BENGALI IN BILATH - UNITED KINGDOM

    বিলাতে ; বাঙালি  একজন 




ষাটের  দশক তখনও লন্ডনের আকাশ থাকত সবসময় মেঘাছন্ন - কালো- আলো আধারির খেলা প্রচন্ড ঠান্ডা।  শীতের সকালে কিংবা মেঘলা দুপুরে বা গভীর রাতে কিবা গ্রীষ্হ কিবা শীত সকল বাধা - সকল সমস্যা এবং সকল ক্লান্তি উপ্পেখা করে এগিয়ে চলে আসছিল এক নতুন নির্ভিক যুবক এবং একজন  ব্যবসায়ী - কারী হাউস এর মালিক।  

১৬ বছর বয়েসে বাবার হাত ধরে মৃদু মৃদু পায়ে ভয় - ক্লান্তি - জড়তা এবং সকলকে দেশে ফেলে রেখে আসার দুঃখ কে নিয়ে একদিন আসলো সেই যুবক স্বপ্নের শহর লন্ডন এ।  বিলাত এ।  স্বপ্ন সফল হলো তার।   বার বার মনের ঈশান কোণে উকি দিত সেই হারিয়ে যাওয়া  অবয়ব গুলো- অনেক কে না বলে অগস্ত যাত্রা - বলতে যেয়েও বলা হলোনা রিদয়ের কথা - মনের অজান্তে গাইল- দুইটি পংতি- আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইলোনা মোরে কেহ ; জোসনা রাতে আর যায়না সে বনে। 

ব্রিক লেনের রুমানিয়া থেকে আগত ইহুদি রিফুজি ( বিশ্ব যুদ্ধের ভিকটিম) বেঞ্জামিন কোয়েনের '' লেদার ফেক্টরী '' তে সপ্তাহের ছয় দিন কাজ -মালিক বেন কোয়েন অশতিপর এক সবল কর্মঠ বৃদ্ধ - এক জন অমায়িক - হিতৈষী মহা মানব।  সাড়া সপ্তাহের উপার্জনের ৮৫% বাবাকে সপিয়ে দিয়ে ক্লান্তির লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমানো - দেশে ১১ জনের পরিবার - বাবা আর সে মিলে করতে হবে অনেক গুলো প্রয়োজনীয় কাজ - জমি কিনা - শহরে একটা ছোট্ট  বাসা - গ্রামের ঘর টাকে বদলিয়ে বড় দহলিজ সহ দালান বানানো - ছোট পাঁচ ভাই বোনকে গ্রাম এ না রেখে শহরে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা সম্বিলিত শিক্ষা দেওয়া।  বৃদ্ধ পিতোমহের চিকিত্সা। কত বিরাট এবং ব্যাপক এক দায়িত্ব ওর মাথার উপর- সাপ্তাহিক ছুটির দিনে চাড ওয়েল  হিথে ইতালীয়ন রেস্তোরাতে ওয়েটার এর  কাজ করত - কয়েক টা  অতিরিক্ত পয়সা কামানোর জন্য। পকেট খরচের জন্য। বালক থেকে যুবক হবার সন্ধিলগ্নে এক গাদা কাজের চাপে হারিয়ে গেল  তার যৌবনের সেই উল্লাস কিছুটা - কিন্তু মাথায় চেপে বসলো অসাধ্য সাধনের বাসনা - ইতালিয়ান রেস্তোরার মালিক চির সবুজ - ফ্লেম্বয়েন্ট - সুদর্শন সুপুরুষ পাওলো গুদুচিনী হয়ে গেল তার আদর্শ সুপুরুষ এবং সেও ভাবতে লাগলো কিভাবে সে ও এক দিন পাওলো 'র মত একটা রেস্তোরা খুলবে বা খুলতে পারবে। ..


