাল হাসি দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলো - কিন্তু োর টু শব্দটিও না করে আমাদের পাস কাটিয়ে উল্টোপথে চলে গেলো দ্বিধাহীন ভাবে। খালি পায়ে পিচ্ছিল পথ আর মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাথরের টুকরায় পাড়া দেওয়া যে কি কষ্ট তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছিলাম। আম্মা একটা কথাও বলছে না। রাস্তাটা সম্পূর্ণ কাদা ই কাদা শুধু একটা লিক ( চুয়াডাঙ্গায় ( উত্তর বঙ্গে)লিকপড়ছে মানে হচ্ছে যে গরুর গাড়ির চাকার পেষণে কাদা শক্ত হয়ে উঠেছে একটা চাকার পরিমান জায়গা) পরিমান পথ শুষ্ক ১২ থেকে ১৮ ইঞ্চি চওড়া মাত্র। কতক্ষন পর আবার একটা টিলা - উঁচুতে উঠা যে কষ্টের তা সেই জানে যে সারাদিন যাবৎ কিছুই খাইনি। একেকটা কদম মনে হচ্ছিলো - ধরণী তুমি দ্বিধা হও আর আমি প্রবেশ করি ; যাতে না বের হতে হয় চিরতরে ;
এই জনপদে মনে হলো আমরাই প্রথম উনুপ্রেবেশ করি শরণার্থী - এর আগে কোনো দল এখানে আসছে বলে মনে হলো না। যে দুই সপ্তাহ আত্মীয়দের আশ্রয়ে ছিলাম তখন নিজেদের এতটা অসহায় মনে হয় নাই - জীবনে এই প্রথম আমরা কোথাও বাড়াতে গিয়েছিলাম - মনে মনে বেশ কয়েকটা দিন ফুর্তিতে কাটিয়েছিলাম প্রথম প্রথম। কিন্তু গ্রামের মানুষ রা আমাদের কে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে গেলো সহসা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানা সবচে বেশি যুদ্ধ দেখেছে এবং ওখানকার বাসিন্দারা খুবই বিপদে ছিল নয় টি মাস - আমাদের কে লুকানো ওদের জন্য বিপদজনক বৈ কিছুই ছিল না - উপায়ান্তর না পেয়েই আমাদেরকে পালিয়ে যেতে হলো ভারত অভিমুখে - এক অজ্ঞস্ত যাত্রায় - আমরা কেই ই জানিনা ভবিষ্যৎ কি আছে সামনে। ৪৪ বছর আজ ঐ নিরুদেশ যাত্রার কথা চিন্তা করতেই গায়ের লোম শিউরে উঠে।
জীবন যে কারো জন্য এত কঠিন আর পথ চলা যে এত বন্ধূর হতে পারে তা সেই বলতে পারবে যে এই রকম একটা বিপদজনক অবস্থায় পড়েছে।
''এ' তুফান ভারী দিতে হবে পারি - কান্ডারি হুশিয়ার ''
উঁচু টিলায় উঠেই দেখা পেলাম হাতের বামে একটা বড় ফুটবল খেলার মাঠ আর তারই কোনায় উঁচু মাটির পাঁচিল ঘেরা বি এস অফ এর চৌকী।
আমরা বামে মাঠের মধ্যে খান দিয়ে হেটে হেটে হাজির হলাম - বি এস এফ সেন্ট্রির সম্মুখে - হল্ট হ্যান্ডস আপ - রাইফেল তাক করে ধরে ব্যাংকার থেকে উঁকি মেরে শুধু ওঁর বেল্ট থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা গেলো- আম্মা বললো - দাঁড়িয়ে পর সবাই - আস্তে আস্তে বললেন ওর গোঁফ এর পাঁকানো দেখে মনে হচ্ছে এই বেটা JHAT সম্প্রদায় ভুক্ত হবে।
ভাইজান আর আম্মা এগিয়ে যেয়ে - কথা বললো সেন্ট্রির সাথে - অবাক হয়ে দেখলাম আম্মা অনর্গল নির্দ্বিধায় হিন্দিতে কথোপকথন করছে - টুলু আপা এর মধ্যেই নীচু স্বরে বললো - মা ' কাস্টমসে যখন চাকরি করতেন তখন হর হামেশা ইন্ডিয়ান কাস্টমস অফিসার দেড় সাথে বেনাপোল - গোদাগাড়ী - প্রেমতলী - আখাউড়া - তামাবিল চেক পোস্টে হিন্দিতে কথা বলে অভ্যস্থ .
সবাই ভুলেই গিয়েছিলাম যে আম্মার জন্ম কলকাতায় - ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আসা - কত হাজার বার যে আমাদের সাথে আর আব্বার সাথে গল্প করতো সেই ট্রামে চড়া - এসপ্ল্যানেড - পার্ক সার্কাস- হাওড়া ব্রিজ- গড়ের মাঠ আর সেন্ট পৌলস বা ফোর্ট উইলিয়াম এর স্মৃতি।
পা ' গুলো আর পারছিলো না দাঁড়িয়ে থাকতে - ভিজা ঘাসেই বসে পড়লাম মনের অজান্তে - একটু ভয়ার্তও ছিলাম বই কি - যে বিশাল দস্যু ধরণের মোছ ওই প্রহরীর - দেখলে কার না ভয় লাগবে ?

'ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো ; ক্ষমা করো ; প্রভু। ....পথে যদি পিছিয়ে - পিছিয়ে পড়ি কভু - ক্ষমা করো ; প্রভু। ''

বসা থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙতে যেয়ে পশ্চিম দিকে তাকাতেই দেখলাম ওই বহুদূরে ফেলে আসা দেশের বিশাল জলাশয় গোপীনাথপুর - বাড়াই গ্রাম বিস্তৃত সরিষা ডুলির বিল এ আস্তে করে অস্ত গেলো লাল রাতুল আলো বিকিরণ করে জলের উপরে - মনে মনে ভাবলাম -
আবার কি আসিব ফিরে এই বাংলার - খাল - বিল বা নদীটির তীরে ?

আমার স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৯৭১ পর্ব - ৪


তখনও শরণার্থী শিবির খোলা হয় নাই আমার ওই হিন্দু পরিবারের বাড়িতেই থাকছি - কঠিন সে জীবন - স্কুল নেই - নেই কোন লেখাপড়া - সারা দিন ঘরেই বসে বসে দিন কাটাচ্ছিলাম কয়েক টা দিন। অভাব যখন আসে আর যদি উপাৰ্জন যদি না থাকে সব কিছু যখন কিনে খেতে হয় তখন অল্প দিনেই টাকা ফুরিয়ে যায়।