এক অদম্য উদ্দীপনা এবং উত্সাহ এক স্বপ্ন এক অভিলাস - 

২০১৬ সাল - মে' ফেয়ার এর কার্জোন স্ট্রিট থেকে  বামে মোড় ঘুরে বিশ্বের অন্যতম নামকরা রাস্তা ''পার্ক লেনে'' ঢুকার ঠিক এক মুহূর্ত আগে - গোল্ডেন কালারের - ক্রীম লেদার এ  মোড়ানো সিট এর মোলায়েম মসৃনতা সমৃদ্ধ বেন্টলি কন্টিনেন্টাল বসে মনের অজান্তে স্মৃতি রোমন্থন করলো কয়েক মুহুর্তের জন্য - সেই ফেলা আসা স্মৃতিময় সৃতিগুলোর।  মুখে এক পশলা মুচকি হাসি একে ধীর গতিতে অনুপ্রবেশ করলো - পার্ক লেনে। .....

হারিয়ে গেল গাড়ি ঘোড়ার স্রোতে।  স্মৃতির শীততাপ নিয়ন্ত্রনের আমাজের চাদরে মুড়িয়ে এগিয়ে চললো বিলাতের এক হাজার বছরের পুরানো রাজ বংশের  রানী ' র রাজ প্রাসাদের সম্মুখের রাজপথে মনে হলো যেন জকিগঞ্জের বড়ই গ্রামের  গোপাটের মত সেই অতি পরিচিত এক জনপদ তার কাছে । ..


ট্রাফালগার এস্কয়ার কে বামে রেখে নেলসন কলামের পাশে এসে ট্রাফিক জ্যামে স্লো করলো বেন্টলি গাড়ীর গতি- আবার নিমিষেই হারিয়ে গেল অতীতে নিভৃতে অজান্তে ; সেই ১৯৬১ সাল - ইতিম্মধ্যে চিল্ত্রান পাহাড়ের পাদদেশে জন্মগ্রহণকারী টেমস নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে  - মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে ও গেল না বুঝার আগে; আব্বাজান বলতেন বাবা এখনই কাজ করার সময় - মন লাগাইয়া কম কর কয়েক বছর পর  বাপ পুত চল যাব টেমস থেকে সুরমা হয়ে কুশিয়ারার তীরে - ; গোপিনগরের প্রতাপশালী যুগল হিসেবে ফিরব আমাদের সেই গায়ে ; জায়গিরদারের সব জমি গুলো কিনে ফেলবো চড়া দামে আর থাকবে গোলা ভরা ধান - হাওর এর মাছ - বাশ ঝাড় আর তৈরী করবো একটা গয়না নৌকা পাল উঠানো ছয়জন মাঝী বৈঠা বাইবে  - উজান আর ভাটি তে নৌকা সার্ভিস চালু করবে - কে খাবে আমাদের পয়সা - আব্ব্জান তার আশা পূরণ করতে করতে একদিন ছেলকে  একা একা ফেলে চলে গেলেন - আসলেন না আর ফিরে তাকে দেখতে - শখের গোরস্থানে না পারলেন উনি ঘুমাতে চিরতরে - ওকিং এর মুসলিম কবরস্তানে ঘুমিয়ে আছেন উনি শ্রান্ত হয়ে ; আর আজ ও চালিয়ে যাচ্ছে  জীবনের সেই স্বপ্ন বিলাসী গয়না নৌকা টি - কুশিয়ারা বা সুরমা নদীতে নয় - বিলাতের মানুষ সমুদ্রে - উনআশি টি প্রপার্টি - তার মাঝে বারো টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাড়া দেওয়া - টেনিস খেলার প্রসিদ্ধ উইম্বিলদনে এগারো বেড  রুম সমৃদ্ধ প্রাসাদতুল্য অট্টালিকা।  জীবিত থাকলে আব্বুজান কে দেখাতে পারতো - তার প্রিয় সন্তানের জগতটাকে।  