আমাদের ও একই অবস্থা প্রায় - মা বললেন , এই ত্রিপুরা দেড় কাছ থেকে লাকড়ি কিনা আর সম্ভব না - আমাকে বললেন কাল থেকে তুমি জঙ্গলে যেয়ে কাঠ - দল পালা - আর শুঁকনো গাছের পাতা কুঁড়িয়ে নিয়ে আসবে তা না হলে লাকড়ি কিনতে কিনতে সব পয়সা ফুরিয়ে যাবে।
যেই বলা সেই কাজ পর দিন সকালে ওই বাড়ি ওয়ালার কাছ থেকে একটা দা' ধার করলাম আর বেরিয়ে পড়লাম - কাঠ জোগাড়ে - সারাদিন বৃষ্টি, গাছ - জঙ্গল সব ভিজা - লাল মাটির টিলা গুলো পিচ্ছিল - হাতের পাশে যা পেলাম ওই গুলোই এক জায়গায় করে টেনে টেনে নিয়ে আসতে শুরু করলাম - একেবারে চপ চপে ভিজা ; কাঁঠাল গাছের ডাল পালা , শুকিয়ে ভেঙে পড়া ডাল পালা , মরিচ্যা গাছ নামের এক ধরনের ভেজিটেশন জাতীয় লম্বা লম্বা গাছ কেটে ও গুলো শুকিয়েই করতে হবে রান্না - এগুলোর আবার অভাব নেই। লক্ষ্য লক্ষ্য গাছ পাহাড়ের ভিতর। বড় বড় বিশাল গাছ গুলোতে দেখতে পাচ্ছি অনেক শুকনো ডাল পালা - কিন্তু গাছ তো বেয়ে উঠতে পারি না। আমার জীবনেও গাছ উঠা শিখে উঠতে পারি নাই। তীক্ষ্ণ গাছের পাতার ধাঁরে হাত পা' কেটে যাচ্ছিলো - রক্ত বেরোচ্ছে দেধারে - লজ্জাবতী গাছ গুলো আমার দুর্দশা দেখে কেমন যেন লজ্জা পেয়ে লুকিয়ে যেতো - মনে হতো
আমার কাছে ; মুখ, হাত, পা কোনো কিছুই রেহাই পাচ্ছিলো না ওই গাছের তীক্ষ্ণ ধার পাতার ছোবল থেকে। জঙ্গলের ভিতর ভীষণ গরম এই ভাবেই শুরু হলো আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায়।
জোঁক , মাকড়সার জাল, চেলা আর মাঝে মধ্যে ধোরা সাপ আড়মোড়া ভেঙে পালিয়ে যেত আমার পদার্পণে। একা এক দিন ভর লাকড়ি কুঁড়াতে শুরু করলাম - আমার নতুন এল ব্যস্ততা - ক্ষিদে পেলেই নাগালের মাঝে পাওয়া ছোট কাঁঠাল গাছ থেকে পেরে খেয়ে নিতাম একটা কাঁঠাল অথবা পাহাড়ের ঢালুতে আনারস বাগানে যেয়ে লাল দেখে একটা আনারস ওই দা দিয়ে কোনো রকমে কেটে আনারসের চোখ গুলো এড়িয়ে গো গ্রাসে সাবাড় করে দিতাম একটা আস্ত আনারস - জীবনেও কোনো দিন দুই থেকে তিন ফালির উপর খাই নাই কখনও। কান্না পেতো - এত কষ্ট ; জীবনেও এত কাজ কর্ম করি নাই কোনো দিন - চোক্তা পাতার ঘষায় সর্ব শরীর প্রচন্ড ভাবে চুলকাতো কিন্তু - চুলকিয়ে সময় নষ্ট করার মত প্রাচুর্য ছিল না আমার তখন।