ক্লাস নাইনে পড়ার সময় একদিন সব প্রাতিষ্ঠানিক লেখপড়া কে বিদায় দিয়ে - চলে আশা হয়েছিল বিলাতে - বিলাত লালিত সহজাত এক অবিচ্ছ্ন স্বপ্ন পুরী।  তার পর আর ক্রিকেট প্লেআর দের যেমন বেটে আর বোলে যেমন সংযোগ হয় না ঠিক তেমনি ওর ও আর  কখনো বই আর চোখের সংযোগ হয় নি ।  জীবন পুস্তকের প্রতেক পাতা হাজার বার চোখ বুলিয়ে আজ আজ উপনীত হয়েছে এইখানে ; কি বিচিত্র এই জার্নি ! 

পিছন থেকে সাদা রংগের ভ্যান ড্রাইভারের হর্ন এর আওয়াজে প্রকিতস্থ হয়ে গাড়ি চালানো সুরু করলো আর ঠিক তখনি সিডি প্লেআর অ বেজে উঠলো - ''হোয়াট এ ওয়ান ডার ফুল ওর্ল্ড'' 

সারা সপ্তাহ পরিশ্রম করে পেনি- শিলিং - পাউন্ড গুনে গুনে জমিয়ে জমিয়ে আজ গড়ে তুলেছে সে এই বিশাল সাম্রাজ্য - এগারো জন পরিবারের সদস্য কে অর্থনৈতিক উন্নতি দান - আব্বাজানের সব স্বপ্ন শুধু নৌকাটা বাদে সবই পরিপূর্ণ করা হয়েছে - আজ রানীর বাগানে চা চক্রতে আমন্ত্রণ - সংসদ এলাকায় লাঞ্চ করা - বিলাতের রাজনৈতিক দলে অর্থনৈতিক অনুদান - লর্ড দের সাথে বন্ধুত্ব - সাভোয় হোটেলে আফটার নুন টি পান - গ্রভ্নার হাউস হোটেলে ডিনার এ যেন এক ধরনের নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার বৈ কিছুই না।  

ছয় ফুট দেহে - এক ফোটা চর্বির কোনো উপস্থিতি নাই - প্রতহ প্রত্যুষে প্রাতভ্রমন করা - এবং চর্বি বিহীন খাবার সাথে সাথে ধুমপান- মদ্যপান - এবং পরিছন্ন জীবন যাপন করার সেই অদম্য প্রতাশাই আজও এক্কাতুর বছর বয়েসেও যুবক যেন সে এক - জীবনের সেই প্রথম গভনর বেন কোয়েন  এর  পদান্ক্ক অনুসরণ করেই এগিয়ে চলছে এই পথচারী ; 

ছেড়া কাথা থেকে কোটিপতি হওয়ার এ এক বিশাল গল্প - আজ সকালে কিংস কলেজে সে লেকচার দিল তার জীবনের ঘটে যাওয়া নাটকের বিভিন্ন  অনুছেদ্দের বর্ণনা ; মন্ত্র মুক্ধ হয়ে শুনলো তরুণ তরুনীরা - ; কি নাটকিয়াতাময় এই জীবন - সব কিছুই হয়েছে তার অবিশ্শাস্সো উচ্চ অভিলাষের  জন্য - আজ  এক শ পাউন্ড দিয়ে আরম্ভ করা থেকে আজ নয় শত মিলিয়ন পাউন্ডের মালিক হওয়ার গল্প বলে অন্যদের কে তার মত অনুপ্রানীত করার উদ্দেশে।  

কি অদ্ভুত এই নগরী আর কি অদ্ভুত এর বাসিন্দারা ? ভাবতে ভাবতে গাড়িটা টেমস নদীর দিকে ধাবিত হতে থাকলো - ভাবলো আব্বুজান তোমার সুরমা আরে কুশিয়ারা আর হলো না যাওয়া - আমার ছোট্ট তরী - ঠাই নাই  ঠাই  নাই ছোট্ট অ তরী তোমার ই ভালবাসায় আর আদরের কথায় গিয়াছে ভরী।  


চলবে। ...

Comments