সারাদিন পর বিকালে ঘরে ফিরে আসতাম - এই হলো আমার নিত্য দিনের কাজ ; ভাইজান আর আম্মা চলে গেলেন গোকুল নগর হয়ে শেখের হাত হয়ে আগরতলা - প্রধান রাস্তা ওই খান থেকেই শুরু - আমাদের আশ্রয় ডাটা বাড়ি ওয়ালা সব বাতলিয়ে দিলো - ; আগরতলা তে যেয়ে খোঁজ পেলো আমার বাবার কাজিন মমতাজ বেগম - আমাদের খুবই প্রিয় আমেনা ফুফুর খবর - আগরতলায় তখন অনেক বাঙালিদের সমাগম - চিটাগংয়ের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী ওখানে সব দেখাশুনা করছেন ; উনিই বলে দিলেন ফুফা কে কোথায় পাওয়া যাবে ; আমেনা ফুফু কলেজ জীবন থেকেই ছাত্র লীগ করতেন ওনার বাবা আমাদের গনি দাদা ফুফুকে বিয়ে দিবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন - ফুফু আম্মাকে অনুরোধ করলেছিলেনা ওনার বাবাকে বোঝানোর জন্য ; শেষমেষ গনি দাদা আম্মার কথা মানলেন এবং ফুফুকে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে দিলেন - সেই থেকে ফুফু আর আম্মার মাঝে গড়ে উঠেছিল এক সুদৃঢ় বন্ধুত্ব। ওই মহা বিপদের সময় আম্মা শরণাপন্ন হবেন ওনার কাছে সিদ্ধান্ত নিয়েই ছয় মাইল কাঁদা , পানি, পিচ্ছিল পথ পায়ে হেঁটে ভাইজান কি নিয়ে রাত প্রায় আটটা নয়টার দিকে ফেৰত আসলেন ; আগরতলায় ভালো দামে আরো এক দফা গয়না বিক্রি করে কিছু পয়সা নিয়ে ফিরেলন সেই রাতে - পরদিন আবার যাবেন সেই ছয় ছয় বারো মাইল হাঁটা এবং বিশালগড়ে যাবেন আমেনা ফুফুর সাথে দেখা করতে - মনে ফুফু আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যা এবং বড় মাপের নেত্রী।
খুবই একজন শ্নেহপরায়ণ আমেনা ফুফুর দেখা পাওয়ার অধীর অপেক্ষাই রাতে আমরা কেউই ঘুমাতে পারলাম না ; এই মহাসমুদ্রের মাঝে উনিই আমাদের একমাত্র ভরসা। বিপদগ্রস্থ হয়ে মা প্রায় হিমশিম খাচ্ছিলো তখন ফুফুর ঠিকানা টা মা' মনে মনে খুবই আনন্দিত হয়ে উঠেছিলেন - বুঝতেই পৰ যাচ্ছিলো ওনার কথা বার্তায় ; আমার পিতা ছিলেন আমাদের বংশের সব চে বড় এবং সবার প্রিয় ''খোকা ভাই'' - ফুফু কে আমার আব্বা খুবই স্নেহ করতেন - কারণ আমার বাবার কোন বোন ছিল না তাই উনি সব কাজিন দেড় কে খুবই আদর এবং স্নেহ করতেন ; মা বললেন আমেনা আমাদের এই সময়ে ওর প্রিয় খোকা ভাইয়ের পরিবারকে ফেলে দিবে না ; সবাই ঘুমাও কাল ওর সাথে যেয়ে দেখা করে সব ঠিকঠাক করে ফেলবো।
সকালে মান্দারপুর থেকে এসে হাজির হলেন আমাদের দাদা অসতিপর সায়ীদ মিয়া চৌধুরী - বললেন অনেক কষ্ঠে খুঁজে পেলাম তোমাদের - এই নেও দু হাজার টাকা আমি মফিজ মাস্টারের কাছে পাঁচ কানি জমি ডাইসুদি ( আজও জানিনা এই শব্দটার অর্থটা কি - কিন্তু ঐ যে শুনে ছিলাম তা আজ মনে আছে) দিয়ে এই টাকাটা তোমাদের জন্য নিয়ে এসেছি - আমার ভাতিজা খোকা মিয়া সারা জীবন সেই কলকাতার দিন গুলো থেকেই আমাকের এত দেখাশুনা করেছে - ওর ঋণ কি আর শোধ করা যাবে এই অল্প কয়টা পয়সা দিয়ে ; দাদা সেই দিনই আবার ফিরে গেলেন - আমাদের ঐ অবস্থা দেখে বেচারা চোঁখের পানি সারাক্ষন থামাতে পারেন নি - কান্না বিজড়িত ভাবে বিদায় নিলেন - ওনার ওই ঋণ আমরা জীবনেও শোধ করতে পারবো না। ভাইজান আর আমি দু জন অনেক ধজ্যনগর মসজিদ পার হয়ে অনেক দূর পর্যন্ত হেটে হেটে এগিয়ে দিয়ে আসলাম - উনি ঐ রাতে থাকবেন বাড়াই গ্রামে এক আত্মীয়র বাড়ি তার পর দিন সকালে আবার রওনা দিয়ে হেটে হেটে যাবেন মান্দারপুর গ্রামে - উনাকে পার হতে হবে সেই সি এন বি রোড - সাক্ষাৎ যমের মুখোমুখি হয়ে ;
অশ্রুসজল চোখে দাদা কে বিদায় দিয়ে আমরা দুই ভাই ফিরে আসলাম আমাদের আবাসস্থলে - মাথার উপর সূর্য টাকে ফেলে পিছনে আমার অবারিত বাংলার আলিঙ্গন উপেক্ষা করে। ...........

Comments